সেদিন ক্লাস শেষে ফিরতে একটু দেরি হয়েছিল।তার ওপর কিছু টা পথ আসতেই হঠাৎ প্রচন্ড ঝড় শুরু হল ।আমার স্কুল যাওয়ার পথে একটা ফরেস্ট পরে,আমি ঝড়ের সময় ওই ফরেস্টের পথ ধরেই হাঁটছিলাম।ঝড়ের বেগ এতটাই ছিল যে চোখের সামনে দুটো বড়ো আকারের গাছ ভেঙে পড়ল।এক ভদ্রলোক আমার পেছনে বাইকে চেপে আসছিলেন,উনি আমায় দেখে বললেন,আমার যদি আপত্তি না থাকে তবে উনার কোয়াটারে যেতে,উনি নাকি এই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে চাকরিরত।আমিও আর কোন অপশন না দেখে রাজি হয়েগেলাম। পাশেই ছিল উনার কোয়াটার।
দেখলাম বেশ পুরনো বিল্ডিংটি,একজন ভদ্রমহিলা দরজা খুলে আমাদের দেখে এক গাল হাসি নিয়ে ঘরে বসতে দিলেন,বুঝলাম ইনি ওই ভদ্রলোকের স্ত্রী।উনি চটজলদি দুই কাপ গরম-গরম চা এনে আমাদের দিলেন, আমার এখন এটারই খুব দরকার ছিল।যাইহোক এবার ওই ভদ্রলোক নিজের পরিচয় জানালেন উনার নাম রাজেন্দ্র নাথ সরকার স্বপরিবারে উনারা এখানে থাকেন। আমার দিকে কাপ টা এগিয়ে দিয়ে, তা মাস্টামশাই আপনি এখানে কতদিন,শহুরে মানুষ হয়ে এই গ্রাম্য এলাকায় মানিয়ে নিতে আপনার অসুবিধে হচ্ছে না!উনি আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন,আমি একটু অবাক হয়েই বললাম,আপনি আমায় চেনেন নাকি! সে তো একটু খোঁজ খবর রাখতে হয় আর কি,উনি বললেন ।এরই মাঝে মিসেস সরকার বছর চারের একটি বাচ্চা মেয়ে কে কোলে নিয়ে আমাদের সাথে চায়ের টেবিলে যোগ দিয়েছেন । আমার মাস সাতেক হলো এই চাকরির ,তো আপনারা কতোদিন এখানে…? রাজেন্দ্র বাবু,আমরা সেই নব্বই সাল থেকে এখানে। এখন এ জায়গাটার উপর একটা মায়া পড়ে গেছে।
সে তো অনেক বছর হয়েগেছে এখানে,এই ফরেস্ট এলাকায় একা ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন আসে-পাশে আর তো কেউ থাকে না মনে হচ্ছে,ভয় করে না আপনাদের? মিসেস সরকার,কি করব আর বলুন ইচ্ছে তো ছিলো অনেক কিছুই; এই যে আমাদের মেয়ে টিয়া, ওকে শহরে একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করবো,মনের মত করে ওকে বড়ো করবো কিন্তু… রাজেন্দ্র বাবু,জানেন তো আমার বদলির চিঠি এসেছিল কিন্তু আর কোথায়…. যাওয়াই হল না, মৃত্যুর পরেও হয়তো আমাদের আর ঠিকানা বদল হবে না। হাহাহা….
আমি দেখলাম ঝড় থেমেছে,এবার আমায় ফিরতে হবে।উনারা আমায় বিদায় জানাতে জানাতে বললেন আবার কখনো পথ ভুলে আসবেন আমাদের ঘরে,এ পথে তো কেউ আর আসেনা,আপনি এলেন আমাদের খুব ভালো লাগল… আবার এলে বেশ জমিয়ে গল্প হবে আর সেদিন রাতের খাবার খেয়ে যেতে হবে কিন্তু….।উনি আমায় উনার বাইকে ওই ফরেস্টের পথ পার করিয়ে বড়ো রাস্তা অবধি এগিয়ে দোয়েছিলেন। আমি উনাদের আপ্যায়নে মুগ্ধ কি অমায়িক র্ব্যবহার।
পর দিন স্কুলে আমার কলিগদের সাথে গতকালের ঘটনা আলোচনা করলে উনারা সকলে আমার কথা শুনে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করে…একজন সিনিয়র সোমনাথ বাবু আমায় বললেন,সৌভিক তুমি আর ওই ফরেস্টের পথে যেওনা,আমি বিস্মিত ভাবে জানতে চাইলাম কিন্তু কেন??? সোমনাথ বাবু,”সৌভিক… তুমি যাদের কথা আমাদের বললে আজ থেকে দুবছর আগে উনাদের কোয়াটারে এক দুঃসাহসিক ডাকাতি হয়,,ডাকাত দল উনাদের সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায় আর যাওয়ার সময় রাজেন্দ্র নাথ বাবু ওনার স্ত্রী আর চার বছরের মেয়েকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে”।বিস্বাস না হলে এই দেখ..একটি পুরনো খবরের কাগজ আমার সামনে এগিয়ে দিলেন। ছবিসহ খবর টি কাগজে বেরিয়ে ছিল ।
আজও যখন ঝড় হয় আমার সেদিনের সমস্ত স্মৃতি জীবন্ত হয়ে ওঠে..।
সমাপ্ত