আয়নার অশরীরী

আয়নার অশরীরী

আয়নাটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আমি। এতক্ষণ রাগ হচ্ছিলো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আয়নাটা ভালোই লাগছে আমার ঘরটাতে। কি সুন্দর কারুকাজ করা চৌকোনা আকৃতির আয়না। নিশ্চয়ই বিলাশ বহুল কোনো জমিদার এই আয়না তৈরি করেছে। দেখলেই রিদয় ছুয়ে যায়। বাবার পছন্দ আছে বলতে হবে। ছোটবেলা থেকেই তার এইসব পুরনো জিনিসের প্রতি একটু বেশি টান। বিভিন্ন এন্টিক শপ থেকে বিভিন্ন রকমের পুরনো জিনিস কিনে তিনি তার ঘরটা সাজিয়েছেন। আম্মুরো এসবে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তিনি এবার যে আয়নাটা কিনেছেন তার জায়গা দিলেন আমার ঘরে। কতো করে বল্লাম এসব পুরনো জিনিস আমার ঘরে রাখবে না। কিন্তু কে শুনে কার কথা। তার ঘরে নাকি এটা রাখার কোনো জায়গা নেই। অগত্যা আমার ঘরে থেকে গেলো। এ যুগের ছেলে আমি। পুরনো জিনিসে কি মন ভরে। কিন্তু আয়নাটা দেখার পর থেকে কেনো যেনো বারবার মুগ্ধ হচ্ছি তার কারুকাজে। কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম তারপর উঠে গেলাম। আয়নায় পর্দা টেনে দিলাম।

রাতে খাবার টেবিলে বাবার সাথে আয়না নিয়ে কিছু কথা হলো ..
_কিরে, আয়নাটা তোর কেমন লেগেছে?বাবার এ প্রশ্নে অনিচ্ছা সত্বেও বল্লাম অনেক ভালো লেগেছে। কি সুন্দর কারুকাজ করা। ভালোই লাগে। বাবা একটু মুচকি হাসলেন। বল্লেন .. ভালো হবেনা আবার? সেই জমিদার আমলের আয়না। পুরো পাচ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি। অমন জিনিস কি আমি হাতছাড়া করি বল। কিন্তু আমার ঘরে ওটার জায়গা হলো না তাই তোর ঘরেই রাখতে হলো। তুইও একটু পুরনো আমলের জিনিস ব্যবহার করে দেখ। দেখবি মনের মধ্যে একটা জমিদার জমিদার ভাব চলে আসবে।
বাবার এমন সব কথা বার্তায় মাঝে মাঝে খুব হাসি পায়। বাবা একটু বেশি শৌখিন। আর এইসব পুরনো জিনিস পাওয়ার জন্য তিনি লাখ টাকাও খরচ করতে রাজি। এমন সব জিনিসের হদিস পায় কিভাবে কে যানে।

রাতের খাওয়া শেষ করে আমি আমার রুমে চলে গেলাম। কম্পিউটারে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম কিন্তু ক্লান্ত লাগছিলো খুব। তাই কম্পিউটার অফ করে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কি মনে করে যেনো আয়নাটার দিকে চোখ গেলো। পশ্চিম দিকের দেয়াল ঘেষে আয়নাটা বসানো হয়েছে। আয়নাতে চেহারা দেখার অভ্যাস নেই আমার। তবু কেনো যেনো আজ দেখার ইচ্ছা হলো। হয়তো বাবার কথাই ঠিক। এসব পুরনো জিনিস হয়তো মনে জমিদার জমিদার ভাব নিয়ে আসবে। মনে মনে হাসতে লাগলাম। আয়নার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে পর্দা টা সরালাম। আয়নার কাচে আমার প্রতিবিম্ব টা দেখা যাচ্ছে। ভালোই লাগছিলো খুব। পুরনো জিনিস জোস আছে। মন ভালো করে দিতে পারে। আয়নাটা যতোই দেখছি ততই যেনো মুগ্ধ হচ্ছি। চোখ ধরে এসেছে। আয়নায় পর্দা টেনে। রুমের লাইট নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পরলাম।

কখন ঘুমিয়ে গেছি জানিনা। তবে মাঝরাতে নুপুরের ঝুম ঝুম শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মনে হলো আমার ঘরে কোনো মেয়ে নুপুর পরে সারা ঘরে ছুটাছুটি করছে। বালিশের নিচ থেকে হাতরে হাতরে মোবাইল টা বের করে জালালাম ,স্কিনে তাকিয়ে দেখি রাত পোনে দুইটা বাজে। এতো রাতে আমার ঘরে কে আসবে। তাছাড়া দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। আর আমার বাসায় নুপুর পরার মতো কোনো মেয়ে নেই। এদিকে নুপুর শব্দ আর পেলাম না। বিছানা থেকে উঠে রুমের লাইট টা জালিয়ে দিলাম। টেবিলে রাখা জগ থেকে একটু পানি খেয়ে নিলাম। ভাবলাম হয়তো সপ্নের ঘোরে শব্দ শুনেছিলাম। পাত্তা দিলাম না লাইট নিভিয়ে আবার ঘুমিয়ে গেলাম।

কিন্তু পরের রাতে একই ঘটনা ঘটলো। আমি জেগে গেলাম। কিন্তু আজ জেগে যাওয়ার পরও অনেক্ষণ সেই নুপুর ধনি শুনছিলাম। কেউ একজন নুপুর পায়ে আমার ঘরে ছূটাছুটি করছে। লাইট জালাতে গেলাম সেই মুহুর্তে কেউ একজন বলে উঠলো …
_দয়া করে আলো জালাবেন না। আলো আমি সহ্য করতে পারি না।
একটা মেয়েলি কন্ঠ ছিলো। আমি চমকে উঠলাম। আমার ঘরে মেয়ে মানুষ আসবে কোথা থেকে। শরীর কুল কুল করে ঘেমে যাচ্ছে। তবুও মনে সাহস নিয়ে বল্লাম..
_কে আপনি? আর আমার ঘরে কিভাবে এলেন। আর আপনাকে দেখতেই বা কেনো পাচ্ছি না?
নারী কন্ঠে উত্তর এলো
_আমি আপনার ঘরের এই পুরনো আয়নার ভিতরে। আমাকে দেখতে চাইলে মোম জালিয়ে আয়নার সামনে আসুন।
আমি তার কথা শুনে অবাক হলাম। আয়নাটার কথা মনে হলো। সাথে বাবাকে ধিক্কার দিচ্ছিলাম। শেষে কিনা ছেলের ঘরে ভুত ঢুকিয়ে দিলো। তবুও সেই অপরিচিত মধুর কন্ঠধারি নারীটিকে দেখার জন্য আমার মন ব্যাকুল। টেবিলের ডয়ারে মোম আছে। একটা জালিয়ে নিলাম। আস্তে আস্তে আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ালাম। পর্দাটা সরিয়ে দিলাম। ঘরটা কেমন যেনো শান্ত হয়ে গেছে। আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছি কিন্তু আমার প্রতিবিম্ব হাড়া তো কিছুই নেই। বল্লাম কই আপনি? দেখা দিবেন না?
আয়নার কাচে আস্তে আস্তে এক নারীর বিম্ব তৈরী হতে লাগলো।
সাদা জামা গায় সাথে সাদা ওরনা। মাথায় মুকুট। আলতা রাংগা পা আর সেই পায়ে নুপুর। সারা শরীরে অলংকার দিয়ে ভর্তি। বয়স আনুমানিক বিশ বাইশ আন্দাজ করলাম। তার রূপে আয়নাটা যেনো ঝলমল করছে। আমার পুরো ঘরটাই আয়নার আলোয় আলোকিত হয়ে গেছে। আমি সপ্নের ঘোরে আছি কিনা তা জানার জন্য নিজের শরীরে চিমটি কাটাতে লাগলাম।
আয়নার ভিতর থেকে নারী বিম্বটি বলে উঠলো
_আপ্নি জেগে আছেন। ভয় নেই আমি আপনার কোনো ক্ষতি করবো না।
আমি একটু সাহস পেলাম। জিজ্ঞেস করলাম। আপনি এই আয়নায় কিভাবে এলেন। আর কি আপনার পরিচয়?
নারী বিম্বটি অশ্রুসিক্ত চোখে বলে উঠলো শুনবেন আমার সেই অশরীরী হওয়ার কাহিনী।সুন্দরী নারীর সেই চোখের জল আমার সহ্য হলো না। ইচ্ছে হলো মেয়েটির চোখের জল মুছে দিতে কিন্তু পারলাম না। কারণ সে যে অশরীরী। তাকে ছূতে পারবো না আমি। বল্লাম …
_হ্যাঁ বলুন। আমি শুনতে চাই আপনার সেই ইতিহাস।
বিমবটি বলতে শুরু করলো। আমি টেবিলের পাশ থেকে চেয়ারটা টেনে নিয়ে আয়নার সামনে বসলাম। শুনতে লাগলাম তার অশরীরী হওয়ার করুন ইতিহাস।

আজ থেকে তোমার জন্মেরও বহু বছর পূর্বে এই দেশে এক জমিদার ছিলো। আর তার নাম ছিলো শ্রীকান্ত। আমি জমিদারের সেই গ্রামেরই এক সাধারণ মেয়ে ছিলাম। একদিন জমিদার গ্রাম ঘুরে দেখার সময় আমাকে দখে ফেলে। আমি তখন বিশ বছরের টকবগে যুবতী। রূপে গুনে ছিলাম অনন্য। কিন্তু গরীব ঘরের মেয়ে ছিলাম আমি। জমিদার আমায় প্রথম দেখেই আমার প্রেমে পরে গেলেন। আর কিছুদিন পরেই আমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। এত বড় জমিদার ঘরের সম্বন্ধ আমার মা বাবা না করলেন না। জমিদার আমায় বিয়ে করে তার ঘরে উঠালেন। জমিদার শ্রীকান্ত আমায় এতটা ভালোবাসতেন যা কল্পনারও বাইরে। আমার জন্য তিনি সব করতে পারেন। একবার এই আমি অনেক অসুস্থ হয়ে গেলাম। দূর দূরান্ত থেকে কবিরাজ আনার পরও কেউ আমায় সারিয়ে তুলতে পারলো না। আমার এমন অবস্থায় শ্রীকান্ত পাগলের মতো হয়ে গেলো। একসময় তিনি এক তান্ত্রিকের শরণাপন্ন হলেন। তান্ত্রিক আমায় দেখে বল্লেন। আমি নাকি আর বাচবো না। জমিদার এ কথা মেনে নিতে পারলেন না। তিনি একটা উপায় বার করতে বললেন। অবশেষে তান্ত্রিক একটা ভয়ানক উপায় বল্লেন। আর তা হলো আমাকে আয়নার ভিতরে জীবিত রাখা যাবে। শ্রীকান্ত রাজি হলো। সে যেভাবেই হোক আমাকে তার কাছেই রাখবে। আমাকে হারাতে চায় না সে। এক অমাবস্যা রাতে তান্ত্রিক আর শ্রীকান্ত দুজনে মিলে আমাকে এক আয়নার সামনে নিয়ে গেলো। গভীর রাতে আমার অসুস্থ দেহের সামনে বসে তান্ত্রিক মন্ত্র জপ করছে। পাশেই আয়না। তার পাশেই অশ্রুসিক্ত নয়নে দাড়িয়ে আছে আমার সামী শ্রীকান্ত। আমার কিছুই বলার শক্তি নেই। শুধু দেখে যাচ্ছি তাদের কান্ড।

একসময় আমার শরীরে জালাপুরা শুরু হয়ে গেলো। মরে যাওয়ার উপক্রম। আমার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। পুরো শরীর আমার ঝলসে যেতে শুরু করলো। আমি চিৎকার করছিলাম। চোখের সামনে মৃত্যুকে দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি যেনো মরে গিয়েও বেচে রইলাম। আমার আত্মা এই আয়নার ভিতরে ঢুকে গেলো। আমি আয়নার ভিতর থেকে দেখলাম তান্ত্রিক আর শ্রীকান্তকে। রান্ত্রিক বললো … হুজুর কাজ শেষ। রাণীমা অনন্ত কাল এই আয়নায় থাকবে। যতোদিন এই আয়না থাকবে ততদিন রাণীমার আত্মা এই আয়নায় থেকে যাবে। তান্ত্রিক বিদায় নিলো। শ্রীকান্ত আমার সামনে দাড়ালো। অপরাধীর মতো আমার সামনে দাড়ালো। কাদতে কাদতে বললো আমায় ক্ষমা করে দিও। আমি তোমাকে হারাতে চাইনি। আমি তার চোখে ভালোবাসায় ভরা অশ্রু দেখেছিলাম। কিছুই বলিনি তাই। সে সবসময় আমার এই আয়নার সামনে বসে থাকতো আর আমার সাথে গল্প করতো।আমার এই আয়নার অনেক যত্ন নিতো সে। একসময় জমিদারো অসুস্থ হয়ে গেলো। বয়স হয়ে গেছে তো অনেক তাই হয়তো। তখন আর সে আয়নার সামনে আসতো না। মনটা কেমন ব্যাকুল হয়ে থাকতো তার জন্য। কিন্তু একদিন জমিদার মরে গেলো। কিন্তু আমার আত্মা মুক্তি না পেয়ে তখন থেকেই একাকি এই আয়নায় বন্দী জীবন কাটাতে লাগলো। আর আজ আমি এই তোমার সামনে। মুক্তি চাই আমি মুক্তি …. চিৎকার করে উঠলো নারী বিম্বটি। কিন্তু এই চিৎকার আমি ছাড়া কেউ শুনলো না।

আমি গ্লাস থেকে আবার পানি খেলাম। মোমটা প্রায় গলে গেছে সবটাই। আর কিছুক্ষণ জলবে হয়তো। নারী বিমবটি আয়নার ভিতর থেকে কেদেই চলেছে। আমি একটু গলা খাকাড়ি দিয় জিজ্ঞেস করলাম …
_আচ্ছা কি করলে আপনার এই বন্দী আত্মার মুক্তি মিলবে?
সে কান্না থামালো আমার দিকে তাকিয়ে বললো … হ্যাঁ তুমি পারবে আমায় মুক্তি দিতে। এই আয়নাটা ভেংগে ফেললেই আমি মুক্তি পাবো।
_আমি কারুখচিত আয়নাটার দিকে তাকালাম। আর বল্লাম
_ঠিকআছে আমি এখনই আয়নাটা ভাংছি ..

বসে থাকা চেয়ারটা থেকে উঠে দাড়ালাম। চেয়ারটা হাতে নিলাম। আয়নাটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলাম। বাবার মুখটা মনে পরে গেলো। আয়নার ভিতর থেকে বিম্বটি চিৎকার করে বারবার বলছে … ভেঙ্গে ফেলো আয়নাটা মুক্তি দাও আমায়। মনে মনে বল্লাম বাবা মাফ করে দিয়ো আমায়। তোমার শখের আয়না আজ আমাকে ভেংগে ফেলতেই হবে। একটা বন্দী আত্মাকে মুক্তি দিতে হবে যে। চেয়ার দিয়ে আয়নার কাচে সজোরে আঘাত করলাম। ঝরঝর শব্দ করে আয়নাটা ভেঙ্গে গেলো। আয়না থেকে সাদা একটা ছায়া বেরিয়ে গেলো দক্ষিণে জানালার দিকে। বাবা মা
দরজায় ধাক্কা দিতে থাকলো। আমি দরজা খুলে দিলাম। মোমটা নিভে গেছে। জানালার পিছনে এক সাদা ছায়ার নিঃশব্দ হাসি দেখতে পেলাম। এ হাসি মুক্তির হাসি। ছায়াটি দূর আকাশে মিলিয়ে গেলো। মা লাইট জালালেন। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলেন। বাবা আয়নার দিকে তাকিয়ে চোখ ছানাবড়া। আমায় কথা শুনাতে থাকলেন।
আমি সেদিকে কান দিচ্ছি না। মনের মধ্যে ভালোলাগা কাজ করছে।কেননা আমার এই আয়না ভাঙ্গার কারণেই আজ মুক্তি পেলো এক বন্দী আত্মা। রেহাই পেলো সে এই অতৃপ্ত জীবন থেকে।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত