সুমাদের পুকুরে নাকি অলৌক আত্মা

সুমাদের পুকুরে নাকি অলৌক আত্মা

সুমাদের পুকুরে নাকি অলৌক আত্মা আছে। কাউকে একা পেলেই ঐ অলৌকিক আত্মা নাকি তার
জীবন প্রদীপ নিভিয়ে। আব্বু মারা যাওযার পর থেকেই আমরা নানু বাড়িতে থাকি। নানু বাড়িতে
আসার পরেই আমাদের দু-ভাইকেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল আমরা যেন কখনই সুমাদের পুকুর না নামি। পুকুরে খারাপ আত্মা আছে।
নামলেই আমাদের মেরে ফেলবে। নানু আমাদের দু-ভাইকে প্রায় এক ঘন্টা ধরে ঐ পুকুরের গল্প শুনিয়েছিল।
সুমার আব্বুরা পাঁচ ভাই। আর তারা সবাই বিবাহিত হওয়ার কারনে বাড়িতে জায়গার সংকট দেখা দেয়।
তাই সুমার আব্বু আর তার ছোট চাচা বাধ্য হয়ে আলাদা জায়গায় বাড়ি করে।
ঘর, উঠোন,
বাড়ির আঙ্গিনা মাটি কেটে অনেক উচু করে যাতে বর্ষায় পানি না উঠতে পারে। এই মাটি সংগ্রহ
করতে গিয়ে বাড়ির পাশেই অনেকটা
জায়গা জুড়ে গর্ত করতে হয়। সুমার চাচারাও এখান থেকে
মাটি নিয়ে উঠোন এবং বাড়ির আঙ্গিনায় দিয়ে উচু করে ফলে গর্তের এরিয়া আরও বড় হয়ে যায়।
তাই সুমার বাবা সিদ্ধান্ত নেয় এটাকে পুকুর বানানোর। ওখান থেকে আরও কিছু মাটি আর বালি
বিক্রি করে দিয়ে পুকুর চার পাড় অনেক উচু করে বাধ দেয়। তখন পুকুর বিশাল আকার ধারন করে। প্রায় পনের দিন পর বাড়ির সব কাজ শেষ
হয়ে যাওয়ায় সুমারা নতুন বাড়িতে উঠে যায়। গ্রীষ্মে সূর্যের অগ্নিঝরা রুপ। গরমের পরিমানও অতিমাত্রায়। পুকুরে স্বচ্ছ পানি। তাই আশপাশের প্রায় সবাই আসে সুমাদের পুকুরে গোসল করতে।
চারদিন পর সুমার আব্বু অনেকগুলো ছোটমাছের পোনা এনে পুকুরে ছেড়ে দেয়। পুকুরের পাড় দিয়ে সারি বদ্ধভাবে সুপারি আর নারকেল গাছের চারা এনে লাগায় সুমার চাচ্চু। পরিবারের ছোটদের আনন্দ সীমানা পেরিয়ে দুর আকাশে ডানা মেলে।
এভাবেই সুমাদের নতুন বাড়িতে পেরিয়ে যায় তের দিন। সব কিছু ঠিকভাবেই চলছিল। বিপত্তি বাধে চৌদ্দ দিনের রাতে।
সুমার চাচি রাতে স্বপ্ন দেখে এক বৃদ্ধা মহিলা তার কাছে এসে খাবার চাচ্ছে। সে নাকি ভিশন ক্ষুধার্ত।
অনেকদিন হলো কিছু খাইনি। সুমার চাচি যতই বুঝানোর চেষ্টা করতেছে এখনো রান্না হয়নি আর ঘরে কোন খাবারও নেই।
বৃদ্ধ মহিলাটি কিছুতেই বুঝ মানতেছে না। জোর করেই ঘরে ঢোকার চেষ্টা করতেছে।
এক পর্যায়ে সুমার চাচি ভয় পেয়ে অনেক জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে। পরিবারের প্রায় সবার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
পরে তার কাছে এই ঘটনা শুনে সবাই বলে এটা নিছক একটা স্বপ্ন। এর বাইরে কিছু নয়। বলেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ে।
কয়েক দিন পর পর ই এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। একদিন সুমার আম্মুও একই স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ওঠে।
তাই পরের দিনই কবিরাজ ডেকে এনে বাড়ির চারপাশ বন্ধ করা হয়। তারপর বেশকিছু তারা আর এ স্বপ্নটা দেখে নি।

সেদিন ছিল মঙ্গলবার। সূর্যের প্রখরতা প্রায় সহ্য সীমার বাইরে গিয়ে ঠেকেছে। মাঠে গরুগুলো প্রচন্ড তাপে হাপাচ্ছিল। তাই সুমার চাচা গরুগুলোকে বাড়িতে নিয়ে আসে এবং গোসল করানোর সিদ্ধান্ত নেই।
সবগুলোর গোছল করানো শেষ। একটা মাত্র ষাঁড় বাকি আছে। সবগুলোকে ছায়ায় রেখে এসে ষাঁড়টাকে পুকুরের পানিতে নামিয়েছে। লাল বর্ণের ষাঁড়। গজ টা অনেক বড়। কুরবানির ঈদে বিক্রি করবে বলে অনেক যত্ন করে খাইয়ে মোটা তাজা বানিয়েছে।
গোসল করানো প্রায় শেষ শধু মাথাটা একটু ভালভাবে ভিজিয়ে দিয়ে নিয়ে চলে আসবে। একটু বেশি পানিতে নিয়ে গিয়ে ষাঁড়ের মাথাটা পানিতে ডুবানোর জন্য মাথাটা ধরে নিচের দিকে চাপ দিয়েছে।
ষাঁড়ের গলায় লাগারো রশিটা তার হাতেই ছিল। হঠাৎ সে অনুভব করলো কেউ যেন তার হাত থেকে রশিটা টান দিয়ে নিয়ে গেল।
ষাঁড়ও পানিতে তলিয়ে গেছে। সুমার চাচ্চু নিজেই কিছুক্ষন খোঁজার পর না পেয়ে লোকজনেক ডাকা শুরু করল। সবাই এসে গরু পানিতে তলিয়ে গেছে শুনে নেমে খোঁজা শুরু করেছে। প্রায় আড়াই ঘন্টা পর ষাঁড়ের মৃতদেহ খোঁজে পাই।

ঐ দিন রাতে সুমার চাচি আবারও সেই বৃদ্ধাকে দেখত পায়। অনেক ভয়ানক আর ক্ষুধার্ত। ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে। ঘটনাটা প্রায় গ্রামের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
তারপর থেকে ঐ পুকুরে কেউ একা নামতে সাহস পায় না। বৃদ্ধাকে স্বপ্নে দেখার মাত্রাটা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই আবারও কবিরাজ ডেকে আনা হয়।
সে তার অনুগত আত্মাকে হাজির করার মাধ্যমে সবাই কে জানায় এই পুকুরে ভাল আত্মার সাথে একটি খারাপ অতৃপ্ত আত্মা আছে যে মানুষের ক্ষতি করে।
তাই কেউ যেন বিশেষ করে শনিবার, মঙ্গলবার, ভর দুপুর এবং সন্ধ্যায় পুকুরে না নামে।
তাহলে এই অতৃপ্ত আত্মা ক্ষতি করবে। তার পর বাড়ির চার পাশ আবারও বন্ধ করে দিয়ে কবিরাজ চলে যায়।
তারপর কিছুদিন বেশ ভালভাবেই কাটতে থাকে। ঐ বুড়িকেও আর দেখা যায় না।

পুকুরের চারধারে লাগানো সুপারি আর নারিকেল গাছগুলো বেশ বড় হয়ে গেছে। দেখেতেও অনেক সুন্দর লাগে। সুমার বাবা পুরাতন সুপারির গাছ কেটে বাড়ির সাথেই লাগানো পুকুরের পাড়ে টঙ পেতে দিয়েছে। প্রতিদিন বিকাল বেলা অনেকে এসে পুকুরের ধারে বসে থাকে।
একদিন সুমার খালু, খালামনি আর দুই খালাতো ভাই বোন বেড়াতে আসে সুমাদের বাড়িতে।

সুমার ফুপুর বিয়ে। এজন্যই তারা এসেছেন। না হলে সহজে আসেন না তারা। সুমার খালুর চাকরির ব্যস্ততা, সন্তানদের পড়াশুনা ইত্যাদি কারনে আসা হয়ে ওঠে না।

বিয়ে বাড়ি। চারদিকেই খুশির আমেজ। সবকিছু যেন ভালভাবে হয় সে জন্য তোড়জোড় চলছে।
বাড়ির সামনে বিশাল গেট বানানো হয়েছে বরের জন্য। চার পাশেই আলোর জলকানি। তবে সবচেয়ে যেটা সবাইকে বেশি আকর্ষিত করেছে তা হল পুকুর।
ছোট ছোট রঙিন আলোয় পুকুরের চার ধার আলোকিত। সুপারি আর নারিকেল গাছে লাগানো রঙ্গিন নিয়নের আলো, পুকুরে ক্রস চিহ্ন আকারে ছোট রঙ্গন বাতি আর মাঝখানে পানির ফোয়ারা বাধ্য করছে সবাইকে মনোমুগ্ধ হতে। এরই মধ্যে বর আসে। হৈহুল্লোড় বেড়ে যায়।
গেটে প্রবেশের টাকা নিয়ে মিষ্টি কথা কাটাকাটি বাড়তি আমোদের যোগান দেয়। বিয়ের কাজ শেষ। বর কনে বিদায়ের পালা। কান্নার রোল উঠেছে।
বর কনেকে বিদায় দিয়ে সবাই গিয়ে শুয়ে পড়েছে। কিন্তু সুমার খালাতো ভাই সিহাব বয়স নয় বছর তার চোখে ঘুম নেই।
এই আলোর জলকানি রেখে ঘুমাতে মন চাইছে না। তাই সে স্থির করেছে
অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠবে সবার আগে। যেই কথা সেই কাজ। চার দিকে নিরবতা কারো ঘুম ভাঙ্গেনি।

হঠাৎ কারো চিৎকার শুনে সবার ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাহিরে এসে দেখে পুকুরের সাথে পাতা টঙ্গের পাশেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে সিহাব। তাড়াতাড়ি
ধরে বাড়িতে আনা হয়। সবার ডাকাডাকি আর চোখে মুখে পানি দেওয়ার পর জ্ঞান ফিরে আসে সিহাবের।
কি হয়েছিল জানতে চাইলে সব খোলে বলে সিহাব।
একটা বৃদ্ধা মহিলার সারা মাথার এলো চুলগুলো পুকুরের পানিতে অনেকটা জায়গা জুড়ে ভেসে আছে। তার ভয়ানক চোখ আর বিশ্রি মুখমন্ডল দেখে সে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
শোনার পর সাথে সাথেই তাকে লোহা গরম করে পানিতে ডুবিয়ে সেই পানি খাওয়ানো হয়।
তেল পড়া দেওয়া হয়। তারপর গোসল করিয়ে খাবার খাওয়ানো হয়। পরে সারাদিন আর ঘর থেকে বের হয়নি সিহাব। বিকালের দিকে গায়ে জ্বর আসে।
ধীরে ধীরে শরীরে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। জ্বরের ঔষধ খাওয়ানো হয়। কিন্তু জ্বরের মাত্রা বেড়েই চলেছে।
রাতে অতিমাত্রায় জ্বরের কারনে ভুলবাল বকতে শুর করে। কবিরাজ ডাকা হয়।
কিন্তু কোন ফল আসে না। অবস্থা বেগতিক দেখে পরেরদিন
সকালেই সিহাবকে ঢাকায় এনে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিন্তু অবস্থার কোন উন্নতি হয় না।
শরীরে স্যালাইন পুশ করা হয়। অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। অবশেষে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে সবাইকে কাদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমায় সিহাব।

এর কিছুদিন পর দুপুরে পাশের গ্রামের এক মেয়ে ঐ বৃদ্ধাকে একই অবস্থায় দেখতে পায় সুমাদের পুকুরে।
আজ ঐ মেয়েটি উন্মাদ। মাথায় ঝটা চুল আর কুৎসিত পোষাক পরে ঘুরে বেড়ায়। কাউকেই চিনতে পারে না। তার বাবা মা কেউ।
তারপর থেকে
সুমাদের পুকুরে কেউ নামে না সহজে। একটা ভয় সবার মনে ঘুরে বেড়ায়।

তবে আমি এসবে বৃদ্ধা আঙ্গুলি দেখিয়ে সুযোগ পেলেই সাতার কেটে বেড়াই সুমাদের পুকুরে। বিনিময়ে উপহারও পাই আম্মুর কাছ থেকে।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত