আমরা সবাই শান্তি চাই, কেও অশান্তি চাইনা। তবে কখনো কখনো আপন স্বার্থ কিংবা অন্যের স্বার্থের বলি হয়ে কেও কারো উপর ঝাঁপিয়ে পরে আবার কেও নিজের অস্তিত্ব, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে লড়ে যায়। নিউ কলোনিয়ালিজমের কারণে এখন আর বড়রা ছোট দেশগুলোতে ঝাঁপিয়ে পরে দখল দারিত্ব নিতে চায়না বরং তারা চায় সে অঞ্চলের লোকেরা নিজেরাই লড়ে ধ্বংস হয়ে আপনাতেই তার আধিপত্য ও আনুগত্য মেনে নিক। এমনি এক কঠিন সমীকরণের মাঝে পরে অস্থিতিশীল অঞ্চলের স্বীকৃতি পেয়েছে নাগারনো কারাবাখ।
ককেশাস অঞ্চলের দুই সাবেক সেভিয়েত অঞ্চলগুলোর মাঝে ভৌগুলিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হল আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান। আজারবাইজান হয়ে যেমন রাশিয়া সহজেই ককেশাস পার হয়ে আরব অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ করতে পারে, একইভাবে ককেশাসের পরেই রাশিয়ার জন্যে আনাতোলিয়া ও বলকানের প্রবেশদ্বার বলা যায় আর্মেনিয়াকে। আপন সুবিধার কারণেই রাশিয়া ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা দেয়ার পরেও দেশ দুটির সাথে নিজের আপন সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তাই বিশ্বে বাকু ও ইয়েরেভেন উভয়েই রাশিয়ার অন্যতম মিত্র অঞ্চল হিসেবেই পরিচিত। একই সাথে কূটনৈতিক দিক দিয়ে আর্মেনিয়াই এমন একটি দেশ যে রাশিয়া ও মার্কিন বেল্ট তথা নেটো উভয় পক্ষের সাথে তাল মিলিয়ে চলে। কৃষ্ণ সাগরে আধিপত্য বিস্তারে আর্মেনিয়াকে রাশিয়ার যেমন প্রয়োজন ঠিক তেমনি আনাতোলিয়ায় ব্যালেঞ্চ রক্ষার ক্ষেত্রেও নেটোর কাছে ইয়ারেভেন মূল্য ততটুকুই তাই এ অঞ্চলের শক্তিশালী কূটনৈতিক শক্তির দেশ আর্মেনিয়া বললেও অত্যুক্তি হবে না।
১৯৯১ সালের কারাবাখ যুদ্ধ
সেভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর অঞ্চল দুটি রাশিয়া স্বাধীন করে দিলেও নিওকলোনিয়ালিজমের থিউরি অনুসারে রাশিয়া দেশ দুটিতে অসম্পূর্ণ স্বাধীনতার চুক্তিপত্র তৈরি করায় স্বাধীনতার পর থেকেই দেশ দুটি একে অপরের শত্রু হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। প্রতিবেশি দেশ হিসেবে পারস্পারিক উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক বাজার ও কর্ম সংস্থানে উভয়ে একে অপরের পরিপুরক হওয়ার পরিবর্তে ইতিমধ্যে কয়েক দফা বড় যুদ্ধ ও সীমান্ত যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ নিরাপত্তার স্বার্থে পালাতে বাধ্য হলেও কোন সুনির্দিষ্ট সমাধানে আসতে পারেনি। অপর দিকে বিশ্ব শক্তিগুলো যুদ্ধ লাগলে শুধুমাত্র যুদ্ধবিরতীর আবেদন জানায় আর তাদের মাঝে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করার আহবান জানালেও বিশ্ব মোড়লেরা কোন এক অজানা কারণেই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের কোন বাস্তবিক পরিকল্পনা উত্থাপন করেনি।
সাধারণ জ্ঞানের সে নাগারনো কারাবাখ যে এত গভীর সমস্যা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা এ বছরের যুদ্ধের আগে খুব কম মানুষই জানতো। দেশ ভাগাভাগির সময় রাশিয়া আর্মেনিয়া অধ্যুষিত নাগারনো কারাবাখ দিয়ে দিল আজারবাইজানকে অথচ আগে থেকেই জানাই ছিল কারাবাখ আজারবাইজানের সাথে থাকতে ইচ্ছুক না। অন্যদিকে আর্মেনিয়ার পশ্চিম দক্ষিনে ইরান ও তুর্কি সিমান্তের সাথে নাকশিবাম আজারবাইজান অধ্যুষিত অঞ্চলও পেল আজারবাইজান। মাঝখানে রইল ইরান সিমান্তের সাথে সম্পৃক্ত আর্মেনিয়ান মেগরি করিডোর। দেশ ভাগের এই নীতিই মূলত আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ান বৈরী সম্পর্ককে না কমিয়ে আরও উস্কে দিয়েছে। যা বর্তমানে সমস্যার সমাধান অপেক্ষার অধিকরতর জটিল সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
প্রতিপক্ষের অপেক্ষায় ট্যাংক বিগ্রেড
আজারবাইজানের মাঝে আর্মেনিয়ান করিডোর না দিয়ে এক চিলতে করিডোরের মাধ্যমে আজারি অধ্যুষিত নাকশিবাম আজারবাইজানের সাথে যুক্ত করে লাচির মাধ্যমে আর্মেনিয় অধ্যুষিত কারাবাখ আর্মেনিয়ার সাথে সংযুক্ত করে দিলেই সমস্যা সমাধান সম্ভব ছিল। কিন্তু এ কাজ না করে দুই বিপরীত অঞ্চলকে দুই দেশের সীমার মাঝে ফেলে দুই দেশকেই স্বজাতি ও স্বদেশের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে দিয়েছে। আজারবাইজানের সিমান্ত অনেকাংশে দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী পুল্যান্ডের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় যা কিনা অবশেষে ৬ কোটি মানুষের হত্যাজজ্ঞের পর শান্ত হয়েছিল। সীমান্ত বিভাজনের পূর্বে অবশ্যই রাশিয়ার কাছে এ বিষয়টি অজানা ছিলনা।
মানচিত্রে বিরোধপূর্ণ অঞ্চল
দেশ ভাগের পর যখন আন্তর্জাতিকভাবে উভয় দেশ স্বীকৃতি লাভ করলে কারাবাখ হটাৎ করেই দাবী করে বসে তারা আজারবাইজানের সাথে থাকবেনা বরং কেন্দ্রের সাথে কোনোরূপ সিদ্ধান্ত ছাড়াই নিজেরাই গণভোটের আয়োজন করে কারাবাখকে আর্মেনিয়ার সাথে সংযুক্ত করার ঘোষণা দেয়। সাধারণভাবেই আজারবাইজান এর বিরোধীতা করলে ও কারাবাখের নিয়ন্ত্রন নিজেদের হাতে নেয়ার চেষ্টা করলে আর্মেনিয়া। স্ব-জাতি বাঁচানোর নামে আজারবাইজান হামলা করে বসে এবং কারাবাখ সংলগ্ন আরও কিছু অঞ্চল দখল করে নিয়ে কারাবাখ ও দখলকৃত অঞ্চলে কয়েকটি স্থায়ী সেনা স্থাপনা নির্মানের পাশাপাশি স্থানিয় আর্তসেক গেরিলাদের আরও শক্তিশালী করে গড়ে তুলেছে। শুরু হল দুই জাতির আভ্যন্তরীণ সংঘাত। প্রথম কারাবাখ যুদ্ধ চলে ১৯৮৮-১৯৯৪ সাল পর্যন্ত। এর পর থেমে থেমে যুদ্ধ ও সীমান্ত যুদ্ধ চলতে থাকে।
অভিভাবক হিসেবসে রাশিয়া বরাবরের মতই উভয় পক্ষে দূতিয়ালি করেছে এবং সমস্যার সমাধানে যত না এগিয়েছে তারচাইতে নিজের অস্রের বড় বাজার হিসেবেই দেশ দুটিকে বেশী বিবেচনা করেছে। দুই দেশই অস্রভান্ডার সমৃদ্ধ করায় সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়ে বরং আরও বেশী ঘোলাটে হয়েছে। আগেই বলেছি বিশ্বের প্রথম কোন রাশিয়ান মিত্র হিসেবে আর্মেনিয়া ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান সাপোর্টও কমবেশি পেয়ে থাকে। অপরদিকে আজারবাইজানে পক্ষ্যে দাড়ানোর কেউ ছিলনা। ফলে সমস্যার সমাধান না এসে সঙ্কট আরও বেশী ঘনীভূতই শুধু হয়েছে। অধিকাংশ সময়েই দেখা গিয়েছে আন্তর্জাতিক কমিউনিটি বলেছে নাগারনো কারাবাখ আজারবাইজানের ভূমি কিন্তু যখনই আজারবাইজান আপন ভূমির দখল দারিত্ব নিতে চেয়েছে তখনই মানবতার কথা বলে কিংবা আঞ্চলিক স্থিতিস্থাপকতার কথা বলে কোন না কোনভাবে আজারবাইজানকে কোণঠাসা করে আর্মেনিয়াকে তার দখলদারিত্ব চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
আর্তসেক মিলিটারি
আর্মেনিয়া আগে থেকেই জানে তার দেশের আর্মি আজারবাইজানের বৃহৎ আর্মির সাথে যুদ্ধে সহজেই পেরে উঠবেনা তাই সে রাশিয়ার সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি করে। এখানে রাশিয়া রাষ্ট্রদ্বয়ের শোভাকাঙ্খির দাবী করলেও বিরোধপূর্ণ অঞ্চল নিয়ে এক পক্ষের সাথে সামরিক চুক্তি করায় বুঝাই যায় রাশিয়া নিজেও চায়না আজারবাইজান তার অধিকার ফিরে পাক। অপর দিকে আজারবাইজানের ছিল ত্রাহি অবস্থা, একদিকে আন্তর্জাতিক চাপ ও রাশিয়ার চাপের পাশাপাশি নাগারনো কারাবাখের অবস্থানগত কারণেও খুব বেশী সুবিধা করতে পারছিলনা।
অবস্থানগতভাবে আর্মেনিয়ান সেনা পোস্টগুলো সুবিধা অবস্থান অবস্থানে থাকায় স্থল অভিযান কঠিন, এমন আকাশ শক্তিও আজারবাইজানের নেই যার দ্বারা একটি অলআউট যুদ্ধে জয়ী হওয়ার যায়। সেই সাথে অঞ্চলটি আজারবাইজানের ভিতরে হওয়ায় সামগ্রিক যুদ্ধ হবে আজারবাইজানের ভূমিতে। অন্যদিকে যুদ্ধ শুরু হলে আর্মেনিয়ার ভারি গোলাবারুদ অবশ্যই আশপাশের শহর ও অঞ্চলগুলোকেই জ্বালিয়ে দিবে এবং যুদ্ধের সুযোগে দূরবর্তি নাকসিবামও হারাতে হতে পারে। সামগ্রিকভাবে আজারবাইজানের লাভের চাইতে লসের পাল্লাই বেশী ভারী ছিল।
কামান দাগাচ্ছে আর্মেনিয় সেনা
এই সুযোগে আর্মেনিয়া ও আর্তসেক ক্রমাগতহারে একটু একটু করে আজারবাইজানের কোশলগত অঞ্চলগুলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সব দেখে শুনেও বাকুর যেন তেমন কিছুই করার ছিলোনা। প্রধান মিত্র রাশিয়া প্রকাশ্যেই এখন আর্মেনিয়ার বন্ধু, শিয়া অধ্যুষিত হওয়ার পরও ইরান আজারবাইজান থেকেও আর্মেনিয়ার ঘনিষ্ঠ সুতরাং এ পক্ষথেকেও সাহায্যের আশা করা যায়না। তাই বাধ্য হয়েই আজারবাইজানকে বিকল্প এক পথ খুঁজতে নামতে হয়েছে।
যদিও শিয়া সুন্নি দ্বন্দ্ব তুরস্কের সাথে আজারিদের মনস্তাত্বিক দূরত্ব রয়েছে তবে জাতিগতভাবে আজারিরাও তুর্কি হওয়ায় তুরস্কের সাথে সহজেই মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আজারবাইজান এই সুযোগ হাতছাড়া না করে তুরস্কের সাথে বিভিন্ন সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয় এবং উভয় দেশের প্রশিক্ষণ, আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে তুরস্ককে একটি স্থায়ী যৌথঘাটি গাড়ার সুযোগ করে দেয়। এতে একদিকে নাকসিবাম হয় নিরাপদ এবং তুরস্কের কুর্দি মিলিশিয়া পিকেকের সাপ্লাই লাইনও তুরস্কের দখলে চলে আসে, এতে করে তুরস্ক এখন উভয় দিক থেকেই পিকেকের উপর চাপ প্রয়োগের সুযোগ পেয়েছে।
সামগ্রিক প্রস্তুতির শেষে অবশেষে চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বার আজারিরা কারাবাখ দখলের চূড়ান্ত অভিযানে নামে। পূর্বের মত আজারি বাহিনীকে ঠেকাতে আর্মেনিয়া প্রস্তুত থাকলেও আজারবাইজান শুরুতেই স্থল অভিযানে না গিয়ে ড্রোন অভিযানকেই অগ্রাধিকার দেয়ায় আর্মেনিয় বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যূহে ফাটল ধরে এবং এ সুযোগে স্থল বাহিনী অলআউট এটাকে গেলে আর্মেনিয়া আর পেরে উঠেনি। সর্বশেষ ৯ই নভেম্বর আর্মেনিয়া তার পরাজয় স্বীকার করে সকল আর্মেনিয় সেনাদের সরিয়ে দখলকৃত অঞ্চল আজারবাইজানের কাছে ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নিকোল পেশিনিয়ান চুক্তিপত্রে সাক্ষ্যর করেছেন।
আক্রমনে আজারবাইজান-২০২০
যদিও আপাতত মনে হচ্ছে সমস্যার সমাধান হয়েছে, তবে সামগ্রিকভাবে ভবিষ্যতে এ চুক্তি শান্তি বয়ে আনবে না কি আবারো দুই জাতির মাঝে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাঁধাবে তা সময়েই বলবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অপজিশনদের বিক্ষোভ ও তাকে হত্যার মত জঘন্য প্রচেষ্টা এবং বিদেশে অবস্থানরত আর্মেনিয়দের বিদ্বেষপূর্ণ ও উসকানিমূলক প্রচারণা ইঙ্গিত দিচ্ছে এ অঞ্চলে শান্তি এত সহজেই আসবে না। তবে ততদিন পর্যন্ত যুদ্ধ মুক্ত থাকুক ও জনজীবনে শান্তি আসুক এটাই কামনা।