প্রত্যেক জাতির জাতীয় জীবনে এমন কিছু বিশেষ দিন থাকে যা স্বমহীমায় ভাস্বর হয়ে বার বার ফিরে আসে। জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেয় তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত। এমন কিছু বীরত্বের নিদর্শন থাকে যা সহস্র বছর জাতিকে অনুপ্রেরণা যোগায়। যুগ থেকে যুগান্তরে সেসব বীরত্বগাথাঁ, লোকগাথাঁ হয়ে স্থান পায় ইতিহাসের পাতায়।
ভাবুনতো এমন এক যুদ্ধের কথা যেখানে এক পক্ষে আছে মাত্র চার সপ্তাহ ট্রেনিং নেয়া হাজার দুয়েক সাধারণ গেরিলা যোদ্ধা। যাদের কাছে অস্ত্র বলতে আছে ৩০৩ রাইফেল, পুরাতন কিছু মেশিনগান, বন্ধু রাষ্ট্র থেকে পাওয়া আটটা সোভিয়েত আমলের ট্যাংক। সঙ্গী বলতে আছে বুক ভরা আত্মবিশ্বাস! ফুসফুস ভরা দেশপ্রেম! কমান্ডারের প্রতি আনুগত্যে নিয়ে তারা মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়েছে সে সময়ের অন্যতম প্রশিক্ষিত এক সামরিক বাহিনীর অন্তত পাচঁ হাজার সদস্য, ত্রিশটির বেশি ট্যাংক আর দেড় শতাধিক কামানের বিরুদ্ধে।
প্রলয়ের মতো শুরু হলো সেই যুদ্ধ। কি প্রচন্ড তার তান্ডব। মেশিনগানের জান্তব চিৎকার, আর্টিলারি শেলের ভুকম্পন, আকাশে যুদ্ধবিমানের শব্দ, কান ফাটানো শব্দের বোম্বিং পাকিস্তান জিন্দাবাদ আর “জয় বাংলা স্লোগান চাপা পরে যেতে লাগলো জলপাই রঙয়ের দানব ট্যাংকের তলায়। ফ্রন্ট ট্রেঞ্চে গেরিলাদের লাশ পরতে লাগলো, মেশিনগানে ঝাঝরা হতে লাগলো সহযোদ্ধার দেহ, আর্টিলারি শেলে উড়ে গেল কারো কারো দুই পা। সহযোদ্ধার লাশ পাশে নিয়ে চলতে থাকলো এই যুদ্ধ। কারো মাথায় আসলো না পিছিয়ে আসার কথা, দেশের সাথে বেইমানি করার কথা। সবার মনের কথা যেন মিশে গেছে এক বাক্যে “হয় শত্রুর আত্মসমর্পন নয়তো আমৃত্যু যুদ্ধ জেনারেল নিয়াজি যখন ঢাকায় আত্মসমর্পন দলিল স্বাক্ষর করছে তখন পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সেরা ট্যাংক যুদ্ধ সংঘটিত হচ্ছে এই বাংলার মাটিতে। এমন এক যুদ্ধ যার ইতিহাস ও রণকৌশল পড়ানো হচ্ছে বিশ্বের ৩০ টির বেশি সামরিক কলেজে। খুলনা জেলার প্রবেশদ্বার, ফুলতলা উপজেলার শিরোমণি নামক এক বর্ধিত গ্রামে সংঘটিত এই যুদ্ধের ইতিহাস থাকছে আজকের পর্বে।
শিরোমণির ভৌগোলিক অবস্থান
কৌশলগত ম্যাপ
খুলনা জেলার অন্যতম এক উপজেলা হলো ফুলতলা। ফুলতলা উপজেলার এক গ্রাম শিরোমণি। ১৯৬১ এবং ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় আদমশুমারি অনুসারে এই গ্রামের আয়তন ছিল ৭৪৮ একর। মজার ব্যাপার হলো এর চেয়েও কম আয়তনের দুটি দেশ বিশ্বমানচিত্রে আছে,দেশ দুটি হলো ভ্যাটিকান সিটি(১০৮.৭)একর এবং মোনাকো(৪৯৯) একর।
