সারাহ ম্যাকব্রাইড: যোগ্যতা এবং সাহসিকতার এক অনন্য মিশেল

সারাহ ম্যাকব্রাইড: যোগ্যতা এবং সাহসিকতার এক অনন্য মিশেল

সংখ্যালখু সম্প্রদায় প্রায় অধিকাংশ সময়ই অবহেলার মাঝে জীবন কাটান। আমরা ভেবেই নেই, সংখ্যায় কম বলেই তারা বুঝি একেবারেই অন্য জগতের মানুষ, যেন সাধারণ মানুষের মতো মানুষ হিসেবে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকবারও অধিকার নেই তাদের। কিন্তু মানবিকতা আর বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। যখন এই সংখ্যালঘু অবহেলিত জনগোষ্ঠীই নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন, যোগ্যতা, নিজেদের জন্য কিছু করবার সৎ সাহস আর দূরদর্শিতা দ্বারা তারা যে আকাশ ছুঁতে পারেন, সেটিই আরো একবার প্রমাণ করে দেখালেন যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের নির্বাচনে ডেলাওয়ারের নির্বাচিত স্টেট সিনেটর সারাহ ম্যাকব্রাইড, লিঙ্গ রূপান্তরকারী এই স্টেট সিনেটর যুক্তরাষ্ট্রের সর্বপ্রথম ট্রান্সজেন্ডার, যিনি দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সক্রিয় ভাবে পদক্ষেপ রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

১৯৯০ সালের ৯ আগস্ট ডেলাওয়ারের উইলমিংটনে জন্ম গ্রহণ করা সারাহ ব্যক্তিগত জীবনে UNHRC এর ন্যাশনাল প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে ট্রান্স রাইট এবং এলজিবিটিকিউ রাইটস নিয়ে কাজ করতেন। এই হিউম্যান রাইটস একটিভিস্ট শৈশব থেকেই তার আশেপাশে ঘটে আসা বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়ে ছিলেন সদা সচেতন। ডেলাওয়ারে মানুষের দুঃখ দুর্দশা এবং তাদের অধিকার নিয়ে নিজস্ব সচেতনতার অভাব সারাহ কে বরাবরই আঘাত দিত।

সারাহ মনে করেন, কেউ যদি সমাজে পরিবর্তন আনতে চায়, তবে অন্য কারো এগিয়ে আসার অপেক্ষা না করে প্রথম উদ্যেগটা নিতে হবে নিজেকেই। সারাহ বলেন, আমি যখন দেখতাম ডেলাওয়ারে একজন অসহায় পিতা নিজের মাদকাসক্ত কন্যার চিকিৎসার ব্যয়ভার এবং পরিবারের ব্যয়ভার বহন করা নিয়ে অসীম দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন কিংবা গর্ভবতী নারী আশঙ্কা করছেন গর্ভবতীকালীন অসুস্থতায় তাকে হয়তো কর্মক্ষেত্র থেকে একদিনের অবসর নিতে হলে তার বেতনেও কিছুটা ছাড় দিতে হবে, তখন আমি বুঝতে পারলাম অন্যান্য এলাকা গুলো থেকে ডেলাওয়ার আজও পিছিয়ে আছে। এবং আমাকে অবশ্যই সাহায্য করতে হতো তাদের। আমাকে অবশ্যই কিছু একটা করতে হতো তাদের জন্য যারা আমাকে এত সুন্দর একটি বেড়ে ওঠার পরিবেশ দান করেছেন; যে এলাকাটিতে আমি কিছু চমৎকার মানুষের সংস্পর্শ লাভ করেছি।

সারাহ জন্ম নেন ডেভিড ম্যাকব্রাইড এবং স্যালি ম্যাকব্রাইডের পরিবারে। আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া চলাকালীন সময়ে ২০১১ সালে সারাহ ছাত্র পরিষদ স্কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সেই সময়েই সর্বপ্রথম নিজের সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন জনসম্মুখে প্রকাশ করাটা সারাহর জন্য যতখানি চ্যালেঞ্জিং ছিল, ঠিক ততখানিই ছিল অনুপ্রেরণাদায়কও। দ্য ইগল নামক বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাগাজিনে তাকে নিয়ে একটি আর্টিকেলও প্রকাশিত হয়। কেবল তাইই নয়, তার নিজেকে প্রকাশ করা নিয়ে প্রশংসাসূচক আর্টিকেল প্রকাশ করে “এনপিআর দ্য হাফিংটন পোস্ট এবং লেডি গাগার “দিস ওয়ে ফাউন্ডেশন ও।

সারাহ র এই সাহসিকতাকে স্বাগত জানিয়ে ডেলাওয়ারের তৎকালীন এটর্নি জেনারেল বিউ বিডেন বলেন, “আমি তোমাকে নিয়ে গর্ববোধ করি, সারাহ! তোমার এই সাহসী পদক্ষেপ কোনোভাবেই বিডেন পরিবারে তোমার অবস্থানকে প্রভাবিত করবে না। তুমি বিডেন পরিবারের অংশস্বরূপ ছিলে এবং থাকবে!” তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সারাহর আত্মপ্রকাশে ইতিবাচক অনুভূতি প্রকাশ করেছিলেন এবং গর্ববোধ করেছিলেন সারাহর সাহসিকতায়। সারাহ ২০১২ সালে হোয়াইট হাউজের এর “পাবলিক এনগেজমেন্ট এবং ইন্টারগর্ভমেন্টাল এফেয়ার্স” সংসদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিই একমাত্র ট্রান্সজেন্ডার, যিনি হোয়াইট হাউজের সর্বপ্রথম সক্রিয় রাজনৈতিক দায়িত্বপালনকারী।

সারাহ বলেন, “পরিবর্তন আনতে চাইলে ইতিবাচকতা এবং সৎসাহসের প্রয়োজনীয়তা সর্বাধিক। আমি নিজেকে চিনি এবং জানি। মনে করি এই সকল বৈশিষ্ট্যই আমার মাঝে বিদ্যমান। আর তাই নিজের এলাকার মানুষের জন্য কিছু করার প্রচেষ্টা আর আন্তরিকতা থেকেই আমার এই পথচলা। ২০১৬ সালে সারাহ ”ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কনভেনশন এ প্রথম ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে নিজের মূল্যবান বক্তব্য রাখেন। ২০১৩ তে সারাহ ডেলাওয়ারের জেন্ডার আইডেন্টিটি বৈষম্যবিরোধী ক্যামপেইনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

সারাহ বলেন, “আজ থেকে আট বছর পূর্বে যেই মনোবল নিয়ে আমি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অর্থাৎ আমার কম্যুনিটির বিরুদ্ধে বৈষম্য দূরীকরণের জন্য রাজপথে নেমেছিলাম, অবিকল সেই মনোবল আর সততাই আমাকে আজ ডেলাওয়ারের স্টেট সিনেটর এর পদটির জন্য নির্বাচনে লড়াই করতে প্রেরণা যুগিয়েছে।”

স্টিভ ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে স্টেট নির্বাচনে সারাহ ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। স্টিভ সহৃদয়তার সাথে অভিবাদন জানিয়েছেন সারাহ কে। এলজিবিটিকিউ রাইটস নিয়ে সারাহ সবসময়ই সক্রিয় ছিলেন। এ বিষয়ে বক্তব্য রেখেছেন অসংখ্য কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ইভেন্টে। “আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ভিক্টরি ফান্ড ন্যাশনাল ব্রাঞ্চ ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়া সহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানে। ২০১৪ সালে সারাহ “ডেলাওয়ার লিবারেল.নেট এর সেরা ১০০ লিবারেলের মাঝে জায়গা করে নেন। ২০১৫ তে ‘নিউজস্টেটম্যান তাদের একটি আর্টিকেলে ভবিষ্যৎ আশা ব্যক্ত করেন যে সারাহই হবেন ভবিষ্যতে ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে রাজনীতিতে পদক্ষেপ গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি। ২০১৮ এর ৬ মার্চে “টুমরো উইল বি ডিফরেন্টঃ লাভ, লস এন্ড দ্য ফাইট ফর ট্রান্স ইক্যুয়ালিটি নামে সারাহর একটি বই প্রকাশিত হয়।

এতসব আশার বাণী আর সমর্থনে ভরপুর সারাহ জীবন গড়েছেন ইতিবাচকতা আর ন্যায়বিচার দিয়ে। একটি ইন্টারভিউ তে সারাহ কে প্রশ্ন করা হয়, “আত্মপ্রকাশ করার ক্ষেত্রে কোন অনুভূতি সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে আপনার জন্য?

এমন প্রশ্নের জবাবে সারাহ বলেন, “আমি যখন ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করি, আমি সেই মুহূর্ত থেকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতাম, প্রত্যেকটি গল্প এবং প্রত্যেকটি কন্ঠস্বর গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখনই আপনার গল্পটি জনসম্মুখে আনবেন, আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন, কিছু মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পারে আপনার বাণী। কিছু মানুষকে সাহস যোগাতে পারে আপনার বাণী। হয়তো আপনার সৎ সাহস থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে আপনারই সাহসী পদাঙ্ক অনুসরণ করবে অসংখ্য মানুষ। আর তাই, নিজেকে প্রকাশ করা টা গুরুত্বপূর্ণ।

এলজিবিটিকিউ পলিটিক্যাল একশন কমিটি বলেছে, সারাহর এই বিজয় সেইসব ট্রান্সজেন্ডার দের অনুপ্রাণিত করবে যারা তাদের সাধারণ মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত এবং যারা মনে করেন তাদের দ্বারা কিছুই সম্ভব নয়।

নির্বাচিত সারাহর সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। তিনি কাজ করবেন ডেলাওয়ারের অধিবাসীদের পরিপূর্ণ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণ, সম্পূর্ণ বেতন পরিশোধ করে ছুটি নিশ্চিতকরণ, ক্রিমিনাল জাস্টিস আইন এর সংস্করণ এবং ডেলাওয়ারের শ্রমিক দের মজুরি বৃদ্ধির লক্ষ্যে।

যৌবনে সারাহ যখন নিজের আত্মপরিচয় নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিলেন তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার কম্যুনিটির মানুষ দের জন্য ব্যাপার টা কতখানি চ্যালেঞ্জিং। যদিও সারাহ বুঝতে পারতেন, তিনি যে লিঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন সেটি থেকে তার সেক্সুয়্যাল ওরিয়েন্টেশন সম্পূর্ণ আলাদা তবু সেটি মেনে নিতে তার পরিশ্রম করতে হয়েছিল। সারাহ বলেন, “আমি যখন আয়নার সামনে দাঁড়াতাম, আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হতো, আমি ট্রান্সজেন্ডার। কিন্তু পরক্ষণেই আবার যেন নিজেকে নিজেই বোঝাতাম, নাহ! আমি নই!

সারাহ চান, তার কম্যুনিটির মানুষেরা প্রতিনিয়ত নিজেদের আত্মপ্রকাশ করুক। মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখুক। কারণ তিনি মনে করেন, নিজেকে লুকিয়ে বসে থাকা কোনো মানুষের জন্যই শুভ নয়। ওটা আত্মাকে ছোট করে দেয়। মূলত সমাজে একটি পরিবর্তন আনার লক্ষ্যেই সারাহ এর রাজনীতিতে আগমন।

ব্যক্তিগত জীবনে সারাহ এন্ড্রু ক্রে এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। জীবনসঙ্গী এন্ড্রু ভুগছেন দুরারোগ্য ওরাল টাং ক্যান্সারে। সারাহ এবং এন্ড্রু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ২০১৪ সালে। এন্ড্রু বরাবরই সারাহ কে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা প্রদান করে গেছেন। ২০১৪ এর মার্চে তিনি এলজিবিটিকিউ কম্যুনিটি তে হেলথ ইন্স্যুরেন্স এর জন্য একটি ক্যামপেইন আয়োজন করেন। সেখানে এন্ড্রু বলেন, “এলজিবিটিকিউ কম্যুনিটি স্বতন্ত্র এবং শক্তিশালী। আমাদের এই আয়োজন মূলত তাদের জন্যই যারা অবহেলিত এবং যাদের সামনে তাদের সম্পূর্ণ জীবন পড়ে আছে। ক্যান্সার আমার থেকে হয়তো অনেক কিছুই কেড়েছে। কিন্তু এটি স্বপ্ন এবং আশা কেড়ে নিতে পারে নি।

৩০ বছর বয়সী সারাহ বিশ্বাস করেন, তিনি একদিন ডেলাওয়ারের জনগণদের এমন একটি পর্যায়ে আনতে সক্ষম হবেন, যেখানে তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জনসম্মুখে আওয়াজ তুলতে পারবে। নিজেদের বিরুদ্ধে যেকোনো অবিচার নিয়ে প্রতিবাদ করবে। ডেলাওয়ার কে তিনি প্রতিনিয়ত উন্নত করতে চান এবং এগিয়ে নিতে চান।

সারাহ বলেন, আমার বিশ্বাস আমি তা পারবো। কারণ এই লড়াইটি আমি নিজেও লড়েছি। এই চ্যালেঞ্জটির ভুক্তভোগী আমি নিজেও। ট্রান্সজেন্ডার কম্যুনিটির অনুপ্রেরণার আধার সারাহ এখন তার লক্ষ্যে কতখানি সফল হোন সেটিই দেখবার বিষয়!।

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত