জাতিসংঘে বাংলাদেশঃ বাংলা ভাষায় ভাষনের প্রচলনে বঙ্গবন্ধু

জাতিসংঘে বাংলাদেশঃ বাংলা ভাষায় ভাষনের প্রচলনে বঙ্গবন্ধু

১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। সেদিন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য রাষ্ট্ররূপে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়। এর ঠিক সপ্তাহখানেক পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রথমবারের মত বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান।

একাত্তরের দিনে জাতিসংঘের সহায়তা

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়েই বাংলাদেশের সঙ্গে জাতিসংঘের সম্পর্কের সূচনা হয়। আনুষ্ঠানিক কোনো সদস্যপদ না থাকলেও সে সময় বাংলাদেশের পাশে থাকতে জাতিসংঘ যুক্ত হয়েছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ এবং শরণার্থীদের সহায়তা দানের লক্ষ্যে ।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের উপর যে গণহত্যার মত নির্মমতা সংঘঠিত হয়, তা সারা বিশ্বেই তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি করে। তৎকালীন  জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট এই গণহত্যাকে নিন্দা করে একে ‘মানব ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায় বলে অভিহিত করেছিলেন।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গঠিত মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ প্রতিনিধিদলকে সে বছরের ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৬ তম অধিবেশনে প্রেরণ করা হয়। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল অক্টোবরে জাতিসংঘ প্লাজায় একটি সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে বিশ্বকে জানিয়ে দেয় যে,  “আপোষ সম্ভাবনার পরিস্থিতি থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের দীর্ঘ বক্তব্য পাঠানো হয় এবং এটি নিরাপত্তা পরিষদের অফিসিয়াল ডকুমেন্ট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেবারই প্রথম জাতিসংঘে বাংলাদেশের মানুষের বক্তব্য বাংলাদেশের প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থাপিত হয়।

পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার নিপীড়ন থেকে বাঁচতে এদেশের অসহায় মানুষেরা শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেয়। এই শরণার্থীদের সহায়তার জন্য জাতিসংঘ ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা চালায়। বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা ইউএনএইচসিআর ছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী, ইউনিসেফ প্রভৃতি জাতিসংঘ-সংস্থা শরণার্থীদের জন্য কাজ শুরু করে। অন্যদিকে, তৎকালে অধিকৃত-বাংলাদেশেও জাতিসংঘ ত্রাণ তৎপরতা শুরু করে। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে জন আর কেলির নেতৃত্বে ইস্ট পাকিস্তান রিলিফ অপারেশন (ইউএনইপিআরও) ত্রাণ তৎপরতা শুরু করে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও বৃহৎ আকারের ত্রাণ এবং পুনর্বাসন কার্যক্রম অব্যাহত রাখে সংস্থাটি। বাংলাদেশ-জাতিসংঘ সম্পর্ক আরো মজবুত হয়  ১৯৭৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ডহেইম বাংলাদেশ সফরে আসার মাধ্যমে। তিনি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা করেন। এ সময়ে জাতিসংঘের সহায়তায় যুদ্ধকালীন সময়ে বিধ্বস্ত চালনা পোর্টে ডুবে যাওয়া জাহাজসমূহও অপসারন করা হয়। একই বছরের জুলাইতে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের ফিরিয়ে আনতেও জাতিসংঘ উদ্যোগ গ্রহণ করে।

জাতিসংঘে বাংলাদেশ

স্বাধীনতার পর পরই বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রাপ্তির জন্য চেষ্টা শুরু করে। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির লক্ষ্যে তৎপরতা চালায়। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের প্ররোচনায় নিরাপত্তা পরিষদে চীনের ভেটো প্রয়োগের কারণে পর পর দুবার বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হতে ব্যর্থ হয়।

বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ১৩৬ তম সদস্য হিসেবে জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে। এই ঘোষণার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “আমি সুখী হয়েছি যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার ন্যায্য আসন লাভ করেছে। জাতি আজ গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। সেই শহীদদের কথা জাতি আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।”

সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবার

সপ্তাহখানেক পরই ছিল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশন। সংস্থাটির নিউইয়র্কের সদর দপ্তরে অনুষ্ঠেয় এই অধিবেশনে প্রথমবারের মত যোগ দেয়ার প্রস্তুতি শুরু করে বাংলাদেশ৷ ২৩ সেপ্টেম্বর ২৪ সদস্যদের একটি দল নিয়ে নিউইয়র্কে যান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার হোটেলকক্ষে এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

জাতিসংঘ সদর দপ্তর

জাতিসংঘের  ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, আরবি, রাশান, চায়নিজ এবং স্প্যানিশ এই ছয়টি দাপ্তরিক ভাষা রয়েছে। সাধারণত অধিবেশনে ইংরেজিতেই বক্তৃতা দেওয়ার চল ছিল। জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও ইংরেজিতেই বক্তৃতা দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল।  কিন্তু বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন তাঁর নিজ দেশের মাতৃভাষাকে সারাবিশ্বের মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠিত করে তুলতে। সে লক্ষ্যে তিনি বাংলা’য় ভাষণ দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্যের ইংরেজি ভাষান্তরের দায়িত্ব দেয়া হয় লন্ডনে বাংলাদেশের তৎকালীন ডেপুটি হাইকমিশনার ফারুক চৌধুরীকে।

প্রথমবার বাংলায় ভাষণ

১৯৭৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর।  আসে সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত। সাধারণ পরিষদের অধিবেশন কক্ষে সকল বিশ্বনেতা উপস্থিত।  বঙ্গবন্ধু গিয়ে দাঁড়ান বক্তৃতা মঞ্চে। “মাননীয় সভাপতি, আজ এই মহামহিমান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সাথে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালি জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এভাবেই শুরু করেন বক্তব্য।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রামে সমর্থনদানকারী দেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, যাঁহাদের ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ বিশ্বসমাজে স্থান লাভ করিয়াছে এই সুযোগে আমি তাঁহাদেরকে অভিনন্দন জানাই। বাংলাদেশের সংগ্রামে সমর্থনকারী সকল দেশ ও জনগণের প্রতি আমি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ছিল শান্তি ও ন্যায়ের মিলিত সংগ্রাম। জাতিসংঘ গত ২৫ বছর ধরিয়া এই শান্তি ও ন্যায়ের জন্যই সংগ্রাম করিয়া যাইতেছে।

বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস উল্লেখ করে তিনি বলেন, “স্বাধীন ভাবে বাঁচিবার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচিবার জন্য বাঙালি জাতি শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাহারা বিশ্বের সব জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাঙ্ক্ষিত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ সনদে রক্ষিত আছে, আমদের লাখ লাখ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করিয়াছেন। আমি জানি শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মানুষের আশা-আকাঙক্ষা বাস্তবায়নের উপযোগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তুলিবার জন্য বাঙালি জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞচিত্তে আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারী বুমেদিনের নাম উল্লেখ করে বলেন, জোটনিরপেক্ষ দেশগুলো যাতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায় তাহার জন্য প্রেসিডেন্ট বুমেদিন বিশেষ আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি তার ভাষণে বার্মাসহ (বর্তমান মিয়ানমার) ‘আঞ্চলিক জোন গঠনের সম্ভাবনা ও বাস্তবতার প্রতি তার চিন্তার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অভ্যুদয় এই উপমহাদেশে শক্তিকাঠামো তৈরি করিয়াছে। আমরা শান্তি চাই, আর শুধু এইজন্যই অতীতের সব গ্লানি ভুলিয়া যাইয়া পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করিয়াছি। ইহা শান্তির জন্য আমাদের বিনিয়োগ বলিতে পারেন।

জাতির জনক সেদিন তাঁর ভাষণে জাতিসংঘের প্রচেষ্টা এবং দেশে দেশে অধিকার আদায়ের আন্দোলন প্রসঙ্গে বলেন, “জাতিসংঘ সৃষ্টির পর এক-চতুর্থাংশ শতাব্দী সময়কালের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এর আদর্শ বাস্তবায়নে নানাবিধ সমস্যার সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম চালাতে হয়েছে। জাতিসংঘ সনদে যে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা বলা হয়েছে তা অর্জনের জন্য এশিয়া, আফ্রিকা ল্যাটিন আমেরিকার লাখো লাখো সেনানিকে আত্মাহুতি দিতে হইয়াছে।

বেআইনিভাবে এলাকা দখল, জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার নস্যাত করার জন্য শক্তির ব্যবহার এবং বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে চলছে জাতিসংঘের সংগ্রাম। আমাদের আরব ভাইয়েরা এখনও লড়ছেন তাদের ভূমি থেকে জবরদখলকারীদের সম্পূর্ণ উচ্ছেদের জন্য। প্যালেস্টানিয়ান জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায় এখনও অর্জিত হয়নি। ঔপনিবেশবাদ উচ্ছেদের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হলেও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছেনি এখনোও। এ কথা আফ্রিকার জন্য আরও বেশি সত্য। যেখানে জিম্বাবুয়ে ও নামিবিয়ার জনগন জাতীয় স্বাধীনতা ও চরম মুক্তির জন্য এখনও সংগ্রামে লিপ্ত। বর্ণবৈষম্য এ পরিষদে চরম অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও তা অনেকের বিবেক নাড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে। অন্যায়-অবিচারের ধারা উৎখাতের সংগ্রাম ও স্বাধীকার অর্জন আন্দোলনের বিরাট চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে।

বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত অধিকার-হারা মানুষদের কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা মুক্ত, শান্তিময় এক পৃথিবী গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি তার ভাষণে বলেন, “অনাহার, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও বুভুক্ষের তাড়নায় জর্জরিত, পারমাণবিক যুদ্ধে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় শিহরিত বিভীষিকাময় পৃথিবীর দিকে আমরা এগুবো না, আমরা তাকাবো এমন এক পৃথিবীর দিকে যেখানে বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির যুগে মানুষের সৃষ্টি ক্ষমতা ও বিরাট সাফল্য আমাদের জন্য এক শঙ্কামুক্ত উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনে সক্ষম। পৃথিবীর সব সম্পদ ও কারিগরি জ্ঞানের সুষ্ঠু বণ্টনের মাধ্যমে এমন এক পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব যেখানে প্রত্যেক মানুষ সুখী ও সম্মানজনক জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তা লাভ করবে।

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত