মুক্তিযুদ্ধ: কলমযোদ্ধাদের অবদান কতটা?

মুক্তিযুদ্ধ: কলমযোদ্ধাদের অবদান কতটা?

স্বাধীনতা একটি দেশের অনেক বড় অর্জন। প্রতিটি মানুষ স্বাধীনতাকামি। দাসত্ব এবং বন্দিত্ব কারোরই কাম্য নয়। একটি দেশ কখনও পরাধীনতার শেকল ভেঙে এক দিনেই মুক্তির স্বাদ পায় না। এর জন্য প্রয়োজন হয় বহুদিনের শ্রম। এই শ্রমের শ্রমিক শুধু সেই দেশের মুক্তি বাহিনী নয়। বরং সবাই, সবার আত্মনিয়োগই এনে দেয় স্বাধীনতা। তেমনি আমাদের দেশের একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বহু পূর্ব থেকেই যারা যোদ্ধাদের উজ্জীবিত করে গিয়েছেন তারা হচ্ছেন লেখক, সাহিত্যিক গণ। আজকের বিজয় দিবসে তাদের স্মরণেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।

পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন কবি সাহিত্যিকগণও। তাদের ক্ষুরধার কলমের শক্তি মুক্তিবাহিনীর রাইফেলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।

সেই সাহিত্যিকগণের মধ্যে সবার আগে যার নাম উচ্চারিত হয় তিনি হচ্ছেন জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম। তিনি ২৫ মে ১৮৯৯ সালে পশ্চিম বঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। তাকে আমরা বিদ্রোহী কবি হিসেবেও চিনি। কিন্তু কেন তিনি বিদ্রোহী? তিনি কি তৎকালীন সরকার বিরোধী কোন বিদ্রোহী দলের নেতা ছিলেন? না, তিনি সেরকম কোন দলের সদস্যও ছিলেন না, তবুও তিনি বিদ্রোহী, বিদ্রোহী অপবাদে তাকে কারাবরণও করতে হয়েছে বহুবার। তাই তো তার “রাজবন্দির জবানবন্দি প্রবন্ধে বলেন, আমি মরব, রাজাও মরবে, কেননা আমার মত অনেক রাজবিদ্রোহী মরেছে। আবার এমনি অভিযোগ আনয়নকারী বহু রাজাও মরেছে। কিন্তু কোন কালেই কোন কারণেই সত্য প্রকাশ নিরুদ্ধ হয়নি, তার বাণী মরেনি।”

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিত্র।

কাজী নজরুল ইসলামের লেখনী এমনই ক্ষুরধার ছিল যে সবার রক্ত টগবগিয়ে উঠত। সেই যে “অগ্নীবিণা” রচনা করলেন। সেখানকার প্রতিটি কবিতায় স্বপ্ন বুনেছেন একটা স্বাধীন দেশের। এছাড়াও তার “সাম্যবাদী প্রবন্ধ গ্রন্থে তিনি তৎকালীন সরকারের তুমুল সমালোচনা করে সমতার অহ্বান জানান। কাজি নজরুল ইসলাম। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে “দেশাত্মবোধক গান” গুলো। স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য এই গানগুলো অনুপ্রেরণা জোগায় সকল ধর্ম বর্ণের মানুষের। রেডিওতে নিয়মিত প্রচারও হত সেসব গান।

তৎকালীন সময়ে “ধুমকেতুর পত্রিকা”র মত একটা দরাজ পত্রিকার সম্পাদনা করাও যথেষ্ট কঠিন ছিল। কিন্তু তিনি দমবার পাত্র ছিলেন না কোনভাবে। তাই তো তিনি বলে উঠেন, “সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেননা ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীনে থাকবে না।

ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশির মোড়লী অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এদেশে মোড়লী করে দেশকে শ্মশান ভূমিতে পরিণত করেছেন তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে বোঁচকা পুটুলি বেঁধে সাগর পাড়ে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তারা শুনবেন না। তাদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদের এই প্রার্থন করার, ভিক্ষে করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে এরকমই ছিলো এই কলম যোদ্ধার যুদ্ধের স্বরূপ। আপোষহীন এই বিদ্রোহী কবি ২৭ আগস্ট ১৯৭৬ সালে ঢাকা জেলায় ইন্তেকাল করেন।

কাজী নজরুল ইসলামের পরেই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য যার নাম আসে তিনি হচ্ছেন, কবি শামসুর রাহমান। তার কবিতা গুলো এখনো মর্মে স্পর্শ করে যায়। আর সেই সময়ের উত্তপ্ত পরিস্থিতে এসব কবিতা লেখা সত্যিই দেশের মানুষকে সচেতন করে তোলে, একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের কল্পনা করতে সাহায্য করে, তার লেখা, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা, বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট সন্ত্রাসবন্দী বুলেটবিদ্ধ দিন-রাত্রি ‘স্বাধীনতা তুমি সহ আরও অনেক কবিতা।

কবি শামসুর রহমানের স্থিরচিত্র।

কবি শামসুর রহমানের লেখা বিখ্যাত কবিতা

“স্বাধীনতা তুমি”র কিছু অংশ-

“স্বাধীনতা তুমি,

রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।

স্বাধীনতা তুমি

কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো

মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা- “

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস লিখে তৎকালীন সময়ে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান। এই বিশিষ্ট লেখক ২রা জানুয়ারি ১৯১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার লেখা ‘জাহান্নাম হইতে বিদায় নেকড়ে অরণ্য দুই সৈনিক জলাঙ্গী বিখ্যাত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস। যা বর্তমানের আমাদের মত তরুণ প্রজন্মকেও মুক্তিযুদ্ধের স্বরূপ অনুধাবন করতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। লেখক শওকত ওসমান শুরু উপন্যাস লিখেই তার দায়িত্ব শেষ করেন নি। তিনি তার লেখা কবিতার মূর্ছনায় সম্মোহ করে তুলেছিলেন পাঠককে। তার লেখা ‘জন্ম যদি তবে বঙ্গে অপঘাত বিখ্যাত লেখা।

ঔপন্যাসিক শওকত ওসমান এর ছবি।

শুধু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, আটান্নর সামরিক শাসন, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি ইতিহাসের নানা প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ মুদ্রিত হয়েছে শওকত ওসমানের লেখা ও উপন্যাসগুলোতে। এই বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক ও কলামিস্ট ১৪ই মে ১৯৯৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আরেক নাম যিনি দেশের স্বাধীনতা কামনা করে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তার লেখা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছোটগল্প গুলোর তুলনা কেবল তিনিই। এই প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক ১২-ই ফেব্রুয়ারী ১৯৪৩ সালে গাইবান্ধা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় তিনি রচনা করেন বহু গল্প। আর তার রচিত গল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, রেইনকোট অপঘাত। তিনি তার জীবনে “বাংলা একাডেমি পদক ও একুশে পদক লাভ করেন। এই সাহিত্যিক ১৪-ই জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে ঢাকার আজিমপুরে মৃত্যুবরণ করেন।

গল্পকার আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের স্থিরচিত্র।

আমরা নতুন প্রজন্মের পাঠক যারা তারা তো সবাই হুমায়ূন আহমেদের নাম শুনেছি। বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নাট্যকার তিনি। তিনি ১৩-ই নভেম্বর ১৯৪৮ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে তিনিও লিখেছেন বহু লেখা। যার মধ্যে অন্যতম হলো,  ‘শ্যামল ছায়া সৌরভ শীত উনিশ শ একাত্তর ইত্যাদি। তার কলমের জাদুতে তিনি তার জীবদ্দশায় মুগ্ধ করেছেন সকলকে। মুক্তিযুদ্ধের অনেক নাটকও লিখেছিলেন তিনি। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই এই কালজয়ী সাহিত্যিক মৃত্যুবরণ করেন।

নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের চিত্র।

এছাড়াও, সৈয়দ শামসুল হক, জাহানারা ইমাম, সেলিনা হোসেন,রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ইমদাদুল হক মিলন, মুনীর চৌধুরী প্রমুখ সাহিত্যিকগণও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লিখেছেন কালজয়ী গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধগ্রন্থ, গল্পগ্রন্থ সহ ছোট বড় বহু কবিতা।

যেমন লেখিকা সেলিনা হোসেন লিখেন ‘হাঙর নদী গ্রেনেড ও ‘একাত্তরের ঢাকা নামক বিখ্যাত মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস। সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন, ‘পায়ের আওয়াজ নামক বিখ্যাত নাটক। “জলেশ্বরীর গল্পগুলো নীল দংশন ও ‘নিষিদ্ধ লোবান। জাহানার ইমামের বিখ্যাত ‘একাত্তরের দিনগুলো উপন্যাসের নাম কে না জানি আমরা। এছাড়া তার লেখা ‘রায়বাগিনি’ও মুক্তিযুদ্ধের অনেক অভিজ্ঞতা উল্লেখ করা। আর তরুণ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ‘বাতাসে লাশের গন্ধ পাই’ সহ অনেক কবিতা যা আমাদের ইতিহাসের ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

আমাদের দেশীয় সাহিত্য ভাণ্ডার অনেক বিশাল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও আমাদের স্বাধীনতা আমাদের বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডারকে আরও বিশাল করার সুযোগ করে দিয়েছে। যেসব কবি সাহিত্যিক গণ আমাদের গ্রামীণ জনপদের মানুষ গুলোকে আর ছাত্র সমাজকে প্রেরণা যুগিয়েছিল, তাদের কাছেও আমরা সমানভাবে ঋণি, যতটা ঋণি শহিদ ভাইয়ের প্রতি। এজন্যই আল্লামা ইকবাল রহঃ বলেন, “কবিদের হৃদয়ে জাতির জন্ম হয়, আর জাতির উন্নতি কিংবা মৃত্যু ঘটে রাজনীতিবিদদের হাতে। তাই প্রতিটি মানুষ যারা আমাদের স্বাধীন দেশ উপহার দেবার জন্য শ্রম দিয়েছেন তাদের সকলের প্রতি আমার বিনম্র সালাম।

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত