২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর ইরানি পরমাণুবিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহ খুন হন, এবং এই খুনের সঙ্গে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই ঘটনাটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। কিন্তু মোসাদের হাতে ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী খুন হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। বস্তুত শত্রুরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের খুন করা এবং এর মাধ্যমে শত্রুরাষ্ট্রের মস্তিষ্কে আঘাত করা মোসাদের একটি ‘ঐতিহ্য বা ‘স্ট্যান্ডার্ড রণকৌশলে পরিণত হয়েছে।
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের ভূমি থেকে ফিলিস্তিনি আরব মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বিতাড়িত করে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ইহুদিরা ‘ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ভাগ্যের পরিহাসে, যে ইহুদিরা ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রে চরম নিপীড়নের (এবং ক্ষেত্রবিশেষে গণহত্যার) শিকার হয়েছিল, তারাই ফিলিস্তিনি আরবদের ওপর দমনপীড়ন আরম্ভ করে। মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলো প্রথম থেকেই ইসরায়েলের তীব্র বিরোধী ছিল, এবং তদানীন্তন পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রাথমিকভাবে ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও পরবর্তীতে তারা আরব–ইসরায়েলি দ্বন্দ্বে আরবদের পক্ষ অবলম্বন করে। চতুর্দিকে শত্রু পরিবেষ্টিত এবং কমিউনিস্ট পরাশক্তির ভয়ে ভীত ইসরায়েল আত্মরক্ষা ও আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার তাগিদে ১৯৬০–এর দশকে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ করে ফেলে। এবং একই উদ্দেশ্যে ইসরায়েলের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো রাষ্ট্র যেন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না পারে, সেজন্যও ইসরায়েল সক্রিয় হয়ে ওঠে।
১৯৫০ ও ১৯৬০–এর দশকে মিসরীয় পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্র নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীকে মোসাদ খুন করে। ১৯৮০–এর দশকে ইরাকি পরমাণু প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীকে মোসাদ খুন করে, এবং ১৯৮১ সালে ইসরায়েল বিমান হামলা চালিয়ে ইরাকি পরমাণু প্রকল্প গুঁড়িয়ে দেয়। ২০০৭ সালে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী অনুরূপ একটি হামলা চালিয়ে সিরীয় পরমাণু প্রকল্প ধ্বংস করে দেয়। অর্থাৎ, ইসরায়েল তার অস্তিত্ব (ও দখলদারিত্ব) এবং আঞ্চলিক সামরিক আধিপত্য বজায় রাখার লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো রাষ্ট্রকে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হতে দিতে নারাজ।
ইরাকি পরমাণু প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত মিসরীয় বিজ্ঞানী ইয়াহিয়া এল মাশাদকে ১৯৮০ সালে মোসাদ খুন করে
১৯৭৯ সালের আগ পর্যন্ত ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, কিন্তু ১৯৭৯ সালে শাহের পতনের পর ইরানের নতুন সরকার তীব্র ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে [যদিও ১৯৮০–এর দশকে ইরান ও ইসরায়েল গোপনে ইরাকের বিরুদ্ধে পরস্পরকে সহায়তা করেছিল]। শাহের শাসনামলেই ইরানে পরমাণু প্রকল্প আরম্ভ হয়েছিল, এবং ১৯৯০–এর দশকে ইরানি সরকার নতুন করে এই প্রকল্প চালু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (যেটিকে ইরান ‘বড় শয়তান হিসেবে অভিহিত করে) এবং ইসরায়েল (যেটিকে ইরান ‘ছোট শয়তান হিসেবে অভিহিত করে) উভয়েই ইরানি পরমাণু প্রকল্পের তীব্র বিরোধিতা করে, এবং ১৯৯৫ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে শুরু করে। কিন্তু তাতে ইরানের পরমাণু প্রকল্প বিলম্বিত হলেও বন্ধ হয় নি।
২০০৩ সালের মে মাসে মোসাদের পরিচালক মেয়ের দাগানের ডেপুটি তামির পারদো সিনিয়র মোসাদ কর্মকর্তাদের একটি গোপন বৈঠকে জানান যে, ইরান প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত একটি রাষ্ট্র এবং তদানীন্তন পরিস্থিতিতে তারা শীঘ্রই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হবে। এটি ঠেকানোর জন্য ইসরায়েলের সামনে তিনটি পথ খোলা রয়েছে – হয় তাদেরকে ইরান দখল করতে হবে, নয়ত ইরানের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে নতুন একটি সরকারকে ক্ষমতাসীন করতে হবে, কিংবা ইরানের জন্য পরমাণু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা এতটা কঠিন ও ব্যয়বহুল করে ফেলতে হবে, যাতে ইরান এই প্রকল্প ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু ইরানের মতো বৃহৎ একটি দেশকে দখল করা কিংবা ইরানের শক্তিশালী ধর্মভিত্তিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা ইসরায়েলের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং, পারদো তৃতীয় পন্থাটিকে বেছে নেয়ার প্রস্তাব করেন।
চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ইরানকে পরমাণু প্রকল্প ত্যাগ করতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে পারদো পাঁচ স্তরবিশিষ্ট একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রস্তাব করেন। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইরানের ওপর প্রবল আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করাতে হবে; ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাতে হবে; ইরানের বিরোধী দলগুলোকে এবং জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সরকারবিরোধী কার্যক্রমে সহায়তা করতে হবে; ইরান যাতে পরমাণু প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও কাঁচামাল বাইরে থেকে আমদানি করতে না পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে; এবং ইরানের অভ্যন্তরে গোপন অভিযান চালিয়ে পরমাণু প্রকল্পে অন্তর্ঘাত চালাতে হবে। ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের খুন করা এই অন্তর্ঘাতেরই অংশ। যুক্তিটা খুবই সরল, একজন সাধারণ সৈনিক বা কর্মীকে সহজেই প্রতিস্থাপন করা যায়, কিন্তু একজন পরমাণু বিজ্ঞানীকে সহজে প্রতিস্থাপন করা যায় না।
একটি মিছিলে ইরানি জনসাধারণ যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পতাকায় অগ্নিসংযোগ করছে
এই পরিকল্পনাকে ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরানবিরোধী কার্যক্রমের সঙ্গে সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই উদ্দেশ্যে মোসাদ, ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আমান এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও এনএসএর মধ্যে একটি সমঝোতা হয়, এবং পরবর্তীতে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ জুনিয়র ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্টের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ইরানকে পরমাণু প্রকল্প ত্যাগ করানোর জন্য দেশটির ওপর বিপুল আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করা হয় এবং কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ইরানি বিরোধীদলগুলো ও সংখ্যালঘুদের যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল নানাবিধ সহায়তা করতে শুরু করে। ইরান যাতে পরমাণু প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও কাঁচামাল ক্রয় করতে না পারে, সেজন্য কড়া নজরদারি আরোপ করা হয়।
সর্বোপরি, মোসাদ ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের খুন করতে শুরু করে এবং অন্য বিভিন্নভাবে (যেমন: সাইবার আক্রমণের মাধ্যমে) ইরানি পরমাণু প্রকল্পকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে। এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী মোসাদের হাতে খুন হয়েছেন। চলুন, তাঁদের সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
আর্দেশির হোসেইনপুর
আর্দেশির হোসেইনপুর ছিলেন একজন ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম বিশেষজ্ঞ এবং পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। তিনি ইরানের ‘শিরাজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইস্ফাহানে অবস্থিত ‘মালেক আশতার প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। ইরানি পরমাণু প্রকল্পের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ২০০৫ সালে তিনি ইস্ফাহানে ‘পারমাণবিক প্রযুক্তি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন, যেটি ইরানের পরমাণু প্রকল্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
মোসাদ এবং ইরানি ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী উভয়কেই আর্দেশির হোসেইনপুরের খুনের জন্য দায়ী করা হয়েছে
২০০৭ সালের ১৫ জানুয়ারি রহস্যময় পরিস্থিতিতে হোসেইনপুরের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর ছয় দিন পর ইরানি প্রচারমাধ্যমে এই সংবাদ প্রচারিত হয়। ইরানি সরকারের ভাষ্য ছিল, হোসেইনপুর একটি গ্যাস দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। কিন্তু ২০০৭ সালে মার্কিন ভূরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ‘স্ট্র্যাটফোর মন্তব্য করে যে, গ্যাস দুর্ঘটনা নয়, বরং রেডিয়েশন পয়জনিং–এর ফলে হোসেইনপুরের মৃত্যু হয়েছে, এবং তাঁকে বিষপ্রয়োগের সঙ্গে মোসাদ জড়িত ছিল। মোসাদ এই অভিযোগ স্বীকার করে নি।
অবশ্য ২০১৪ সালে হোসেইনপুরের বোন মাহবুবেহ হোসেইনপুর পশ্চিমা গণমাধ্যমকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, মোসাদ নয়, বরং ইরানের ‘ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী (Islamic Revolutionary Guard Corps, ‘IRGC’) তাঁর ভাইকে খুন করেছে। তাঁর মতে, হোসেইনপুর ইরানি পরমাণু প্রকল্পে জড়িতে হতে আগ্রহী ছিলেন না, এজন্য ইরানি সরকার তাঁকে খুন করেছে। এই অভিযোগ কতটুকু সত্য সেটি অবশ্য প্রশ্নসাপেক্ষ।
মাসুদ আলিমোহাম্মাদি
মাসুদ আলিমোহাম্মাদি ছিলেন একজন ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী, কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তাত্ত্বিক এবং এলিমেন্টারি পার্টিকল বিষয়ক পদার্থবিদ। তিনি ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন। তিনি ইরানি পরমাণু প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, কিন্তু তাঁর জীবদ্দশায় এই তথ্য প্রচারিত হয় নি। ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন। তাঁর গাড়ির পাশে একটি বুবিট্র্যাপযুক্ত মোটর সাইকেল রেখে দেয়া হয়েছিল। তিনি গাড়ির কাছাকাছি যাওয়া মাত্রই মোটর সাইকেলটি বিস্ফোরিত হয়, এবং তিনি তৎক্ষণাৎ নিহত হন। বিস্ফোরণে আশেপাশের আরো দুইজন ব্যক্তি আহত হয়।
পরমাণুবিজ্ঞানী মাসুদ আলিমোহাম্মাদি মোসাদের গাড়িবোমা হামলায় নিহত হন
ইরানি সরকার এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে দায়ী করে, কিন্তু উভয় রাষ্ট্রই এই অভিযোগ অস্বীকার করে। এই খুনের কয়েকদিনের মধ্যেই ইরানিরা মাজিদ জামালি ফাশি নামক এক তরুণকে উক্ত খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করে। সে জবানবন্দিতে জানায় যে, সে ইরানি মিলিট্যান্ট গ্রুপ ‘তোন্দার এর সদস্য এবং মোসাদের নির্দেশে সে এই কাজ করেছে। উল্লেখ্য, তোন্দার সুইজারল্যান্ডভিত্তিক একটি ছোট্ট ইরানি দল, যাদের উদ্দেশ্য ইরানে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। মোসাদ এই সংস্থাটিকে সহায়তা করে থাকে। পশ্চিমা গণমাধ্যমের মতে, মোসাদই আলিমোহাম্মদির খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল।
মাজিদ শাহরিয়ারি
মাজিদ শাহরিয়ারি ছিলেন একজন ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী। তিনি তেহরানে অবস্থিত ‘শহীদ বেহেশতি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন এবং একই সঙ্গে ‘ইরান পরমাণু শক্তি সংস্থারও সদস্য ছিলেন। পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমের মতে, তিনি ছিলেন ইরানি পরমাণু প্রকল্পের শীর্ষ বিজ্ঞানী।
২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি গাড়িতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলেন। এসময় কয়েকজন মোটরবাইক আরোহী তাঁর গাড়ির কাছাকাছি আসে এবং তাদের মধ্যে একজন শাহরিয়ারির গাড়ির দরজায় বিস্ফোরক সংযুক্ত করে। বিস্ফোরণের ফলে শাহরিয়ারি নিহত হন এবং গাড়িতে থাকা তাঁর স্ত্রী আহত হন। ইরানি সরকার এই খুনের জন্য মোসাদকে দায়ী করে। আরাশ কেরহাদকিশ ও মারিয়াম ইজাদিসহ আরো কয়েকজন ইরানি নাগরিককে এই খুনের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়, এবং তারা স্বীকার করেছে যে, তারা মোসাদের হয়ে কাজ করছে।
মোসাদের গাড়িবোমা হামলায় নিহত বিজ্ঞানী মাজিদ শাহরিয়ারির স্ত্রীর সঙ্গে ইরানি রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানি। পিছনে শাহরিয়ারির পোর্ট্রেট দেখা যাচ্ছে
একই দিনে আরেক ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী ফেরেইদুন আব্বাসির ওপরেও অনুরূপ গাড়িবোমা হামলা চালানো হয়, এবং গাড়িতে থাকা আব্বাসি ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই আহত হন। অবশ্য তাঁরা প্রাণে বেঁচে যান।
দারিয়ুশ রেজায়িনেজাদ
দারিয়ুশ রেজায়িনেজাদ ছিলেন একজন ইরানি প্রকৌশলী। তিনি তেহরানে অবস্থিত ‘খাজেহ নাসির তুসি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ের একজন স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী ছিলেন। পশ্চিমা সূত্রমতে, তিনি ইরানি পরমাণু প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
২০১১ সালের ২৩ জুলাই তিনি ও তাঁর স্ত্রী তাঁদের মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। তাঁর বাসার সামনে কয়েকজন মোটরবাইক আরোহী তাঁর ওপর গুলি চালায়। রেজায়িনেজাদের শরীরে পাঁচটি গুলি বিদ্ধ হয় এবং তিনি ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্ত্রীও এই আক্রমণে আহত হন। ইরানি পার্লামেন্টের স্পিকার আলী লারিজানি এই খুনের জন্য ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেন।
মোস্তফা আহমাদি রোশান
মোস্তফা আহমাদি রোশান ছিলেন একজন ইরানি পরমাণুবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক। তিনি তেহরানে অবস্থিত ‘শরিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। তিনি ছিলেন ইরানি পরমাণু প্রকল্পের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা, এবং তিনি নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রের বাণিজ্যিক বিভাগের উপপরিচালক ছিলেন।
মোসাদের গাড়িবোমা হামলায় নিহত ইরানি পরমাণুবিজ্ঞানী মোস্তফা আহমাদি রোশান
২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৮টায় রোশান গাড়িতে করে বাসায় ফিরছিলেন। এসময় কয়েকজন মোটরবাইক আরোহী তাঁর গাড়িতে ম্যাগনেটিক বিস্ফোরক সংযুক্ত করে দেয়। বিস্ফোরণের ফলে রোশান নিহত হন। ইরানি সরকার এই খুনের জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে।
একই বছরের মে মাসে ইরানি গোয়েন্দা সংস্থা এই খুনগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ১৪ জন ইরানি নাগরিককে গ্রেপ্তার করে, যাদের মধ্যে ৮ জন ছিল পুরুষ এবং ৬ জন ছিল নারী। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, তারা মোসাদের হয়ে কাজ করছিল এবং মোসাদের নির্দেশেই এই খুনগুলো করেছে। ইরানি সরকার টেলিভিশনে বন্দিদের প্রদর্শন করে এবং জনসম্মুখে জবানবন্দি দিতে বাধ্য করে। মার্কিন সাংবাদিক ড্যান রাভিভের মতে, মোসাদের কর্মকর্তারা তাঁদের এজেন্টদের এভাবে ফাঁস হয়ে যেতে দেখে যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন।
এই ঘটনার পর মোসাদ আর নতুন করে ইরানের অভ্যন্তরে কোনো খুনখারাবি করতে আগ্রহী ছিল না, কারণ এর ফলে ইরানে তাদের বাকি এজেন্টদেরও ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তদুপরি, ধারণা করা হয়, এসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও ইসরায়েলের ওপর চাপ দিচ্ছিল এই অভিযান বন্ধ করার জন্য। ওবামা প্রশাসন ইরানের সঙ্গে একটি পারমাণবিক চুক্তি করার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল এবং নতুন কোনো খুনখারাবি এই প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিতে পারত। ২০১৫ সালে ‘ইরান নিউক্লিয়ার ডিল স্বাক্ষরিত হয়, কিন্তু ইসরায়েল এই চুক্তির বিরুদ্ধে ছিল। একই বছর ইরানি কর্মকর্তারা দাবি করেন যে, তাঁরা আরেকজন ইরানি বিজ্ঞানীকে খুন করার ইসরায়েলি প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছেন।
অবশ্য ২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং কট্টর ইসরায়েলপন্থী নীতি অবলম্বন করেন। তিনি ‘ইরান নিউক্লিয়ার ডিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন এবং ইরানের ওপর অত্যন্ত কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এর ফলে ইরানের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সামগ্রিকভাবে, মোসাদ কর্মকর্তাদের ধারণা, ইরানের বিরুদ্ধে পরিচালিত ইসরায়েলি অভিযান ইরানের পরমাণু প্রকল্পকে বন্ধ করতে পারে নি, কিন্তু প্রকল্পটিকে যথেষ্ট বিলম্বিত করতে সক্ষম হয়েছে।
মোহসেন ফাখরিজাদেহ
সম্প্রতি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসা ফাখরিজাদেহ ছিলেন একজন সিনিয়র ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী এবং ইরানি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। তিনি তেহরানে অবস্থিত ‘ইমাম হুসেইন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, এবং তাঁকে ইরানের পরমাণু প্রকল্পের ‘মূল মস্তিষ্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইরানি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘অর্গানাইজেশন অফ ডিফেন্স ইনোভেশন অ্যান্ড রিসার্চের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। কয়েক বছর আগেও তাঁর ওপর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ছিল।
সম্প্রতি খুন হওয়া মোহসেন ফাখরিজাদেহকে ইরানি পরমাণু প্রকল্পের শীর্ষ ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হত
২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর ফাখরিজাদেহের গাড়িবহর তেহরানের নিকটবর্তী আবসার্দ শহরের রাস্তা দিয়ে আসছিল। এসময় একদল বন্দুকধারী তাদের ওপর গুলিবর্ষণ আরম্ভ করে, এবং ফাখরিজাদেহের দেহরক্ষীরা পাল্টা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। এসময় একটি ট্রাক ফাখরিজাদেহের গাড়ির নিকটে আসে। ট্রাকটিতে বিস্ফোরক সংযুক্ত করা ছিল এবং সেটি বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের ফলে ফাখরিজাদেহ গুরুতরভাবে আহত হন এবং তাঁর দেহরক্ষী ও পরিবারের সদস্যরাও আহত হন। অন্যদিকে, ইরানি সরকারের ভাষ্যমতে, ৪/৫ জন আক্রমণকারীও গোলাগুলিতে প্রাণ হারিয়েছে। ফাখরিজাদেহকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়, কিন্তু তিনি সেখানে মৃত্যুবরণ করেন।
ফাখরিজাদেহের খুনকে চলমান বছরের শুরুতে সংঘটিত ইরানি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর কুদস ফোর্সের কমান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সুলেইমানির খুনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ইরানি সরকার এই খুনের জন্য মোসাদকে দায়ী করেছে এবং প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি দিয়েছে। বিশ্লেষকরাও এই খুনের সঙ্গে মোসাদ জড়িত বলে মত প্রকাশ করেছেন। প্রশ্ন হলো, কয়েক বছর পর মোসাদ আবার কেন হঠাৎ করে একজন ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীকে খুন করার প্রয়োজন বোধ করল?
এটির পুরোপুরি সঠিক উত্তর এই মুহূর্তে দেয়ার কোনো উপায় নেই, কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে কিছু বিষয় আন্দাজ করা যেতে পারে।
প্রথমত, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজিত হয়েছেন, এবং জোসেফ বাইডেন বিজয়ী হয়েছেন। বিগত চার বছরে ট্রাম্প প্রশাসন কট্টর ইসরায়েলপন্থী নীতি অনুসরণ করে এসেছে এবং ইরানের ওপর ব্যাপক অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করেছে। কিন্তু বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতি ইসরায়েলের জন্য এতটা সুবিধাজনক হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন না। ধারণা করা হচ্ছে, বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর ‘ইরান নিউক্লিয়ার ডিল নবায়ন করতে পারেন এবং ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আংশিক বা পুরোপুরিভাবে উঠিয়ে নিতে পারেন। এরকম পরিস্থিতিতে ইরানের অর্থনীতি শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে। ইসরায়েল এটি ঘটতে দিতে ইচ্ছুক নয়, এবং তাদের জন্য সবচেয়ে যৌক্তিক পদক্ষেপ হচ্ছে এমন কিছু ঘটানো, যার ফলে ইরান হঠকারী কোনো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা বাইডেনের জন্য জটিল হয়ে দাঁড়াবে।
মার্কিন হামলায় নিহত মেজর জেনারেল কাসেম সুলেইমানির জানাজায় ইরানি জনতার ভিড়
দ্বিতীয়ত, সম্প্রতি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু গোপনে সৌদি আরব সফর করেছেন এবং সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে, যদিও সৌদি আরব এই খবরকে অস্বীকার করেছে। ইসরায়েলের মতো সৌদি আরবও মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বিস্তারের বিরোধী, কিন্তু বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্পের মতো সৌদি আরবের প্রতি পুরোপুরি সহানুভূতিশীল হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। এমতাবস্থায় এটি অসম্ভব নয় যে, অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ফাখরিজাদেহের সম্ভাব্য গুপ্তহত্যার বিষয়েও নেতানিয়াহু সৌদিদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং এই ব্যাপারে তাদের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন।
সর্বোপরি, সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানি ঘাঁটিগুলোর ওপরেও ইসরায়েল আক্রমণের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে। সামগ্রিকভাবে এটি প্রতীয়মান যে, ইসরায়েল চাচ্ছে ইরানকে হঠকারী কোনো পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বাধ্য করতে। তারা এই কার্যক্রমকে ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বী উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সমন্বিত করে নিয়েছে, এবং চূড়ান্ত উস্কানি হিসেবে মোহসেন ফাখরিজাদেহকে খুন করেছে।
কাসেম সুলেইমানির বহুল আলোচিত খুনের পর ইরান কোনো হঠকারী পদক্ষেপ নেয় নি, বরং ইরাকে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর সীমিত আকারে ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালানো পর্যন্ত তাদের প্রত্যুত্তর সীমাবদ্ধ রেখেছিল। অল্প কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে যেন ইরানের সম্পর্ক তিক্ত না হয়, সেজন্য ইরান ইরাকে অবস্থিত মার্কিন স্থাপনাগুলোর ওপর কোনো ধরনের আক্রমণ পরিচালনা থেকে বিরত থাকার জন্য ইরানি–সমর্থিত ইরাকি মিলিশিয়াগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। অন্যদিকে, ইসরায়েল ক্রমাগত ইরানকে উস্কানি দিয়ে চলেছে। এখন ক্রমাগত উস্কানির মুখে ইরান তার বাস্তববাদী অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হবে কিনা, সেটাই প্রশ্ন।