আজ আমার সেমিস্টার ফাইনাল শেষ হয়েছে। বাড়ি যাইনা প্রায় দুই মাস। তাই ভাবলাম একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। আমার দেশের বাড়ি বরিশালের পটুয়াখালী জেলার বাউফলে। সন্ধ্যায় লঞ্চে উঠলে সকালে পৌঁছানো যায়। তো সেদিনই রওয়ানা হলাম। এতদিন পড় বাড়ি গেলাম। সবাই তো আমাকে দেখে যারপরনাই খুশি। যাইহোক,এবার প্রায় ১৫-২০ দিন থাকার প্ল্যান নিয়ে গেছিলাম। তিন-চারদিন শান্তিতেই কাটালাম। এরপর একদিন সকালে নানাবাড়ি থেকে খবর এলো যে আমার নানাভাই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেদিন রাতে আবার আমার ফ্রেন্ডদের সাথে পিকনিক ছিলো। তাই আমি বাদে সবাই ই নানাবাড়ি চলে গেলো। আমি সন্ধ্যা নাগাদ ই বন্ধুদের সাথে পিকনিক স্পটে চলে যাই। গ্রাম বিঁভূই। এইদিকে রাত ৮ টার পড় কেউ সজাগ থাকেনা। কিন্তু আমাদের পিকনিক শেষ হতে হতে রাত ১২ টা বেজে যায়। পিকনিক স্পট থেকে আমার বাসা সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে। আর আমাদের এই পথে বন্ধুদের কারো বাড়িও পড়েনা। অগত্যা আমাকে একাই রওয়ানা হতে হয়। চাঁদনী রাত দেখে হাঁটতে ভালোই লাগছিলো। কিন্তু কিছুক্ষন যাবার পড়ে যেন আমার গা ছমছম করতে শুরু করে। রাতের নিস্তব্ধতা!! ঝিঝি পোকা আর পেঁচার ডাক যেন পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। কিন্তু সবে তো আধমাইল পথ এলাম!! এখনো তিন মাইল বাকি। এত রাতে কেউ এপথে আসবেনা আমি নিশ্চিত। তাই ভয়টা যেন একটু বেশিই লাগছিলো। কিন্তু বাড়ি তো যেতে হবে? এইদিকে আব্বু আম্মু বাড়ি নাই। বাড়ি পুরো ফাঁকা। চোর-ডাকাতের ভয় তো আছেই। তাই আপাতত আমি সাময়িক ভয়টা দূর করতে চাইলাম। মোবাইলে ফুল ভলিউমে গান ছেড়ে তার সাথে গলা মিলাতে মিলাতে আমি হাঁটতেছি। মোবাইলে গান বাজতেছে-“এই পথে আমি যখনই যাই। মাঝে মাঝে একটা মেয়ে দেখতে পাই। আলতা রাঙা পায়ে আবার নুপুর পড়েছে। বোরকা পড়া মেয়ে পাগল করেছে। আয়হায় বোরকা পড়া মেয়ে পাগল করেছে।” শরিফুদ্দিন এর গান আমি সচারচার যদিও শুনিনা। কিন্তু সেদিন কেমন যেন ভালোই লাগতেছিলো। মনে মনে ভাবছিলাম বোরকা মেয়ে না হোক লুঙ্গি পড়া কোনো কাউকে পেলেও এখন আমার চলবে। কারন সামনেই যে সেই চৌধুরী বাড়ির জোড় তালগাছ!! এই বাড়িটি একটি পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ি। লোকমুখে শোনা যায় এই জমিদারেরা খুব অত্যাচারী ছিলো। খাজনা না দিলেই মারধোর করত। লঘু পাপে গুরুদন্ড হিসেবে কাউকে ফাঁসিও দিত। আর ফাঁসির মঞ্চ ছিলো এই জোড় তালগাছের মাঝের স্থান!! আমার তো গাঁ সিউরে উঠতে লাগলো। হঠাৎ দেখি দুজন হুজুর যাচ্ছে। তাদের দেখে আমি যেন প্রান ফিরে পেলাম। জোরে হাঁক দিলাম। ও হুজুউউউউর…….
-কেডা বাজান তুমি?
– জ্বে,আজ্ঞে আমি শফি মাস্টারের পোলা আলাভী। বন্ধুগো লগে পিকনিকে গেছিলাম। এখন একা বাড়ি যাইতে ভাল্লাগে না। আপনাগো লগে কতদুর যাই?
-আইচ্চ্যা আসো।
চলতে শুরু করলাম। কিন্তু চলতি পথে দুজনের কেউই আমার সাথে একটা কথাও বলল নাহ। এভাবে অনেকক্ষন চলে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় তিনটা বাজে। কিন্তু একি!!! এখনো যে চৌধুরী বাড়ির সীমানাই পার হইনি?? এরই মধ্যে দেখি হুজুর দুজন আগের থেকে অনেকটা লম্বা হয়ে গেছে। আর তাদের পা উল্টো দিকে!! আমার আর বুঝতে বাকি রইলো নাহ কিসের পাল্লায় পড়লাম। মনে মনে বললাম,বেটা আলাভী আজকই মনে হয় তোর শেষ দিন। ভয়ে হাত-পা কাঁপতেছে। চিৎকার করার জন্য মূখ ও খুলতে পারতেসিনা। যতই চেঁচাই গলা দিয়ে স্বর বের হয়না!! আমি দৌড়েও কিছুতেই হুজুরদের পিছনে ফেলতে পারছিনা। দিশেহারা হয়ে আমি রাস্তার পাশের খালে ঝাপ দিলাম। এরপর আর কিছুই মনে নেই। জ্ঞান ফিরে দেখি আমি খালপাড়ে শুয়ে আছি। আর দুই-তিনজন লোক আমায় ঘিরে আছে। জ্ঞান ফিরতেই তারা আমায় নানা প্রশ্ন করতে শুরু করলো! আমিও সবকিছু তাদের জানাই। এরপর আমি কিছুদিন টানা জ্বরে ভুগি। কোনো ওষুধ-পথ্যেও সুস্থ হচ্ছিলাম নাহ। শেষে বাবার এক বন্ধুর পরামর্শে এক হুজুরের থেকে পানিপড়া ও তাবিজ নিয়ে আমি সুস্থ হই।