প্রতিশ্রুতি

প্রতিশ্রুতি

প্রতিশ্রুতি:

অনেক দিন বাদে আজ দুলাল মামা এসেছে,মামা আমাদের কাছে মামা কম আর বন্ধু বেশি। বিয়ে-টিয়ে করেননি,.. রিটায়ারমেন্ট এর পর থেকে বিদেশ ভ্রমণের নতুন ভূত উনার মাথায় চেপেছে..কোন পিছুটান তো নেই তাই পায়ের নিচে সর্ষে ছড়িয়ে বেরিয়ে পড়েন। এতকাল চাকরি জীবনের বেশিরভাগ সময়টা কাটিয়েছেন গ্রামাঞ্চলে। উনি পেশায় একজন চিকিৎসক । ভাবলে অবাক লাগে কোথায় সবাই চাই শহরের অভিমুখে আসতে কিন্তু উনার এক কথা… এই গ্রামের মানুষ গুলোকে কে দেখবে??..এই করে-করেই কেটে গেল গোটা চাকরি জীবন টা। আর সে সব দিনের নানান অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে শেয়ার করেন। তাই মামা এলেই আমাদের গল্প পিপাসু মনের হাহাকার বেড়ে যায়।
রাতের খাওয়া- দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই বালিশ চাদর নিয়ে আমরা চার ভাই বোনে হাজির হলাম মামার ঘরে.. যদিও মা – কাকিমা অনেক বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু সবই বিফলে গেছে। প্রত্যেক বারের মতো এবারেও মামা আমাদের সাদরে গ্রহণ করেছে। মামা আগে থেকেই জানতেন যে আমরা এ ঘরে হানা দেব তাই চানাচুর-বাদাম ভাজার আয়োজন করে রেখে ছিলেন।
একটু আধটু কথার পরেই এবার মামা আস্তে-আস্তে গল্পের ঝুলি খুলতে শুরু করলেন। মামার মত করেই তোমাদের বলছি….
তখন আমি পুরুলিয়ার বাগমন্ডি গ্রামে, অযোধ্যা পাহাড়ের পাশ ঘেঁষা একটা ছোট গ্রাম।এটাই ছিল আমার ফার্স্ট পোস্টিং, চাকরির তখন বেশি দিন হয়নি ,অভিজ্ঞতা ছিল কম। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা চাষ -আবাদ তাদের প্রধান জীবিকা। তারা হয়তো শিক্ষিত ছিল না জানত না কোন শহুরে আদব-কায়দা তবে তাদের কাছে ছিল আন্তরিকতা, তাদের মনটা ছিল সহজ -সরল । আমার কোয়াটারটা ছিল গ্রাম থেকে একটু দূরে,আর সেখান থেকে হসপিটাল ছিল মিনিট দশেকের হাঁটা পথ।
সেবার আমি কয়েকদিনের জন্য বাড়ি এসেছিলাম,ছুটির মেয়াদ শেষ হতেই আবার রওনা হলাম।পুরুলিয়া স্টেশনে যখন ট্রেন পৌঁছালো তখন এই রাত আটটা একেই বৃষ্টি বাদলার দিন তার ওপর সে সময় এটাই ছিল লাস্ট ট্রেন…এর আগে আমি যতবার এসেছে সবই দুপুরের ট্রেনে তাই রাতের ব্যপারটা জানা ছিল না। লোকজন তেমন নেই বললেই চলে এক পা দু পা হাঁটতেই একটা বাস পেয়ে গেলাম…ঘন্টা খানেক বাদেই এসে গেল বাগমন্ডি গ্রাম…বাস থেকে নেবেই ঘোরালো অন্ধকার যেন সজোরে একটা থাবা বসালো…. এতটাই অন্ধকার ছিল যে আমি নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না… পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিন সব তখন গুলিয়ে এক হয়েছে আমার , একটা জনপ্রাণীরও দেখা নেই.. বড়ো রাস্তার ধারে তখন আমি একলা দাঁড়িয়ে.. আমার একাকিত্ব কে ভেঙ্গে খান খান করছে ঝিঝি পোকা আর ব্যাঙের ডাক সাথে আবার বিদ্যুতের ঝলকানি ও মেঘের গর্জন…এমন সময় অন্ধকারের চাদর সরিয়ে কেউ যেন এগিয়ে আসছে আমার দিকে… একটু ভয় করছিল আমার কোন চোর ডাকাতের খপ্পরে পড়লাম না তো আবার…..
“ডাইক্তার সাহিব তু ইখানে ইত্ত রাইতে….কুথাকে গেছিলিস তু????”…গলাটা ভীষণ চেনা মনে হচ্ছিল… কিন্তু ঠিক ঠাহর করতে পারছিলাম না।ওর সাথে থাকা ভ্যান দেখে বুঝলাম ও কালুয়া..এই গ্রামেই থাকে, পেশায় একজন ভান চালক.. ওর সর্বক্ষণের সাথী এই ভ্যান। নেশা-ভান করে মাঝে মধ্যেই পেটের ব্যথা নিয়ে আসে আমার কাছে…এই চেনা অজানা আঁধারের মাঝে ওকে পেয়ে যেন ধরে প্রাণের সঞ্চার হল আমার।
আরে কালুয়া যে..আর বোলো না বাড়ি গিয়ে রাতের ট্রেনে ফিরছিলাম কিন্তু এখানে এসে আর ঠিক রাস্তাটা বুঝতে পারছি না… তুমি এখন এ পথে…রাতেও ভাড়া টানছ নাকি??? না রে সাহিব তুর লিগ্যেই মু আসিছি…আই চাপাইন যা তুকে তুর ঘর ছারাইনদি আসি…।ওর কথার সাত-পাঁচ না বুঝে চেপে বসলাম ওর বাহনের ওপর…
বড়ো রাস্তা থেকে বাঁয়ে কেটে গেল কাঁচা রাস্তা সেই রাস্তা বেয়েই চলেছে কালুয়ার ভ্যান..আমি পেছনের দিক টাই বসেছিলাম সাথে ছিল একটা সাইড ব্যাগ…দুধারে ঝোঁপ-ঝার ছোট বড়ো নানান গাছের সারি…ভেজা মাটি স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ…..হালকা বাতাসও বইছে…আচমকা মনে হলো কতগুলো হলুদ চোখ আমার দিকে ধেয়ে আসছে…আমি ভয়ে চিৎকার করে ডাকলাম….কালুয়ায়ায়া……ভ্যান না থামিয়েই…কি হুলোক সাহিব তুর…মু কে বুল ক্যেনে…।ওই দেখো কত গুলো হলদে জ্বলন্ত চোখ ….হুক্কাহুয়া হুয়া হুয়া..উউউউওওওওওওওও… কি বিকট আওয়াজ….আরে সাহিব ই তো শিলাই আইছে রে…. হা..হুুসসস্…তু ইখানে মুর পাইসটাতি আসি বুস কেনে…ডরাইস না মু আচ্ছি তুর সাথে..তু চুখ বুজাইন থাক..মু তুকে তুর ঘর ছারাইনদিবক তুবেই ইখান হুতে যাবক।
ওর পাশে বসতেই একটা কেমন গন্ধ নাকে এল…তাঁরির গন্ধ নানা এ তো…যেন পঁচা কিছুর গন্ধ..যেমন কোন জীব জন্তু…এতো পঁচা মাংসের গন্ধ.. ক্রমেই গন্ধটা বিকট হয়ে উঠছে… না পারতে কালুয়া কে বলেই ফেললাম…আচ্ছা কালুয়া তোমার কি কোথাও কোনো পুরনো ক্ষত আছে,যেখানে এখন পচন ধরেছে??? ও ঘাড় নেড়ে জানালো..লা রে সাহিব…লে তুর ঘর আসি গিন্ছে…যা তু ঘরেত যা আর পিচ্ছন ফিরি চাহিনস লা..যা কেনে….।আমি ভ্যান থেকে নেবে ব্যাগ টা নাবিয়ে ওকে পয়সা দিতে চাইলে ও বলে..সাহিব মু আর উু পয়সা লিয়ে কি করবক..তু মু কে উু পয়সা টো না দিয়ে মু কে ইকটা কত্থা দিবিক???
বলো কি কথা…তু মুদের ছাড়ি দি কুথাকে চলি যাবিকলাই…মু কে কত্থা দে তু….তু মু দিগের লিইগ্যে ইত্ত ভাবিস তু মু দের উু ভগবান আছিস…তু চলি গিলে মুরা সব রোগে ভোগে মরি যাবক..তু যাস লা সাহিব…। আচ্ছা যতদিন চাকরি আছে আমি যাব না.. তুমি পয়সাটা নাও…কালুয়া….কালুয়া…কোথাও নেই ও…চলে গেছে…এই অন্ধকারে ওকে কোথাও দেখতে পেলাম না।
এদিকে আমার গলা শুনতে পেয়ে রঘু ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে…ও আমার ঘরের কাজকর্ম রান্না- বান্না করে,আমার সাথেই থাকে। আরে সাহেব আপনি এত রাতে…ভেতরে আসুন…আমি জল এনে দিচ্ছি হাত মুখ ধুয়ে নিন…হারিকেনের আলোয় দেখলাম ঘড়িতে তখন বারোটা… খানিক বাদে মুখ হাত ধুয়ে এসে বসতেই রঘু গরম ভাত আর মাছ ভাজা দিয়ে আমায় খেতে দিয়েছে। কয়েক গ্রাস মুখে তুলতে-তুলতে রঘুকে বললাম তুই খেয়েছিস???? হ্যাঁ সাহেব আজ আমি ওই লখায়ের বাড়ি খেয়ে এসেছি…। কেন রে…. কিছু ছিল না কি কোনো পরব ছিল??? না সাহেব ওর বাপটা দুদিনের জ্বরে মরেছে,এসেছিল এখানে..আপনি তো ছিলেন না তাই বিনে চিকিৎসায়……ওর ছেরাধ্যে খাওয়া ছিল আজ। লখায়ের বাপ মানে…কে বলতো??? আমি কি ওকে চিনি নাকি রে??? হ্যাঁ সাহেব ওই যে আপনার কাছে মাঝে মাঝে আসে না…ওই ভ্যানওয়ালা….কালুয়া।
আমার মাথার ওপর যেন বজ্রপাত হল… বুকের ধরপরানি বেড়ে গেল..মুখ থেকে কোন কথা সরলো না.. চোখ থেকে গড়িয়ে এল জল..পাত থেকে উঠে হাত ধুয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম…আমার কানে ওর কথা গুলো বাজছিলো তখন” মু কে ইকটা কত্থা দিবিক???..তু মুদের ছাড়ি দি কুথাকে চলি যাবিকলাই…মু কে কত্থা দে তু….তু মু দিগের লিইগ্যে ইত্ত ভাবিস তু মু দের উু ভগবান আছিস…তু চলি গিলে মুরা সব রোগে ভোগে মরি যাবক..তু যাস লা সাহিব…তু যাস লা ….।”
তবে আমরা.. সাথে যে ছিল… তবে কি সবই আমার স্বপ্ন…সবই আমার মনের কোন ভুল….??? সে উত্তর আর পাইনি.. আজও পাইনি.. তবে এর পরে অনেক বার ও আমার স্বপ্নে এসেছে…একই কথা ওবলেছে আমাকে..। তারপর থেকে যখনি অনেক রাতে ভ্যানের শব্দ কানে আসে মনে হয়েছে যেন কালুয়া যাচ্ছে।
তোরা জানতে চাস যে আমি কেন ওই গ্রামের পোস্টিং গুলো নিতাম…..এই হল তার কারণ…. আমি কালুয়ার …না…ওই অজানা আগন্তুকের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম তাইতো চাকরী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই শহর মুখী হওয়া আমার আর হলো না।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত