মহাভারতের বিবেক

মহাভারতের বিবেক

দীর্ঘ তেরো দিনের নিষ্ঠুর মহা সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করে অবশেষে কুরুক্ষেত্রের এই মহাযুদ্ধের সব থেকে রক্তাক্ষয়ী অধ্যায়ের সামনে এসে আজ দাঁড়িয়েছি আমি। অর্জুন আজ আমার ভগ্নিপতি জয়দ্রথের রক্তের পিপাসী , এই নরকের কীটের কারণে আজ অনুষ্ঠিত হয়েছে এখনো অব্দি কুরুক্ষেত্রের বুকে ঘটে যাওয়া সব থেকে নৃশংস ঘটনা। সাত তথাকথিত মহারথী নামের অধিকারী কাপুরুষ যুদ্ধের সমস্ত নীতিকে বিসর্জন দিয়ে পাশবিক ভাবে হত্যা করেছে ষোলো বছরের এক বীর কিশোরকে। আর আমি এক দুর্বল ভীরুর মতো দাঁতে দাঁত চেপে দর্শক হয়েছি এই পাশবিকতার। নিজের প্রতি ধিক্কার আর ক্ষোভে আত্মহননের ইচ্ছে হয়েছে একাধিকবার, কিন্তু ক্ষত্রিয় ধর্মের পালনের কর্তব্য বোধে বাধ্য হয়েছি সেই ইচ্ছে থেকে নিজেকে নিরত করতে।
এর আগেও একবার এইরকমই এক পাশবিকতার প্রত্যক্ষদর্শী হতে হয়েছিল আমাকে ,কিন্তু সেইবার এই অন্যায় ঠেকাতে না পারলেও অন্তত সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে পেরেছিলাম। ত্যাগ করতে পেরেছিলাম সেই অধর্ম সভা,কিন্তু এবার তাও করে উঠতে পারলামনা। এই মহাযুদ্ধে নিজের জ্যেষ্ঠের সঙ্গ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজের মুক্তির পথ যে আমি নিজে হাতে রুদ্ধ করে দিয়েছি। তাই এক নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ভিন্ন যেন আর কোনো পথই খোলা ছিলোনা আমার কাছে। শুধু এই তীব্র আত্মদহন সহ্য করতে না পেরে কুরুক্ষেত্রে মহা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর আজ প্রথম বার রাতের অন্ধকারের পালিয়ে এসেছি হস্তিনাপুরে, আমার জীবনের দিশা দেখানো ধ্রুবতারার কাছে।
রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নেওয়া, একান্তচারিনী ,আমার চির ধর্মপরায়ণা রাজরাজেশ্বরী মা! আজ যে, একমাত্র তার কাছেই মিলতে পারে এই পাশবিক স্মৃতির যন্ত্রনা থেকে নিষ্কৃতির পথসন্ধান। হস্তিনাপুরের পাষানপুরীতে যখন প্রবেশ করলাম, তখন মধ্য রাত্রি। প্রাসাদের প্রতিটি মানুষ হারিয়ে গেছে নিদ্রার জগতে, শুধু একমাত্র জাগ্রত রয়েছেন হস্তিনাপুরের এই অসহায় রাজলক্ষ্মী। তার কক্ষে প্রতিষ্ঠিত শিব লিঙ্গের সামনে হাত জোড় করে বসে রয়েছেন এই একান্তচারিনী মনস্বিনী। এক এক পা করে এগিয়ে গেলাম তার কাছে, প্রদীপের মৃদু আলোয় দেখলাম ,তার দুই গাল দিয়ে মুক্তোর মতোন ঝরে পড়ছে অশ্রুধারা ,আর সেই মুক্তায় ধৌত হচ্ছে পাষান পুরীর পাষান দেবতা। যন্ত্রণা কাতর কণ্ঠে অস্ফুট স্বরে ডেকে উঠলাম “মা ”
আমার ব্যাকুল স্বরে ধ্যান ভেঙে বাস্তবের রূঢ় জগতে যেন ফিরে এলেন আমার জীবনের ধ্রুবতারা। একটা ভাঙা স্বরে বলে উঠলেন “আমি জানতাম আজ তুই আসবি, তোর জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম রে ,আজ কুরুক্ষেত্রে বুকে যে নৃশংসতা ঘটেছে তার সত্যতা সম্পর্কে একমাত্র তুই যে অবগত করতে পারিস তোর এই অভাগী মাকে। ”
স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি এই ব্যাকুল জিজ্ঞাসার সামনে দাঁড়িয়ে ,কি বলবো আমি ? কিভাবে এই অসহায় রাজলক্ষ্মীর সামনে ব্যক্ত করবো তাঁরই বংশের পাপের কাহিনী।………………
ভাঙা স্বরে বলে উঠলাম “আমাকে ক্ষমা করো মা, আজ তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবোনা আমি, সেই ক্ষমতা আজ আর পরে নেই আমার ”
কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি, তারপর এক গভীর স্বরে বলে উঠলেন ” আজ থেকে তেরো বছর আগে বিবেকের মূর্ত রূপ হয়ে আরেক পাশবিকতার বাস্তব রূপ আমার সামনে তুইই তুলে ধরেছিলি। সেই দিন প্রথমবার এক মা রূপে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠেছিল, মনে আশা জেগেছিলো অন্তত আমার একজন পুত্র ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি । আর ধর্মের পথে যারা অগ্রসর হয় তার সত্য কে ভয় করেনা । আজ এই গভীর কালো দিনে সেই সত্য থেকে পালিয়ে যাসনা বাবা, বল আমাকে সঞ্জয় যা বলেছে তা কি সত্যি ঘটেছে কুরুক্ষেত্রের বুকে ? ওই ষোলো বছরের বালককে কি সত্যি ঐভাবে হত্যা করা হয়েছে চক্রব্যূহে ? আর গুরু দ্রোণ, কুলগুরু,অঙ্গরাজ, গুরুপুত্র, হার্দিক্য এরা কেউ একবার ও কোনো প্রতিবাদ করেননি দুর্যোধনের এই পাপের বিরুদ্ধে ? কেউ না ?? আর তুই ? তুই ও কি এবার স্তব্ধ হয়ে গেলি ?”
এই মনস্বিনীর জিজ্ঞাসার সামনে আর স্তব্ধ হয়ে থাকতে পারলামনা আমি। পরাজিত স্বরে বলে উঠলাম “হ্যাঁ মা, তুমি যা শুনেছ সব সত্যি। সত্যি আজ এই যুগের সব থেকে ভয়ংকর নৃশংসতা ঘটেছে কুরুক্ষেত্রের বুকে, আর তুমি যাদের যাদের নাম করলে প্রতিবাদ করা তো দুরস্ত, বরং এরা প্রত্যেকেই সোত্সাহের সাথে যোগদান করেছেন এই মহৎ কর্মে। প্রত্যেকেই প্রমান করতে চেয়েছেন কে কত বড়ো বীর সেই ষোলো বছরের অসহায় বালককে নিষ্ঠুর আঘাতের পর আঘাত করে। কখনো মহান দানবীর অঙ্গরাজ অন্যায় যুদ্ধে তার ধনুক কেটেছেন তো কখনো কৃপাচার্য তার সারথীকে বধ করেছেন, কখনো হার্দিক্য তার ঘোড়া কটাকে হত্যা করেছে তো কখনো স্বয়ং ভরদ্বাজ পুত্র মহান গুরু দ্রোণাচার্য অঙ্গরাজের সাথে মিলিত হয়ে ছলনার দ্বারা কেটেছেন তার প্রিয় শিষ্যপুত্রের খড়গ চর্ম। আর যখন সেই হতভাগা ছেলেটা রথের একটা ভাঙা চাকা তুলে নিয়ে রক্তাক্ত শরীরে শেষ প্রয়াস করে যাচ্ছিলো নিজের ক্ষাত্র ধর্ম পালন করার ,তখন গান্ধার রাজের পরামর্শে সাত মহারথী এক হয়ে চার দিক থেকে ঘিরে অসংখ্য বাণের আশীষে রক্তাক্ত করে চলেছিল তার কোমল শরীর। আর আমার কথা বলছো ,আমি কেন প্রতিবাদ করিনি ? আমার প্রতিবাদের কি মূল্য আছে মা ? কে আমি ? না অস্ত্রবিদ্যায় তেমন সিদ্ধি লাভ করতে পেরেছি, আর না রাজনীতিতে জ্যেষ্ঠের সহযোগী হতে পেরেছি! আমি তো কৌরব পক্ষের সব থেকে অপাংতেয় পাত্র মা, শুধুই এক অপদার্থ বোঝা! তাও অপমানের ভয় না করে অনুরোধ করেছিলাম জ্যেষ্ঠকে অন্তত ধর্ম যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে। কিন্তু না আমার মতের মূল্য তেরো বছর আগে ছিল না এখন আছে মা। জ্যেষ্ঠ আর অঙ্গরাজের তীক্ষ্ণ কটূক্তি ভরা বাক্য আমায় আবারো স্তব্ধ করে দেয় । তেরো বছর আগে সেই অধর্ম সভা ত্যাগ করতে পেরেছিলাম কিন্তু এবার তাও করতে পারলামনা , কি করে করবো বলো যুদ্ধের পূর্বেই যে জ্যেষ্ঠকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম রণক্ষেত্রে কোনো পরিস্থিতিতেই তার সঙ্গ না ছাড়ার। তাই এক নীরব দর্শক হয়ে প্রত্যক্ষ করতে হলো এই নারকীয়তাকে। কিন্তু নিজের বিবেকের কণ্ঠ রোধ করে এই নারকীয়তাকে দর্শন করার পর আর বেঁচে থাকার শক্তি যে পরে নেই আমার মধ্যে ,তাই শেষ বারের মতো একবার তোমার পায়ের ধুলো নেবার লোভ আর সামলাতে পারলামনা মা ”
একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে উঠলেন আমার জীবন পথের ধ্রুবতারা “বিকর্ণ ?”
আমি ভাঙা স্বরে বলে উঠলাম , “হ্যাঁ মা, এই যুদ্ধে কেন আমি যোগদান করেছি সেই সত্য একমাত্র তোমারই জানা । এই যুদ্ধে পাণ্ডবেরা জয় লাভ করতে চলেছে আমার নিরানব্বই ভাইয়ের মৃতদেহের উপর দিয়ে। আর শুধু আমার নিরানব্বই ভাইয়েরাই নয় এই শবদেহের ভীড়ে পিতামহের সঙ্গে সঙ্গে যোগ দিতে চলেছেন গুরুদেব, অঙ্গরাজ, মাতুল গান্ধার নরেশ এবং আরো অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ। এই মৃত্যুর মিছিল থেকে নিজের প্রাণ রক্ষার জন্য যুযুৎসুর মতো পালিয়ে গিয়ে কাপুরুষের উপাধি আমি অর্জন করতে চাইনা মা। যুবরাজ দুর্যোধন যতই অন্যায় করে থাকুননা কেন ,তিনি আমার অগ্রজ, তোমার প্রথম সন্তান , তাকে মৃত্যুর মুখে একা রেখে আমি কিছুতেই পালাতে পারিনা। আর তার সাথে সাথে এক দুরাশাও ছিল মনের অগোচরে, যদি কোনোভাবে জ্যেষ্ঠকে বুঝিয়ে থামাতে পারি এই মহা সংগ্রাম । আর এই দুই কারণেই এই ধর্ম যুদ্ধে জেনে বুঝে ধর্মের বিরুদ্ধে আমাকে অস্ত্র ধারণ করতে হয়েছে। কিন্তু যে পক্ষে স্বয়ং বাসুদেব ধর্মের রথের সারথি হয়ে আছেন ,সেই রথের গতি রোধ করা স্বয়ং নিয়তির পক্ষেও অসম্ভব মা। কিন্তু এবার এই মহা সংগ্রামে একের পর এক অন্যায়ের নীরব দর্শক হয়ে থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে তোমার বিকর্ণ।
প্রথমে দেখলাম শিখণ্ডীকে রথে চড়িয়ে তার আড়াল থেকে একের পর এক ধারালো বাণের আঘাতে পিতামহকে অন্যায় যুদ্ধে শরশয্যায় শুইয়ে দিলো তারই সর্বাধিক প্রিয় পৌত্র ফাল্গুনী। অর্জুনকে আটকাতে ছুটে আসছিলাম কিন্তু পাঞ্চাল রাজ্ আমার পথ রোধ করলেন, নীরব দর্শক হয়ে অসহায়ের মতো দেখলাম কুরুকুলের প্রাচীন বটবৃক্ষকে ভূমিশয্যা নিতে । ভাবতে পারিনি কিভাবে অর্জুনের মতো মর্যাদাবান বীর পারলো এই ভাবে ছলনার সাহায্য নিয়ে কুরুকুলের ভিত্তিপ্রস্তরকে চূর্ণ বিচূর্ণ করতে । তারপর আজ দেখলাম গুরুদেব অগ্রজের কাছে নিজের মর্যাদা বজায় রাখতে কিভাবে একটি ষোলো বছরের বালককে পাশবিক ভাবে হত্যার চক্রান্ত রচনা করলেন, আর সেই চক্রান্তে অগ্রণী হয়ে উঠলেন আমাদেরই ভগ্নীপতি সিন্ধুরাজ। মহাদেবের বরে বলীয়ান হয়ে সে কিভাবে পান্ডব পক্ষ থেকে একজন মহারথী কেও আসতে দিলোনা এই বালক মহাবীরের সহায়তায়। আর সহ্য করার শক্তি পরে নেই তোমার এই বিকর্ণের মধ্যে মা। এবার তোমার এই অপদার্থ পুত্র মুক্তি চায়। ”
নিজের অন্ধ স্বামীর প্রতি ভালোবাসায় স্বেচ্ছায় নিজের চোখ দুটোকে কাপড়ে আবৃত করে সারাজীবনের জন্য অন্ধকারকে বরণ করে নিয়েছিলেন আমার মা। কোনোদিন আমাদের কারোর মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার। কিন্তু আমাদের প্রত্যেককে আমাদের পদধ্বনি থেকেই চিনে নিতে পারেন তিনি। আমাদের প্রত্যেকের মুখের প্রতিটি রেখা অব্দি তার হাতের পরিচিত। ধীরে ধীরে আমার দিকে ফিরে তার স্নেহে ভরা নরম হাতটি দিয়ে আমার মাথা স্পর্শ করলেন কুরু কুলের জ্যেষ্ঠা বধূ। ধীর স্বরে বলে উঠলেন “এক মায়ের কাছে তার সমস্ত সন্তানই সমান হওয়া উচিত। কিন্তু আমি হতভাগী তাও পারিনি , সমস্ত সন্তানদের মধ্যে একমাত্র তোকেই কেন জানিনা চিরকাল নিজের অন্তরের কাছাকাছি পেয়েছি। তোর প্রতিটা অনুভূতিকে বুঝে নিতে কোনো দিন ও তোর এই হতভাগী মায়ের না দৃষ্টির প্রয়োজন হয়েছিল না তোর মুখ থেকে উচ্চারিত হয় কোনো ধ্বনি শ্রবণের। তুই ছাড়া আর কোনো সন্তানকে যে নিজের মতো করে বড়ো করে তোলার সুযোগও তো পায়নি তোর এই হতভাগী মাতা। তোদের শৈশব থেকেই তোদের আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে বড় করে তোলা হয়েছে মহারাজের উচ্চাকাঙ্খা আর ভ্রাতা শকুনির ধূর্ত কূটনীতির ছায়ায়। আর নিজের হাতে নিজের দৃষ্টি রুদ্ধ করে নিজের সন্তানদের থেকে দূরে একান্তচারিনী হয়ে বাঁচতে হয়েছে আমাকে। চেষ্টা করেছিলাম ন্যায়, নীতি ও ধর্মবোধের ছায়ায় তোদের বড় করে তুলতে, কিন্তু পারিনি। এক মুহূর্তের জন্যও তোদের আমার কাছে আসতে দেয়নি আমারই ভ্রাতা। নিজের প্রতিশোধ চরিতার্থ করার জন্য সে তোদের শৈশবেই কেড়ে নিয়েছিল আমার বুক থেকে। আর মহারাজের ছিল অন্ধ বিশ্বাস তার উপর। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম রে, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তবু তার মধ্যেও একমাত্র তুই সমস্ত বাধা পার করে সবার আড়ালে চিরকাল ছুটে এসেছিস আমার কাছে। একমাত্র তুই গ্রহণ করেছিলি তোর এই নির্বোধ মায়ের আদর্শ আর ধর্মনীতিকে। আর সেই দিন সেই কাপুরুষদের সভায় কুরুকুল বধূর সম্মানের জন্য প্রতিবাদে ঠিকরে উঠে তুই তোর মায়ের শিক্ষার দাম রেখেছিলি বাবা। শত যন্ত্রনা আর বেদনার মধ্যেও সেই দিন এইটুকুই ছিল আমার সান্ত্বনা।
অন্তত আমার বিকর্ণ নিজের বিবেককে বিকিয়ে দেয়নি। তাই আজ আর তোকে স্নেহের বাঁধনে বাঁধবোনা আমি। তুই নিজের বিবেককে হত্যা করে সমস্ত অন্যায়ের নীরব দর্শক হয়ে থেকে গেছিস , এই দৃশ্য আমিও যে কল্পনা করতে পারবোনা। ইতিমধ্যে আমার শত পুত্রের মধ্যে অনেককে হারিয়েছি ,জানি একে একে বাকিদেরও হারাবো, শতপুত্রবতী এই অভাগী মাতা শেষে এক পুত্রহীনায় পরিণত হবে। কিন্তু তার ভয়ে তোকে তোর বিবেক বিসর্জন দিতে আমি বলতে পারবোনা। যদি অন্তত আমার একজন পুত্র ও ধর্মপথে অবিচল থেকে বীরের মৃত্যু বরণ তবে তাই হবে এই অভাগী মায়ের জীবনে একমাত্র গর্ব। তুই যদি ধর্ম পথে অবিচল থেকে বীরের মৃত্যু বরণ করতে চাস, তবে তাই হোক। আশীর্বাদ করি শেষ মুহূর্ত অব্দি নিজের ধর্মে অবিচল থাক। ”
রুদ্ধ কণ্ঠে আমি বলে উঠলাম “মা ”
নিজের নরম হাতটা আমার মাথার অবিন্যস্ত চুলের মধ্যে ধীরে ধীরে বুলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠলেন আমার রাজ রাজেশ্বরী মা “হ্যাঁ রে,তোর এই হতভাগী মায়ের শেষ আশীর্বাদকে পাথেয় করে তুই তোর পথে এগিয়ে যা। আর সত্যি বলতে কী জানিস, এই ভবিষ্যতের ধারণা অনেক আগে থেকেই ছিল আমার । সেই দিন সেই অভিশপ্ত সভাতেই আমি জানতাম কি ঘটতে চলেছে এই রাজবংশে, যে বংশে কুলবধূর এতো বড় অমর্যাদা হয় ,সেই বংশের জন্য শুধু এই ভবিতব্যই অপেক্ষা করে। পান্ডবদের আমি কোনো দোষ দিইনা রে , শৈশব থেকেই ওদেরও তো আমি তোদের মতোই নিজের সন্তানের সমানই দেখে এসেছি। আর যে অপমান পাঞ্চালীকে করা হয়েছে, যে ভাবে প্রতারণায় ওদের সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে তারপর ওদের কোন মুখে দোষ দেব বলতো ? কিন্তু একজন আছে যাকে আমি আজ দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছি ,তাকে আমি কোনদিনও ক্ষমা করতে পারবোনা রে। শাস্তি তাকে পেতেই হবে। ”
আমি স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকলাম আমার এই মনস্বিনী ধর্মপরায়ণা মাতার দিকে ,কার কথা বলছে মা ?
সেই প্রশ্নই বেরিয়ে এলো আমার কণ্ঠ থেকে “কার কথা তুমি বলছো মা, মাতুল শকুনি, ভ্রাতা দুর্যোধন, পিতা মহারাজা ধৃতরাষ্ট্র নাকি যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদী ?”
একটা অদ্ভুত বিষন্ন হাসি বেরিয়ে এলো এই জগতছাড়া মানুষটির মুখ থেকে , “না রে এরা কেউ নয়, দ্রৌপদী কে কোন মুখে দোষ দেব বলতো , বরং আজও ওর সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস নেই আমার। আর শকুনি ,দুর্যোধন বা মহারাজ ? যারা ধর্মের স্বরূপকেই চেনেনা, প্রতিশোধ, উচ্চাকাঙ্খা আর অহংকারে যাদের চোখ অন্ধ হয়ে রয়েছে তাদের কাছে আর কি প্রত্যাশা পরে থাকে? প্রত্যাশা থাকে তার কাছে যে ধর্মের জ্ঞানী , যার ভবিষ্যৎ দেখার শক্তি রয়েছে , যে মানবিকতার মূল্য জানে। আর যখন সে এই সব জেনেও সব কিছুকে উপেক্ষা করে নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করতে নিরীহ মানুষের বলি দেয় , তখন তাকে ক্ষমা করা যায়না। ”
আমি স্থলিত স্বরে বলে উঠলাম “কে সে মা ?”
একটা তীক্ষ্ণ স্বরে এই মানুষটি উত্তর দিয়ে ওঠে ,”সে আর কেউ নয় রে ,সে বাসুদেব কৃষ্ণ ”
আমি কয়েক মুহূর্তের জন্য বাক্য হারিয়ে ফেলি, কি বলছে মা! যে মানুষটি এই ধর্ম যুদ্ধ আটকানোর শেষ মুহূর্ত অব্দি প্রয়াস করে গেছিলো তাকেই সে দায়ী করছে এই মহাযুদ্ধের জন্য? সত্যি কি শেষ অব্দি শোকে নিজের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে এই মনস্বিনী রমণী?
একটা তীক্ষ্ণ হাসিতে আমার বিমূঢ়তাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে বলে উঠলেন সেই মহা তপস্বিনী ,”কি ভাবছিস এটাই না, যে তোর মা এবার শোকে দুঃখ পাগল হয়ে গেছে! সেই মানুষটাকেই সে দোষারোপ করছে যে এই যুদ্ধ আটকানোর সব থেকে বেশি প্রয়াস করেছিল , কিন্তু একটা কথা জেনে রাখ বিকর্ণ, শোকে, দুঃখে অন্ধ হয়ে এই সিদ্ধান্ত আমি নিইনি।যদি তাই নিতাম তবে সবার আগে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করতাম যাজ্ঞসেনীকে ,অথবা আমার একশত পুত্র কে হত্যার সংকল্প নেওয়া বৃকোদরকে অথবা জ্যেষ্ঠ পান্ডব যুধিষ্ঠিরকে। কিন্তু এরা কেউ আমার চোখে দোষী নয় ,কারণ এরা কেউ সব জেনে শুধু নিজের সংকল্পকে সত্য করার জন্য সমস্ত আর্যাবর্তকে বলি দিচ্ছেনা। কিন্তু বাসুদেব তাই করছেন ,তাই তার কোনো ক্ষমা নেই। ”
আমি আর সংযত থাকতে পারলামনা ,ব্যাকুল স্বরে বলে উঠলাম ,”কেন তুমি এতো বড় অভিযোগ করছে বাসুদেবের নামে মা ? তিনি তো নিজেই কতবার প্রয়াস করেছিল এই মহাযুদ্ধ থামানোর। নিজে এসেছিলেন এই হস্তিনাপুরে যুদ্ধ থামানোর বার্তা নিয়ে ,এমনকি সেই প্রয়াসে জ্যেষ্ঠের হাতে কত অপমান সহ্য করতে হয়েছিল তাঁকে। তারপরেও কেন তুমি তাঁকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছ ?”
একটা তীব্র বিদ্রূপে ভরা হাসিতে ভরে উঠলো মায়ের মুখ, স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। জীবনে কোনো দিন এই রকম বিদ্রূপে ভরা হাসি দেখিনি আমি এই মানুষটির মুখে। চিরটাকাল শুধুই স্নেহ ,দয়া আর ভালোবাসা দেখে এসেছি এই মুখে। না তার সাথে জীবনে প্রথমবার অসহনীয় ক্রোধ ও অপমানের আগুন দেখেছিলাম তেরো বছর আগের সেই সভায়। আর তেরো দিন আগে অব্দি দেখেছি এক প্রবল অসহায়তার ছাপ । কিন্তু এই রকম তীক্ষ্ণ বিদ্রূপে ভরা হাসিতো আজ অব্দি দেখিনি এই মুখে!
সেই তীক্ষ্ণ বিদ্রূপে ভরা হাসি মুখে নিয়ে, একটা ধারালো স্বরে আবারো বলে উঠলেন তিনি “যুদ্ধ থামানোর প্রয়াস করেছিলেন বাসুদেব ? এর থেকে বড় কৌতুকের আর কিছু হতে পারেনা রে। যিনি এই মহাযজ্ঞের প্রধান ঋত্বিক , তিনি নাকি করেছিলেন এই মহাযজ্ঞ থামানোর প্রয়াস! না রে বাসুদেব যে প্রয়াসটা সবার সামনে করেছিলেন তা এক প্রহসন ছাড়া আর কিচ্ছু ছিলোনা । তিনি খুব ভালো করেই জানতেন কি করলে এই মহা সংগ্রাম থামানো যায়। কিন্তু তা না করে তিনি সেই প্রয়াস করেছিলেন যাতে সবাই মনে করে তিনি যুদ্ধ থামাতে চান কিন্তু আদৌ যে প্রয়াস কোনভাবেই ফলপ্রসূ হবেনা। ”
বিস্ময়ে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম, ব্যাকুল স্বরে বলে উঠলাম “কি বলছো তুমি ?”
সুদৃঢ় স্বরে বলে উঠলেন আমার জীবন পথের দিশারী ,”ঠিকই বলছি রে, বাসুদেব মানব চরিত্র বিষয়ে সব থেকে বড়ো জ্ঞানী । দুর্যোধনের দুর্বলতা, শক্তি, অহংকার, ভীতি সব কিছুকেই তিনি খুব ভালো করেই জানতেন। তিনি জানতেন দুর্যোধন ন্যায়ের আবেদনকে গুরুত্ব দেবেনা , যুদ্ধ থামানোর জন্য করা বলিদানকে বুঝবেনা , শত সহস্র নিরপরাধ প্রাণের কোনো মূল্য নেই তার কাছে। সে শুধু বোঝে শক্তিকে। তাই তাকে যদি তিনি সত্যি আটকাতে চাইতেন তবে তিনি আজ সসৈন্যে নিজে হাতে অস্ত্র ধরে পান্ডব পক্ষে যোগদান করতেন। বাসুদেবকে দ্বারকার অপরাজেয় সৈন্য সহ পান্ডব পক্ষে এসে দাঁড়াতে দেখলে দুর্যোধনের সাহস হতোনা এই যুদ্ধের শঙ্খ ধ্বনি করার। কিন্তু তিনি তা কিছুই করেননি বরং এক প্রহসন রচনা করে ,দুর্যোধনকে এক অর্বুদ নারায়ণী সৈন্যের সহায়তা প্রদান করে আর নিজে অস্ত্র না ধারণ করার শপথ নিয়ে তাকে পরোক্ষ ভাবে যুদ্ধে প্ররোচিত করেছেন। একমাত্র সাত্যকি ছাড়া আর কোনো যাদবকে পান্ডব পক্ষে যোগদান করার অনুমতি দেননি তিনি, বরং শক্তিসাম্য বজায় রাখতে যাদব বংশীয় কৃতবর্মা কে দুর্যোধনের পক্ষে যোগদান করতে দিয়েছেন। যদি সত্যি তিনি এই যুদ্ধ আটকাতে চাইতেন তবে এই কূটনীতি কেন প্রয়োগ করেছেন বলতে পারিস ? আর শুধু আজ নয় রে, আজ থেকে অনেক বছর আগে থেকেই এই মহাসংগ্রামের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন কেশব। ”
বিমূঢ় ভাবে আমি বলে উঠলাম “কবে ? কবে থেকে এই মহা যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছিলেন বাসুদেব?”
অল্প হেসে মা বলে উঠলেন “প্রথম যেদিন পাঞ্চাল রাজ্যে যাজ্ঞসেনী বরণ করে নিয়েছিল পার্থকে সেই দিন। আর তার উদ্দেশ্যের প্রথম আভাস আমি পেয়েছিলাম যেদিন কুরুরাজ্য ভাগের আবেদন নিয়ে আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে তিনি প্রথম পা রেখেছিলেন এই হস্তিনাপুরের বুকে।

আমি স্তব্ধ হয়ে যেন ফিরে যাই পঁচিশ বছর আগের সেই দিনটির স্মৃতিতে, সেই দিন প্রথমবার হাসিমুখে পঞ্চ পান্ডব, ছোটমা,আর পাঞ্চাল দুহিতাকে নিয়ে এই হস্তিনাপুরে পদার্পন করেছিলেন বাসুদেব।
এক গাঢ় স্বরে মা বলে চললেন “সেই দিনই তার প্রতিটি কথায় এক যুগান্তরকারী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের আভাস পেয়েছিলাম রে । না হলে মহারাজের পাণ্ডবদের খাণ্ডবপ্রস্থের মতো পোড়া ভূমি প্রদানের প্রস্তাবে সোৎসাহে সম্মত হতেননা তিনি। পঞ্চ পাণ্ডবকে দিয়ে তিনি প্রথমে এক স্বল্প ঊষর ভূমিকে নতুন রূপে প্রাণদায়ী করে তুলতে চেয়েছিলেন। আর মনে করে দেখ তা করতে গিয়ে নিষ্ঠুর হাতে খাণ্ডব বনের কত নিরীহ প্রাণী, কত প্রাচীন বৃক্ষ আর কত উপজাতির প্রাণ সংহার করিয়েছিলেন তিনি অর্জুনকে দিয়ে। আর শেষ অব্দি খাণ্ডব প্রস্থকে ভেঙে নতুন করে গড়ে রূপ দিয়েছিলেন ইন্দ্রপ্রস্থের ।
কোনো বড় নাট্য অভিনীত হবার আগে একবার তার একটা শেষ সসজ্জা মহড়া হয় রে বিকর্ণ, খাণ্ডব দহন ছিল সেই সসজ্জা মহড়া। খাণ্ডব প্রস্থ ছিল একটি ছোট চারা গাছ যাকে পরীক্ষামূলক ভাবে শিকড়সমেত উপড়ে ফেলে নতুন ভূমিতে নতুন করে সিঞ্চন করা হয় সেই বিরাট বৃক্ষকে ভূমিশায়ী করার পূর্বে । ”
আমি উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠলাম “সেই বিরাট বৃক্ষ কে মা ,সেকি হস্তিনাপুর ?”
একটা বিষাদ হাসি মুখে নিয়ে তিনি বলে উঠলেন ‘না রে, সেই বিরাট বৃক্ষ যদি হস্তিনাপুর হতো তাহলে হয়তো তাও বাসুদেবকে ক্ষমা করা যেত ,কিন্তু সেই বৃক্ষ শুধু হস্তিনাপুর নয় ,সেই বৃক্ষ হলো সমগ্র আর্যাবর্ত। ”
একটা তীক্ষ্ণ চীৎকার বেরিয়ে এলো আমার কণ্ঠ থেকে “মাআআআ , কি বলছো তুমি ?”
একটা অদ্ভুত উদাস হাসি হেসে মা বলে উঠলেন “হ্যাঁ রে, বাসুদেব তার মহা যজ্ঞে গোটা আর্যাবর্তকে আহুতি দিতে চলেছেন। তিনি প্রথমে এই যুদ্ধ না করেই তার বৃহত্তর উদ্দেশ্য সফল করতে চেয়েছিলেন, যুধিষ্ঠিরকে আর্যাবর্তের সম্রাটের সিংহাসনে বসিয়ে । কিন্তু তার সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি, রাজসূয় যজ্ঞের বেদীতেই শিশুপাল তীব্র ভাষায় তাকে কুৎসিত ভাবে আক্রমণ করে, অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তার রচিত শক্তি সাম্যের বিরুদ্ধে গোপন রাজনৈতিক জোট নির্মাণে প্রয়াসী হয়। এই অবস্থায় শুধু একটা পথই খোলা থাকে তার সামনে তার স্বপ্নকে সফল করার , এক মহাসংগ্রামের আহ্বান করে এই সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক শক্তিকে আর্যাবর্ত থেকে শিকড় সমেত উপড়ে ফেলার পথ। আর সেই পরিকল্পনাকেই তিনি বাস্তবের রূপ দিতে ব্রতী হন। না হলে ভাবতো রাজসূয় যজ্ঞের পর ইন্দ্রপ্রস্থের মায়া পুরীতে শুধুমাত্র দুর্যোধনের সাথেই এতো অপমান কেন হলো ? আর কেনই বা তারপরেই সেই ছল পাশা খেলার সময়েই শাল্ব রাজ্যের আক্রমণ ঠেকাতে তাকে ছুটে যেতে হলো মূল আর্যাবর্ত থেকে অত দূরে পশ্চিমে ? যদুবংশে তো বীরের অভাব নেই , হলধর, সাত্যকি, কৃতবর্মা, অক্রুর এমনকি তার নিজের পুত্র প্রদ্যুম্ন এরা প্রত্যেকেই তো এক একজন অসামান্য বীর। তবে তাকেই কেন শুধু ছুটে যেতে হলো সেই সুদূর পশ্চিমে ওই ভয়ানক সময়ে। আর সত্যি যদি তিনি কোন আভাস না পেতেন আগামী বিপর্যয়ের, তবে কেন তিনি তার সখীকে দ্বারকার ওই মহার্ঘ একশো হাতের অদ্ভুত বস্ত্র প্রদান করেছিলেন ? আর কেনই বা তাকে বার বার অনুরোধ করেছিল হস্তিনাপুরে থাকা কালে শুধু এই বস্ত্রই পরিধান করতে ? আর তারপর কি ঘটেছিল নিশ্চয়ই আজও বিস্মৃত হসনি ?”
একটা আতঙ্কের স্রোত আজও আমার মেরুদন্ড দিয়ে বয়ে গেলো সেই অভিশপ্ত সভার স্মৃতি মনে করে। দুঃশাসন পশুর মতো চুলের মুঠি ধরে রাজসভায় টেনে নিয়ে আসছে হস্তিনাপুরের কুলবধূকে, আর পঞ্চ পাণ্ডব পাষানের মতন নীরব দর্শক হয়ে রয়েছে সেই ভয়ানক দৃশ্যের। রাজসভার সমস্ত প্রাচীনেরা স্তব্ধ । পিতামহ, গুরুদেব, পিতা,কুলগুরু সবাই যেন নিজের বাকশক্তিকে বিসর্জন দিয়েছেন। শুধু একমাত্র কাকা বিদুর অসহায়ের মতো বার বার প্রশ্ন করে চলেছেন রাজসভার কাছে। বারংবার অনুরোধ করে চলেছেন পিতা আর পিতামহের কাছে এই বিপর্যয় ঠেকানোর।
আর যাজ্ঞসেনী ব্যাকুল ভাবে প্রশ্ন রেখেছেন যুধিষ্ঠিরের তাকে হারার যৌক্তিকতা নিয়ে। কিন্তু তাকে নির্যাতন করার পাশবিক বাসনা নিয়ে তখন মত্ত হয়েছে ভ্রাতা দুর্যোধন, অঙ্গরাজ আর দুঃশাসন। তার প্রশ্নের প্রতি কারোর ভ্রূক্ষেপ নেই। পিতার চোখের সামনে প্রথমে কাকা বিদুরকে দাসীপুত্র বলে সম্বোধন করলো অগ্রজ। আর তারপর দুঃশাসন যাজ্ঞসেনীকে দাসী বলে উপহাস করা শুরু করলো। আর থেমে থাকতে পারিনি সেদিন আমি, সভার সকলের সামনে মাথা উঁচু করে প্রশ্ন রেখেছিলাম ,
“কোন অধিকারে যুধিষ্ঠির হেরেছে যাজ্ঞসেনী কে? নিজেকে হারার পর যাজ্ঞসেনীকে হারার কোন অধিকার ছিল তার ? আর যাজ্ঞসেনী শুধু তার একার পত্নী নয়, বাকি পাণ্ডবদের পত্নী সে ,তাদের কাছ থেকেও অনুমতি না নিয়ে ,আর প্রধানত যাজ্ঞসেনীর নিজের অজান্তে কিভাবে তাকে পণ হিসেবে রাখতে পারেন প্রথম পান্ডব ? কৌরব কুলবধূকে এইভাবে অপমান করে কোন কুলের মুখে কালি লেপন করা হচ্ছে ???
কিন্তু আমাকে থামিয়ে দিয়েছিলো অহংকারী অঙ্গরাজের নারকীয় উক্তি “যে রমণী পাঁচ স্বামীর পত্নী, সে আবার সতী কোন হিসেবে বিকর্ণ ? সে তো বেশ্যা , আর বেশ্যার সম্মানই বা কি আর অসম্মানই বা কি ? তাকে নগ্ন করে দিলেও ক্ষতি কি ? দুঃশাসন তুমি এই মুহূর্তে এই পঞ্চ পুরুষ দ্বারা ভুক্তা বেশ্যাকে নগ্ন করে দাও। ”
ক্রোধে, ক্ষোভে আর অপমানে আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম, আর আরো স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম দেখে যে দুঃশাসনের হাত সত্যি সত্যি এগিয়ে যাচ্ছে পাঞ্চালীর বস্ত্রের দিকে,আর গোটা কৌরব কুল নীরব দর্শক হয়ে প্রত্যক্ষ করে চলেছে এই ভয়ানক দৃশ্য। আর থাকতে পারিনি আমি ,সেই অধর্ম সভা ত্যাগ করে আজকেরই মতো সেইদিনও ছুটে এসেছিলাম একান্তচারিণী আমার মায়ের কাছে । তার অনুমতি না নিয়েই এই অধর্ম পাশা খেলার সূত্রপাত করা হয়েছিল, কিন্তু আমি জানতাম যদি কেউ আজ এই অনর্থকে ঠেকাতে পারে তবে তা একমাত্র আমার এই একান্তচারিণী মাতাই পারবেন।
আমার কাছ থেকে এই ভয়াবহ সত্য শুনে একমুহূর্তও অপেক্ষা না করে জীবনে প্রথম বারের মতো আমার মাতা ছুটে গেছিলেন কুরুরাজসভায়। কিন্তু ততক্ষনে ঘটে গেছে সেই অনর্থ, না এক অদ্ভুত মায়াবী বস্ত্র রক্ষা করেছে যাজ্ঞসেনীর লজ্জা ,কিন্তু রক্ষা হয়নি কুরুবংশের সম্মান। সেদিন কুরুকুলেরই সন্তানদের হাতে চিরকলংকিত হয়েছিল কুরুকুলের মর্যাদা।
মাতার প্রয়াসে সেই দিন মহাসতীর অভিশাপ থেকে রক্ষা পেয়েছিলো কুরুকুল। আর জীবনে প্রথমবার দেখেছিলাম পিতাকে মাতার প্রতিবাদের সামনে নতি স্বীকার করতে । যুধিষ্ঠিরকে তার সমস্ত সম্পদ, তার সাম্রাজ্য সব ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরক্ষনেই অগ্রজ, অঙ্গরাজ আর মাতুল শকুনির পরামর্শে আবার পাণ্ডবদের ডেকে এনে পুনরায় অবতারণা করা হয়েছিল সেই ছল পাশা খেলার, আবার পাণ্ডবদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তাদের তেরো বছরের জন্য বিতাড়িত করেছিলেন অগ্রজ।
নতুন করে পুনর্বার রোপন করা হয়েছিল কুরু পান্ডব যুদ্ধের বীজ।
মায়ের কণ্ঠস্বরে, সেই ভয়াবহ স্মৃতি থেকে বাস্তবের মাটিতে ফিরে এলাম আমি, “একবার ও কি ভেবে দেখেছিস যদি বাসুদেবের কোনো ধারণাই না থাকতো যে কি ঘটতে চলেছে তাহলে ওই বস্ত্র তিনি কেন দিলেন পাঞ্চালীকে ? আর দীর্ঘ বারো বছরের বনবাসে পাঞ্চালী ভিন্ন আর কোনো পান্ডব বধূর পক্ষে কেন সম্ভব হয়নি পাণ্ডবদের সাথে বনবাস করার ? এমনকি কেশব তার নিজের ছোট বোন সুভদ্রার অনুরোধ ও রক্ষা করেননি , কেন জানিস ? কারণ তিনি চেয়েছিলেন এই দীর্ঘ তেরো বছর পঞ্চ পাণ্ডবের দহন হোক যাজ্ঞসেনীর প্রতিশোধের অগ্নিতে। অগ্নিকন্যার আগুনে পুড়ে আরো সুদৃঢ় ও সুতীক্ষ্ণ হয়ে উঠুক তার হাতের ওই পাঁচ অস্ত্র। ”
আমি স্তম্ভিত হয়ে বলে উঠলাম “তাহলে বাসুদেব জেনে বুঝে পাঞ্চালীর অপমান হতে দিয়েছেন , পঞ্চপান্ডবকে সব খুইয়ে বনবাস আর অজ্ঞাতবাসে পাঠিয়েছেন। এতো নিষ্ঠুর ভাবে ব্যবহার করে চলেছেন তিনি এদের ?”
ক্লান্ত স্বরে বলে উঠলেন মাতা “হ্যাঁ, বাসুদেব নিজের বৃহত্তর উদ্দেশ্যের জন্য এমন কোনো ব্যক্তি নেই যার ব্যবহার করা থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন। যখনি যার প্রয়োজন হবে নিজের কূট চালে তার ব্যবহার তিনি করবেন ,আর যখন তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে তখন তাকে নির্মম হাতে ছুড়ে ফেলে দিতে একমুহূর্তের জন্য ও ভাববেননা তিনি। তা সে ব্যক্তি যেই হোকনা কেন, কৌরব কি পান্ডব কি তার নিজের রক্ত অথবা নিজেকেই। তার উদ্দেশ্য পূর্তির জন্য কারোরই এমনকি তার নিজেরও কোনো মূল্য পরে নেই তার কাছে। না হলে কিভাবে তিনি পারলেন আজকে নিজের ভাগ্নেকে বলি দিতে ?”
আমি ব্যাকুল স্বরে বলে উঠলাম “কিন্তু অভিমন্যুর মৃত্যুর সাথে কি সম্পর্ক শ্রীকৃষ্ণের , তিনি তো তখন অর্জুনকে নিয়ে রণক্ষেত্রের অন্য পারে ব্যস্ত ছিলেন সংশপ্তকের সাথে যুদ্ধে ?”
মা অল্প হেসে বললেন ,”সংশপ্তকের সাথে যুদ্ধ তো পিতৃব্যের মৃত্যুর পর থেকেই অর্জুনের চলছে পুত্র । কিন্তু তার মধ্যেও বারংবার অর্জুন সফল হয়েছে যুধিষ্ঠির এবং বাকি পাণ্ডবদের সহায়তায় এগিয়ে আসতে। তা সে গুরু দ্রোণের আক্রমণ ঠেকাতে হোক কি ভগদত্তকে বধ করতে ,প্রতিবারই বাসুদেবের চরেদের মাধ্যমে যুদ্ধের সকল খবর পৌঁছে গেছে সঠিক সময়ে তার কাছে । এমনকি যুদ্ধের আগের রাতেই কৌরব পক্ষে কোন ব্যূহ রচনা হতে চলেছে সেই সংবাদ ও জেনে যেতেন বাসুদেব, তাহলে আজকেই এমন কি হলো যে সারাদিন অর্জুনের একবার ও অবকাশ হলোনা কি ঘটে চলেছে যুদ্ধের এই প্রান্তে জানার? চক্রব্যূহের খবরও বা কিভাবে অজ্ঞাত থেকে গেলো পান্ডব পক্ষে ,বলতে পারিস ? ”
একটা শব্দ ও উচ্চারণ করার শক্তি আর আমার পড়েছিলনা ,কোনো মতে বিমূঢ় ভাবে মাথা নেড়ে জানালাম “না। ”
মা বেদনা মিশ্রিত স্বরে বলে উঠলো “অর্জুনের কাছে কোনো সংবাদ পৌঁছয়নি কারণ বাসুদেব তা চাননি , চক্রব্যূহের খবর পাণ্ডবেরা কেউ আগে জানতে পারিনি কারণ তা বাসুদেবের ইচ্ছে ছিলোনা। বাসুদেবেরই অধীনস্থ যাদব হার্দিক্য বিনা সংকোচে এই হত্যালীলার অংশ নিতে পেরেছে কারণ সেই অনুমতি সে পেয়েছে বাসুদেবের কাছ থেকে। নিজের প্রয়োজনে আজ ওই ষোলো বছরের নিষ্পাপ বীর বালককে বলি দিলেন বাসুদেব। ”
আমি আর চুপ করে থাকতে পারলামনা ,একটা তীক্ষ্ণ চীৎকার করে বলে উঠলাম ,”কিন্তু কেন?কেন নিজের রক্তকে আজ এইভাবে বলি দিলেন বাসুদেব ? ”
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে, তারপর এক গভীর স্বরে বলে উঠলেন মা “কারণ তার প্রয়োজন ছিল বিকর্ণ। তুই নিজেই প্রথমে আজ বলেছিস যে তুই স্তব্ধ হয়ে গেছিলি অর্জুনকে অন্যায় যুদ্ধে গঙ্গাপুত্রকে আক্রমণ করতে দেখে। ভেবে দেখতো যে দৃশ্য দেখে তুই নিজে স্তব্ধ হয়ে গেছিলি ,সেই দৃশ্যকে কার্যে পরিণত করতে গিয়ে কতটা মানসিক যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়েছে ফাল্গুনীকে। অর্জুনকে আমি ওর শৈশব থেকেই চিনি, তোদের সবার মধ্যে পিতৃব্যের সব থেকে প্রিয় ছিল ও। ছোটবেলায় পিতৃব্যের কোলে উঠে তাকে পিতা সম্বোধন করতো সে। সেই তাঁকে নিষ্ঠুর হাতে অন্যায় যুদ্ধে ধয়াশায়ী করতে গিয়ে কি পরিমাণে বিবেকের দংশন তাকে সহ্য করতে হয়েছে ভাবতে পারিস ? তাই তারপর থেকে তার যুদ্ধের একটাই উদ্দেশ্য পড়েছিল যুধিষ্ঠির সহ পান্ডব পক্ষকে রক্ষা করা , যুদ্ধ জয়ের সমস্ত স্পৃহা একটু একটু করে নিভে যাচ্ছিলো তার অন্তর থেকে। প্রতিশোধের উপরে জায়গা নিয়েছিল বিবেকের দংশন ,আর সেই দংশনকে মুছে দিতেই অভিমন্যুর বলি দিয়েছেন বাসুদেব। অর্জুনের অন্তর থেকে সব দুর্বলতা চিরতরে মুছে দিয়ে প্রতিশোধের সব থেকে ভয়ানক আগুন জ্বালাতে চেয়েছেন তিনি। যাতে এরপর আর যে অন্যায়ই অর্জুনকে দিয়ে করানো হোকনা কেন, এই বিবেকের দংশন যেন আর স্পর্শ করতে না পারে তার অন্তরকে। ”
আমি কাতর স্বরে বলে উঠলাম “শুধু এর জন্য ? ওই ষোলো বছরের বালককে এর জন্য এইভাবে বলি দিলেন তিনি ?”
মা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন ” শুধু অভিমন্যু একা নয়, এরকম আরো কত মানুষকে যে তিনি বলি দেবেন ,তার ধারণা নেই তোর। নিজের গোপন উদ্দেশ্যকে সফল করার এতো কাছে এসে কোনোভাবেই নিজের গতি স্তব্ধ হতে দেবেননা বাসুদেব। আর তার জন্য যার বলি দিতে হয় তিনি বিনা সংকোচে দেবেন। ”
আমি ব্যাকুল ভাবে অবশেষে বলে উঠলাম “কিন্তু কি সেই বাসুদেবের গোপন উদ্দেশ্য মা ,যার জন্য এইভাবে একের পর এক নিরপরাধকে বলি দিয়ে চলেছেন তিনি ? তার নিজের কি কোনো ব্যক্তিগত লাভ নাকি দ্বারকার শ্রীবৃদ্ধি ?”
মা অল্প হেসে বলে উঠলেন “না রে, সেই উদ্দেশ্য থাকলে তাকেও আমি দোষীর কাঠগড়ায় বসাতাম না ,কারণ সেক্ষেত্রে তোর পিতা,ভ্রাতা বা মাতুলের সাথে কোনো পার্থক্য থেকে যেতোনা তার। কিন্তু বাসুদেবের উদ্দেশ্য অনেক মহৎ, এই গোটা আর্যাবর্ত থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির এই ক্রম সংগ্রামকে বন্ধ করে এক ঐক্যের মালায় তিনি তাদের জুড়তে চান। একটি মাত্র কেন্দ্রীয় শক্তির অধীনে তিনি আনতে চান সম্পূর্ণ আর্যাবর্তকে। এই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন রাজ্য গুলির রেষারেষি ,প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আর বলি হতে দিতে চাননা তিনি সাধারণ মানুষদের। এক নতুন সমাজব্যবস্থা, এক নতুন কেন্দ্রীয় শাসন শুরু করতে চান তিনি এই আর্যাবর্তে , নিয়ে আনতে চান এক যুগান্তর। আর তারজন্যই এই পুরোনো যুগের মহাবিনাশ যজ্ঞের আহ্বান করেছেন তিনি।
কিন্তু ভবিষ্যতের শ্রীবৃদ্ধি করতে গিয়ে তিনি ভুলে গেছেন বর্তমানকে। শত সহস্র বিধবার রোদন আজ পৌছচ্ছেনা তার কানে। যুগান্তরকে সময়ের আগে আনার জন্য মরিয়া হয়ে তিনি একের পর এক নিরপরাধ কে বলি দিয়ে চলেছেন। কিন্তু কি পরিণাম হবে এই মহাযজ্ঞের ? সত্যি কি আসবে যুগান্তর ? সত্যি কি সাধারণ মানুষদের স্বর্গভূমি হয়ে উঠবে এই আর্যাবর্ত ?
না আমি মনে করিনা রে এতজন নিরীহ মানুষের বলির মূল্যে আসতে পারে সময়ের পূর্বে সেই যুগান্তর! যদি তার এই স্বপ্ন সত্যি সফল হত,তবে তার সব অপরাধ হয়ত ক্ষমা করে দেওয়া যেত ,কিন্তু যদি তা সফল না হয় তবে কেউ তাকে ক্ষমা করবেনা , না আর্যাবর্তের বর্তমান ,না ভবিষ্যৎ আর না এই অভাগী কুরুরাজমাতা। ”
আমি স্তব্ধ হয়ে শুনছিলাম আপাতদৃষ্টিতে রাজনীতি থেকে শত যোজন দূরে বাস করা এই মনস্বিনী রাজলক্ষ্মীর অসামান্য রাজনৈতিক বিশ্লেষণ।
আমার মনেও জেগে উঠছিলো একই প্রশ্ন “সত্যি কি সফল হবে বাসুদেবের স্বপ্ন ,সত্যি কি আসতে চলেছে এক যুগান্তর এই আর্যাবর্তের বুকে ? ”
আচমকা এক ভীষণ পরিচিত শব্দে কল্পনার জগৎ থেকে কঠোর বাস্তবের মাটিতে ফিরে এলাম। প্রভাত ফেরি ধ্বনিত হচ্ছে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তে। সময় এসে গেছে আমার আজকের আত্মবলিদানের। শেষবারের মতো আমার জীবনপথের ধ্রুবতারার চরণ স্পর্শ করলাম । এক উদাস হাসি মাখা স্বরে বলে উঠলাম “এবার বিদায় দাও মা ,সময় এসে গেছে তোমার বিকর্ণের বিদায় নেবার। আজকের যুদ্ধে অবশেষে বীরের মৃত্যু বরণ করতে চলেছে তোমার এই অপদার্থ পুত্র ”
আস্তে আস্তে তার স্নেহ ভরা হাতটা আবার আমার মাথার উপর স্থাপন করলেন আমার চিরধর্মপরায়ণা মাতা ,একটা কাঁপা স্বরে বলে উঠলেন “আশীর্বাদ করি রে ,শেষ মুহূর্ত অব্দি ধর্মে অবিচল থেকে বীরের মৃত্যু বরণ কর। চিন্তা করিসনা ,খুব শিগগিরই আবার দেখা হবে সেই অমরত্বের জগতে। ”
আমি তীব্র স্বরে বলে উঠলাম ,”না মা, এখনো হস্তিনাপুরের এবং আর্যাবর্তের প্রয়োজন আছে তোমাকে। বাসুদেবের নবরাজ্য যদি সত্যি প্রতিষ্ঠিত হয় তবে তার জন্য যে জ্ঞানের প্রয়োজন হবে তার জন্য তোমার এখনো বহুকাল বেঁচে থাকা দরকার মা। বাসুদেব সত্যি যুগান্তর আনতে পারলেন কি পারলেননা তার মূল্যায়ন কে করবে মা, যদি তুমিই না থাকো এই আর্যাবর্তে ? কথা দাও মা যতদিন আর্যাবর্তের এবং হস্তিনাপুরের কাছে তোমার প্রয়োজন ফুরিয়ে না যাবে ,ততদিন জীবিত থাকবে তুমি। ”
মা তীব্র আর্তনাদ করে ওঠে “বিকর্ণ ?”
আমি তার হাত দুটো ধরে বলে উঠলাম “তোমার এই অপদার্থ সন্তান অন্তিমবারের মতো তোমার কাছ থেকে কিছু চাইছে মা, প্রতিশ্রুতি দাও আমাকে। ”
কিছুসময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো আমার অভাগী মাতা। তারপর এক ধীর স্বরে বলে উঠলেন “ঠিক আছে তুই যা চাস তাই হবে, প্রতিশ্রুতি দিলাম যতদিন এই হস্তিনাপুরের কাছে আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে না যায় ততদিন আমি জীবিত থাকবো এই শ্মশানে। কিন্তু তুইও একটা কথা জেনে রাখ , তুই আমার কোনো অপদার্থ সন্তান নোস, বরং এই অভাগী মায়ের সমস্ত সন্তানদের মধ্যে তুই একমাত্র মনুষ্যত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া প্রকৃত মানব সন্তান। মরার আগের দিন অব্দি এক হতভাগী মাতা হওয়ার যন্ত্রণার মধ্যেও অন্তত এইটুকু সান্ত্বনা তোর মায়ের থাকবে যে সে তোকে গর্ভে ধারণ করেছিল।”
আমি আর কিছু বলতে পারলামনা , শুধু নিজের হাতটা এই মহিয়সী রাজলক্ষ্মীর হাত থেকে আস্তে আস্তে সরিয়ে নিয়ে রথে গিয়ে আবার উঠলাম। আলতো স্বরে শেষবারের মতো বলে উঠলাম “বিদায় মাতা।”

সারথি রথ এগিয়ে নিয়ে চললো সামনের দিকে, হস্তিনাপুরের পাষাণপুরী আর তারমধ্যে বন্দিনী রাজলক্ষ্মীকে পেছনে ফেলে রেখে কুরুক্ষেত্রের ভয়ানক প্রান্তে আবারো ফিরে এলাম আমি। পাষণ্ড জয়দ্রথকে বাঁচানোর জন্য আজ ভয়ানক সূচি ব্যূহ রচনা করেছেন আচার্য। তাকে যেকোন উপায়ে রক্ষা করতে আজ বদ্ধ পরিকর গোটা কৌরব পক্ষ। আর অন্যদিকে অর্জুন ভয়ঙ্কর প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন আজ সূর্য অস্ত যাবার আগে হয় জয়দ্রথকে তিনি হত্যা করবেন, আর নচেৎ নিজে চিতায় আত্মহুতি দেবেন। অর্জুনকে আটকানোর জন্য সর্বশক্তি দিয়ে আজ প্রস্তুত কৌরব বীরেরা। আর সেই দলে আজ নাম লেখাতে হয়েছে এই অকিঞ্চিৎ কৌরব রাজকুমারকেও।
যুদ্ধের শঙ্খ ধ্বনি বেজে উঠলো , অর্জুন আজ কাল ভৈরবের মূর্তি নিয়ে ছুটে আসছে সুচিব্যূহের অন্তরে। না আজ আমি অর্জুনের সামনাসামনি হবোনা , আজ এক ব্যথিত হৃদয়ের পিতাকে তার প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বিরত করার প্রয়াস আমি করবোনা। এগিয়ে যাও অর্জুন, যত শীঘ্র সম্ভব এগিয়ে যাও ওই পাপাত্মা জয়দ্রথকে তার পাপের শাস্তি দিতে। অর্জুনের রথের পাশ দিয়ে সরে গেলাম আমি, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য আমার দৃষ্টি পড়লো বাসুদেবের উপর। সোজাসুজি তার চোখের দিকে তাকালাম আমি, মনে পরে গেলো আমার হতভাগী মায়ের বলা প্রতিটি শব্দ। জানিনা কি ছিল আমার দৃষ্টিতে, কিন্তু দেখলাম এক মুহূর্তের মধ্যে বাসুদেবের চির পরিচিত হাসিমাখানো দৃষ্টি মুছে যেতে। তার জায়গায় স্থান পেলো, এক অদ্ভুত উদার দৃষ্টি, জানিনা কি মাখানো আছে সেই দৃষ্টিতে , ক্ষমা প্রার্থনা ,না এক উদাত্ত আহ্বান ,না কি এক নতুন যুগের স্বপ্ন। কিন্তু সেই দৃষ্টিতে যেন হারিয়ে গেলাম আমি , …………..
অর্জুনের তীব্র স্বরে বাস্তবের মাটিতে ফিরে এলাম ,পার্থ বলছে পার্থ সারথীকে ” কি হলো কেশব, এগিয়ে চলো ওই পামর জয়দ্রথের দিকে, বিকর্ণ তো আমাদের পথ আড়াল করে নেই। ”
পার্থসারথি কপিধ্বজ রথ নিয়ে এগিয়ে গেলেন ব্যূহের আরো অভ্যন্তরে।
কিছু সময় পর সাত্যকি ও এগিয়ে গেলো তার গুরুর সহায়তায়।
এবার এগিয়ে আসছে মধ্যম পান্ডব তার হাতের কালদন্ড রূপ গদা নিয়ে। আমি নিজে থেকেই এগিয়ে গেলাম তার সামনে ,তার পথ রুদ্ধ করলাম।
ভীম বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠলো “সরে যাও বিকর্ণ , তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে আমি চাইনা । আমি ভুলে যাইনি কিভাবে সেই দিন সেই সভায় তুমি দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষার জন্য সবার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলে। তুমি একমাত্র ধর্মপরায়ণ কৌরব রাজকুমার, তোমার রক্তে আমি আমার হাত রাঙাতে চাইনা , চলে যাও আমার সামনে থেকে। ”
আমি সুদৃঢ় স্বরে বলে উঠলাম “সেই দিন সেটা ছিল আমার ধর্ম ,আর আজ আমার অগ্রজের জন্য এই মহা যুদ্ধে প্রয়োজনে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া আমার ধর্ম। এগিয়ে এস হে পবন পুত্র ,এই গান্ধারী নন্দন তোমাকে ধর্ম যুদ্ধে আহ্বান করছে। ”
ভীম উদাত্ত স্বরে বলে উঠলো “তবে ওঠাও তোমার অস্ত্র। ”
আমি ধীরে ধীরে আমার রথের একপ্রান্তে রাখা গদা তুলে নিলাম।
বৃকোদর বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলো “তুমি তো চিরকালই ধনুর্বানেই বেশি স্বচ্ছন্দ বিকর্ণ। কৌরব রাজকুমারদের মধ্যে ধনুর্বানে তোমার খ্যাতিই সর্বাধিক। তবে আজ সেই ধনুর্বান পরিত্যাগ করে গদা কেন তুলে নিচ্ছ তুমি ?”
আমি কিভাবে বোঝাবো এই সরল মনের মধ্যম পাণ্ডবকে ,যে আজ এই গান্ধারী নন্দন ,যুদ্ধের জন্য আসেনি এই রণক্ষেত্রে, বরং এসেছে নিজের আত্মহুতি দিয়ে মুক্তির সন্ধানে। আর সেই মুক্তি সে পেতে চায় এই চির সরল শিশুর মতো উদার মনের মানুষটির হাত দিয়ে।
অল্প হেসে বলে উঠলাম “ধরে নাওনা বৃকোদর ,যে তোমার গদা যুদ্ধের যে খ্যাতির কথা শুনেছি তা নিজের চোখে পরখ করার সাধ জন্মেছে একবার। প্রমান করো হে বৃকোদর যে তুমি এক শ্রেষ্ঠ গদাধারী , যে তুমি সত্যি হলধর এবং দ্রোণাচার্য্যের কাছ থেকে নিয়েছো এই গদা শিক্ষা , সাবধান বৃকোদর। ”
গদা হাতে রথ থেকে নেমে আমি এগিয়ে গেলাম মধ্যম পাণ্ডবের দিকে , সরল মনের পবন পুত্রও তার কাল গদা নিয়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তার হাতের এই কাল গদা আজ আমাকে মুক্তি দেবে আমার এই অভিশপ্ত জীবন থেকে।
শেষবারের মতন আমার মহিয়সী মাকে স্মরণ করে গদা হাতে নিয়ে আমি এগিয়ে গেলাম নিজের মুক্তিদাতার দিকে। ….

………………………………………..(সমাপ্ত)…………………………………..

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত