জায়গীর বাড়ির এই রুমটি রফিকের ভারী পছন্দ ।সুন্দর- পরিপাটি করে নিজ হাতে সাজানো ।শোয়ার বিছানা আর পড়ার টেবিল বাদ দিলে তেমন কোনো আসবাবপত্র নেই রুমে ।পুরো রুমটিতে একটি মাত্র খুঁত–বিছানার ঠিক উপরে টিনের চালের সাথে রক্সি পেইন্টের খালি একটা কৌটা বেঁধে রাখা,বৃষ্টির পানি জমে সেই কৌটায় ।ঘোর বর্ষাকাল এখন, সময়-অসময়ে বৃষ্টি নামে ।এতো জায়গায় থাকতে ঠিক মাথার বালিশ বরাবর টিনে ছিদ্র কেন হলো–এই চিন্তায় রফিকের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো ।মেজাজ খারাপ হলে তার মুখে থুথু আসে,মুখে এক গাদা থুথু নিয়ে রফিক মুখ কালো করে বসে আছে ।থুথু ফেলতে হলে ঘর থেকে বের হতে হবে,কিন্তু বিছানা থেকে নামতে ইচ্ছে করছে না তার ।খানিক বাদে থু’করে মাটির মেঝেতে থুথু ফেলার চেষ্টা করলো রফিক,কপাল খারাপ তার–থুথু গিয়ে পড়লো তার স্যান্ডেলের ওপর ।বিরস
মুখে স্যান্ডেলে পড়া থুথু দেখছে রফিক,আজকে সব কিছু এমন উল্টোপাল্টা হচ্ছে কেন– এটাই ধরতে পারছে না সে !ঘড়িতে রাত ১১ টা ৪০ বাজে ।
থুথুওয়ালা স্যান্ডেল পরে রফিক ঘর থেকে বেরোলো । স্কুল মাঠের দিকে হাঁটা দিলো সে ।বিশাল এক চ্যালেঞ্জ নিয়েছে রফিক,জিততে পারলে নগদ ১০০০ টাকা ।এই
টাকার লোভই মধ্যম প্রকৃতির ভীতু রফিককে অসীম সাহসী করে তুলেছে ।কাজটি খুব বড় কিছু না,জায়গীর বাড়ির উত্তরে বিশাল কবরস্থান,সপ্তাহ দুই
আগে মুন্সী বাড়ির শহীদ মুন্সীর কবর দেয়া হয়েছিল সেখানে ।দুই সপ্তাহে এই নিয়ে তিনবার কবর ভাঙ্গলো বৃষ্টির পানির স্রোতে ।রফিকের বন্ধুদের আবার
ভিন্ন ধারণা,অশরীরী কিছু একটা আছে ওখানে । কবরস্থানের পাশ ঘেঁষে মাটির রাস্তা,গত পরশু রাতে বাজার থেকে বন্ধুদের সাথে ফেরার সময় দেখা গেলো ভাঙ্গা কবরের ভেতর শহীদ মুন্সীর দাঁত চকচক করছে ।তখনি বাজির কথা উঠলো,রাত ১২ টার সময় কবর থেকে মুন্সীর দাঁতের পাটি তুলে আনতে পারলে নগদ ১০০০ টাকা।
রফিক সাহসের সাথে বাজি ধরেছে,স্কুলের মাঠের দিকে এতো রাতে যাবার কারণ সেটাই ।সিদ্ধান্ত হলো মড়ার দাঁতের পাটি নিয়ে রফিক হেঁটে স্কুলের মাঠেই ফেরত আসবে ।টাকা নগদে দেয়া হবে–রফিককে আশ্বস্ত করলো মামুন,টাকা নিয়ে মামুনরা অপেক্ষায় থাকবে । বুকে ফু দিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে রওনা করলো রফিক,সাথে লাইট জাতীয় কিছু নেয়া যাবে না ।ঘুটঘুটে অন্ধকারে কবরস্থানের দিকে পা চালালো সে ।কবরস্থানের মাথায় এসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেয়ার কথা ভাবলো রফিক,প্রথম ভয়টা পেল ঠিক তখুনি ।মেঘলা আকাশে হঠাত বিকট শব্দ করে বিদ্যুত চমকালো, মুহুর্তের আলোয় রফিক পাঁচ হাত সামনে কুচকুচে কালো একটি বিড়াল দেখতে পেল ।বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো তার, বিড়ালের জ্বলজ্বল করা চোখ এখনো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ।ধুম করেই বৃষ্টি নামলো ।পিচ্ছিল মাটিতে আঙ্গুল টিপে হাঁটতে হাঁটতে আরেকবার দুনিয়া ভেঙ্গে বাজ পড়লো ।রফিকের মনে হলো বাজ বোধহয় মুন্সীর কবরের কাছেই পড়লো! কানে তালা লেগে গেলো রফিকের,আঙ্গুল দিয়ে কান ঝাঁকানোর সময় আরো চারটি কালো বিড়াল আবিষ্কার করলো সে ।কবরস্থানে ঢুকার পর এই প্রথম গা ছমছম করে উঠলো তার!
পাঁচ-পাঁচটি কালো বিড়াল হাতের বামে রেখে দোআ- কালাম পড়তে পড়তে এগিয়ে গেলো রফিক,বৃষ্টির গতি হুহু করে বাড়ছে ।কোনাকুনি ১৫ হাতের মধ্যেই মুন্সীর
কবর,আরো কয়েক হাত সামনে গিয়ে পেছন ফেরলো সে । তাজ্জব কাহিনী,বিড়ালের নাম-গন্ধ পর্যন্ত নেই! সামনে ফিরে এগুতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালো রফিক,মুন্সীর
কবরের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিড়ালগুলো, ফসফরাসের দাঁত বিড়ালগুলোর ঠিক সামনে!
মনে সাহস নিয়ে আরো কয়েক হাত সামনে গেলো রফিক,মাঝখানের বিড়ালটি শরীর হিম করা লম্বা ডাক দিলো ।বিড়ালের ডাক না; অন্য কিছুর ডাক হবে,রফিকের জীবনে এতো হিংস্র কোনো কিছুর ডাক শুনে নি সে ।রফিকের স্থির বিশ্বাস,এই পাঁচটি আর যাই হোক বিড়াল অন্তত নয় ।রফিকের বিশ্বাস প্রমান করতেই যেন ‘প্রানীগুলো’ কবরের ভেতর থেকে টানতে টানতে গোলাকার একটা কিছু নিয়ে ঠেলে দিলো সামনে । ঘোর অন্ধকারেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো–মুন্সীর মাথার খুলি সেটা! বৃষ্টির পানি দুই চোখের জায়গার ছিদ্র দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ।দুই সপ্তাহের মড়া,চুল-দাড়ি পঁচে নি এখনো ।অনেক কষ্টে চুল কিংবা দাড়ি- কিছু একটা ধরে প্রানীগুলোর দিকে ছুড়ে মারলো খুলিটি সে,ক্ষুধার্ত পশুর মতো ওটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো প্রাণীগুলো,শুধু একটি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো জ্বলজ্বল করা দাঁতের সামনে ।
মুরগির রানের মতো মটমট করে মুন্সীর খুলি খাচ্ছে চারটে বিড়াল–চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা তার,শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা কিছু
একটা বয়ে গেলো রফিকের ।এখান থেকে আর যাই হোক- ফিরে যাওয়া চলবে না, রফিক ঠিক করে ফেললো ।নিচু হয়ে মাটির মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে এগোলো সে,লম্বা করে শ্বাস নিলো দাঁতের পাটি ছোঁ মেরে নেয়ার আগে । তক্ষুনি কড়কড় শব্দে বাজ পড়লো আরেকবার,বিদ্যুতের ঝলকানিতে মুন্সীর খুলিবিহীন শরীর থরথর করে কাঁপছে! মুহুর্তেই ছোঁ মেরে দাঁতের পাটি টান মেরে ঝেড়ে দৌড় দিলো রফিক ।উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে পেছন ফিরে তাকিয়ে মূর্ছা যাবার দশা তার,পাঁচটি প্রাণীই তীব্র বেগে পিছু নিয়েছে ।সমানে পা চালালো রফিক, ওই যে স্কুল ঘরের আলো দেখা যাচ্ছে ।শেষ দমটুকু নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে রফিক,ডান হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে দাঁতের পাটি ।তীব্র বৃষ্টির মধ্যে হঠাত করেই আশেপাশের সব কিছু অন্ধকার হয়ে এলো তার কাছে, স্কুল ঘরের কোনায় গিয়ে জ্ঞান হারালো রফিক!
পরেরদিন বাদ জোহর মুন্সীর ভেঙ্গে যাওয়া কবর আবার বাঁধানো হলো ।রফিকের শরীর ভেঙ্গে জ্বর আসছে,তারপরেও সবার সাথে এসেছে সে ।মুন্সীর খুলি পাওয়া গেলো কবরের থেকে ১০/১২ দক্ষিনে, মানুষজন নানা কথা বলছে । মামুনদের সাথে চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলো রফিক, জ্ঞান ফেরার পরে সব বলেছে সে তাদের ।
সব শেষ করে আসরের নামাজের পরে বাড়ি ফিরল রফিক । বালিশের নিচ থেকে ১০০ টাকার ১০টা চকচকে নোট নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে মুখের কাছে ধরলো রফিক ।কান পর্যন্ত হাসি টেনে টাকাগুলো পকেটে চালান করে দিয়ে আয়নার দিকে তাকাতেই ভয়ে কুঁকড়ে গেলো সে ।আস্তে করে মুখের ভেতর হাত দিলো সে,সামনের মাড়ির মাঝখানের দুটো দাঁত খুলে অবলীলায় হাতের সাথে চলে এলো ।রক্তের চিহ্ন পর্যন্ত নেই সেখানে! দুটো দাঁতই শুকনো, মাটি লাগা; ঠিক শহীদ মুন্সীর দাঁতের মত !
সমাপ্ত