কালো বাটের ছাতাটি

কালো বাটের ছাতাটি

দমদম স্টেশন , প্রায় সন্ধ্যা হয় হয় ভাব । আব্দুল লতিফ বার বার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে । রশিদ মিঞার এতক্ষনে চলে আসার কথা । ট্রেন আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে অথচ তার কোন খবর নেই । রশিদ মিঞা না এলে কলকাতা শহরে একাই যেতে হবে । মা বেশ অসুস্থ , ডাক্তার যে ওষুধের নাম বলে দিয়েছে তা কলকাতা শহর ছাড়া নাকি পাওয়া যাবেনা । পনেরো বছর বয়সি আব্দুল লতিফ এর আগে কখনো শহরে একা যায়নি । আজ কেমন ভয় ভয় করছে , তার উপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে । শহরে রাতে তেমন আধার নামতে পারেনা , চারিদিকে বৈদ্যুতিক লাল নীল আলোকছটায় জ্বল জ্বল করে পুরো শহর । এদিকে গ্রামে ভিন্ন চিত্র । সন্ধ্যা নামলেই নিকষ কালো ছেয়ে যায় চারিদিকে । মাগরিবের আযানের সময় হয়ে এসেছে । তাতেই স্টেশনের আসে পাশে যেনো ছোপ ছোপ আঁধার নেমে আসতে শুরু করেছে । স্টেশনে বেশ লোকজন , সবাই ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে । এত মানুষের ভীরেও কেমন একা একা লাগছে । মনের মাঝে কেমন একটা কুহু ডাকছে । দূরে ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছে , তার সাথে আযানের শব্দ । হঠাৎ মনে হলো কেউএকজন ওর দিকে তাকিয়ে আছে । ডান পাশে চোখ পরতেই প্রথমে চমকে উঠলো । শুভ্র সাদা দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ তার দিকে তাকিয়ে আছে । সাদা দাড়িগুলি বুক অব্দি নেমে গেছে , পরনে ধবধবে সাদা জোব্বা , হাতে একটি কালো বাট ওয়ালা বেশ বড়সড় ছাতা । বৃদ্ধ হলেও বয়সের ভার মোটেও ছুতে পারেনি তাকে । বেশ উঁচু লম্বা এবং বলিষ্ঠ দেহ । দাড়ানোর ভাব দেখেই বোঝা যায় বেশ শক্ত সামর্থ্য । ট্রেন প্রায় চলে এসেছে , বৃদ্ধ লোকটি দ্রুত এগিয়ে এসে আব্দুল লতিফের সামনে দাঁড়িয়ে বললো , সামনে তোর ঘোর বিপদ বাছা , এই ছাতাটি রাখ , তোকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে । আব্দুল লতিফ লোকটির কথার আগামাথা কিছুই বুঝলোনা , তার কথা বলার ধরনে গা কেমন ছমছম করে উঠলো । তবুও ছাতাটি নিতে অস্বিকার করে বললো , এখন তো বৃষ্টি নেই আর আপনার ছাতা আমি নেবোই বা কেনো ! লোকটি জোর করে ছাতাটি হাতে দিয়ে বললো , সাবধানে যাস আর কিছুদিন রাতে এভাবে একা বের হোসনে , যা ছাতাটি তোকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছে । লোকটির এমন কথাবার্তার কারন বুঝে উঠতে পারলোনা আব্দুল লতিফ আর বোঝার সময়ও নেই , ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে । ওদিকে ছাতাটি ধরিয়ে দিয়েই লোকটি হনহন করে হেটে চলে যাচ্ছে । আব্দুল লতিফ উপায় না দেখে ছাতা হাতেই দৌড়ে ট্রেনে উঠে পরলো ।
লোকজনের ভীরে সামনে আগাতে পারলোনা । দরজার থেকে কিছুটা সামনে একটা সীট ধরে দাড়িয়ে রইলো । এই বগিটাতে লোকজনে যেনো ঠাসা । সব অপরিচিত মুখ । তবুও চোখ যেনো ঘুরে ফিরে চেনা জানা মুখ খুঁজে ফিরছে। লোকটির কথাটি তখনো মাথায় ঘুরছে । কিসের বিপদের কথা বললো সে ! আর এই ছাতাটিই বা কি করে রক্ষা করবে ! কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সবকিছু । কেমন অস্বস্তি লাগছে সাথে ভয়ও । রশিদ মিঞাকে কষে একটা গালি দিতে ইচ্ছে করছে যদিও বয়সে তিন বছরের বড় । এখন বড় ছোটর হিসেব মাথায় আসছেনা , মাথায় শুধু ঘুরছে সেই বৃদ্ধ লোকটির কথা , সামনে তোর ঘোর বিপদ !
শহর বেশি দূরে নয় , মাত্র একটি স্টেশন পার হলেই পরের স্টেশন ।
ট্রেনের গতি এখন ধীরে ধীরে কমে আসছে , সামনে নলখাগড়া স্টেশন , কিছু লোক নামবে হয়তো কিছু উঠবে । ট্রেন থামতেই কিছু লোক হুড়মুড় করে নেমে গেলো । সীট খালি না হলেও কিছুটা ফাঁকা হলো । এতক্ষণ ঠাসাঠাসতে মনে হচ্ছিলো দম বন্ধ হয়ে আসছে । এবার একটু আরাম লাগলো , ট্রেন চলতে শুরু করেছে । এতক্ষন গায়ে হাওয়া লাগছিলোনা , তবে লোকজন কিছুটা কমায় এবার বেশ ফুরফুরে হাওয়া লাগছে । ট্রেনের গতি বেশ বেড়েছে , হঠাৎ আব্দুল লতিফের মনে হলো বেশ একটা দমকা হাওয়া শীষ কেটে ওর কানে পাশ দিয়ে চলে গেলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই কে যেনো পেছন থেকে খুব জোরে ধাক্কা দিলো । এক ধাক্কায় নিজেকে শূন্যে আবিষ্কার করলো , মনে হচ্ছিলো হাওয়া যেনো তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে ভাসিয়ে দরজার দিকে নিয়ে যাচ্ছে । আচমকা ঘটাং করে আওয়াজ হলো দুটি ধাতব পদার্থের বারি খাবার মতন । আর তখুনই আব্দুল লতিফ ছিটকে পরলো দরজার সামনেই ট্রেনের বগির মেঝেতে । সঙ্গে সঙ্গেই কানের পাশ দিয়ে শীষ কেটে চলে গেলো ঝড়ো হাওয়া মনে হলো হাওয়ার ভেতর থেকে কেউ বলে উঠলো , ছাতাটির জন্য বেঁচে গেলি ! সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো ছাতাটি দরজার সামনে আড়াআড়ি ভাবে নিচে পরে আছে । খুব একটা ব্যথা না পেলেও প্রচন্ড ভয় পেয়েছে । দু তিনজন ছুটে এসে ওকে ধরে তুললো আর বাকি সবাই অবাক দৃস্টিতে ওর দিকে চেয়ে রইলো । এই এক মুহুর্তে কি যে ঘটে গেলো কারো মাথায় ঢুকছেনা । সবাই বিস্মিত । শুধু এতটুকুনই বললো , তোমার হাতের ছাতাটি যদি দরজায় বেঁধে না যেতে তবে হয়তো এতক্ষনে তুমি ছুটন্ত ট্রেনের বাহিরে আছড়ে পরতে । একজন এগিয়ে এসে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো , তুমি তো খুব একটা হালকা পাতলাও নও কিন্তু ওভাবে উড়ে গিয়ে দরজার সামনে পরলে কি করে !! এ প্রশ্নের উত্তর যে আব্দুল লতিফের কাছেও নেই সেটা বুঝতে পেরে ওকে নিয়ে নিজের সীটে বসিয়ে দিলো । ইতিমধ্যে ট্রেনের গতি কমতে শুরু করেছে । ট্রেন কলকাতার প্লাটফর্মে ঢুকছে ।
সেদিন রাতে ওষুধ নিয়ে ফেরার মত সাহস আর আব্দুল লতিফের হয়ে ওঠেনি । সে রাতটি মামার বাড়ি কাটিয়ে পরদিন সকালের ট্রেন ধরেছে । দমদম
স্টেশনে নেমেই সেই বৃদ্ধটিকে দেখতে পেলো । যেনো ওর পথ চেয়েই দাঁড়িয়ে আছে । আব্দুল লতিফ ছুটে গিয়ে বৃদ্ধটির সামনে গিয়ে প্রশ্ন করলো , আপনি কি করে বুঝলেন যে আমার বিপদ ! এবং কি করেই বা জানলেন এই ছাতাটিই আমাকে বিপদ হতে রক্ষা করবে !
বৃদ্ধটি মুচকি হেসে বললো , সব প্রশ্নের উত্তর হয়নারে বেটা । তবে আমি দেখতে পেয়েছিলাম বদটা তোর পিছু নিয়েছে । ওকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম তোর ঘোর বিপদ ! বলেই আব্দুল লতিফের হাত থেকে ছাতাটি নিয়ে হনহন করে স্টেশন ত্যাগ করলো ।
আব্দুল লতিফ এখনো ভাবে , সেটা হয়তো দুঃস্বপ্ন ছিলো । আর যদি বাস্তব হয় তবে এর কোন ব্যাখ্যা সে আজ পর্যন্ত পায়নি ।

গল্পের বিষয়:
ভৌতিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত