মুজিবনগর সরকার: যে সরকার ছিল সময়ের অনিবার্য দাবি

মুজিবনগর সরকার: যে সরকার ছিল সময়ের অনিবার্য দাবি

জ্বলে পুড়ে ছাড়-খার তবুও মাথা নোয়াবার নয়; এমন এক অপরাজেয় মনোভাব ইতিপূর্বেই বাংলার জনগণের অন্তরের অন্তঃস্থলে জাগ্রত করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে অগ্রসর হওয়া বাংলার জনগণের অধিক শক্তি সঞ্চার করে রণাঙ্গনে একত্রিত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার মনোবলকে প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেয় মুজিবনগর সরকার। স্মৃতি হাতড়ে আজ ফিরে যাব সেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে, জানবো, কেন মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল এবং কীভাবে সে সরকার সময়ের অনিবার্য দাবি হয়ে উঠেছিল।

মুজিবনগর সরকার গঠনের নেপথ্যের কারণ

১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে লাভ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের দীর্ঘ ২৩ বছরের ইতিহাসের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে জনমনের অসন্তোষ প্রকাশ পায় নির্বাচনের এই ফলাফলের মাধ্যমে। অন্যদিকে, ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে শুরু হয় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নানা টাল বাহানা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র জনগণের উপর ইতিহাসের বর্বর গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি জান্তারা।

সে কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হবার পূর্বেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়্যারলেস মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পর থেকে ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করে প্রেক্ষাপট। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের জনগণের প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তবে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিয়ে এই প্রতিরোধযুদ্ধকে প্রবল যুদ্ধে রূপ দিতে প্রয়োজন ছিল একটি সরকার ব্যাবস্থার। সেই প্রেক্ষাপট থেকেই মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনা করার লক্ষ্যে গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়।

তবে বঙ্গন্ধুর অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপ্রধান এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন তাজউদ্দীন আহমেদ। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ঘোষণা দিয়ে ভাষণ প্রদান করেন। প্রবাসে মুজিবনগর সরকার গঠিত হলেও সরকারের মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ তখনও বাকি ছিল।

মুজিবনগরে প্রথম সরকারের শপথগ্রহণ স্থানে ১৯৭৮ সালে নির্মিত হয়েছে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ

বৈদ্যনাথতলা থেকে মুজিবনগর সরকারের পথচলা

১৭ই এপ্রিল, ১৯৭১, শনিবার মেহেরপুরের অখ্যাত গ্রাম ভবেরপাড়া। সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ভবেরপাড়ার বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। ভবেরপাড়ার অম্রকাননের তিন দিকে ভারতের ভূখণ্ড থাকলেও, পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান হামলার ঝুঁকি থেকে স্থানটি পুরোপুরি মুক্ত ছিল না। যে কোন মুহুর্তে পাকিস্তানি বাহিনীর বিমান হামলার ঘটনা ঘটতে পারে, ঘটে যেতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত যে কোন ঘটনাই; এমন এক অজানা শঙ্কার মুখে সেদিন মেহেরপুরের ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে সাদামাটা পরিবেশে শপথ নিয়েছিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার।

মুজিবনগরে শপথগ্রহণের কারণে সে সরকারও পরিচিতি পায় মুজিবনগর সরকার নামে। মুক্তিযুদ্ধকালে এই মুজিবনগরই হয়ে উঠেছিল বাংলার অস্থায়ী রাজধানী।

মাথায় এক অজানা শঙ্কা থাকলেও, মনে ছিল অদাধ দেশপ্রেম। যে কারণে সকল শঙ্কাকে উপেক্ষা করে বেলা ১১ টায় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হয়। এই অনুষ্ঠানের স্থায়িত্ব ছিল ৪৫ মিনিট। অনুষ্ঠানে হাজারো কণ্ঠের সম্মিলিত সুরে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে প্রথমবারের মতো শোনা যায়, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। একইসাথে মানচিত্র খচিত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। শপথ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর পূর্বেই বাংলাদেশকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বালাদেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তাই এই সরকারকে প্রবাসী, বিপ্লবী, অস্থায়ী কিংবা মুজিবনগর সরকার—যে নামেই ডাকা হোক না কেন তা ছিল ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের চিপ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য এবং সেনাপ্রধানকে শপথবাক্য পাঠ করান তিনি। শপথগ্রহণের পরপরই সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা এবং আনসার সদস্যরা নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের গার্ড অব অনার প্রদান করে।

বাম দিক থেকে ডানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহাম্মদ, খন্দকার মোশতাক আহম্মদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কর্ণেল এম, এ, জি, ওসমানী

শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত নানা দেশের বহু সাংবাদিক, গণপরিষদের সদস্য ও বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সেদিন তার ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। তাঁর ভাষণের শেষাংশে তিনি বলেছিলেন,

বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম, বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। কেননা, আর কোন জাতি আমাদের চাইতে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করেনি। জয়বাংলা।

প্রধানমন্ত্রী তার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দেশী বিদেশী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। আর এভাবেই বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার নির্দেশিত পথেই মুক্তিযুদ্ধকে নেতৃত্ব দিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সূচনা হয়।

বিশ্বজুড়ে পাকিস্তানি জান্তারা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিল, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে ভারতের মাটিতে বসে। এই প্রচারণার অসাড়তা প্রমাণিত হয়ে যায় যখন মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশের মাটিতে শপথ গ্রহণ করে। তাই এই প্রকাশ্য শপথ গ্রহণ ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ বা টার্নিং পয়েন্ট।

মুজিবনগর সরকারের আত্মপ্রকাশের পর পরই দখলদার পাক হানাদার বাহিনী আটতে থাকে অস্থায়ী রাজধানী মেহেরপুর মহকুমা দখলের পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনার জের ধরে ২১ ও ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী সেখানকার ইপিআর ক্যাম্প দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে বটে, তবে তারা ব্যর্থ হয়। এরপরেও পাক বাহিনী থেমে যায় নি পরে আরও কয়েকবার ইপিআর ক্যাম্প দখলে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। এমন এক প্রেক্ষাপটে বাধ্য হয়ে একপর্যায়ে মুজিবনগর প্রশাসন সুবিধামতো মুক্তাঞ্চলে চলে যায়। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে এই সরকারের সদরদপ্তর কলকাতাতে স্থাপন করা হয়। এর প্রধান কারণ ছিল নিরাপত্তা ও মুক্তিযুদ্ধে নির্বিঘ্নে নেতৃত্ব প্রদান।

মুজিবনগর সরকার

মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম ও পরিকল্পনা

মুজিবনগর সরকার গঠনের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ প্রবল যুদ্ধে রূপ নিতে বেশি সময়ের প্রয়োজন পরে নি। এই সরকারের অধীনে থাকা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় মুক্তিযুদ্ধকে সুসংগঠিতভাবে পরিচালনার সুবিধার কথা বিবেচনা করে সমগ্র বাংলাদেশকে ১৯৭১ এর জুলাই মাসের মধ্যেই ৯টি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। এর প্রধান কারণ ছিল বেসামরিক প্রশাসনকে অধিক গণতান্ত্রিক করা এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা। মুজিবনগর সরকারের অধীনেই সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ সমগ্র বাংলাদেশকে চূড়ান্তভাবে ১১টি অঞ্চলে ভাগ করে পরিচালিত হয় সশস্ত্র সংগ্রাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী রাষ্ট্র ভারতের সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে এই সরকারের ভূমিকা ছিল অনন্য।

অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার পাশাপাশি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার এনং যথাসম্ভব মিত্র রাষ্ট্রদের থেকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা চালানো হতো এই সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে। এছাড়াও, যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যয়, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত সম্পদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা, বন্ধুপ্রতিম দেশসমূহ থেকে প্রাপ্ত অর্থ সাহায্যের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা ইত্যাদি কাজ শৃঙ্খলার সাথে পরিচালনা করে গেছে অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যুদ্ধের একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে নিয়মিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষদের অবিরাম উৎসাহ জোগানো, পত্র-পত্রিকা থেকে শুরু করে পুস্তিকা, লিফলেট ইত্যাদি নিয়মিত প্রকাশের মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে বিভিন্ন খবরাখবর পৌছানো সকল কাজ করে গেছে তথ্য মন্ত্রণালয়।

পাশাপাশি ত্রাণ বিতরণ, শরণার্থী ও দেশের অবস্থানকারী নাগরিকদের চিকিৎসা-সুবিধার জন্যেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন তা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে গেছে মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। মোট কথা, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার নির্দেশিত পথ ধরে মুজিবনগর সরকার দক্ষ হাতে মুক্তির সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন। সরকারের দক্ষ নেতৃত্বগুণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হানাদার বধে; যার পরবর্তী ঘটনা কারো অজানা নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা অর্জন।

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত