রাইফেল, রোটি, আওরাত: মুক্তিযুদ্ধের ভয়ংকর বর্ণনায় প্রথম উপন্যাস

রাইফেল, রোটি, আওরাত: মুক্তিযুদ্ধের ভয়ংকর বর্ণনায় প্রথম উপন্যাস

মৃত্যুর ভয়ে বসে থাকা, আর না/পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা/প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয়, অদ্য/এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা/দুর্যোগে পথ হোক দুর্বোধ্য/চিনে নেবে যৌবন আত্মা।

বাংলাদেশে সূর্য উঠল, স্বাধীন সূর্য। এরপর বাংলা সামগ্রিক সাহিত্যে আমাদের অস্তিত্বের প্রতিক, স্বাধীনতার অবলম্বন, বিজয় তথা মুক্তি আছে বৃহৎ অংশ জুড়ে। মুক্তিযুদ্ধের দুঃখ-গাঁথা রচিত হয়েছে সাহিত্যিকদের তীক্ষ্ণ ভাবনায় বা প্রত্যক্ষ দর্শনের নিরিখেই। পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে তাঁরা সুনিপুণ ভাবনায়, আবহে ফুটিয়ে তুলেছেন কলমে। বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ আজ সমার্থক। এ নিয়ে অগণিত সাহিত্যকর্ম—কী গল্প কী উপন্যাস কী নাটক সব লেখা হয়েছে এবং আজও হচ্ছে। তবে প্রথম সর্বদা প্রথমই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রচিত ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত প্রথম উপন্যাস। এখানে প্রারম্ভিক যুদ্ধের নির্মম, নিশংস, ভয়ংকর রূপ বর্ণনা করেছেন লেখক আনোয়ার পাশা।

লেখক নিজেই শহিদ

নরকের ছায়া নেমে এসেছিল শ্যামল বাংলায়। সেই জাহান্নমে বসে কৃত্রিম জাহান্নম রচয়িতা কুলাঙ্গারদের অপকর্ম নৃশংসতা লেখার সাহস করেছিলেন আনোয়ার পাশা। মৃত্যুর মাঝখানে অবস্থান করে মৃত্যু-বিভীষিকার ছবি অঙ্কনের দুঃসাধ্য কাজটি করেছেন। ১৩৩৫ সনের ২রা বৈশাখ মুর্শিদাবাদ জেলার কাজী শাহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ বাংলায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। ‘৫৮-এ পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সালের ১লা নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যোগ দেন। ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত  উপন্যাসটির রচনাকাল ১৯৭১-এর এপ্রিল থেকে জুন মাস। এতে তুলে ধরেছেন পাকিস্তান ও তাদের দালালের নিশংস ও নোংরা অমানবিক রূপ। বঙ্গবন্ধুকে বাংলার প্রয়োজন। তাঁকে ছাড়া বাংলা অসম্পূর্ণ। লেখক লিখেছেন,

“শেখ মুজিবুর রহমান- শুধুই একটি নাম তো নয়, তা যে বাঙ্গালির আত্মমর্যাদার প্রতীক। এবং আনন্দময় জীবনেরও।”

বঙ্গবন্ধুর সাথে আনোয়ার পাশা।

স্বাধীনতা ঘোষণার আগে রাত অর্থাৎ ২৫শে মার্চের শেষ প্রহর থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ক্ষুদ্র সময়ের বর্ণনা পড়লেই যে কারও গা শিউরে উঠতে পারে, কিংবা বুক ফেটে কান্না। কাব্য, উপন্যাস, ছোটোগল্প, সমালোচনাও লেখেছেন আনোয়ার পাশা; সংখ্যায় প্রাধান্য দেননি। ১৪ই ডিসেম্বর তাঁকে নিজের দেশের মানুষ (আল-বদর) অপহরণ করে মিরপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। তাঁর প্রধান চরিত্র সুদীপ্তকে উপন্যাসে শেষ অবধি বাচিয়ে রাখলেও তিনি নিজে নিস্তার পেলেন না। তাঁর নামের সামনে ‘শহিদ নামক পবিত্র শব্দটি যুক্ত হয়। দেশকে ভালোবেসে জন্ম যাঁর, মৃত্যুতে মৃত্যুতে পরোয়া কীসের তাঁর?

রাইফেল, রোটি, আওরাত: উপন্যাসের নামই নৃশংসতার প্রতিক

‘রাইফেল, রোটি, আওরাত একটি একক নামের রূপ নয়। প্রথমত, রাইফেল অর্থ বন্দুক; যা পাক-হানাদারবাহিনী খেলনার মতো ব্যবহার করেছে এদেশের নিরীহ বাঙালীর উপর। যাঁকে দেখেছে তাঁকেই গুলি করার জন্য কুত্তার মতো তেড়ে এসেছে। খাবার হিসেবে এরা (পাক-হানাদার) খেত রুটি। ২৫শে মার্চের অনেক আগে থেকেই এদেশে হামলা ও অবস্থানের নীল-নকশা পাকাতে শুরু করে। রুটি খেয়ে যোগাতো শক্তি। এবং শেষে আওরাত যার অর্থ নারী। নারীদের প্রতি ছিল কুদৃষ্টি ও প্রবল কাম। মদ-গাঁজা ছাড়া চললেও নারী না হলে ঘুম হতো না। প্রথমে ধর্ষণ ও পরে হত্যা। এভাবে আমার দেশের প্রায় তিন লাখ নারীর সম্ভ্রম নিয়েছে এই কুলাঙ্গারের দল। বাংলাকে হিন্দুয়ানী ভাষা বলে, ইসলামের শত্রু ঘোষণা করে বাঙালি হত্যাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে হালাল করে নিয়েছিল এরা। আনোয়ার পাশা তার বইয়ে লিখেছেন,

“রোটি (রুটি) খেয়ে গায়ের তাকত বাড়াও, আর রাইফেল ধরে প্রতিপক্ষকে খতম কর, তারপর আওরাত নিয়ে ফুর্তি কর।”

তরুণ বয়সে আনোয়ার পাশা, বামে তার অমর-কীর্তি

উপন্যাসের নিমিখে

শহিদ আনোয়ার পাশার এই উপাখ্যানের প্রধান চরিত্র সুদীপ্ত শাহীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক। এই চরিত্রের চারপাশের অবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেন লেখক। স্ত্রী আমেনা খাতুন ও তিন সন্তানকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা নীলক্ষেতে থাকতেন। তাঁর চারপাশের প্রতিবেশী শিক্ষকদের মৃত্যু নিশ্চিত করে কুলাঙ্গার তাঁর ঘরের মাড়ায়নি এমন নয়। খাটের নিচে গুটিসুটি হয়ে লুকিয়ে থাকায়, হানাদার বাহিনী খালি ঘর পেয়ে দেয়ালে ঝুলে থাকা কয়েকটি ছবিতে গুলি করে এবং ঘরের বুক সেলফ আগুন দিয়ে যায়; এতেই যেন মানুষ মারার আনন্দ পয়ে গেছে। বই এঁদের জ্ঞান বাড়ায় কি-না আনন্দ! লুটতরাজের মতো পায়নি সেখানে কিছুই ফলে ক্ষোভ নিয়েই অনেকটা বিদায় হয় বলা চলে।

২৫শে মার্চের অপারেশন সার্চলাইটে কোনোভাবে সপরিবারে বেঁচে যান সুদীপ্ত শাহীন। সেজন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। আশ্রয় নেন বন্ধু ও সহকর্মী একই সাথে আওয়ামী লীগের রাজনীতিক মহিউদ্দিন ফিরোজের বাসায়। সুদীপ্তের প্রবল ধারণা ছিল মানুষ জীবনে আর কিছু না করতে পারলেও সকলেই মরতে পারে। খাও-দাও একসময় পর তুমি সহসাই শেষ! আত্মীয়-স্বজনের ক্ষুদ্র সময় চোখের পানিতে ভাসিয়ে নিজেও শেষ যাত্রায় ভেসে যাবে। তবে ২৫শে মার্চের রাতের পর তার ধারণা ভেঙে যায়। তিনি যতটুকু ভেবেছেন মৃত্যু যেন আরো সহজ হয়ে গেছে। মৃত্যু সহজ তবে, মরে যাওয়াটা নয়। মারা সহজ, মরে যাওয়াটা ততটাই কঠিন, কষ্টের, মর্মান্তিক। মৃত্যু নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক ভাবনা অমূলক ছিল না। চারদিকে মৃত্যু দেখেছেন নিজ চক্ষুতে; উপরে-নিচে সর্বত্র মৃতদেহ (কোনোটি গলিত কোনোটি সদ্য) যার মাঝে পরিচিত ব্যক্তি ছিল বেশি।

ইকবাল হলের মসজিদের ছাদের উপরে জন পঞ্চাশেক লোককে কত সহজেই মেরে ফেলল। ১৮ই এপ্রিল পর্যন্ত পড়ে থাকা লাশের কঙ্কাল কেবল পড়ে ছিল, বাংলার মেধাবীর দেহ খেয়েছে কাক-শকুনের দল। জগন্নাথ হলের ছাত্র-শিক্ষকদের চাপা দেওয়া হয় হলের সামনে। আসল শকুন কারা! শয়তানের অনুসারী এসব কুলাঙ্গারদের অপব্যাখ্যার প্রমাণ পাওয়া যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান অধ্যাপক এম. এন. মুনিরুজ্জামানকে জানলে।

তিনি ও তাঁর স্ত্রী বেগম মুনিরুজ্জামান ছিলেন ধার্মিক। মুনিরুজ্জামানকে কোরআন অধ্যয়ন অবস্থা থেকে বড়ো সন্তান-সহ হত্যা করে তাঁদের দেহ টেনে নিয়ে জগন্নাথ হল প্রাঙ্গনে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবৃন্দের জন্য নির্ধারিত সেই বাড়িতেই ছিলেন ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। গুলি শরীরে গ্রহণ করলেও প্রাণে বেঁচে যান। তাঁর স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতার ভাষ্যে বেগম মুনিরুজ্জামান অসীম তেজস্বী শক্ত মস্তিষ্কের মানুষ। জ্যেষ্ঠ পুত্র ও স্বামীকে হারিয়েও কী এক অসীম মনোবলে ড. গুহঠাকুরতাকে বাসার নিচে অচেতন পড়ে থাকতে দেখে বাঁচাতে এগিয়ে গেছেন বাসন্তীর কাছে

“দিদি, বের হন। আপনার সাহেবকে ঘরে নিন। আমার সাহেব মারা গেছেন। আপনার সাহেব এখনও বেঁচে আছেন।”

অথচ কিছুক্ষণ আগে ছেলে-স্বামীকে নিয়ে যাওয়ার পূর্বে মাটিতে আহত ছেলেটি পানি চাইছিল, নিজের স্তনের দুগ্ধে ছোটোবেলা বাঁচাতে পারলেও অন্তিমযাত্রায় এক-চামচ পানি মুখে দিতে পারলেন না; তার আগেই প্রাণটি চলে যায়।

ড. ফজলুর রহমানের বুকের গুলির দাগগুলো রক্তজবার মতো মনে হয়েছে। সূর্যসন্তানদের হত্যা করে ফেলে রাখে যেখানে সেখানে। পরবর্তীতে বধ্যভূমির লাশ শনাক্তে এসে ভয়াবহতা দেখে অনেকেই মূর্ছা যান। শিল্পী আমন চিত্রকর্মে পাক মুল্লুক নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁকে প্রথমে ধরতে না পেরে (বাড়িতে না থাকায়) স্ত্রী পলি ও কন্যা-পুত্রকে আঘাত করে। দরজা ভেঙে হত্যা করে পুত্র-কন্যাকে। নিয়ে যায় স্ত্রীকে।

এতটুকু ছোটো বাচ্চা দুটির রক্তমাখা শরীর পড়ে থাকতে দেখে অসামান্য শোকে বিহ্বল হয়ে যান আমন। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। কতটুকু শোক গ্রহণ করা সম্ভব একজন মানুষের! ভারসাম্য হারানোর পূর্বে যতক্ষণ গলায় কুলিয়েছে চিৎকার করে আরশের অধিপতির কাছে বিচার চেয়েছেন; গজব আবেদন করেছেন। সুদীপ্ত শাহিনের সাথে দেখা হলো যখন তখনই তা সে বুঝতে পারল সে। একটি বড়ো ইটের টুকরো যখন অসুস্থ আমন তাক করলেন পাকসেনা বরাবর, তৎক্ষণাৎ গুলি এসে ঝগড়া করে দিয়ে গেল আমনকে। আমন ধাক্কা দিয়ে সুদীপ্তকে ফেলে দেওয়ায় গুলিটা এবারও বিচ্যুত হলো সুদীপ্তের কাছ থেকে।

একপলকে উপন্যাসের তথ্যাদি।

পাক-হানাদার কিংবা তাদের নির্দেশদানকারী সব নীচ ও পশুর চেয়েও নিচে চলে গিয়েছিল। পশুর মতোই এদের প্রবৃত্তি ছিল ক্ষুধা ও রিরংসা। হাজার মাইলের ব্যবধান পেরিয়ে পশু আসে মানুষের মাংস ভক্ষণে। আওরাত ভোগ করেছে জোর করে, অস্ত্র ঠেকিয়ে। বাসা-বাড়ি থেকে অস্ত্রের ভয় বা মিথ্যার ছলনায় অপহরণ। মূল লক্ষ ছিল শহরের সম্ভ্রান্ত মহিলা। এদের নেশা ছিল নারী দিনের বেলা দাসীবৃত্তি ও রাতে গণিকাবৃত্তি চালাত সম্ভ্রান্ত নারী দিয়ে। গণিকাবৃত্তির জন্য বলি দিয়েছে আমার দেশের প্রায় আড়াই-তিন লাখ নারীকে। সেই বলি হয়েছেন সম্ভ্রান্ত বা হত্যায়।

আমনের স্ত্রী পলিকে সে অভিপ্রায়েই হত্যা না করে তুলে নেয়। মাত্র তিনবছরের ছোট্ট কন্যার মৃত্যু চোখে দেখে পাষাণ প্রাচীরে ডুবে যান পলি। মনে স্থির করেন প্রতিশোধ নেওয়ার। অন্তত একটি পশুকেও মারবেই। কলেজে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পাঞ্জাবি অফিসারকে প্রেমের অভিনয়ে ভুলিয়ে ফেলেন। মদ্যপ অবস্থায় বটিতে পশুর রক্তে ঘর রাঙান পলি। এটি ছিল একজন নারীর দুঃখের রূপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলেও আক্রম করা হয়েছিল। অবস্থা বুঝে আগেই চলে গিয়েছিলেন অনেকে। আর যাঁরা কাজকর্মের জন্য ছিলেন তাঁরা সরাসরি মৃত্যু আর কয়েকজন ছাত্রী নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে দেয়ালের ওপর থেকে লাফ দিয়ে পশু থেকে বাঁচেন। যাঁকে পেয়েছে তাঁকে চুলের মুঠো ধরে টেনে-হিঁচড়ে নামায়। চেপে ধরার প্রচণ্ডতায় মাংসসুদ্ধ চুলের গোছা মাথা থেকে চলে আসে। রক্তে ভেসে যায় হাঁটার পথ। হাঁটতে অক্ষমবোধ করেন সুদীপ্ত।

এখানেই শেষ নয়! ২৬শে মার্চ ভোরে একটি মসজিদের মোয়াজ্জিন আল্লাহর মাহাত্ম্য (আল্লাহু আকবার) ঘোষণায় দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়ার পূর্বেই পাক রাইফেলের ট্রিগারের চাপের ফল (গুলি) এসে লাগে বুকে। লুটিয়ে পড়েন মিনারেই। রক্তে রঞ্জিত হয় অনেক মসজিদের সিজদার স্থান-মিম্বার। যে ব্যক্তি কোনোদিন জুমা ত্যাগ করেননি তিনিও অভিশাপ দেন সৃষ্টিকর্তার কাছে। এছাড়া আর উপায়ই বা কী? যারা আল্লাহর ঘর মসজিদে রক্তাক্ত প্রান্তর রচনা করতে পারে, আজানের ধ্বনি সহ্য হয় না এরা আবার অভিন্ন ধর্ম নিয়েই (সে অজুহাতে) হত্যা করেছে নিরীহ মানুষকে!

ছাড়েনি অবুঝ প্রাণীটিকেও। নীলক্ষেতে অপরিচিত কেউ দেখলেই ঘেউঘেউ করে সরব করত একটি কুকুর। সে এলাকার অতি পরিচিত মুখ সে। যে রাতে তার চেয়েও নীচ-দীন কুলাঙ্গারদের দেখে হয়তো প্রতিবাদ করেছিল তার ফল হিসেবে বাঙালির মৃতদেহের স্তুপে কুকুরটিরও স্থান হয়। পাক-হানাদারদের সাহায্যে তৎপর ছিল কতক এদেশীয় নেমকহারাম। ফিরোজের চাচা একজন। জামাতে ইসলাম পরিচয়ে নিজেল বংশের নাম উজ্জ্বল(!) করেছে। তিনজন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশ বিপদে পড়ে সেই চাচার আশ্রয় নেন। চাচার ভালো ব্যবহারে সহজেই মুগ্ধ হন তিনজন। নিরাপদে তাঁদের অাবাসে পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাসে থাকেন সেখানে। ফিরোজের চাচা তিনদিন পর ফিরোজের গাড়ি করে পাকদের খবর দিয়ে সোপর্দ করে। চাচার কাছে নিরাপদ আশ্রয় পাবেন বোধ করে এসেছিলেন ফিরোজ, তাঁর স্ত্রী মীনাক্ষী নাজমা, সুদীপ্ত ও তাঁর স্ত্রী-সন্তান।

সকলে এই ঘটনার আবহে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যান। এরপর বাকযুদ্ধে ফিরোজেরও একই হাল করার ইচ্ছা প্রকাশ করে চাচা। ততক্ষণে বাড়ি ত্যাগ করেছেন সুদীপ্তরা। তবে পাক-গোষ্ঠী তাদেরকে সাহায্যকারীকেও কখনও বখশিশ দিয়েছে। ড. মালেক তাদের একজন। ইয়াহিয়ার পক্ষ নিয়ে বেশ অবস্থা গড়েছিলেন তিনি। অনেক পাক-পন্থি শিক্ষকই রাজাকার হয়েছে। তবে মালেক সাহেব তার পুরস্কার পেয়েছে। সেনা সাহায্য চেয়ে আসে এবং সব লুট করে নিয়ে যায়। আপ্যায়নের পর লুট এবং বাড়ির মেয়ে কন্যাকে-সহ লুট করে। হাহাকারে ভরে যায় মালেকের বুক। ব্যাপক লুটতরাজ করেছে সেনারা। এখন মনে হয় অস্ত্রের মূল্য তুলে নিয়েছে দোকান, ঘরবাড়ি-সব লুট করে। রক্তে হয়নি। সোনা-দানা, নারী সব চাই। সব।

আনোয়ার পাশার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির শেষ পৃষ্ঠা

সুদীপ্ত নিজেই পরিস্থিতি না বুঝে চুপ হয়ে যান। নিজের মেয়ের অবুঝ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না যে, পাক-হানাদার আমাদের কেন মারছে। একটি মেশিনগান খোদা যদি তাঁর হাতে দিতেন। চাচার কাছ থেকে এসে শেষ আশ্রয় খুঁজতে আমেনার খালার বাসার উদ্দেশ্যে। কিন্তু খালাও নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য গ্রামে চলে যান। সেখানেও তাঁরা বাঁচতে পারলেন না। আমেনারা বিপদে পড়ে গেলেন। কারফিউ শুরু হয়ে গেছে। স্থান নিলেন খালার প্রতিবেশী শ্রীমতি বুধার কাছে। আসলে এই বুধা যোদ্ধাদের সহযোগী। মুক্তিবাহিনীর একটি কেন্দ্র বলা যেতে পারে তাঁর বাড়িকে। সুদীপ্তকে পরখ করার জন্যই বসিয়ে রাখেন সাড়াদিন। বুধার ভাষায়, কোয়ার‌্যানটীন। নেতা জামাল ও মুক্তিবাহিনীর সাথে সঙ্গি হতে পেরে সুদীপ্তের মনে হলো,  মা ভৈঃ অর্থাৎ ভয় নেই। আঁধার কাটিয়ে সূর্য উঠল বলে। উঠতেই হবে। একটি দেশের এত মূল্য বৃথা যেতে পারে না কখনই না।

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত