গল্প চাচ্ছো, গল্প? কোন রঙের গল্প চাও কালো গল্প, ধূসর গল্প, নীল গল্প, লাল গল্প নাকি সবুজ গল্প? হোঁচট খেলে? গল্পেরও কিন্তু রং আছে। কষ্ট হচ্ছে বুঝতে? বাদ দাও তবে।
এবার বলো- কত পৃষ্ঠা গল্প চাও, কত রিম কাগজে চাও? ও আচ্ছা, দুঃখিত।
তাহলে বলো, কোন ধাঁচের গল্প চাও? মিথ্যাকে সত্য, সত্যকে মিথ্যা বলে চালিয়ে দেবার গল্প? তিলকে তাল বানানোর গল্প? ভুলিয়ে-ভালিয়ে বিক্রি করে খাওয়ার গল্প? উপরে তোলা বা হ্যাঁচকা মেরে নীচে নামানোর গল্প? ট্র্যাজিক, রোমান্টিক, সামাজিক, যাপিত জীবন ইত্যাদি? যৌনআনন্দ লাভের জন্য পাতা ফাঁদের গল্প? নাকি হারানোর গল্প, বেদনার গল্প, লক্ষ্য পূরণের গল্প, হতাশার গল্প, ব্যর্থ প্রেমের অব্যর্থ গল্প, বিষ পানের তিক্ত গল্প, আলো জ্বালানোর গল্প? হাই পাওয়ার ফুল ৪০টা ঘুমের বড়ি খেয়েও না মারা যাওয়ার গল্প? আগুনের শিখায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে, বাতাসে ছাই উড়ানোর গল্প চাচ্ছো? চলবে…?
আচ্ছা, ঠিক আছে, এটাও বাদ দাও। এবার বলো- কোন ভাষায় গল্প চাও? বাংলা, ইংরেজি, ফারসি, উর্দু? শেষ সুযোগ…!
ফুপিয়ে, আকাশ দীর্ণবিদীর্ণ করা কাঁদা, প্রতারণাজাত অট্টহাসি, দিলখোলা হাসির গল্প চলবে? বিষপান করে নীল হয়ে সবুজ দুর্বার বিছানায় ছটফট করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের গল্প?
ওহ্, ঠিক বুঝতে পারছি না, কোন গল্প চাচ্ছো?
আচ্ছা ঠিক আছে আমি বলছি… আমি জানি না এটি হাসির কিনা!তবে এটি হাসির আড়ালে বিষাদের গল্প!!
আমার এক সদা হাস্যোজ্জল প্রিয় মানুষের গল্প। হাস্যরস প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হলেও যান্ত্রিক জীবনের বেড়াজালে হারিয়ে যায় নির্মল হাসি। আপনার মলিন মুখে হাসি ফোটানোর জন্য অনেকে অনেক কিছু করে। কেউ আপনার প্রিয় জিনিস আপনার সামনে এনে হাজির করে, অনেকে মজার মজার কৌতুক বলে, কিন্তু একদম নির্বাক থেকে নির্মল আনন্দ দিতে সবাই পারে না। কিছু মানুষ আছেন যারা টুঁ শব্দটি উচ্চারণ না করেও আপনাকে হাসিয়ে যাবে, বলে যাবে না বলা অনেক কথা। জানাবে অনেক সত্য কিংবা হাসতে হাসতেই আপনি জানবেন অনেক ব্যথাতুর গল্প। আপনি হয়তো এই হাসির ছলে কোনো জটিল বিষয়ে সচেতনও হবেন। এসব মানুষকে আমরা কমেডিয়ান, ক্লাউন অনেক কিছু বলে থাকি। অনেক সময় সমাজে তাদের অবদান খুব অল্প পরিসরেই জেনে থাকি।
আজ এমনই একজন মূকাভিনেতার কথা জানব, যিনি নিজের চোখের পানি আড়াল করে শুধু মূকাভিনয়ের মাধ্যমে অগণিত মানুষের হাসির খোরাক হয়েছেন, জায়গা করে নিয়েছেন হৃদয়ে। আমাদের আজকের জিরো থেকে হিরো “স্যার চার্লেস স্পেন্সার চার্লি চ্যাপলিন”। ১৮৮৯ সালের এই দিনে, দক্ষিণ লন্ডনের এক ছোট্ট ঘরে জন্ম হয় স্যার চার্লেস স্পেন্সার চার্লি চ্যাপলিনের। যদিও এটা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। বাবা-মা দু’জনই অন্যদের আনন্দের খোরাক হিসেবে কাজ করতেন তখন, অর্থাৎ তারা দু’জনেই মিউজিক হলে গান গাইতেন। কিন্তু তারা তেমন জনপ্রিয় ছিলেন না। চার্লির মা ছিলেন এক মুচি পরিবারের সন্তান। চার্লি ছিলেন তার মায়ের দ্বিতীয় ঘরের সন্তান। যেহেতু বাবা-মা দু’জনই বিনোদন জগতে কাজ করতেন সেহেতু স্বাভাবিকভাবেই চার্লির ভেতরও শৈল্পিক দিকগুলো কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। কিন্তু পরিবারের আয় যৎসামান্য ছিল। তার ওপর বাবা-মা আলাদা থাকতেন। অভাবের তাড়নায় মাত্র সাত বছর বয়সে গৃহকর্মীর কাজ শুরু করেন চার্লি। কিন্তু জীবনে বিপর্যয় আরও বাকি ছিল। চার্লির বয়স যখন নয় বছর তখন তার মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। চার্লি এবং তার সৎভাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় চার্লির বাবার কাছে। চার্লির বাবা ছিলেন বিভিন্ন নেশা জাতীয় জিনিসে আসক্ত। ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনা তিনি কোনোভাবেই করতে পারতেন না।
দিনের পর দিন দুই ভাই একা ঘরে খাবার-দাবার ছাড়া আটকা পড়ে থাকতেন। কখনও খাবারের খোঁজে পথে পথে ঘুরতেন, পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে থাকতেন। কখনও কখনও অন্য পথশিশুদের সঙ্গে মনোমালিন্য হতো, হতো হাতাহাতি। তাই সরকারিভাবে বাচ্চাদের দেখভালের জন্য সরকারি শিশু সদনে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। এবং ঠিক তার দুই বছর পর, চার্লির বাবা মারা যান। সম্পূর্ণ অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন দু’ভাই। বড় ভাই নৌবাহিনীতে যোগ দিতে চলে গেলে আরও একা হয়ে পড়েন চার্লি। ভবঘুরের মতো পথে পথে ঘুরতে শুরু করেন। বিভিন্ন বোহেমিয়ান দলের সঙ্গে চলাফেরা বাড়তে থাকে। বাবার মৃত্যুর এক বছর পর যোগ দেন ‘এইট ল্যাংকাশায়ার লেড’ দলে। দলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে করতে শুরু করেন গান, নাচ। এরপর যুক্ত হয়ে পড়েন কমেডিয়ান দলের সঙ্গে। পাশাপাশি করতেন মূকাভিনয়।
১৯১৩ সাল, নিউইয়র্ক মোশন পিকচার কোম্পানি সাপ্তাহিক ১৫০ ডলারের ভিত্তিতে চার্লির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। বলা যেতে পারে ভাগ্যের লিখন, এরপরের বছর বেশ ক’টি ছবি মুক্তি পায় চার্লির। রাতারাতি পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। পেছনের দুঃখের সময়গুলো ম্লান হতে শুরু করে। ১৯১৫ সালে চার্লি স্বয়ং পরিচালনা, চিত্রনাট্য এবং গল্প লেখার কাজও শুরু করেন।
১৯১৮ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে নয়টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে ফেলেন তিনি। এবং সেগুলোর বেশিরভাগই দর্শকজনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯২৫ সালে নিজের প্রযোজিত ছবির জন্য পান একাডেমি অ্যাওয়ার্ড। ১৯৩৬ সালে মুক্তি পায় অন্যতম সাড়া জাগানো ছবি ‘মডার্ন টাইমস’। ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের কারণে বিশ্বের পরিবর্তন সম্পূর্ণ নির্বাক ছবিতে শুধু অভিব্যক্তির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়।
১৯৫২ সালে মুক্তি পায় লাইম লাইট নামে আত্মজীবনীমূলক ছবি। এটিও দর্শকদের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। কিন্তু এত শত খ্যাতির পরও পারিবারিক জীবনে তিনি উলেল্গখ করার মতো সুখী ছিলেন না। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি চারবার সংসার জীবনে পা রাখলেও শুধু শেষ পরিণয়টিই শেষ পর্যন্ত তার অন্তিম মুহূর্তে পাশে ছিল।
১৯৭৭ সালে, সদা হাস্যোজ্জ্বল এই প্রিয় মানুষটি চলে যান না ফেরার দেশে। একাধারে অভিনেতা, গায়ক, চিত্রনাট্যকার, গল্প লেখক, পরিচালকসহ আরও বিভিন্ন বিশেষণে বিশেষিত এই মানুষটি একটি দুর্বিষহ শৈশব পার করে এলেও জীবনের কাছে কখনও হার মানেননি। এজন্যই হয়তো তিনি পেয়েছেন সাধারণ মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। ভূষিত হয়েছেন বিভিন্ন সম্মানজনক পদকে। অনেক বেশি জীবনমুখী ছিলেন বলেই হয়তো আজও তাকে আমরা স্মরণ করি। অনেক বেশি প্রাণবন্ত ছিলেন বলেই হয়তো এই মহৎপ্রাণ বলে গিয়েছেন, ‘আমার জীবনে অনেক সমস্যা আছে কিন্তু আমার ঠোঁট তা জানে না, তাই সে সবসময় হাসতে থাকে।’ হ আদর্শ..!