শিরোমণিকে ঠিক গ্রাম বলা ঠিক হবে না বরং এটি ছিল একটি শহরতলী বা উপশহর। এর পূর্বদিকে বয়ে চলেছে ভৈরব নদ। সড়ক, নৌ ও রেলপথ সংযোগ থাকায় কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই এলাকা। ছয়টি পাটকল ও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এলাকা(বিসিক) থাকায় অর্থনৈতিক ভাবেও ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ।
যশোর শহর দখলমুক্ত করন
শিরোমণি যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে যুদ্ধের একেবারে শুরুতে। ঢাকায় গণহত্যা শুরু হওয়ার পর যেসব ইপিআর ও পুলিশ সদস্য পালাতে পেরেছিলেন, তাদের অনেকেই যোগ দিয়েছিল আট নাম্বার সেক্টরে। কুষ্টিয়া, যশোর,খুলনা ও সাতক্ষিরা জেলা নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের তৎকালীন কমান্ডারের ছিলেন মেজর আবু ওসমান। তার নেতৃত্বে সাধারন মুক্তিযোদ্ধারা ৩১ মার্চ যশোর শহর দখলে নিতে সক্ষম হয়। যশোর শহর দখলে নিতে পারলেও যশোর সেনানিবাস পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা এগুতে পারেনি। অত্যন্ত শক্তিশালী ও দূর্ভেদ্য এক ঘাঁটি এই যশোর সেনানিবাস। ব্রিটিশ ভারতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময় এর ব্যাপক সংস্কার করা হয় যার ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল পাকিস্থান আমলেও। বিমান হামলা থেকে রক্ষার জন্য এটি বিশেষ ভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল।
মুক্তি বাহিনী সাময়িক সময়ের জন্য যশোর শহরের নিয়ন্ত্রন নিতে পেরেছিল। সেনানিবাস থেকে যশোর দখলের জন্য ৩ রা এপ্রিল দ্রুত রিইনফোর্সমেন্ট পাঠায় পাকবাহিনী। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে চালানো হয় ব্যাপক আর্টিলারি হামলা। আকাশ থেকেও চালানো হয় বিমান হামলা। মাত্র তিন দিনের মাথায় পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয় মুক্তিবাহিনী। ৬ এপ্রিল যশোর পূণর্দখল করে পাক বাহিনী। একই সাথে যশোরের আশেপাশের সমগ্র অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে তারা। যশোর শহর সাময়িকভাবে হাত ছাড়া হয়ে গেলেও, যুদ্ধের শুরুতেই প্রতিরোধ ও আক্রমনের যে রূপ রেখা মুক্তিবাহিনী দেখিয়েছিল তা ছিল দেশপ্রেমের অনন্য প্রকাশ। ট্যাংক,মেশিনগান আর ভারি অস্ত্রের বিপরীতে শুধু রাইফেল আর পাচঁ রাউন্ড কামানের গোলা নিয়ে যুদ্ধে নামা ছিল মরিয়া প্রচেষ্টার সামিল।
এরপর কেটে গেছে অনেক সময়। ক্রমেই যুদ্ধের পরিস্থিতি মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে আসতে থাকে। বিভিন্ন ফ্রন্টে তখন পাকবাহিনীকে পরাজিত করছে বীর সেনানিগন। যশোর শহরের আশে আশে একের পর এক সীমান্ত এলাকা দখলে নিতে থাকে তারা। গ্রামের পর গ্রাম দখল করে শহর কে আলাদা করে দেয়ার এই ট্যাকটিক্স তারা নিয়ে নিয়েছিল মাওসেতুং এর আন্দোলন থেকে। নভেম্বরের শুরুর দিকে সম্মুখ সমরে নামতে থাকে মুক্তিবাহিনী। ১৩ নভেম্বর গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে মিত্রবাহিনী। মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড কার্যালয় ছিল কলকাতায়।
ফলে বেগবান হয় যৌথ আক্রমন। একের পর এক আক্রমনে দিশেহারা হয়ে পরে পাকসেনারা। যুদ্ধের পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে বুঝতে পেরে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তারা তাদের ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টার যশোর থেকে মাগুরায় স্থানান্তরিত করে। জীবন বাঁচানোর আর কোন পথ খোলা না থাকায় যশোর শহর ও সেনা নিবাস থেকে তিনভাগ হয়ে পালিয়ে যায় পাকবাহিনী। ৬ ডিসেম্বর প্রথম শত্রুমুক্ত জেলার মর্যাদা পায় যশোর। পাকবাহিনীর বিগ্রেডিয়ার হায়াত খানের নেতৃত্বে পালিয়ে যাওয়া বাহিনীর একাংশ খুলনার শিরোমণি ও আশে পাশের এলাকায় আশ্রয় নেয়। এখানেই গড়ে তোলে এক দূর্ভেদ্য ঘাঁটি।
শিরোমণিতে পাকবাহিনীর আগমন ও ঘাঁটি নির্মাণ
পাকবাহিনীর বিগ্রেডিয়ার হায়াত খান ছিলেন একজন ঝানু ও ধুরন্ধর সামরিক অফিসার। যশোর থেকে পালালেও আত্মসমর্পন করার কোন ইচ্ছা তার ছিল না। তাই ডিফেন্সিভ যুদ্ধ করার জন্য তিনি বেছে নেন কৌশলগত এক সুবিধাজনক স্থান। খুলনা শহরের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত শিরোমণিতে তিনি যখন এসে পৌঁছান তখন তার অধিনে ছিল–
১.১০৭ পদাতিক বিগ্রেড (নবম পদাতিক ডিভিশনের অধিনে)
৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট
১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স
১৫ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স
২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট
৪৮ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স
এছাড়াও সাতক্ষিরা খুলনা ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা পাক সেনা ও অসংখ্য বেইমান রাজাকার যোগ দিয়েছিল তাদের সাথে অস্ত্রশস্ত্র ছিল প্রয়োজনের চেয়েও বেশি। যশোর সেনানিবাস থেকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেখানে। তাই শক্তি ও সামর্থ্যের কোন কমতি ছিল না শত্রু পক্ষের। বিগ্রেডিয়ার হায়াত খানের লক্ষ্য ছিল মিত্রবাহিনীকে ততদিন পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখা যতদিন না আমেরিকা তাদের সপ্তম নৌবহর পাঠাচ্ছে। তিনি ভেবেছিলেন ভৈরব অথবা পশুর নদী দিয়ে যাওয়ার সময় তারা তাদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
তাই শিরোমণিতে এক দূর্ভেদ্য ঘাঁটি তৈরি করতে থাকেন বিগ্রেডিয়ার হায়াত খান। সেখানের প্রতিটি পাকা বাড়িকে ঘাঁটিতে পরিনত করা হয়। শিরোমণির কেবল ফ্যাক্টরিকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয় পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এক নিরাপত্তা দেয়াল। ১০-১৫ গজ পর পর ছিল এক একটি বাংকার আর আউটপোস্ট। ৩২ টা ট্যাংক বার্লিন ওয়ালের মত চক্রাকারে চক্কর কাটছিল সমগ্র এলাকা জুড়ে। ইস্টার্নগেট, আলিম, জুটমিল, আফিলজুটমিল, আটরা, গিলাতলা, মশিয়াটি এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা হয় মাইন ফিল্ড ও ট্যাংক ধ্বংসের ফাঁদ। ৭ -১২ ডিসেম্বর সময়ে এই ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালায় পাকবাহিনী।
মুক্তিবাহিনীর আগমন ও শক্তিমাত্রা
যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে আট নাম্বার সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন মনজুরকে। দূর্ধষ এই সামরিক অফিসার পাকবাহিনীতে উচ্চসামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত ছিলেন। যশোর শহরের আশপাশ দখল মুক্ত করে তিনি যখন সেখানে চূড়ান্ত আক্রমনের লক্ষ্য নিয়ে যশোর শহরে পুনঃরায় প্রবেশ করতে থাকেন। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন সেনানিবাস থেকে কোন পাল্টা আক্রমন আসছেনা। মুক্তিযোদ্ধারা যশোর দখল করে দেখতে পান, পাখি খাঁচা ছাড়া হয়ে গেছে। প্রানের ভয়ে যশোর ছেড়ে খুলনার দিকে পালাচ্ছে পাকসেনারা। সাথে সাথে তিনি পরিকল্পনা করেন তাদের পশ্চাৎপদসরন করার। যশোর ত্যাগ করার আগেই তিনি শিরোমণিতে তাদের শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরির খবর পেয়েছিলেন। খুলনার উপকন্ঠে এসে যখন তিনি পৌছান তখন তার সাথে ছিল-
১. ৮ নাম্বার সেক্টরের নিয়মিত সেনা
২. স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা
৩. অতিরিক্ত সেনা(যৌথ বাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশন)
১১ ডিসেম্বর সকালে মুক্তিবাহিনীর প্রথম দলটি ফুলতলার কাছাকাছি ১৪ মাইল নামক স্থানে এসে পৌছায়। এসময় তাদের সাথে যুক্ত হয় মিত্রবাহিনীর রাজপুত ব্যাটেলিয়ন যার নেতৃত্বে ছিলেন মেজর মাহেন্দ্র সিং। সেনাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করছিলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল। রেজওয়ান আলী,আলকাস আলী, আব্দুল গণি প্রমূখ ছিলেন এই দলের অন্যতম। এছাড়াও নবম সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যশোর খুলনা মহাসড়কের পাশে অবস্থান নেওয়ায় চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পরে পাক-বাহিনী। ফলে ভয়ানক এক যুদ্ধ ছিল অনিবার্য।
প্রবল সংঘাত
ঐতিহাসিক এই যুদ্ধের সূচনা ঘটে ১২ ডিসেম্বর মাঝ রাতে (১৩ ডিসেম্বর ১ ম প্রহর)। ইস্টার্ন জুটমিল,আফিল জুট মিল ও কেবল ফ্যাক্টরির অবস্থানে যৌথবাহিনীর আর্টিলারি হামলায় কেপে উঠতে থাকে পুরো অঞ্চল। একই সাথে ভারতীয় বাহিনীর ভারি মেশিনগানের কাভারিং ফায়ারে সামনে এগুতে থাকে তারা। সেদিনের যুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধা স.ম. বাবর আলী তার বিখ্যাত বই স্বাধীনতার দূর্জয় অভিযান এ স্মৃতিচারণ করেছেন যে-
মুক্তিবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য করে প্রবল আর্টিলারি হামলা চালানো শুরু করে পাক-বাহিনী। তবে বাঙ্কারে অবস্থান নেয়ায় তেমন ক্ষতি করতে পারেনি এই আক্রমন। মুক্তি বাহিনীর পাল্টা হামলা ও মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হতে থাকে পাক শিবিরে। সাজোয়া যান ও সুরক্ষিত বাঙ্কার গুলো বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ছিল সবচেয়ে বেশি। এত প্রবল হামলা চালানোর পরেও পাকি ট্যাংক গুলোকে ধ্বংস করতে পারছিল না মিত্রবাহিনী।
২৪ ঘন্টা ধরে যৌথবাহিনীর টানা হামলার ফলে পাক শিবির থেকে পাল্টা কোন উত্তর আসছিলো না। পাক-বাহিনীর কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে মিত্রবাহিনীর ভারতীয় কমান্ডার মাহেন্দ্র সিং ভাবলেন শত্রুরা হয়তো খুলনার দিকে পালিয়েছে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর হিসেব তখনো বলছিলো অন্যকথা। মেজর মনজুর পাক-বাহিনী পলায়ন নিয়ে সন্ধিহান ছিলেন এবং সামনে আগ্রসর হওয়ার ব্যাপারে মিত্রবাহিনীকে নিষেধ করেন।
বারংবার নিষেধ করা সত্ত্বেও মাহেন্দ্র সিং তা মানতে অস্বীকৃতি জানান। ১৪ ডিসেম্বর তার নেতৃত্বে মিত্রবাহিনীর ২৮টি গাড়ির এক বিশাল বহর সামনে আগ্রসর হতে থাকে। শিরোমণি পেরিয়ে বাদামতলীতে প্রবেশ করা মাত্রই এম্বুশের শিকার হয় সেই বহর। ২৬টি গাড়ি সম্পূর্ন ধ্বংস হয়ে যায়। প্রান হারায় রাজপুত ব্যাটেলিয়ন এর প্রায় ৩০০ সেনা। শহীদ হন মুক্তিযুদ্ধের সংঘঠক ও রণাঙ্গনের বীর সেনানী মেজর গণি। কমান্ডারের অদূরদর্শীতা ও শত্রুর অবস্থান নির্নয়ে ভারতীয় বাহিনীর ব্যার্থতা ডেকে আনে এই যুদ্ধ বিপর্যয়। এই দূর্ঘটনা মুক্তিবাহিনীর মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর প্রতিশোধ নিতে তারা হয়ে পরে চূড়ান্ত মরিয়া।
চূড়ান্ত আক্রমন
১৪ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আচমকা এম্বুশে শহীদ হন বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। সহযোদ্ধাদের এমন করুন মৃত্যু মেনে নিতে পারেন নি সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর। শুরু থেকেই মেজর মাহেন্দ্র সিং এর দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে তিনি সন্ধিহান ছিলেন। উর্ধতন কর্মকর্তাকে তিনি সরাসরি জানিয়ে দেন মাহেন্দ্র সিং এর অধিনে তিনি যুদ্ধ করবেন না। হয় তিনি নিজের মত যুদ্ধ করবেন না হলে তাকে যুদ্ধের সর্বময় কমান্ডার হিসেবে মেনে নিতে হবে। মিত্রবাহিনী যতদ্রুত সম্ভব ঢাকার দিকে পৌছাতে চাচ্ছিল সেকারনে শিরোমণিকে মুক্ত করা ছিল অবশ্য কর্তব্য। সেকারনেই সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরকে একই সাথে মুক্তিবাহিনী ও যৌথবাহিনীর ফিল্ড কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। সাধারন মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করার সহজাত ক্ষমতা ছিল এই কমান্ডারের। তার আবেগঘন ভাষনে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে লক্ষ্য নির্ধারিত হয়ে যায় শত্রুর মৃত্যু নয়তো আত্মসমর্পন। ঢাকায় জেনারেল নিয়াজি যখন আত্মসমর্পনের দলিল স্বাক্ষর করছে সেদিন,১৬ ডিসেম্বর বিকেলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুতি নিচ্ছে চূড়ান্ত আঘাতের।
১৬ ডিসেম্বর রাত ৯টায় শুরু হওয়া এই দ্বিতীয় দফা আক্রমন সম্পর্কে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও সেদিনের সম্মুখ সমরে অংশ নেয়া বীরসেনানী মুসা সাদিক তার মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম গ্রন্থে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন,
কুয়াশা মোড়ানো সেই শীতের রাতে প্রতিটি শিশির বিন্দুতে যেন মিশে গিয়েছিল বারুদের গন্ধ। ঘর ঘর হুংকার ছেড়ে মাটি কামড়ে যুদ্ধে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল ১৬০ ট্যাংক গুলো। প্রথম আক্রমনেই মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি অগ্রবর্তী ট্রেঞ্চ ধ্বংস হয়ে যায় ট্যাংক আক্রমনে। শহীদ হন বেশ কয়েকজন বীর সেনানী। উঁচু উঁচু গাছ গুলো সব ভেঙে ভেঙে পরছিলো প্রচন্ড গোলাগুলিতে। কামান মর্টার আর মেশিনগানের গুলিতে পুড়ে যাচ্ছিল শিরোমণির মাটি।
সেকেন্ড সেকেন্ড করে এগিয়ে যাচ্ছিল এই মারণযজ্ঞ। প্রচুর রক্ত ঝরছিলো উভয় পক্ষেই। ঝরছিলো অনেক প্রান। ছয় ঘন্টার বিরতিহীন এই সংঘাত চলতে থাকলো। বাঙ্কারে বাঙ্কারে আহত সাথীদের ব্যান্ডেজ বেধে দিচ্ছিল কেউ কেউ। সেকেন্ড ডিফেন্স থেকে হামাগুড়ি দিয়ে কেউ কেউ নিয়ে আসছিলো কয়েকমগ পানি। পাগলের মত ট্রিগারে আঙুল চালিয়ে যাচ্ছিল সবাই। কারোরই যেন কোন বিরাম নেই,শত্রু নিধনে সবাই যেন মত্ত হয়ে রয়েছে। কোন দিকে দৃষ্টি নেই,নেই কোন শংকা সবার চোখ সামনে, শত্রুর সন্ধানে।
১৬ ডিসেম্বর সারারাত যুদ্ধের পরও তেমন আগ্রসর হতে পারেনি মুক্তিযোদ্ধারা। ফ্রন্টট্রেঞ্চের মাত্র কয়েকটি বাংকার দখলে নিতে পেরেছিল তারা। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় কমান্ডার যুদ্ধকৌশল নতুনভাবে সাজানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ভোর চারটার দিকে যুদ্ধের ফরমেশান পরিবর্তন করার স্বীদ্ধান্ত নেন। মুল বাহিনীর রাইট উইং এ থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কলামকে তিনি ফ্রন্ট লাইনের সেকেন্ড ডিফেন্স এ নিয়ে আসেন। এই দলের দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর হুদাকে। ফ্রন্টলাইনের মেইন আক্রমনে থাকা আল্যাইড ফোর্সকে নিয়ে আসেন রাইট উইং এর ডিফেন্সে,১৪ ডিসেম্বরের ব্যর্থতার কারণে তাদের উপর তিনি ভরসা করতে রাজি ছিলেন না। বামদিকের দুটি ও পেছন দিকে রিজার্ভ হিসেবে থাকা তিন কলাম মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডোকে নিয়ে আসেন মুল ফ্রন্টে। ফ্রন্টলাইনে হেভি মেশিনগানের বদলে দেয়া হয় এসএলআর। ব্যাকাপ ফায়ার দেয়ার জন্যে সেগুলোকে পাঠিয়ে দেয়া হয় সেকেন্ড ডিফেন্সের এলাইড ফোর্সকে।
মিত্রবাহিনীর আটটি 160 ট্যাংক এর মধ্যে দুটিকে টোপ হিসেবে যশোর খুলনা মহাসড়কের দিকে পাঠান তিনি। শত্রুর হেভি ফায়ার নিয়ে তাদের মনোযোগ সরানোয় ছিল মুল উদ্দেশ্য। অবশিষ্ট ছয় ট্যাংকের প্রতিটির পিছনে ১২ জন শহীদ হতে প্রস্তুত কমান্ডো দিয়ে সরাসরি আক্রমন করেন শত্রুর ফ্রণ্টে। আত্নহত্যার সামিল এই আক্রমন ছিল অপ্রতিরোধ্য।মুক্তিযোদ্ধা মুসা সাদিকের ভাষায়-
মেজর মনজুর কমান্ডারের দায়িত্ব নিলেন। সামনে ত্রিশটার বেশি ট্যাংক,দেড় শতাধিক কামান আর অসংখ্য মেশিনগান। শক্তিশালী বাঙ্কারে বাঙ্কারে অজস্র শত্রু। প্রতি মুহুর্তে ছুটে আসছে অসংখ্য মারণ তীর। লাভা উদগীরন করে চলেছে সব কয়টি শত্রুর অস্ত্র। এর ভেতরেই শত্রুর গহ্বরে আত্মঘাতি এক হামলার স্বীদ্ধান্ত নিলেন কমান্ডার। পরিকল্পনা মত দুটি ভারতীয় ট্যাংককে টোপ হিসেবে যশোর খুলনা মহাসড়কের দিকে পাঠানো হয়। প্রতিটি ট্যাংকের পিছনে ছিল ৮ জন করে কমান্ডো। শত্রুর দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরানোই ছিল এর উদ্দেশ্য। হেভি গান ফায়ার মেনে নিয়েও ট্যাংক দুটি এগিয়ে যেতে থাকে। এর পরই শুরু হয় আসল আঘাত।
মেজর মঞ্জুরের নিজের হাতে প্রস্তুত কমান্ডো দলের ১২ জন করে সদস্যদকে প্রতিটি ট্যাংকের সাথে জুড়ে দিয়ে অবশিষ্ট ছয়টা ট্যাংককে নিচু বেত বনের ভিতর দিয়ে ঢুকে যেতে বলেন শত্রুর বাঙ্কারে। উল্কার বেগে ছুটে গেল কমান্ডোরা। কি অবিশ্বাস্য তাদের গতি! কি ভয়ংকর সুন্দর সেই দৃশ্য! কারো ডানে গুলি পড়ছে তো কারো সামনে। স্পিলন্টাররের লকলকে শিখা ছুয়ে যাচ্ছে তাদের দেহ! গুলি বৃষ্টির মধ্যে গা বাঁচিয়ে দৌড়াতে থাকলো তারা। কুয়াশার ভিড়ে ৩০০ গজ সামনে শত্রুর বাঙ্কারে হারিয়ে গেলেন মেজর মঞ্জুর আর তার প্রাণপ্রিয় কমান্ডো দল। কেউ কিছু দেখতে পাচ্ছে না। শুধু শুনতে পাচ্ছে অস্ত্রের হুঙ্কার,ট্যাংক ধ্বংসী মাইনের গুরুগম্ভীর আওয়াজ। কেউ জানে না তারা বেঁচে আছে কিনা।
যুদ্ধের এমন টালটামাল মুহুর্তে মেজর হুদা সেকেন্ড ডিফেন্সকে এগুনোর নির্দেশ দিলেন। ভারি আর্টিলারির কাভার নিয়ে পায়ে পায়ে মৃত্যুর গান গেয়ে এগুতে লাগলো লেফট ও রাইট উইং এ থাকা মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। সেন্টারের পিছনে থাকা কমান্ডো দল ছুটে গেল সবার আগে। ৫ কি.মি. লম্বা সংঘাত লাইনে তখন যেন নরক নেমে এলো। রাতের অন্ধকার হার মেনে গেল বারুদ বিস্ফোরনের উজ্জলতায়। দিনের মত আলোকিত হয়ে ছিল সেদিনের রাতের আকাশ। পাচঁ ছয় ফুটের বেশি কোন গাছ আর অবশিষ্ট ছিল না সেই প্রান্তর জুড়ে। আর্টিলারি শেল ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল প্রতিটি গাছ। এর ভেতরেই জেনারেল হায়াত খানের বানানো দূর্গে শেষ আঘাত হেনে চলেছেন মেজর মঞ্জুর। নিজ হাতে ধ্বংস করেছেন অসংখ্য বাঙ্কারে থাকা শত্রু।
পাকিস্তানী কমান্ডাররা বুঝে উঠার আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে তাদের ফ্রন্ট ডিফেন্স। যতক্ষনে মুক্তিবাহিনীর সেকেন্ড ডিফেন্স শত্রুর দূর্গে প্রবেশ করেছে ততক্ষনে শিরোমণি আমাদের দখলে। অসংখ্য জ্বলন্ত ট্যাংক থেকে বেড়িয়ে মুখ থুবরে পরছে খান সেনারা। এখন আর প্রতিরোধ নয়,বীর পুরুষ জেনারেল হায়াত খান তখন পালাতে ব্যাস্ত। এক স্কাউট এসে যখন মেজর মঞ্জুরকে জানালো শত্রু পালাচ্ছে। তখন এক হাতে সিগেরেট আর আরেক হাতে ট্রিগার চেপে যাচ্ছিলেন এই অসীম সাহসী বীর। একজন স্কাউট এসে খবর দিল খানসেনারা পালাচ্ছে। জয় বাংলা স্লোগান ততক্ষনে ইথারে ইথারে ভেসে পৌঁছে যাচ্ছে বাংলার প্রতিটি ঘরে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে শত্রুর পিছনে তাড়া করে চলেছে বাংলার দামাল ছেলেরা। মরছে তারাও তবে মারছে তারও অনেক বেশি। এ এমন এক যুদ্ধ যেখানে ট্যাংক,কামান থেকে শুরু করে সংঘটিত হয়েছিল আদিম হাতাহাতি যুদ্ধও।
ঘন্টা দুয়েক পরেই মিত্রবাহিনীর জঙ্গি বিমানের হামলায় জ্যান্ত কয়লায় পরিনত হতে থাকে পালায়নপর বাহিনী। তাই আত্মসমর্পন করা ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিলনা তাদের সামনে। অবশেষে ১৭ ডিসেম্বর প্রায় ৩৭০০ সৈন্য সহ নিশঃর্ত আত্মসমর্পন করে বিগ্রেডিয়ার হায়াত খানের নেতৃত্বের পাক-বাহিনী।
আত্মসমর্পন
আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানটি ছিল খুব সাদামাটা। উন্মুক্ত শিরোমণি প্রান্তরে ৩৭০০ পাকসেনা এক কাতারে দাঁড়িয়ে ফেলে দেয় তাদের অস্ত্র। যে ভাত খাওয়া বাঙালীদের নিয়ে তারা উপহাস করতো, বাংলা ভাষাকে পাখির বুলি বলে অপমান করতো, বাঙালীদের সাথে প্রজা সুলভ ব্যাবহার করতো সেই বাংলাদেশিদের কাছে আত্মসমর্পন ছিল তাদের কাছে চরম অপমানজনক। তাইতো র্যাংক ব্যাজ খুলে দেয়ার সময় অপমানে চোখের জল আটকাতে পারেন নি পাকিস্তানী কমান্ডার স্বয়ং হায়াত খান।
কিছু ঘটনা বীরত্বের,কিছু অনুপ্রেরণার। শিরোমণির এই অমর বীরত্বগাথা আমাদের জাতীয় জীবনের এক অনন্যা স্মারক। ভারত,পাকিস্তান,যুক্তরাজ্য সহ বিশ্বের ৩০ টির বেশি সামরিক কলেজে পড়ানো হয় এই যুদ্ধের ইতিহাস। এই যুদ্ধ আমাদের গর্বের, জাতি হিসেবে সাহসীকতার প্রমাণ। যুগ যুগ ধরে সংকট সময়ে আমাদের অনুপ্রেরণা স্থল।