মুক্তিযুদ্ধ: ১৬ ডিসেম্বর কেন অস্ত্র জমা দেয়নি পাকিস্তানি সৈন্যরা?

মুক্তিযুদ্ধ: ১৬ ডিসেম্বর কেন অস্ত্র জমা দেয়নি পাকিস্তানি সৈন্যরা?

১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর। ভারতের কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার এক খবরে বলা হয়, ,‘অফিসারস হুশিয়ার! হাতিয়ার বাহার জমিন! পাকিস্তানি স্থল বাহিনীর মেজর জেনারেল জামসেদ কম্যান্ড দেবার সঙ্গে আজ বেলা ১০টা ৪৫ মিনিটে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের গলফ মাঠে সবুজ ঘাসের ওপর ৪৭৮ জন পাকিস্তানি অফিসার তাদের অস্ত্রগুলি সাজিয়ে রাখলেন। তারপর এক পা পিছিয়ে গিয়ে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়ালেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসার গিয়ে অস্ত্রগুলি কুড়িয়ে নিলেন। নানান ধরনের অস্ত্র, পিস্তল, রিভলবার, এলএমজি, স্টেনগান।

১৯ ডিসেম্বরের এই ঘটনা সে সময় সমসাময়িক সকল সংবাদমাধ্যমেই এসেছিল। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানের আত্মসমর্পণের দিনই কেনও অস্ত্র সমর্পণ করলো না পাকিস্তানিরা? কেনও তিনদিন পর করতে হলো সেটা?

১৬ ডিসেম্বরের সেই দিনটায় ফিরতে চাই আমরা। রেসকোর্স ময়দানে যাওয়ার পথটায় লাখো লাখো জনতা ভীড় করে ছিল রাস্তার দুই পাশে। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আর পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজিকে বহনকারী গাড়ি যখন জনতার ভিড় ঠেলে রেসকোর্স ময়দানের আত্মসমর্পণ স্হলের দিকে এগোচ্ছিল, তখন একাধিকবার সেই বহরের গতি মন্থর হয়ে যায়। ক্ষিপ্ত জনতা নিয়াজিকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। নিয়াজিকে তাদের হাতে তুলে দিতে বারবার চিৎকার করছিল সবাই। লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে মারার শাস্তি জনতাই দিতে চেয়েছিল তাকে। জনতার এই ক্রোধের মুখোমুখি হওয়ার ভয়টাই জেঁকে বসেছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের মনে।

আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করছেন নিয়াজি।

সেদিন আত্মসমর্পণের আগে-পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েই সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা ছিল। তাদের মধ্যে এই আশন্কাটাই বদ্ধমূল হয়ে ওঠে যে,  নয় মাসের গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের প্রতিশোধ ক্রুদ্ধ মুক্তিবাহিনী আর জনতা বিজয়লগ্নে এসে নিয়ে নিতে পারে।

১৬ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকা সেনানিবাসে পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে মিত্রবাহিনীর মেজর জেনারেল জ্যাকব আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়াজির মধ্যে আত্মসমর্পণ চুক্তি নিয়ে যখন দর কষাকষি চলছে,  ঢাকায় তখন পাকিস্তানি সৈন্য আর নানা রকম আধাসামরিক বাহিনীর লোকজন মিলিয়ে প্রায় ৯৪ হাজার সদস্য আটকা পড়েছে।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব তাঁর ‘স্যারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব আ নেশন বইয়ে লিখেছেন, পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ না করে সেনানিবাসে তাঁর সদর দপ্তরেই আত্মসমর্পণের ব্যাপারে চাপাচাপি করছিলেন। এর পেছনে  জনসমক্ষে অবমাননা এড়ানোর মত কারণ থাকলেও বিশ্লেষকদের মতে নিয়াজির সে সময় নিজেদের পিঠ বাঁচানোর চিন্তাও কাজ করেছিল। জনতার ক্রোধের মুখে পড়তে চান নি তিনি। কিন্তু সেটা হতে দেয় নি যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। ফলে সেই আশন্কাটাই সত্যি হতে দেখেছিলেন নিয়াজী। জনতা ঘিরে ধরতে চেয়েছিল তাকে।

পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের খবর পত্রিকায়।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকবের বই থেকে আরও জানা যায়,  “আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনায় সাব্যস্ত হয়, ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হলেও নিয়াজি ও তার বাহিনী তখনই অস্ত্র সমর্পণ করবে না। জেনারেল জ্যাকব ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের অস্ত্র রাখার অনুমতি দেন। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধবন্দী হলেও ঢাকা সেনানিবাসে তাদের অবস্থান ছিল সশস্ত্র। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি।

বীর প্রতীক হাবিবুল আলম। যুদ্ধকালীন দুই নম্বর সেক্টরের গেরিলা এবং কে ফোর্সের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এই মুক্তিযোদ্ধা সে সময় ছিলেন ঢাকায়। তিনি বলছেন, “পাকিস্তানি সৈন্যদের এই ভীতি খুব অবাস্তব ছিল না। তারা জানত, তাদের কৃতকর্ম বাঙালিরা কখনো ক্ষমা করবে না। পাকিস্তানি বাহিনীকে সামনাসামনি পেলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আস্ত রাখত না।

তিন দিন পর ১৯ ডিসেম্বর ঢাকা সেনানিবাসের গলফ মাঠে অস্ত্র সমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩০ হাজার সৈন্য। পাকিস্তানিদের পক্ষে এ সময় নেতৃত্ব দেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। মিত্রবাহিনীর পক্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল সগৎ সিং অস্ত্র গ্রহণ করেন।

ঢাকা সেনানিবাসে জে. রাও ফরমান আলীর (ডান থেকে দ্বিতীয়) নেতৃত্বে অস্ত্রসমর্পণের পর কোমরের বেল্ট খুলে রাখে পাকিস্তানি সেনারা l 

আনন্দবাজারের সেই প্রতিবেদনটিতে আবার ফিরে যেতে চাই। প্রতিবেদনে সাংবাদিক পার্থ সেনগুপ্ত লিখেছেন,  ‘ অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে রাও ফরমান আলি বিমর্ষ থাকলেও তার সৈন্যরা মনে মনে খুশিই ছিলেন। কারণ অস্ত্র সমর্পণ মানে এখন তাঁরা জেনেভা কনভেনশনের আওতায় এলেন। বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ভয় দূর হয়েছে।

জেনারেল নিয়াজি এই অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে ছিলেন না। আগের দিন তাঁকে হেলিকপ্টারে করে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে সরিয়ে নেওয়া হয় বলে সে সময়ের সংবাদমাধ্যমে এসেছে। কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, অস্ত্র সমর্পণের পরও তিনি কিছু পাকিস্তানি সৈন্যকে সেনানিবাস এলাকায় অস্ত্র হাতে ঘোরাফেরা করতে দেখেছেন।

যুগান্তর-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা গ্যারিসনে প্রায় এক হাজারের মতো অফিসার থাকলেও সংক্ষিপ্ত সেই অনুষ্ঠানে অস্ত্র সমর্পণ করেন চার শর কিছু বেশি অফিসার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্বকারী জেনারেল সগৎ সিং তাঁর ভাষণে বলেন, তাদের অস্ত্র সমর্পণ করতে বলাটা ‘কষ্টকর’। তবে প্রত্যেক খেলারই কিছু নিয়ম আছে, যুদ্ধেরও আছে।

সগৎ সিং জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীরা কী কী সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার ভোগ করবেন, তা ঘোষণা করেন। আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি জেনারেল এ.এ.কে. নিয়াজিকে পরদিন ২০ ডিসেম্বর বিশেষ বিমানযোগে ঢাকা থেকে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয়। তার সঙ্গে সে সময় ছিলেন আরেক বন্দি, প্রাক্তন গভর্নরের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি।

ভারতের ইস্টার্ন কম্যান্ডের মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ১৯ ডিসেম্বর  পর্যন্ত আটক পাকিস্তানি সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৫ হাজার ৬৭০ জনে। এছাড়া চট্টগ্রাম গ্যারিসনে আটক ছিল আরও আট হাজার সৈনিক।পশ্চিম পাকিস্তানি আমলা-কর্মচারি, পুলিশ ইত্যাদির সংখ্যা ছিল প্রায় হাজার বিশেক। এদের পরবর্তী এক মাসের মধ্যে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়।

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত