তাকে দেখে হেসেছিলাম বলে

তাকে দেখে হেসেছিলাম বলে

আমি অনয়। আজ আমি তোমাদের সাথে শেয়ার করব আমার সাথে ঘটে যাওয়া এক ভৌতিক গল্প। আমি কথাগুলো শুনেছি আমার মা, দাদু, নানু আর খালামনির কাছ থেকে। আমার এই পৃথিবীতে বয়স তখন ছয়মাস। আব্বু আর আমার একমাত্র ফুফু পৃথিবীতে বেচে। আমরা তখন পৈত্রিক নিবাস গ্রামের বাড়িতেই থাকি। আমি দেখতে খুব সুইট আর একমাত্র শিশু ছিলাম বলে সবার কোলে কোলে চষে বেড়াতাম। একদম-ই কান্না করতাম না বলে সবাই কোলে নিয়ে আনন্দ পেত। একপ্রকার প্রতিযোগিতায় চলত আমায় কোলে নেয়া নিয়ে। সবার অত্যাচারে আম্মুর কোলে উঠতে পেরেছি খুবই কম। একমাত্র খাওয়া আর গোসলের সময় হলে আম্মুর দেখা পেতাম। আমাদের গ্রাম থেকে বাজার বেশ দুরত্বে হওয়ায় মাঝে মাঝে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি স্থানীয় দোকান থেকেই কেনা হত। আর গ্রামের দোকানদার হিসেবে রহিম চাচার খুব নাম ডাক ছিল। আমাদের বাড়ি থেকে রহিম চাচার দোকানের দুরত্ব ছিল পায়ে হেটে গেলে পনের মিনিটের পথ। রহিম চাচার দোকানে যাওয়ার পথে রাস্তার ডানপাশে পড়ত এক পরিত্যাক্ত পুকুর। পরিত্যাক্ত বলতে পুকুরে অনেক পানি ছিল কিন্তু বাঁশ ঝাড় আর বড়ই গাছে ঘিরে থাকায় সেখানে কোন মাছ চাষ করা হত না। আর পুকুরের পানিও ছিল একদম কাল। গ্রামের অনেকেই বলতো এখানে খারাপ কিছু থাকতে পারে তবে কোন কিছুই কখনও কারও চোখে পড়েনি। একদিন খালামনি আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে। বিকালে খালামনি আর ফুফু মিলে আমায় কোলে নিয়ে রহিম চাচার দোকানে যায় চানাচুর আর বাদাম কিনতে। কিনে যথারীতি বাড়িতে চলে আসে। আমি তখনো প্রাণবন্ত হাস্যজ্জ্বল। সন্ধায় হঠাৎ আমার শরীরে জ্বর আসে। স্বাভাবিক জ্বর ভেবে আব্বু বাজারে গিয়ে আমার জন্য মেডিসিন নিয়ে আসে। কিন্তু রাত বাড়ার সাথে সাথে আমার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। আমি কান্না শুরু করি। আমার অবস্থা বেগতিক দেখে রাতেই তেল পড়ে আনা হয়। ঝাড় ফুক দেওয়া হয়। কিন্তু কমার নাম নেই। সারারাত কেউ ঘুমাতে পারেনি। আমায় নিয়ে সারারাত বসে ছিল। ফুফু আর খালামনি তো ভয়ে জড়োসড়ো। তারাই তো আমায় সাথে নিয়ে গিয়েছিল। যদি কিছু হয়ে যায়। পরেরদিন সকালে আমার সমস্যা বুঝতে পেরে কবিরাজ ডেকে আনা হয়। কবিরাজ তার সাধ্যমত চেষ্টা করে কিন্তু কোন ফল আসে না। উল্টো আমার কার্যকলাপ দেখে কবিরাজ নিজেই ভয় পেয়ে যায়। কবিরাজ যখন বিভিন্ন মন্ত্র বলে আমায় ফু দিচ্ছিল আমিও নাকি একইভাবে তারদিকে ফু দিচ্ছিলাম আর হাসছিলাম। কবিরাজ অপারগ হয়ে এটা ছাড়ানো তারপক্ষে সম্ভব নয় বলে চলে যায়। আমাদের বাড়িতে তখন কান্নার রোল। ছোট দাদাকে খবর পাঠানো হয়। তিনি হাইস্কুলের হেডমাস্টার। তার উপর পরীর আছর আছে। অনেক কিছু জানলেও কখনো কবিরাজি করেন না। তিন দিনের জন্য জামাতের সাথী হয়ে গেছেন। আমার এ অবস্থার কথা শোনেই দাদা বুঝতে পারেন কি ঘটতে চলেছে আমার সাথে। তিনি জানিয়ে দেন আজ রাতে যেন কোনভাবেই ঘরের আলো না নিবে। আর সবাই যেন জেগে থাকে। না হলে নাকি আমায় নিয়ে যাবে। আর যাই ঘটুক না কেন কেউ যেন রাতে ঘরে বাহিরে না যায়। তখনও আমাদের ওখানে কারেন্ট পৌছায়নি। ঘরে চারটি হারিকেনের আলো আর কয়েকটা টর্চ লাইট হাতে নিয়ে সবাই জেগে। আমার কান্না থামছেই না। রাত বারোটা পর্যন্ত একমাত্র আমার কান্না ছাড়া সবকিছু ঠিকই ছিল। বারোটার পরেই হঠাৎ সবকিছু পাল্টে যায়। বাইরে বাতাস বইতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে বাতাসের মাত্রাটা বেড়েই চলেছে। সব বাতাস এসে যেন শুধু হারিকেনের গায়েই লাগছে। সবাই হারিকেনের আলোকে বাচিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। রাত পৌনে দুইটা হবে বাহিরে কি যেন ভেঙ্গে পড়ার বিকট শব্দ। সবাই ভয়ে জড়োসড়ো। দাদার কথা অনুস্বরণ করে কেউ ঘর থেকে বের হয়নি। খালামনির ভাষ্য অনুযায়ী “তখন আমাদের ঘরকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম। তখন সবাই সে কি কান্না আর সৃষ্টকর্তাকে ডাকায় ব্যস্ত”। সারারাত সবার মনে আতংক ছড়িয়ে অবশেষে বাহিরে ঝড়ো বাতাস একটু কমতে শুরু করেছে। একটু পরেই মসজিদ থেকে মোয়াজ্জ্বিনের সু-মধুর কণ্টধ্বনিতে ভেসে আসে ফজরের আযান। ঝড়ো হাওয়া থেমেছে। কিন্তু আমার কান্না থামেনি। ঘড়ির কাঁটা আটটার ঘরে না পৌছাতেই ছোট দাদা বাড়িতে এসে পৌছেছে। সারারাত মনে হয় তিনিও ঘুমাননি। কারন আমি-ই তো তখন তার একমাত্র খেলার সাথী। দাদা এসে আমার হাত ধরতেই আমার কান্না বেড়ে দ্বিগুন। কান্নায় রাগান্বিত সুর। আমার বয়স মাত্র ছয়মাস হলেও বড়দের মতই রাগান্বিত ভাবে তাকিয়ে আছি আমি দাদার দিকে। দাদা বিভিন্ন দোয়া পড়ে আমার দিকে ফু দিচ্ছে আমিও তার পূনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। তেল পড়ে দিচ্ছে কোন কাজেই আসছে না। আমার কান্না থামছেই না। খালামনিদের বর্ণনা অনুসারে তখন আনুমানিক সকাল দশটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। খারাপ আত্মাটাকে হাজির করার জন্য সব আয়োজন সম্পন্ন। তুলা রাশি হওয়ায় রহিম চাচাকে ডেকে আনা হয়েছে। তার উপর খারাপ আত্মাটাকে হাজির করা হবে। কারন আমার উপর তা প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। অবশেষে আমাকে আর রহিম চাচাকে প্রটেকশন দিয়ে খারাপ আত্মাটাকে হাজির করা হয় রহিম চাচার উপর। শুরুতে কিছু না বললেও পরে একে একে সব বলতে শুরু করে। কোথায় থাকে, কিভাবে এসেছে, কেন এসেছে ইত্যাদি। এক পর্যায়ে এসে জিজ্ঞাসা করা হয় দুইটা মেয়ে থাকতে এই ছোট্ট শিশুটিকে কেন বেছে নিলি? তার অকপট উত্তর আমি নাকি তাকে দেখে হেসেছিলাম। তাই ও এসেছে আমার সাথে। আমাকে সাথে নিয়ে যেতে। রাতে অত্যাচার করেছিস কেন এ কথা জিজ্ঞাসা করতেই দাদার উপর রেগে যায় অতৃপ্ত আত্মাটা। দাদার জন্য আমাকে নিতে পারে নি এই কথাটা অনেক ব্যাঙ্গ করে বলতে থাকে। আর সবার ভাগ্য ভাল যে রাতে কেউ ঘর ছেড়ে বের হয়নি। পরিশেষে দাদা খারাপ আত্মাটাকে আমাকে ছেড়ে যেতে বলে। প্রথমে ছেড়ে যেতে অসীকৃতি জানালেও কষ্টের পরিমান বাড়িয়ে দিলে যেতে রাজি হয়। যাওয়ার সময় খারাপ আত্মাটাকে একটা চিহ্ন রেখা রেখে যেতে বলে দাদা। দাদার কথামত যাওয়ার একই গাছে দুটি করে ছড়ি হয়েছে এমন চারটি কলাগাছ ভেঙ্গে দিয়ে যায়। আমাকে গোসল করানো হয়। শরীর একটু দুর্বল হলেও আগের মত আমার মুখে চওড়া হাসি। খালামনি আর ফুফু যেন হাফ ছেড়ে বাচে। আমায় কোলে নিয়ে তাদের সেকি আনন্দ। পরে ছোট দাদা রাতের ঘটা ঘটনার বর্ণনা দেন। আমাকে রক্ষা করতে ছোট দাদা তার ছায়া সঙ্গী পরীটিকে পাঠিয়ে ছিল। এজন্যই খারাপ আত্মাটি আমাদের ঘরে প্রবেশ করতে পারে নি। হারিকেনের আলোও নিভাতে পারেনি। পরে ভয় দেখানোর জন্য বিভিন্নভাবে শব্দ করেছে। তখন যে কেউ বের হলেই আর বেচে ফিরত না। রাতে কিছু পড়ার বিকট শব্দ হলেও সকালে কিছুই পাওয়া যায় নি। তারপর আমার শরীর বন্ধ করে দেওয়া একটা কবজ দিয়ে। শুনেছি সেটা নাকি অনেকদিন পর্যন্ত আমার গলায় ছিল। আর আমি নাকি প্রায় সময়-ই চকলেটের মত মুখে পুরে রাখতাম। শরীরে ধকলের কারনে রহিম চাচাও দুইদিন জ্বরে ভোগেছিল। তারপর থেকে আজ অব্দি কোন খারাপ আত্মা আর আমার পিছু নেয় নি।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত