মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী ও পার্বত্য মুক্তিযোদ্ধা: রনাঙ্গনে যারা বাঙ্গালীর মিত্র

মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী ও পার্বত্য মুক্তিযোদ্ধা: রনাঙ্গনে যারা বাঙ্গালীর মিত্র

বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডে বাঙ্গালীর পাশাপাশি আদিকাল থেকে বাস করছে হরেক জাতি। উত্তরবঙ্গ আর ময়মনসিংহ অঞ্চলে আছে সাঁওতাল, হাজং, ওঁরাও, মুন্ডা, গারো; সিলেট অঞ্চলে আছে খাসিয়া আর মণিপুরী, চট্টগ্রাম বিভাগে আছে চাকমা, মারমা, ম্রো, বম, পাংখোয়া, রাখাইন; এগুলি কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। বস্তুত বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকেই অন্তত ৪৫টি জাতি এই ভূখন্ডে বাঙ্গালীদের সাথে বসবাস করে আসছে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পেছনে আছে রক্তাক্ত এক যুদ্ধের ইতিহাস। সংখ্যাগুরু হিসেবে বাঙ্গালীদের ত্যাগ ও অর্জন প্রচুর নজর কুড়িয়েছে স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু বাঙ্গালীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অসংখ্য আদিবাসী-পার্বত্য জাতি যে সশস্ত্র সংগ্রাম চালালেন, সেটা অনেকেই ভুলে গিয়েছেন বা সেভাবে খেয়াল করেন না। আবার চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের পাকিস্তান সমর্থনকে পুঁজি করে অন্তত একটি জাতিকে স্বাধীনতাবিরোধী বলবার চলও লক্ষণীয়।

এই লেখায় আলোচ্য বিষয় হচ্ছে অবাঙ্গালীদের মুক্তিযুদ্ধ। চলুন জেনে নেই নেওয়া যাক সেইসব বীরদের কথা যারা একটি আদর্শ, মুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সাকার করতে অস্ত্র ধরেছিলেন; আহুতি দিয়েছিলেন যুদ্ধের হাড়িকাঠে। উল্লেখ্য, স্থানাভাবে গুটিকয় উদাহরণ এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

মুক্তিবাহিনী

বাংলাদেশের অবাঙ্গালী জনগোষ্ঠী ও সংগ্রাম

ব্রিটিশ শাসনামলেই প্রথম উপমহাদেশের বন-পাহাড় সবকিছুকে বাণিজ্যকরণের সূত্রপাত। বনচারী আদিম অধিবাসীরা এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিরোধ গড়েছেন, ঢেলে দিয়েছেন ছাতির খুন। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়কার সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা কারো অজানা নেই। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে আদিবাসী ও পার্বত্য জাতিগুলি বরাবরই লড়াই চালিয়ে এসেছেন। এর মধ্যে ইংরেজ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে গারো-হাজংদের বিদ্রোহ, গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে হাজংদের টংক বিদ্রোহ, চাকমা দেওয়ান জুম্মা খান কিংবা রাণী কালিন্দীর ইংরেজ বিরোধী সংগ্রাম, সিলেটের ভানুবিল অঞ্চলে মণিপুরী বিদ্রোহ কিংবা উত্তরবঙ্গের সুবিখ্যাত তেভাগা আন্দোলন উল্লেখযোগ্য।

আদিবাসী ও পার্বত্য জাতিরা মুক্তি আর ন্যায়বিচারের প্রশ্নে সোচ্চার ছিলেন। প্রচলিত শিক্ষায় অশিক্ষিত হলেও তাদের সাহস বা ত্যাগকে ছোট করে দেখলে বাংলার ইতিহাস অসম্পুর্ণ থাকবে। ইংরেজদের এদেশীয় দোসর হিন্দু ও মুসলিম জমিদারদের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী কৃষকদের পাশাপাশি তারাও খড়্গহস্ত হয়েছিলেন। পাকিস্তান আমলেও সরকারযন্ত্রের পেষণ অব্যাহত থাকায় স্বভাবতই পূর্ব পাকিস্তানের আদিবাসীদের মনে মুক্তির প্রশ্নটি এসেছিল। যেমনটা এসেছিল অগুণতি বাঙ্গালীর মনে।

মুক্তিসংগ্রামে আদিবাসী ও পার্বত্য জাতি

আদিবাসীদের মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সম্ভবত প্রথম যুদ্ধংদেহী মনোভাব ধরেন সাঁওতালেরা। ১৯৭১ এর ২৩ মার্চ রংপুর সেনানিবাস ঘিরে ধরেন কয়েক হাজার সাঁওতাল। পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে পাকিস্তানী সেনাদল আর সমমনা বাহিনীগুলির মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ ছিল উদ্দেশ্য। দা, ধনুকের মত অস্ত্রের বিরুদ্ধে মেশিনগান তার কাজ করলো, মরলো অগুণতি মানুষ। পরের মাসগুলিতে অন্তত তিরিশ হাজার সাঁওতাল ভারতে আশ্রয় নেয়। তবে তারা বসে থাকেননি। তিন শতাধিক সাঁওতাল প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। সংগঠক সাগরাম মাঝি বা প্লাটুন কমান্ডার বিশ্বনাথ টুডুর অবদান অস্বীকার করা হবে মারাত্মক এক অনাচার।

অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রী কামরুজ্জামানের সাথে সাগরাম মাঝির ছিল বিশেষ সখ্যতা। যদিও স্বাধীন দেশে এসব কল্কে পায়নি। অদ্ভুত সংকীর্ণতার বলি হয়ে আজও মূলধারার বাঙ্গালী সমাজে সাওঁতালদের নিচু জাত হিসেবে ভাববার চল আছে। অথচ এই বীর আদিবাসীরা বরাবরই মুক্তি সংক্রান্ত আন্দোলন-সংগ্রামে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন, ব্যতিক্রম হয়নি স্বাধীনতা যুদ্ধেও।

সাঁওতাল

মিজো যোদ্ধারা লড়েছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে

চাকমাদের কথাই ধরা যাক। সাহসী এই জাতিটি পাকিস্তান আমলে সরকারের বিষনজরে থাকতো, কারণ তারা নাকি ভারতের চর। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হওয়ায় অমুসলিম চাকমারা ধরে নিয়েছিলেন তারা ভারতের অংশ হতে যাচ্ছেন; সেখান থেকেই চরতত্ত্বের উদ্ভব। তাদের প্রতিবাদে কর্ণপাত না করে পাকিস্তান ১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাধের মাধ্যমে লক্ষাধিক চাকমাকে ঘরছাড়া করে ও আবাদী জমির চল্লিশ শতাংশ ডুবিয়ে দেয়।

যুদ্ধের সময় চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় নানাবিধ লোভের বশবর্তী হয়ে পাকিস্তানের পক্ষালম্বন করেছিলেন বটে। কিছু চাকমা বিশেষ করে ত্রিদিব রায়ের ভক্তরা পাকিস্তানপন্থী ছিল; একথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু সেই রাজপরিবারেরই কে কে রায় কিংবা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, অশোক মিত্র প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠনে আর যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। কাজেই এই পার্বত্য জাতিকে ঢালাওভাবে স্বাধীনতাবিরোধী বলা সত্যের চরম অপলাপ।

তবে ত্রিদিব রায়ের কারণে অনেক বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধার কাছেই চাকমাদের একটি নেতিবাচক চিত্র সৃষ্টি হয়। যুদ্ধের সময় বহু চাকমাকে প্রশিক্ষণ দিতে অপরাগতা জানায় ভারত। মুক্তিযোদ্ধাদের খেতাব দেওয়ার সময় তিনজন চাকমা যোদ্ধার নাম নির্বাচিত হলেও পরে অজ্ঞাত কারণে বাদ দেওয়া হয়। তাছাড়া জেনে রাখা ভালো, পাকিস্তানের মদতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশ কিছু স্বাধীনতাকামী ভারতীয় মিজো ঘাঁটি গেড়েছিল। যুদ্ধের সময় রাজাকার ও পাকিস্তানী বাহিনীর হয়ে তারাও পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙ্গালী ও চাকমাদের বিরুদ্ধে অত্যাচার চালায়। পার্বত্য জাতিগোষ্ঠী ও রাজনীতি সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞানের অভাব চাকমাদেরকে স্বাধীনতাবিরোধী বলে চালাবার একটা কারণ হতে পারে।

সুদূর অতীতে বর্মী রাজা বোধিপাও আরাকানে বিজয়াভিযান চালালে দেশছাড়া হয়েছিলেন মারমারা। সেদিন থেকে তাদের আশ্রয় পার্বত্য চট্টগ্রাম। মং ও বোমাং রাজার অধীনে তাদের বাস। কাপ্তাই এর কল্যাণে জমিজোত মারমারাও হারিয়েছিলেন, পাকিস্তানের প্রতি তাদেরও ক্ষোভ ছিল। মারমা রাজা মপ্রু মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। সে আমলে বিবিসিসহ অনেক সংবাদ সংস্থা মারমা রাজার যুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা প্রচার করেছিল।

রাজা মপ্রু সম্মানসূচক ক্যাপ্টেন খেতাব নিয়ে দেশের অভ্যন্তরেও যুদ্ধ করেছেন। বিজয়ের পর পর রাজধানীতে বীরবেশে প্রবেশ করেন এই পার্বত্য রাজা। যদিও তাকে কোন খেতাব-পদবী কিছুই দেওয়া হয়নি। একইভাবে সমানতালে লড়াই করেছেন বরিশাল ও কক্সবাজারনিবাসী রাখাইন জাতির অনেক যোদ্ধা। যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন ত্রিপুরা, ওঁরাও আর মুন্ডা জাতির যোদ্ধারা। আজ মোটামুটি সবাই বিস্মৃত।

আদিবাসী ও পার্বত্য নারী এবং মুক্তিযুদ্ধ

শরণার্থী

পাকিস্তানীরা বাঙ্গালী নারীদের ওপর ধর্ষণ আর অত্যাচারের তাণ্ডব চালিয়ে এক নজিরবিহীন বিভীষিকার জন্ম দেয়। তাদের বিষাক্ত নজর থেকে অন্যান্য জাতিগুলিও রক্ষা পায়নি। তবে এরই মধ্যে আদিবাসী ও পাহাড়ী নারীরাও যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধকে সফল করতে। রাখাইন নারী প্রিনছা খে বরিশালের বাউকাঠি পাকিস্তান ক্যাম্পে সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হন। কোনক্রমে এক বাঙ্গালী ডাক্তারের কাছ থেকে যোগাড় করেন বিষ এবং হানাদারদের ১৪ জনকে পাঠিয়ে দেন পরপারে। বিভা সাংমা ভারতে শরণার্থী গারোদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন। জ্যোতিপ্রভা চাকমা চিকিৎসা আর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি। এর বাইরে চা বাগানের নারীদের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়।

সুদূর ব্রিটিশ আমলে তাদেরকে কাজের লোভ দেখিয়ে সিলেটের চা বাগানগুলিতে আনা হয়েছিল। প্রচলিত সমাজে নিচু জাত হিসেবে তাচ্ছিল্যের শিকার হলেও মুক্তিযোদ্ধারা সিলেটকে মুক্ত করতে যেয়ে এই চা শ্রমিকদের অকুন্ঠ সাহায্য পেয়েছেন। বাঙ্গালী নারীদের মতো এসব আদিবাসী ও পাহাড়ী নারীরাও ঢালাও ধর্ষণ বা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এবং হতভাগ্য অগুণতি বীরাঙ্গনাদের মত তারাও সমাজের কাছে আশ্রয় না পেয়ে কাটিয়েছেন ক্লেদকর জীবন।

স্বীকৃতি

মক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় আদিবাসী ও পার্বত্য জাতির অনেককেই দেখা যায়। তালিকাটি অসম্পূর্ণ হলেও সেখানে আছে ৩৪ জন মণিপুরি, ১৯০ জন গারো, ৮৯ জন সাঁওতাল, ৬৯ জন মারমা, ২৭ জন ত্রিপুরা, ১২ জন চাকমাসহ বেশ কয়েকজন ওঁরাও, মুন্ডা এবং মাহাতো জাতির যোদ্ধা। এমনকি গহীন অরণ্যে বাসকারী একজন বম পর্যন্ত আছেন এই তালিকায়।

পার্বত্য চট্টগ্রাম

তবে বেদনাদায়ক সত্যটা হচ্ছে, এসব সাহসী সন্তানদের যথার্থ কদর হয়নি, ঠিক যেভাবে কদর হয়নি অসংখ্য বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধার। আত্মাভিমানী অনেকে স্বাধীন দেশের কাছে নিজেদের সনদটা আনতে যাননি। যুদ্ধ করেছেন দেশের জন্য হাজার হোক, স্বীকৃতির আশায় নয়। আবার রাজনৈতিক খেলার বলিও হতে হয়েছে অনেককে, বিশেষ করে চাকমা জাতিকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘর্ষের দিনগুলিতে (১৯৭৭-১৯৯৭) শান্তি বাহিনীর ভয়ে অনেকেই নিজের সনদ হারিয়েছেন, অনেকে রাষ্ট্রের প্রতি দুরন্ত অভিমানে চেপে গিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা। বহু গারো তো দেশই ছেড়েছেন।

১৯৭৫ এ জাতির জনক শেখ মুজিবকে হত্যা করা হলে সীমান্তের ওপারের ঘাঁটি থেকে হামলা চালিয়ে ময়মনসিংহ এর সীমান্তবর্তী অঞ্চল উত্তাল করে তুলেছিল কাদেরীয়া বাহিনী। এই বাহিনীর অনেকেই ছিলেন গারো। স্বাধীন দেশে যোগ্য সম্মান না পাওয়া, জাতির জনককে হত্যা প্রভৃতি তাদেরকেও ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল।

কাজেই আজ আদিবাসী, পাহাড়ী জাতি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতি ঘরানার শব্দগুচ্ছের মধ্যে আটকে রাখা অসংখ্য জাতিসত্ত্বার মধ্যে আছেন একজন মাত্র খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা; বীরবিক্রম উক্যজিং মারমা। বাকিদের কথা রাষ্ট্রযন্ত্র তো বটেই; জাতিও ভুলে গিয়েছে। অথচ বাংলাদেশ নামক এক টুকরো জমিনের স্বাধীনতার স্বপ্নে তারাও রক্ত ঝরিয়েছিলেন, হাতে তুলে নিয়েছিলেন মারণাস্ত্র। ভুলে যাওয়ার এই নেশা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এক চরম অপমান বৈকি।

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত