স্টেশনমাস্টার তাঁর লন্ঠনটা আমার মুখের সামনে তুলে ধরলেন। তারপর থেমে থেমে বললেন, “ওলাইতলার বাগানবাড়ি! আপনিও ওলাইতলার বাগানবাড়িতে যাচ্ছেন? কিন্তু কেন?”
আমি বললাম, “মামুদপুরের জমিদার কৃতান্ত চৌধুরী বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, তাঁর একজন ম্যানেজার দরকার।”
স্টেশনমাস্টার : তিনশো টাকা মাহিনা। কেমন, তাই নয় কি?
আমি বললাম “হুঁ”।
স্টেশনমাস্টার : তারাও একই কথা বলেছিল।
“কারা?”
স্টেশনমাস্টার : ‘আপনার আগে যারা ম্যানেজারি করতে এসেছিল। গত আট হপ্তায় আটজন লোক এই ইস্টিশানে নেমে ওলাইতলার বাগানবাড়িতে গেছে। কিন্তু তারা কেউ আর এ পথ দিয়ে ফেরেনি। বুঝলেন মশাই? তারা কেউ আর ফেরেনি!”
আমি বললাম, “তার মানে?”
স্টেশনমাস্টার বললেন, “মানেটানে জানি না। প্রত্যেকেই এসেছে আপনার মতো ঠিক শনিবারেই। আর ঠিক সন্ধ্যা ছ’টার গাড়িতে। আশ্চর্য কথা! আট হপ্তায় আটজন! জমিদার কৃতান্ত চৌধুরীর কত ম্যানেজারের দরকার?”
আমার মনটা কেমন ছাঁৎ করে উঠল। জিজ্ঞেস করলাম, “এই জমিদারবাবুকে আপনি চেনেন?”
স্টেশনমাস্টার বললেন, “উঁহু। তবে তাঁর নাম শুনেছি। অল্পদিন হল এখানে এসে ঐ পোড়ো বাগানবাড়িখানা কিনে বসবাস করছেন। তাঁর সন্মন্ধে নানা কানাঘুষো শোনা যায়। আজ পর্যন্ত গাঁয়ের কেউ তাঁকে দেখেনি। দিনের বেলা ঐ বাগানবাড়িখানা পোড়ো বাড়ির মতো পড়ে থাকে। কেবল রাত্রেই তার ঘরে ঘরে আলো জ্বলে। লোকজনকেও দেখা যায় না। ও-বাড়ির সবই অদ্ভুত!”
আজ অমাবস্যা। আকাশে চাঁদ উঠবে না, তার ওপর মেঘের পর মেঘ জমে আছে। ঠাণ্ডা হাওয়া পেয়ে বুঝলাম, বৃষ্টি আসতে দেরী নেই। সঙ্গে আমার শখের বুলডগ রোভার। ওলাইতলার বাগানবাড়ির দিকে অগ্রসর হবার উপক্রম করলাম। স্টেশনমাস্টারের কথায় কান পাতবার দরকার নেই। লোকটার মাথায় বোধহয় ছিট আছে, নইলে এমন সব আজগুবি কথা বলে?
স্টেশনমাস্টার ডেকে বললেন, “মশাই, তাহলে নিতান্তই যাবেন?”
“এইরকম তো মনে করছি।”
“তাহলে পথঘাট একটু দেখেশুনে যাবেন। ওলাইতলার বাগানবাড়ির ঠিক আগেই একটা কবরস্থান আছে, আগে সেখানে খ্রিস্টানদের গোর দেওয়া হতো। গোরস্থানটার ভারি বদনাম, সন্ধ্যার পর ওদিকে কেউ যেতে চায় না।
আমি আর থাকতে পারলাম না, বললাম, “মশাই, মিথ্যে আমায় ভয় দেখাচ্ছেন, আমি কাপুরুষ নই। দরকার হলে ওই গোরস্থানে শুয়েই রাত কাটাতে পারি।”
অত্যন্ত দয়ার পাত্রের দিকে লোকে যেমনভাবে তাকায়, সেইভাবে আমার দিকে তাকিয়ে স্টেশনমাস্টার একটুখানি ম্লান হাসলেন, কিন্তু মুখে আর কিছু বললেন না।
দামোদর নদীর ধারে ওলাইতলার সেই প্রকাণ্ড বাগান আর প্রকাণ্ড বাড়ি।
মাইলখানেক পথ চলার পর যখন তার ফটকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। দেউড়িতে দারোয়ানের কোনও সাড়া না পেয়ে, ফটক ঠেলে ভেতরে গিয়ে ঢুকলাম।
আমার হাতে ছিল একটা টর্চ, তারই আলোয় যতটা পারা যায় দেখতে দেখতে এগোতে লাগলাম। অনেককালের পুরনো বাগান, এবং তার অবস্থা এমন যে তাকে বাগান না বলে জঙ্গল বলাই উচিত।
পুকুরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখলাম, পানায় তার জল নজরে পড়ে না, ঘাটগুলোরও ভগ্ন দশা। বাড়িখানার অবস্থাও তথৈবচ। ভাঙা জানলা, ভাঙা থাম, চুন বালি সব খসে পড়েছে।
যে জমিদার তিনশো টাকা মাইনে দিয়ে ম্যানেজার রাখবেন, এইখানে তাঁর বাস! মনে খটকা লাগল।
অসংখ্য ঝিঁঝিঁ পোকার আর্তনাদ ছাড়া কোথাও জনপ্রাণীর সাড়া নেই। অথচ বাড়ির ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। একটু ইতস্তত করে চেঁচিয়ে ডাকলাম, “বাড়িতে কে আছেন?”
সামনের ঘর থেকে মোটা গলায় সাড়া এল, “ভেতরে আসুন। “
ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। মস্ত বড় ঘর, কিন্তু কোণে কোণে মাকড়শারজাল, দেওয়ালে দেওয়ালে কালি-ঝুল, মেঝেতে এক ইঞ্চি পুরু ধূলো। একটা ময়লা রঙ ওঠা টেবিল, তিনখানা ভাঙা চেয়ার ও একটা খুব বড় ল্যাম্প ছাড়া ঘরে আর কোনও আসবাব নেই।
অতিশয় শীর্ণ কুচকুচে কালো এক জরাজীর্ণ বুড়ো লোক আদুড় গায়ে একখানা চেয়ারের ওপর বসে আছে। তার বুকের সবকটি পাঁজরা গোনা যায়।
বুড়ো কথা কইলে, ঠিক যেন হাঁড়ির ভেতর থেকে তার গলার আওয়াজ বেরোল। সে বলল, “আপনি কাকে চান?”
আমি বললাম, ” জমিদার কৃতান্তবাবুকে।”
“ও নাম আমারই। আপনার কি দরকার?”
“আপনি একজন ম্যানেজার রাখতে চান, তাই……”
“বুঝেছি, আর বলতে হবে না, বসুন।”
কৃতান্তবাবুর কাছে গিয়েই রোভার হঠাৎ গরররর করে গর্জে উঠল।
কৃতান্তবাবু ক্রুদ্ধস্বরে বললেন, “ও কি! সঙ্গে কুকুর এনেছেন কেন? কামড়াবে নাকি?”
রোভারকে এক ধমক দিলাম। সে গর্জন বন্ধ করল বটে, কিন্তু আমাদের কাছ থেকে অনেক তফাতে সরে গিয়ে তীক্ষ্ণ সন্দিগ্ধ চোখে কৃতান্তবাবুর দিকে তাকিয়ে রইল।
বিরক্ত ভাবে কৃতান্তবাবু বললেন, “ওসব কুকুর টুকুর এখানে চলবে না। ওকে এখনিই তাড়িয়ে দিন।”
আমি বললাম, “ওকে তাড়ালেও ও যাবে না। রোভার আমায় ছাড়া এক মূহুর্ত থাকতে পারে না। রাত্রেও আমার সঙ্গে ঘুমোয়।”
“রাত্রেও ও ব্যাটা আপনার সঙ্গে ঘুমোয়? কি বিপদ, কি বিপদ!” বলে কৃতান্তবাবু চিন্তিত মুখে ভাবতে লাগলেন।
রোভার রাত্রে আমার সঙ্গে ঘুমোবে শুনে কৃতান্তবাবুর এতটা দুশ্চিন্তার কারণ বুঝতে পারলাম না।
খানিকক্ষণ পর কৃতান্তবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “একটু বসুন। আপনার খাওয়া-শোয়ার ব্যবস্থা করে আসি।”
আমি বললাম, “সে জন্য আপনার ব্যস্ত হবার দরকার নেই। আমি যে জন্যে এসেছি, সেই কথাই হোক।”
“আজ আমার শরীরটা ভাল নেই। কথাবার্তা কাল সকালে হবে”, এই বলে কৃতান্তবাবু বেরিয়ে গেলেন।
খানিক পর তিনি ফিরে এসে বললেন, “আসুন, সব প্রস্তুত। “
তাঁর পেছন পেছন অগ্রসর হলাম। মস্ত উঠোন ও অনেকগুলো সারবন্দি ঘর পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গিয়ে উঠলাম। বাড়ির সর্বত্রই ভগ্নদশা, ধুলো আর জঞ্জালের স্তুপ, চামচিকা আর বাদুড়ের আনাগোনা। একটা চাকর-বাকর পর্যন্ত দেখা গেল না। নির্জন বাড়ি যেন খাঁ খাঁ করছে।
একটা ছোট ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। ঘরখানা খুব বেশী নোংরা নয়। একপাশে ছোট একখানা চৌকি, তার ওপর বিছানা পাতা, আর একপাশে থালায় খাবার সাজানো রয়েছে।
কৃতান্তবাবু বললেন, “এখনি খেয়ে নিন, নইলে সব খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।”
নানা কথা ভাবতে ভাবতে মাথা হেঁট করে খেতে খেতে হঠাৎ মুখ তুলে দেখি, কৃতান্তবাবু একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে আছেন আর তাঁর কোটরগত দুই চক্ষুর ভেতর থেকে যেন দু-দুটো অগ্নিশিখা জ্বলছে! আমি মুখ তুলে তাকাতেই সে আগুন নিভে গেল। মানুষের চোখ যে অমন জ্বলতে পারে, আমি জানতাম না। ভয়ানক!
কৃতান্তবাবু বললেন, “আজ তাহলে আসি। খেয়ে দেয়ে আপনি শুয়ে পড়ুন।”
বলে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, “আর দেখুন, রাত্রে এ ঘরের জানলাগুলো যেন খুলবেন না। একে তো বৃষ্টি হচ্ছে, তার ওপর…..।” বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলেন।
আমি বললাম, “থামলেন কেন, কি বলছিলেন বলুন না?”
কৃতান্তবাবু বললেন, “ওধারের জানলা খুললে গোরস্থান দেখা যায়”।
“তা দেখা গেলেই বা!”
“সেখানে হয়তো এমন কিছু দেখতে বা এমন সব গোলমাল শুনতে পাবেন, রাত্রে মানুষ যা দেখতে বা শুনতে চায় না।”
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম।
কৃতান্তবাবু বললেন, “হ্যাঁ, আর একটা কথা। আপনার ওই বিশ্রী বুলডগটাকে বেঁধে রাখবেন। কুকুর অপবিত্র জীব, রাত্রে ও যে বিছানায় গিয়ে উঠবে এটা আমি পছন্দ করি না, বুঝলেন? “
“আচ্ছা”।
কৃতান্তবাবু বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁর শেষ ইচ্ছা আমি পূর্ণ করিনি। রাত্রে রোভার আমার বিছানায় আমার সাথেই শুয়েছিল।
অনেক রাত্রে দারুণ যাতনায় আমার ঘুম ভেঙে গেল। কে আমার গলা টিপে ধরেছে! দুখানা লোহার মতো শক্ত হাত আমার গলার ওপর ক্রমেই বেশ জোর করে চেপে বসতে লাগল!
প্রাণ যখন যায় যায়, আচম্বিতে আমার গলার ওপর থেকে সেই মারাত্মক হাতের বাঁধন আলগা হয়ে খুলে গেল! তারপরেই ঘরময় খুব একটা ঝটাপটি ও হুড়োহুড়ির শব্দ! কিন্তু তখন সেদিকে মন দেবার মতো সময় আমার ছিল না, গলা টিপুনির যন্ত্রণায় তখনো আমি ছটফট করছি।
অনেক পরে যখন যন্ত্রণাটা একটু কমল, তখন ঘর স্তব্ধ। কোনও হুটোপুটির আওয়াজ নেই। বিছানা থেকে উঠলাম আমি। আলোটা নিভে গিয়েছিল, আবার জ্বাললাম। টের পেলাম যে আমায় আক্রমণ করেছিল, সে-ও নেই ঘরে, বিছানায় রোভারও নেই।
“রোভার! রোভার!” বলে অনেকবার ডাকলাম কিন্তু কোনও সাড়া পেলাম না।
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, রাত একটা বেজে গেছে।
দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে আছে। সে অন্ধকার দেখলেই প্রাণ কেমন করে ওঠে! সে অন্ধকার যেন জ্যান্ত কোনও হিংস্র জন্তুর মতো আমার ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়বার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। চট করে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলাম।
ঘরের এই দরজাটা আগেই বন্ধ করে শুয়েছিলাম। কিন্তু যে আমায় আক্রমণ করেছিল, সে তাহলে কোন পথ দিয়ে আমার ঘরে এসেছিল?
এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘরের ভেতর আরেকটা দরজা দেখতে পেলাম। ঠেলতেই সেটা খুলে গেল এবং ভক করে একটা বিষম দূর্গন্ধ এসে আমায় যেন আচ্ছন্ন করে দিল।
হ্যারিকেনটা তুলে ভালো করে দেখলাম। সে কি ভীষণ দৃশ্য! ঘরের মেঝেতে রাশি রাশি হাড়গোড় , মড়ার মাথার খুলি আর রক্তমাখা কাঁচা নাড়ি-ভুঁড়ি ছড়িয়ে পড়ে আছে! একদিকে একটা কাঁচা মড়ার মুন্ডও মাটির ওপর পড়ে হাঁ করে তাকিয়ে আছে!
দুম করে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলাম। এ আমি কি তাহলে কোনও পিশাচের পাল্লায় এসে পড়েছি? আমার দম যেন বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। তাড়াতাড়ি ঘরের জানলাগুলো খুলে দিলাম।
বাইরে আকাশ ভরা অন্ধকারকে ভিজিয়ে হুড়হুড় করে বৃষ্টি পড়ছে, ফালা ফালা হয়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর বোঁ বোঁ করে ঝোড়ো হাওয়া বইছে।
আর ও কী! বিদ্যুতের আলোয় বেশ দেখা গেল‚ সামনের তালগাছতলায় দাঁড়িয়ে লিকলিকে চেহারার একটা ছেলে বেয়াড়া গলায় গান গেয়ে নাচছে।
হঠাৎ ভয়ানক কড়–কড়াৎ শব্দে বিদ্যুৎ চমকাল। গানও থেমে গেল তারপর। তালতলায় ছেলেটাকেও আর দেখা গেল না। কিন্তু ঝোড়ো হাওয়ায় চারদিকের সেই অন্ধকার আর দুর্যোগের মধ্যে নানা রকম ভয়ানক আওয়াজ কানে আসতে লাগল! কখনও মনে হয়, একদল আঁতুড়ের শিশু ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদছে কোথাও! কখনও শুনি আড়াল থেকে কে যেন খিলখিল করে হাসছে! মাঝেমাঝে কে যেন ঝমঝম করে মল বাজিয়ে যাচ্ছে আর আসছে। যাচ্ছে আর আসছে। থেকে থেকে এখানে ওখানে ভূতুড়ে আলো জ্বলছে-নিভছে, বাগানের কোন কোণা থেকে একটা হুলোবেড়াল একবারও না থেমে কেবল চ্যাঁচাচ্ছে‚ ম্যাও‚ ম্যাও‚ ম্যাও….!
আজ কি এখানে রাজ্যের ভূতপ্রেত, দৈত্য দানো এসে জড়ো হয়েছে? না কি ভয়ে আমারই মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে? যা দেখছি, শুনছি, সমস্তই অলীক কল্পনা!
অ্যাঁ‚ ও আবার কে? ঘরের দরজা কে ঠেলছে!
আতঙ্কে আমার মাথার চুলগুলো খাড়া হয়ে উঠল। জানি না, দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে কোনও বীভৎস মূর্তি আমার জন্য অপেক্ষা করছে!
আবার কে যেন দরজা ঠেলল। আমার সমস্ত দেহ যেন পাথর হয়ে গেল।
তারপরেই আবার দরজায় ঘনঘন ধাক্কা আর সাথে সাথে রোভারের ঘেউঘেউ। আহ, বাঁচলাম যেন। এ যে আমার রোভারের ডাক!
ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই রোভার এসে একলাফে আমার বুকের ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই নির্বান্ধব ভূতুড়ে পুরীতে রোভারকে পেয়ে মনে হল, তার চেয়ে বড় আত্মীয় এ পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই।
হঠাৎ রোভারের মুখের দিকে আমার চোখ পড়ল। একি! ওর মুখময় রক্ত কেন! অবাক হয়ে ভাবছি, এমন সময় বাইরের বাগান থেকে অনেক লোকের গলা পেলাম।
জানলার ধারে গিয়ে দেখি, ছ-সাতটা লন্ঠন নিয়ে চোদ্দ-পনেরো জন লোক বাড়ির দিকেই আসছে। তাদের পোশাক দেখেই বুঝলাম, তারা পুলিশের লোক। এবং সেই ভিড়ের ভেতর স্টেশনমাস্টারকেও দেখতে পেলাম যখন, বুঝতে বাকি রইল না যে থানায় খবর উনিই দিয়েছিলেন। মনে মনে তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে আমিও ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
পুলিশের লোকেরা সিঁড়ির তলাতেই দাঁড়িয়ে উত্তেজিত হয়ে গোলমাল করছিল।
ব্যাপার কি! ভিড় ঠেলে সেদিকে এগিয়ে দেখি, জমিদার কৃতান্ত চৌধুরীর কুচকুচে কালো আর লিকলিকে হাড় বের করা দেহটা সিঁড়ির তলায় পড়ে আছে! তাঁর চোখদুটো কপালে উঠেছে এবং সে চোখ দেখলেই বোঝা যায়, কৃতান্তবাবু আর ইহলোকে বর্তমান নেই। কৃতান্তবাবুর গলদেশে মস্ত একটা গর্ত, তার ভেতর থেকে তখনো রক্ত ঝরে চলেছে।
এতক্ষণে বুঝলাম, রোভারের মুখে ও কার রক্ত লেগে আছে? তাহলে এই কৃতান্ত চৌধুরীই আমায় আক্রমণ করতে গিয়েছিল, তারপর রোভার তার টুঁটি কামড়ে ধরে এ যাত্রার মতো তার সব লীলাখেলা শেষ করে দিয়েছে!
স্টেশনমাস্টার দুই চোখ বিস্ফারিত করে বলছেন, “এ কি অসম্ভব কান্ড!”
ইন্সপেক্টর বললেন, “আপনি কি বলছেন?”
স্টেশনমাস্টার ভাল করে কৃতান্ত চৌধুরীর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে তাঁর মুখখানা দেখে বললেন, “না, কোনওই সন্দেহ নেই, এ হচ্ছে এই গাঁয়ের ভুবন বসুর লাশ। ঠিক আড়াই মাস আগে ভুবনবাবু কলেরায় মারা গিয়েছেন। কিন্তু তাঁর দেহ দাহ করা যায়নি। কারণ তাঁর লাশ কোথায় গায়েব হয়ে গিয়েছিল!”