বয়স বাড়ছে, চুল দাড়ি পাকছে, শরীরে ব্লাড সুগার বাড়ছে, আর সাথে সাথে বাড়ছে নারী প্রেতের প্রতি আসক্তি! কেন জানিনা যে, কোন নারী মরে গিয়ে ভুত হয়েছে এমন ভুতের সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য কেমন জানি মরিয়া হয়ে উঠছি দিন দিন। তবে যেন তেন নারী প্রেত নয়!! কেবলমাত্র সুন্দরী নারীর প্রেতাত্মা চাই। যে কিনা মরার আগে অনেক পুরুষের দীর্ঘশ্বাস ছিল। যার সৌন্দর্যে মুগ্ধ ছিল বহু পুরুষ! কিন্তু যেখানে ভুত পেতনীরই কোন দেখা নেই, সেখানে সুন্দরী প্রেত কোত্থেকে পাবো? আর তাছাড়া মরে যাওয়ার পরে কি আদৌ কোন প্রেত সুন্দরী বা সুশ্রী থাকে? কি জানি! ভৌতিক সব গল্পের প্রেত গুলোকে তো সুন্দরীই মনে হয়। তবে প্রেতের সন্ধান আমাকে পেতেই হবে সে যেভাবেই হোকনা কেন।
ঠিক করলাম ঝিনাইদহ মহিষা কুন্ডু শ্মশান ঘাটে তিন দিন তিন রাত অবস্থান করবো। যদিও সেখানে কিছু কর্মী সব সময় থাকে। একজন কর্মী নতুন লাশ এলে তা রেজিষ্টার খাতায় লিপিবদ্ধ করবে। আর অন্য ৩ জন বড় বড় জটা চুল দাড়ি নিয়ে মন্দিরেই ঘুমায় মন্দিরেই খায়। তারা লাশ পোড়ানো ও আনুসাঙ্গিক কাজে নিয়োজিত। মন্দিরটার ঠিক ৩০ কদমের দুরত্বে রয়েছে শব পোড়ানোর জায়গা টা। আর তার সাথেই লাগানো সিড়ি ঘাট। ৫ – ৬ টা সিড়ি ভাঙলেই নদীর পানি এসে ঠেকবে পায়ে। কি সচ্ছ পানি!! মাটি পর্যন্ত দেখা যায়। নদীর ওপারে বিস্তির্ন মাঠ। বিশাল একটা ফাকাঁ জায়গায় অবস্থিত এই শ্মশান। আশ পাসে কয়েক একর জমির ভিতরে কোন বাড়ি ঘর নেই।
জানিনা আমার উদ্যেশ্য সফল হবে কিনা তবুও বেশ রোমাঞ্চিত বোধ করছি আপন মনেই। একটা ছোট ব্যাগে দুটা লুঙ্গি, একটা গামছা আর দুটা গেন্জি এবং আনুসাঙ্গিক প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে রওনা দিলাম শ্মশান ঘাটে। যেহেতু তিন কুলে আমার আপন বলতে কেউ নেই তাই কাউকে জবাবদিহিতা নিয়েও কোন ঝামেলা রইলো না।
শশ্মান ঘাটে যারা কাজ করে তারা এতটাই ভদ্র আর অমায়িক যে তাদের সাথে তিন দিন থাকার প্রস্তাবে বেশ খুশিই হলো তারা। আমিও খুব মানিয়ে নিলাম তাদের সাথে। যে ছেলেটা রেজিষ্টার খাতায় লেখালেখির দ্বায়িত্ব পালন করে তার নাম, দিনোনাত। আর বাকি যে তিনজন জটা চুলওয়ালা, সাধু সন্ন্যাসীদের মত ভেক, তাদের নাম গুলো এতটাই কঠিন ছিলো যে আজ আর তা স্বরনে নেই। আমি সেখানে পৌছলাম দুপুর নাগাদ। বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা তখন ওই জটা চুলওয়ালারা আমাকে তাদের পুজোর প্রসাদ দিল। আমি মনে মনে বিসমিল্লাহ বলে খেয়ে ফেললাম! এরপর দেখলাম দুজন রান্না বান্নার জন্য চুলোর দিকে এগিয়ে গেল আর অন্যজন বেশ মনযোগের সাথে একটা কাটারি দিয়ে কুচিকুচি করে গাঁজা কাটছে। বুজলাম এ তাদের নিত্যদিনের কর্মসূচি। কিন্তু আমাকে তো বসে বসে এগুলো দেখলে চলবে না! আমাকে প্রেতের সন্ধান করতে হবে! আচ্ছা, প্রেত না হয় পেলাম কিন্তু সুন্দরী প্রেত কোথায় পাবো? আর পেলেই বা তা দিয়ে করব টা কি? ধুর ..!! অতশত জানিনা .. আমার সুন্দরী প্রেতের সন্ধান চাই। আপন মনেই বলতে বলতে সিড়ি ঘাটের দিকে এগোতে থাকলাম।
একটা বড় টিনের ছাউনির নিচে পোড়ানো হয় মৃতদেহ। তার নিচ দিয়ে একটা ড্রেনে আছে যেটা গিয়ে মিশেছে নদীতে। ঐ ড্রেন দিয়ে পোড়ানোর পরে ছায় গুলো পানি মেরে নদিতে ফেলা হয়। তার পাশেই সিড়ি ঘাটটা। সময় তখন কত হবে! আনুমানিক ৮ টার মত। যেইনা ঘাটের দিকে তাকিয়েছি ওমনি দেখি একদম নিচের সিড়িটাই একটা কালো শাড়ি পরা মেয়ে পানিতে দুই পা ডুবিয়ে বসে আছে!!!
আমার সরু ঠোটের নিচে একটা তৃপ্তির হাসির রেখা ভেসে উঠলো। ভয় পাওয়ার বদলে যেন যুদ্ধ জয়ের আনন্দ আমাকে চেপে ধরেছে। উত্তেজিত চোখ দুটো নিয়ে তাকিয়ে আছি সেদিকে, আর মনে মনে ভাবছি – তুমি এত তাড়াতাড়ি আমায় দেখা দেবে আমি ভাবতেই পারিনি … দাড়াও একটু .. আমি আসছি ..আসছি .. ঠিক তখনই..
-“ও দাদা চইলবো নাকি একটান?” পিছনে ঘুরে দেখি গাঁজা বানাচ্ছিল যে লোকটা সে একটা পাইপ উচুঁ করে আমাকে উদ্যেশ্য করে বলল। খুব বিরক্ত হলেও মুখে হাসি আর আন্তরিকতা এনে বললাম – “না গো দাদা আমার ওগুলোর অভ্যেস নেই!”
লোকটা হাসি বিনিময় করে ফিরে গেল। আমিও ফিরলাম সিড়ির দিকে। কিন্তু কই? কেউ তো নেই!! বেশ হতাশ হলাম!! কিন্তু হাল ছাড়লাম না। যেখানে মেয়েটি বসে ছিলো ঠিক তার পাশটাতে গিয়ে বসলাম আমি। আর মনে মনে বললাম, “কই গো প্রেয়সী … কোথায় তুমি? আমি তো তোমার সন্ধানেই এসেছি .. দেখা দাও .. দেখা দাও …”
সারারাত বসে থেকেও তার দেখা আর পেলাম না। পরের দিন অর্থাৎ দ্বিতীয় দিন সকাল থেকেই কেমন একটা ঝিমঝিম ভাবের মধ্য দিয়েই কেটে গেল। জটা চুলওয়ালা দের সাথে সারাদিন চলল আড্ডা আর আধ্যাত্মিক গান। বলে রাখা ভালো গতকাল এবং আজ এই দুদিনের ভিতরে কোন লাশ পোড়ানোর জন্য শশ্মানে কেউ আসেনি। কেমন জানি একটু ইচ্ছাও হচ্ছিল দাড়িয়ে থেকে লাশ পোড়ানো দেখব। সে যাহোক, আমি মনে মনে রাতের অপেক্ষায় থাকলাম। বিকাল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা তখনই গিয়ে হাজির হলাম ওই সিড়ি ঘাটে। এবং বিষ্মিত হয়ে দেখলাম আমার ডাকে সারা দিতে সে আগে থেকেই আমার জন্য অপেক্ষা করছে!! আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে তার পাশে গিয়ে বসলাম। কিন্তু সে নির্বিকার!! হালকা বাতাসে তার চুল গুলো উরে উরে গেলেও চাদেঁর মৃদু আলোয় খুব বেশি আচঁ করা গেলনা তার চেহারা সম্পর্কে। আমি একটু চাপা স্বরে তাকে উদ্যেশ্য করে বললাম –
“এই তোমার নাম কি?”
সে নিরুত্তর! আমি আবারো বললাম –
“তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো?”
তাও কোন উত্তর এলোনা! এবার একটু ইতস্তত করে বললাম –
“তুমি কি বাংলা বোঝনা? ঠিক হ্যাই, কিয়া তুম হিন্দি সামাজতে হো? Or do you know English?”
এবার সে আমাকে অবাক করে দিয়ে শুদ্ধ বাংলা ভাষায় বলল – “ঠিক তিনটায় এখানে এসো, আমি অপেক্ষা করব”
কানের ভিতরে কয়েকবার বাজলো কথাটা। জীবনে এই প্রথম এতো মধুর আর আবেদনময়ী কন্ঠ শুনলাম তাতে কোন সন্দেহ নেই। সম্মোহন কাটতেই দেখলাম সেখানে কেউ নেই!! আমি একটা দারুণ তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে উঠে এলাম সেখান থেকে। মনে মনে প্রচন্ড উত্তেজিত বোধ করছি। যদিও দক্ষ অভিনয়ের চাদরে তা ঢেকে রাখলাম শশ্মানের বাকি লোক গুলোর থেকে। খাওয়া দাওয়া সেরে সবাই শুয়ে পরেছি মন্দিরের মেঝেতে। কিন্তু আমার নজর ঘরির কাটার দিকে।
২টো বেজে ৫০ মিনিটেই আমি উঠে পরলাম এবং ধীর গতিতে এগিয়ে গেলাম সিড়ি ঘাটে। ঠিক একই জায়গায় বসে আছে সে। আগের মতই তার পাশে গিয়ে বসলাম। খুব কাছে ঘেঁষে বসলাম! ভাবলাম প্রেতের শরীরের স্পর্শ কেমন তা যদি কিছুটা বোঝা যায়… কিন্তু নাহ .. কোন স্পর্শ অনুভুত হলনা। আমিই কথা শুরু করলাম –
“এবার তো বলবে তোমার নাম কি?”
-“আমার নাম – তিথি”
-“বাহ! সুন্দর নাম, তো তুমি এখানে কি করছ?”
-“কেন জানেন না বুঝি? এটাই আমাদের বসবাসের জায়গা”
-“আমাদের বলতে আর কে?”
-“আমরা যারা অপঘাতে মারা গেছি তারা”
-“কি ভাবে মারা গেছ তুমি?”
-“গলায় দড়ি দিয়ে”
-“কেন মরতে গেলে?”
-“এছাড়া আর উপায় ছিলনা যে!!”
-“কেন কি হয়েছিল?”
-“সে অনেক কথা ..!”
এবার আমি আরো সাহস সঞ্চার করে বললাম –
“আমি একটু তোমায় দেখতে পারি?”
-“অবশ্যই” বলেই সে আমার দিকে ফিরে চাইলো!!
কি বলব সে রূপের কথা। এক কথায় আমি মুগ্ধ!! গায়ের রং একটু চাপা, কিন্তু তাতেই যেন অসাধারনত্ব বিদ্যমান। হঠাৎ করেই মনে হল -কি আজব ব্যাপার!! একটা প্রেতের দেখা চেলাম পেলাম তাও আবার সুন্দরী প্রেত!
ঘটনার এই পর্যন্ত বর্ননা শুনে যে কেউ আমার মুখে ন্যাপা ঘষে দিত!! আর টিটকারী করে বলত –
“ওই জটা বাবুদের কাছ থেকে কই কোলকে গাজাঁ খেয়েছিস? সুন্দরী প্রেতের দেখা পেয়েছিস কিনা জানিনা, তবে দক্ষ গাজাঁ সেবকদের দেখা পেয়েছিলি তা নিসন্দেহ!!”
সৌভাগ্য বলব নাকি দুর্ভাগ্য বলব, ঘটনা ওই পর্যন্ত থেমে থাকেনি!! এবং এই ঘটনার সত্যতা নিয়ে যেন কোনদিনও কেউ সন্দেহ না করতে পারে তার স্পষ্ট প্রমাণও রেখে গেছে ওই প্রেত…
“তোমার কি আমায় একটু ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে?”
চমকিয়ে উঠলাম আমি!! কিন্তু সে কিভাবে জানল আমার মনের কথা!! এছাড়াও লক্ষ্য করলাম সে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে। তার মানে কি সে ধীরে ধীরে আমার অন্তরের গহীনে লালিত কামনার কথা বুজতে পেরেই সে পথেই অগ্রসর হচ্ছে? মনে মনে বেশ ভাললাগা অনুভব করলাম। এবং মাথা ঝুকিয়ে ঝুকিয়ে সম্মতি জানিয়ে বললাম –
“হ্যাঁ গো … জীবনে প্রেতের স্পর্শ পাওয়ার খুব সখ ছিলো”
সে বলল –
“তবে তোমার হাত টা দাও”
আমি আনন্দে কম্পিত হাতটা এগিয়ে দিলাম। কিন্তু আমার ভাগ্যে যে সে রাতে এমন কিছু অপেক্ষা করছিল তা জানতে পারলে হয়তো হাত টা এগিয়ে দিতাম না… হাত তো দুরের কথা ভুত প্রেতের চিন্তাও করতাম না ভুলেও!
আমি হাতটা দেয়া মাত্রই সে আমার হাতটাকে বাঁকিয়ে ধরলো উল্টো দিকে … প্রচন্ড ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম আমি …. কি শীতল বরফ হাত ওর …!! শক্ত লোহার মত ..!! আমি একটু বাকা হয়ে গেলাম ..! আর মুখটা কাচুমাচু করে খুব কষ্টে বললাম –
“এ..এএ এই কি করছো? আমি তো মরে যাবো .. উফফ সহ্য করতে পারছি না … ছাড়ো ছাড়ো ….”
ও সাভাবিকের চেয়ে একটু দৃঢ় কন্ঠে বলল –
“কেন ভালো লাগছে না বুঝি? সারা জীবন তো নারীদের নরম হাতের ছোঁয়ায় কামনার স্পর্শই পেয়ে এসেছো! কিন্তু মৃত্যুর স্পর্শ কেমন লাগে একটু দেখ … ঠিক এভাবেই ধরা হয়েছিল আমাকেও!!”
আমি ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে বললাম –
“এগুলো কি? কে কি করেছে তার সাথে আমার সম্পর্ক কি?”
এবার সে আরো বিষ্ফোরিত হয়ে বলল –
“আছে!! সম্পর্ক আছে, তোদের মত লোক গুলোর জন্যই আমি বাঁচতে পারিনি .. কুকুরের মত ছিড়ে খেয়েছিলি আমাকে .. এখন মরেও শান্তি নেই .. মরার পরেও এসেছিস আমাকে জালাতে???”
এবার সে তুমি থেকে তুই তে নেমে এলো!
বুঝতে কিছু বাকি থাকলোনা কত বড় ভুল আমি করে ফেলেছি … কিন্তু সে উপলব্ধি হতে না হতেই কড়াৎ একটা শব্দে উপলব্ধি করলাম আমার হাত টা কেউ ছিড়ে ফেলল!!! তাকিয়ে দেখলাম আমার একটি হাত নেই … আমার মস্তিষ্কে তখনো এই তথ্য পৌছইনি। ফলে আমি আমার হাত খুজেঁ চলেছি। পেতনীটার দিকে তাকিয়ে দেখি আমার ছেড়া হাতটা ওর হাতে .. আর ওর মুখ ভর্তি আমার শরীরের তাজা রক্তে!! সেই রক্ত মাখা মুখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হাসছে সে … আমি দুচোখ ভরে সেই হাসি দেখছি …. উফফ কি সুন্দর হাসি …!!!
জ্ঞান ফিরলো ২ দিন পর। তাকিয়ে দেখি হাসপাতালের কেবিন রুমে। পাশে বসে আছে তিন জটা চুলওয়ালাদের একজন। দেখলাম আমার জ্ঞান ফেরায় খুশি হয়েছে সে। চোখে পানি চলে এলো। হয়তো এরাই আমাকে উদ্ধার করে এখানে এনেছে। খেয়াল হলো বাম হাতটা নেই!! তারপরেও মনে মনে বললাম ভাগ্যিস পেতনীটাকে বাম হাতটা এগিয়ে দিয়েছিলাম …! নাহলে যে আমার লেখালিখি চুলোয় যেত..আর এই ঘটনাটিও লেখা হতনা!!