মুক্তিযুদ্ধ: ১১ নং সেক্টরের গল্প

মুক্তিযুদ্ধ: ১১ নং সেক্টরের গল্প

১৯৭১ সালে সংগঠিত বাংলাদেশের  মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের সমগ্র ভূখণ্ডকে কৌশলগত কারনেই ১১টি যুদ্ধক্ষেত্র বা সেক্টরে ভাগ করা হয়। দক্ষভাবে সামরিক অভিযানে জন্য প্রতিটি সেক্টরকে কমান্ডারের অধীনে এবং কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়েছিল। সেক্টর কমান্ডাররা পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন।

১০ থেকে ১৭ জুলাই, ১৯৭১, কলকাতায় সেক্টর কমান্ডারদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল৷ সেই সম্মেলনেই নির্ধারণ করা হয়, বাংলাদেশকে কয়টি সেক্টরে ভাগ করা হবে, কে কে সেক্টর কমান্ডার হবেন, কয়টা ব্রিগেড তৈরি হবে, কোনটার কমান্ডার কে হবেন৷ ১১ জুলাই মুজিবনগরে উচ্চপদস্থ ও সামরিক কর্মকর্তাদের বৈঠকে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধাঞ্চল ও যুদ্ধকৌশল সম্মন্ধে বিস্তারিত আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধে  ১১ টি সেক্টরে বিভক্ত মানচিত্র

১১ নং সেক্টরের অধীনে অঞ্চলসমূহ

বৃহত্তর য়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের সাথে রংপুরের কিছু অংশ – গাইবান্ধা, উলিপুর, কমলপুর এবং চিলমারী।

সেক্টর কমান্ডার

মেজর জিয়াউর রহমান

মেজর আবু তাহের

স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ

ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা নিয়ে গঠিত ১১নং সেক্টরে মেজর এম আবু তাহের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। একটি যুদ্ধে মেজর তাহের গুরুতর আহত হওয়ার পরে স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ তার স্থলাভিষিক্ত হন।

সাব সেক্টর

কর্নেল তাহেরের নির্দেশে ১১ নং সেক্টরকে ৮টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়।

১.মানকারচর (স্কোয়াড্রন লিডার এম হামিদুল্লাহ খান)।

২.মহেন্দ্রগঞ্জ (মেজর আবু তাহের; লেফটেন্যান্ট মান্নান)।

৩. পুরা খাসিয়া (লেফটেন্যান্ট হাশেম)।

৪.ডালু (লে. অধ্যাপক কামাল)।

৫. রংরা (মতিউর রহমান)।

৬. শিবাবাড়ি (ইপিআরের জুনিয়র কমিশন অফিসারদের মধ্যে বিভক্ত)।

৭. বাগমারা (ইপিআরের জুনিয়র কমিশনড অফিসারদের মধ্যে বিভক্ত)।

৮. মহেশখোলা (ইপিআরের সদস্য)।

মুক্তিযুদ্ধ

১১ নং সেক্টরের সদরদপ্তর ও মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা

১১ নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার প্রথমে ছিল লেলডালা এবং পরে ১০ অক্টোবর ১৯৭১ সালে মহেন্দ্রগঞ্জ, আসাম, ভারত স্থানান্তর করা হয়। এই সেক্টরে প্রায় পঁচিশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করেছিলেন। কাদের বাহিনীতে ১৬০০০ গেরিলা যোদ্ধা ছিল। তারামন বিবি ১১ নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন মাতৃভূমি থেকে শত্রু বিতাড়িত করতে। তিনি বীর প্রতীক খেতাব লাভ করেন।

বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধা ছিলেন শহীদুল ইসলাম চৌধুরী, তিনিও ১১ নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর।

১১ নং সেক্টরে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি যুদ্ধ

এ সেক্টরে গেরিলা কার্যক্রম প্রাধান্য পেয়েছিল এবং নিয়মিত বাহিনী সীমান্তের নিকটবর্তী অঞ্চলগুলিতে অধিষ্ঠিত ছিল। সুবেদার আফতাব যুদ্ধের নয় মাস জুড়ে রাহুমানীতে মুক্ত অঞ্চলটি একটি বিশাল অংশে ধারণ করেছিলেন।  এই সেক্টরে এমনকি মহিলারাও পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছিল।  এ ছাড়া টাঙ্গাইলের খ্যাতিমান ফ্রি ল্যান্স মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী তার জেলায় ১৬০০০ গেরিলা সংগঠিত করেছিলেন এবং বেশ কিছু স্বাধীনভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধে বীর প্রতীক তারামন বিবি

ডয়চে ভেলের এক সাক্ষাৎকারে বীর প্রতীক তারামন বিবি জানালেন একদিনের সরাসরি যুদ্ধের ঘটনা৷ ঘটনা ছিল ঠিক মধ্য দুপুরের৷ সবাই খেতে বসেছে৷ তারামনকে পাকিস্তানি সেনাদের কেউ আসছে কি না তা দেখার জন্য বলা হলো৷ তারামন সুপারি গাছে উঠে দূরবীন দিয়ে চারিদিকে লক্ষ্য রাখছিলেন৷ হঠাৎ দেখলেন, পাক বাহিনীর একটি গানবোট তাদের দিকে আসছে৷ সবার খাওয়া বন্ধ৷ দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে অ্যাকশনের অপেক্ষা করতে লাগলেন সবাই৷ তারামন তাঁর সহযোদ্ধাদের সাথে যুদ্ধে অংশ নেন৷ দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে৷ সেদিন তারা শত্রুদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন৷ এরপর তারামন অনেক যুদ্ধে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অংশ নেন৷ অনেক বার তাদের ক্যাম্প পাকবাহিনী আক্রমণ করেছে ,তবে ভাগ্যের জোরে তিনি প্রতিবার বেঁচে যান৷

৭ জুলাই, সকাল আনুমানিক ১০টা। নেত্রকোণার সদর থানার বাঁশাটি গ্রাম। গোয়েন্দা সূত্রের খবরের প্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধা আবু সিদ্দিকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে নদীর তীর ঘেঁষে অবস্থান নেয়। ওপার থেকে নৌকাযোগে পাকহানাদাররা তাদের সহযোগীদের নিয়ে এগোচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণ। অস্ত্রের অব্যর্থ গুলিতে পাকহানাদারদের নৌকাটি ঝাঝরা হয়ে পানিতে তলিয়ে যায়। শত্রুপক্ষের বেশ কজন পাকহানাদার নিহত হয়। বাকীরা সাঁতরিয়ে ওপারে ওঠে দৌড়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এদের পিছু ধাওয়া করে ৭(সাত) জনকে ধরে ফেলে এ ৭ জনের মধ্যে পাক হানাদারদের সহযোগী বাঙালি ছিল কজন।

জামালপুরের ধানুয়া কামালপুর এবং ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ এলাকা সামরিক যুদ্ধের কৌশলতগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী মহেন্দ্রগঞ্জ দিয়ে বকশীগঞ্জের ধানুয়া কামালপুর হয়ে যুদ্ধকার্য পরিচালনা করে। মুক্তিযোদ্ধাগণ বকশীগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জের সানন্দবাড়ী ও কাঠারবিলে ক্যাম্প স্থাপন করে এখান থেকে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ  দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে প্ররোচিত করে। এ সময় দেওয়ানগঞ্জ এবং বাহাদুরাবাদ ঘাটে পাকহানাদার বাহিনীর লক্ষ্যবস্ত্তর উপর আক্রমণ চালানো হয়। ১৩ নভেম্বর ধানুয়া কামালপুরে পাকহানাদার বাহিনীর সাথে প্রচন্ড যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল তাহের। এ যুদ্ধেই কর্ণেল তাহের বাঁ পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেন।

মুক্তিযোদ্ধাগণ মরণপন যুদ্ধে হানাদার বাহিনী দীর্ঘ ২১ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর ৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ পূর্ব রণাঙ্গনের হানাদার বাহিনীর সুরক্ষিত ঘাঁটি কামালপুরের পতন হয়। এ যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের নেতৃত্বে ২২০ জন সৈন্য আত্মসমর্পন করে। যুদ্ধে অনেক পাকসেনা নিহত হয়। অপরদিকে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনসহ ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা  এতে শহীদ হন। এ যুদ্ধে হানাদার বাহিনী পরাজয়ের পর দিশেহারা হয়ে যান এবং রণভংগ হয়ে জামালপুর, টাংগাইল এবং ময়মনসিংহের দিকে পিছু হটতে থাকে। মিত্র বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাগণ প্রচন্ড প্রতিরোধ গড়ে তুললে হানাদার বাহিনী মনোবল হারিয়ে ফেলে এবং একের পর একের এক পরাজয় বরণ করায় মুক্তিযোদ্ধাগণ বিজয়ের পথে অগ্রসর হতে থাকে। এদিকে ঝিনাই ব্রীজ, নান্দিনা বানারের  রেল ও জেলা বোর্ডের ব্রীজটি ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয় ফলে হানাদার বাহিনীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় তারা অত্যন্ত বিপদে পড়ে যায়। অবশেষে ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে ৫৭২ জন জোয়ান ৩১ বেলুচের ক্যাপ্টেন শমশাদসহ আত্মসমর্পন  করে।

কর্নেল তাহের

১০-১১ সেপ্টেম্বর, কমলপুর বেস, মহেন্দ্রগঞ্জ: আক্রমণটি দীর্ঘ, শক্ত এবং শেষ পর্যন্ত সফল ছিল।  তাহেরের সেনাবাহিনী নিয়মিতভাবে শত্রুকে জলাভূমির দিকে টেনে নিয়ে যায় এবং অবরোধটি একটি আক্রমণে পরিণত হয়।

১০-১৬ ডিসেম্বর, জামালপুর থেকে ঢাকায় পথে: মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সিকে ৩১ তম বেলুচ রেজিমেন্টের কমান্ডারের কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল, শত্রুকে আত্মসমর্পণ করবে কি না জিজ্ঞেস করতে। কমান্ডার উত্তর হিসাবে কাগজে মোড়ানো একটি পিস্তল পাঠালেন।

পরদিন ভোর ৫ টায় আত্মসমর্পণের সময়, ২১২ জন পাকসেনা মারা গিয়েছিল এবং আরও ২০০ জন আহত হয়েছিল

মুক্তিযুদ্ধ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ১১ নং সেক্টর অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। এ অঞ্চলটিতে বিশেষত গেরিলা কার্যক্রমই প্রাধান্য পেয়েছিলো যা দেশের মুক্তিযুদ্ধকে আরও বেগবান করেছিলো।

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত