জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ এই প্রবাদটিকে যদি কোনো রাষ্ট্রের অবস্থানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে পূর্ব এশীয় রাষ্ট্র মঙ্গোলিয়া হবে সেই রাষ্ট্র। মঙ্গোলিয়া অবশ্য একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র (কার্যত ‘আবদ্ধ সমুদ্রসীমা’বিহীন বিশ্বের বৃহত্তম স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র), এজন্য তার জন্য এই প্রবাদের ‘জলে কুমির’ অংশটি আক্ষরিকভাবে প্রযোজ্য নয়, কিন্তু বাস্তবিক অর্থে মঙ্গোলিয়ার জন্য ‘দুইদিকের ডাঙাতেই বাঘ’। কারণ, মঙ্গোলিয়ার উত্তরে রুশ ফেডারেশন (আয়তনে বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র) এবং দক্ষিণে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন (জনসংখ্যায় বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্র) অবস্থিত, যাদের সঙ্গে মোঙ্গল যাযাবরদের প্রতিযোগিতা/প্রতিদ্বন্দ্বিতা/শত্রুতা করার সুযোগ আক্ষরিক অর্থেই শূণ্য শতাংশ।
মঙ্গোলিয়া দেশটি আয়তনে নেহায়েত ছোট নয়, দেশটির আয়তন ১৫,৬৬,০০০ বর্গ কি.মি., অর্থাৎ আয়তনের দিক থেকে রাষ্ট্রটি বাংলাদেশের তুলনায় ১০ গুণ বড়! কিন্তু সুবৃহৎ এই রাষ্ট্রটির জনসংখ্যা মাত্র ৩৩,৫৩,৪৭০ জন। অর্থাৎ, রাষ্ট্রটির জনসংখ্যা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম শহরের জনসংখ্যার চেয়েও কম। ‘মোঙ্গল উলস’ (মোঙ্গল: Монгол Улс) নামে পরিচিত এই রাষ্ট্রটি ঐতিহাসিক মঙ্গোলীয় ভূমির উত্তরাংশে অবস্থিত, যেটি ‘বাহির মঙ্গোলিয়া’ (Outer Mongolia) নামে পরিচিত। উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক মঙ্গোলীয় ভূমির দক্ষিণাংশ ‘অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়া’ (Inner Mongolia) নামে পরিচিত, এবং ১১,৮৩,০০০ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট এই ভূমি বর্তমানে চীনের অন্তর্গত।
জাতিগতভাবে, মঙ্গোলিয়ার জনসংখ্যার ৯৬% মঙ্গোল, ৩% কাজাখ এবং বাকি ১% অন্যান্য জাতিভুক্ত। ধর্মগতভাবে, মঙ্গোলিয়ার জনসংখ্যার ৫৩% বৌদ্ধ, ৩৮.৬% ধর্মহীন, ৩% মুসলিম এবং বাকি ৭.৪% অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। মঙ্গোলিয়ার ২১টি প্রদেশের মধ্যে সর্ব পশ্চিমের ‘বায়ান-ওলগি’ প্রদেশটি কাজাখ ও মুসলিম-অধ্যুষিত, কিন্তু রাষ্ট্রটিতে কোনো গুরুতর জাতিগত বা ধর্মীয় সমস্যা নেই। রাষ্ট্রটির জনসংখ্যার প্রায় ৩০% এখনো যাযাবর, এবং মোট জনসংখ্যার ৪৫% রাজধানী উলানবাতারে বসবাস করে।
মঙ্গোলীয় সেনাবাহিনীর একদল সৈনিক
রুশ ভাল্লুক এবং চীনা ড্রাগনের মধ্যে পিষ্ট মঙ্গোলিয়ার পররাষ্ট্রনীতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মঙ্গোলিয়ার স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা। কিন্তু ভাল্লুক আর ড্রাগন যখন কোনো রাষ্ট্রের একমাত্র প্রতিবেশী, তখন এই কাজ বহুলাংশেই কঠিন। নিজস্ব স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য মঙ্গোলীয় নীতিনির্ধারকরা একটি বিশেষ পন্থা অবলম্বন করেছেন, যেটি ‘তৃতীয় প্রতিবেশী নীতি’ (Third Neighbor Policy) নামে পরিচিত। এই নীতির সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে মঙ্গোলিয়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং ‘থ্রেট পার্সেপশন’ সম্পর্কে জেনে নেয়া প্রয়োজন।
এককালে মঙ্গোলিয়া ছিল প্রচণ্ড শক্তিশালী একটি রাষ্ট্র। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে চেঙ্গিস খান ও তাঁর বংশধরদের নেতৃত্বে মোঙ্গলরা এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। ৩ কোটি ৩০ লক্ষ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট মোঙ্গল সাম্রাজ্য ছিল মানব ইতিহাসের বৃহত্তম স্থল সাম্রাজ্য, এবং বর্তমান বৃহৎশক্তি রাশিয়া ও চীন উভয়েই সেসময় মঙ্গোল অশ্বারোহীদের পদানত ছিল। পশ্চিমে পোল্যান্ড থেকে পূর্বে কোরীয় উপদ্বীপ পর্যন্ত এবং উত্তরে সাইবেরিয়ায় অংশবিশেষ থেকে দক্ষিণে ওমান উপসাগর ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত মোঙ্গলদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মোঙ্গলরা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তাদের সাম্রাজ্য খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যায়। অবশেষে সপ্তদশ শতাব্দীতে চীনকেন্দ্রিক চিং সাম্রাজ্য প্রথমে অভ্যন্তরীণ/দক্ষিণ মঙ্গোলিয়া এবং পরবর্তীতে বাহির/উত্তর মঙ্গোলিয়া দখল করে নেয়। পরবর্তী দুই শতাব্দী মঙ্গোলিয়া চিং সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ছিল।
১৯১১ সালের চীনা বিপ্লবের ফলে চিং সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং এর ফলে সৃষ্ট গোলযোগের সুযোগে মোঙ্গল ধর্মীয় নেতা বোগদ খানের নেতৃত্বে বাহির/উত্তর মঙ্গোলিয়া ‘মঙ্গোলিয়া বোগদ খানাত’ হিসেবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। চিং সাম্রাজ্যের স্থলে স্থাপিত ‘চীন প্রজাতন্ত্র’ মঙ্গোলিয়ার স্বাধীনতাকে মেনে নেয় নি, কিন্তু মঙ্গোলিয়া রুশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে এবং রুশ সম্রাট মঙ্গোলিয়ার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের ফলে রুশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং রাশিয়ায় বলশেভিক ও বলশেভিকবিরোধীদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই সুযোগে ১৯১৯ সালে চীনা সৈন্যরা ‘মঙ্গোলিয়া বোগদ খানাত’ দখল করে নেয়, কিন্তু ১৯২১ সালে ব্যারন রোমান ভন উঙ্গের্ন–স্তের্নবুর্গ নামক একজন বলশেভিকবিরোধী রুশ সেনা কর্মকর্তা তাঁর সৈন্যদল নিয়ে মঙ্গোলিয়ায় প্রবেশ করেন। তাঁর নেতৃত্বে রুশ ও মোঙ্গল সৈন্যরা মঙ্গোলিয়া থেকে চীনা সৈন্যদের বিতাড়িত করে, এবং মঙ্গোলিয়া পুনরায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
১৯২০–এর দশকে একদল মঙ্গোলীয় সৈন্য ও তাদের সোভিয়েত উপদেষ্টাবৃন্দ
কিন্তু ১৯২১ সালে মঙ্গোলীয় বলশেভিকরা রুশ বলশেভিকদের সহায়তায় উঙ্গের্ন–স্তের্নবুর্গকে পরাজিত করে এবং মঙ্গোলিয়ার ক্ষমতা দখল করে। ১৯২৪ সালে মঙ্গোলিয়ায় রাজতন্ত্রকে বিলুপ্ত করা হয়, এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী মঙ্গোলিয়া’ সোভিয়েত ইউনিয়নের পর বিশ্বের দ্বিতীয় কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। পরবর্তী প্রায় ছয় দশক ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল মঙ্গোলিয়ার স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার ‘রক্ষক’। ১৯৩০–এর দশকে জাপান প্রথমে মাঞ্চুরিয়া এবং পরবর্তীতে অভ্যন্তরীণ/দক্ষিণ মঙ্গোলিয়া ও চীনের বিরাট এক অংশ দখল করে নেয়, এবং মঙ্গোলিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গেও জাপানের সীমান্ত সংঘাত শুরু হয়। জাপান মঙ্গোলিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের এশীয় অংশ দখল করতে আগ্রহী ছিল এবং এজন্য এতদঞ্চলে আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করে।
১৯৩৯ সালে জাপান মঙ্গোলিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আক্রমণ চালায়, কিন্তু প্রচণ্ড যুদ্ধের পর সোভিয়েত ও মঙ্গোলীয় সৈন্যরা জাপানি আক্রমণ প্রতিহত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মঙ্গোলিয়া জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়া ও মাঞ্চুরিয়া থেকে জাপানিদের বিতাড়িত করে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চীন প্রজাতন্ত্র’ তখন পর্যন্ত মঙ্গোলিয়ার স্বাধীনতাকে কার্যত স্বীকার করে নেয় নি, কিন্তু গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত, রাজনৈতিকভাবে খণ্ডিত, অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত ও সামরিকভাবে দুর্বল চীনের ‘কুয়োমিনতাং’ সরকারের পক্ষে তখন সোভিয়েত–সমর্থিত মঙ্গোলিয়াকে আক্রমণ করা সম্ভব ছিল না। ১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠার পরেও চীনা সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য প্রাথমিকভাবে মঙ্গোলিয়ার ওপর চাপ প্রদান থেকে বিরত ছিল, কিন্তু ১৯৬০–এর দশকে চীনা–সোভিয়েত দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে মঙ্গোলিয়ার ওপর চীনের চাপ বৃদ্ধি পায়। মঙ্গোলিয়া নিজস্ব স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সোভিয়েত–নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ জোটে পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগদান করে এবং চীনা–মঙ্গোলীয় সীমান্ত বরাবর সম্ভাব্য চীনা আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য সোভিয়েতরা সেখানে কয়েক লক্ষ সৈন্য মোতায়েন করে রাখে।
১৯৩৯ সালের জাপানি–মঙ্গোলীয় যুদ্ধের সময় একদল মঙ্গোলীয় সৈন্য
কিন্তু ১৯৮৫ সালে মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর সোভিয়েত পররাষ্ট্রনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন আসে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের লক্ষ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন মঙ্গোলিয়া (এবং চীনা–সোভিয়েত সীমান্ত) থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করে, এবং সোভিয়েত নিরাপত্তাকবচ হারিয়ে মঙ্গোলীয় নেতারা চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে বাধ্য হন। এদিকে ১৯৮৯–১৯৯০ সালে পূর্ব ইউরোপ জুড়ে কমিউনিজমের পতন ঘটে এবং এর ফলশ্রুতিতে ১৯৯০ সালে মঙ্গোলিয়াতেও কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটে।
বিংশ শতাব্দীতে মঙ্গোলিয়ার সার্বভৌমত্বের প্রতি সবচেয়ে বড় হুমকি ছিল প্রথমে জাপান এবং পরবর্তীতে চীন। এমতাবস্থায় নিজস্ব অস্তিত্ব রক্ষার্থে মঙ্গোলিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং মঙ্গোলিয়ায় মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সৈন্যদল ছিল মঙ্গোলিয়ার স্বাধীনতার নিশ্চয়তাস্বরূপ। কেবল সামরিক সহায়তাই নয়, মঙ্গোলিয়ার অর্থনীতিও সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর প্রায় সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন মঙ্গোলিয়াকে প্রচুর পরিমাণ অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করত এবং এক পর্যায়ে মঙ্গোলিয়ার জিডিপির এক–তৃতীয়াংশই ছিল সোভিয়েত সহায়তা। মঙ্গোলিয়ার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৮০% হতো সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে এবং ১৫% হতো সোভিয়েত–নেতৃত্বাধীন ‘কমিকন’ জোটের বাকি সদস্যদের সঙ্গে।
কিন্তু ১৯৮০–এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নে গর্বাচেভের উত্থানের পর এবং বিশেষত ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মঙ্গোলিয়া সেই সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা হারিয়ে ফেলে। প্রচণ্ড শক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থলাভিষিক্ত হয় সামরিকভাবে দুর্বল ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত রাশিয়া। ১৯৯০–এর দশকে রুশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বজায় থাকে কিনা, সেটি নিয়েই সংশয় ছিল, সুতরাং রাশিয়ার পক্ষে মঙ্গোলিয়াকে সোভিয়েত আমলের মতো সহায়তা প্রদান করা বা মঙ্গোলিয়ায় চীনা প্রভাব বিস্তার রোধ করা সম্ভব ছিল না।
২০১৫ সালে চীনের বেইজিংয়ে বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত একটি প্যারেডে মঙ্গোলীয় সৈন্যরা অংশগ্রহণ করে
এমতাবস্থায় মঙ্গোলিয়ায় চীনা প্রভাব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। বর্তমানে চীন মঙ্গোলিয়ার প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার। মঙ্গোলিয়ার মোট রপ্তানিদ্রব্যের ৮৫% চীন ক্রয় করে এবং মোট আমদানিকৃত দ্রব্যের ৩২.৬% আসে চীন থেকে। মঙ্গোলিয়া চীনা–পরিচালিত ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) প্রকল্পের একটি অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র, এবং খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ মঙ্গোলিয়ার গুরুত্ব চীনের জন্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্লেখ্য, মঙ্গোলিয়ায় বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কয়লা, তামা, স্বর্ণ, মলিবডেনাম, ইউরেনিয়াম, টিন ও টাংস্টেন।
মঙ্গোলিয়ায় চীনা অর্থনৈতিক আধিপত্যের পাশাপাশি সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের আশঙ্কাও মঙ্গোলীয় নীতিনির্ধারকদের মধ্যে রয়েছে। চীনা–মঙ্গোলীয় সীমান্ত ৪,৬৩০ কি.মি. দীর্ঘ এবং এত দীর্ঘ সীমান্ত কার্যকরভাবে সামরিকভাবে রক্ষা করা মঙ্গোলিয়ার ক্ষুদ্র সামরিক শক্তির পক্ষে অসম্ভব৷ চীন ও মঙ্গোলিয়ার সম্পর্ক কতটা ব্যাপক, সেটা তাদের একে অপরের ভূমিতে অবস্থিত কূটনৈতিক স্থাপনাগুলোর বিস্তার দেখলেই বোঝা যায়৷ মঙ্গোলিয়ার উলানবাতারে একটি চীনা দূতাবাস এবং জামিন–উদ শহরে একটি চীনা কনস্যুলেট অবস্থিত। অন্যদিকে, চীনের বেইজিং–এ একটি মঙ্গোলীয় দূতাবাস এবং এরেনহোৎ, হোহহোৎ, হংকং, হুলুনবুইর ও সাংহাইয়ে মঙ্গোলীয় কনস্যুলেট জেনারেল/কনস্যুলেট অবস্থিত।
তদুপরি, চীনাদের বিপুল জনসংখ্যাও সাধারণ মঙ্গোলীয়দের জন্য ভীতির কারণ। ইতোমধ্যে চীনের অন্তর্গত অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়ায় ‘ডেমোগ্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং’–এর মাধ্যমে চীনারা অঞ্চলটিকে একটি ‘হান চীনা’ অঞ্চলে পরিণত করেছে, এবং বর্তমানে অঞ্চলটির মাত্র ১৭% অধিবাসী জাতিগতভাবে মোঙ্গল। মঙ্গোলীয়দের আশঙ্কা, তাদের রাষ্ট্রেও অনুরূপ ঘটনা ঘটতে পারে। মঙ্গোলীয় রাজনীতিবিদরা তাদের জনসাধারণের মধ্যেকার চীনাভীতিকে আরো ব্যাপক করে তুলেছেন এবং মঙ্গোলীয় উগ্র জাতীয়তাবাদীরা মঙ্গোলিয়ায় বসবাসরত চীনা অভিবাসীদের ওপর আক্রমণও চালিয়েছে।
মঙ্গোলীয় নব্য নাৎসি এবং তীব্র চীনবিরোধী দল ‘ৎসাগান খাস’ এর পতাকা
চীনের অপ্রতিরোধ্য প্রভাবের মুখোমুখি হয়ে মঙ্গোলিয়া রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের প্রয়াস নিয়েছে এবং ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বাধীন পুনরুজ্জীবিত রাশিয়াও মঙ্গোলিয়ায় প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে মনোযোগ দিয়েছে। উভয় পক্ষের মধ্যে সামরিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনের পর রাশিয়া থেকেই মঙ্গোলিয়া সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে থাকে। রাশিয়া মঙ্গোলিয়াকে বাজারমূল্যের চেয়ে কম মূল্যে তেল ও গ্যাস সরবরাহ করে, রাশিয়ার নিকট মঙ্গোলিয়ার ঋণের ৯৮% তারা মওকুফ করে দিয়েছে এবং মঙ্গোলিয়ার মধ্য দিয়ে তারা রাশিয়া ও চীনের মধ্যে একটি পাইপলাইন নির্মাণ করছে। মঙ্গোলিয়ার খনিজ সম্পদের ক্ষেত্রে রাশিয়াও আগ্রহ দেখিয়েছে এবং খনিজ উত্তোলনে বেশ কয়েকটি রুশ কোম্পানি জড়িত। মঙ্গোলীয় জনসাধারণ চীনের তুলনায় রাশিয়াকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে, এবং ২০১৭ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, দেশটির ৯০% অধিবাসী রাশিয়াকে ‘মিত্র’ হিসেবে বিবেচনা করে।
কিন্তু চীনের তুলনায় রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং সামরিক দিক থেকেও সোভিয়েত আমলে সোভিয়েত ইউনিয়ন যেরকম চীনের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল, এখন আর তেমন পরিস্থিতি নেই। তদুপরি, রাশিয়া ও চীন এখন পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগী। এমতাবস্থায় রুশরা মঙ্গোলিয়াকে সম্ভাব্য চীনা ‘আগ্রাসন’ থেকে কতটুকু রক্ষা করবে বা করতে পারবে, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। তদুপরি, রাশিয়ার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতাও মঙ্গোলিয়ার জন্য পুরোপুরি পছন্দনীয় নয়।
কিন্তু মঙ্গোলিয়া একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র এবং তাদের জন্য বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন কঠিন। তা সত্ত্বেও মঙ্গোলীয় সরকার চীন ও রাশিয়া বাদে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই নীতিকে বলা হচ্ছে ‘তৃতীয় প্রতিবেশী নীতি’। ১৯৯০ সালের আগস্টে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বেকার মঙ্গোলিয়া সফর করেছিলেন এবং প্রস্তাব করেছিলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মঙ্গোলিয়ার জন্য একটি তৃতীয় প্রতিবেশী’ হতে পারে। এখান থেকেই ‘তৃতীয় প্রতিবেশী নীতি’ শব্দগুচ্ছটির উৎপত্তি। ২০১১ সালে মঙ্গোলীয় সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে মঙ্গোলিয়ার ‘পররাষ্ট্রনীতি ধারণা’য় (foreign policy concept) ‘তৃতীয় প্রতিবেশী নীতি’কে মঙ্গোলিয়ার পররাষ্ট্রনীতির একটি অন্যতম ভিত্তি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
বলাই বাহুল্য, তৃতীয় প্রতিবেশী’ হিসেবে মঙ্গোলিয়ার প্রথম ও প্রধান পছন্দসই রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কমিউনিজমের পতনের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে। মঙ্গোলিয়াকে ন্যাটোর ‘পার্টনারশিপ ফর পিস’ প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং মঙ্গোলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা বিস্তৃত রূপ ধারণ করে। তদুপরি, যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিত মঙ্গোলিয়াকে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে এবং মঙ্গোলিয়ার খনিজ সম্পদ উত্তোলনের সঙ্গেও বেশকিছু মার্কিন কোম্পানি জড়িত। কিন্তু মঙ্গোলিয়ার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে রাষ্ট্রটি মার্কিন বলয়ে সম্পূর্ণভাবে অঙ্গীভূত হতে ইচ্ছুক নয় এবং রুশ–মার্কিন ও চীনা–মার্কিন ভূরাজনৈতিক ও ভূঅর্থনৈতিক দ্বন্দ্বে মঙ্গোলিয়া যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষতা অবলম্বনের চেষ্টা করেছে।
মঙ্গোলীয় রাষ্ট্রপতি খালৎমাগিন বাত্তুলগা এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প
অবশ্য মঙ্গোলিয়া তার ‘তৃতীয় প্রতিবেশী’ হিসেবে কেবল যুক্তরাষ্ট্রকেই যে বেছে নিয়েছে এমন নয়। আরো বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের সঙ্গে মঙ্গোলিয়া সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছে জাপান। জাপান মঙ্গোলিয়ার অবকাঠামো উন্নয়নে, বিশেষত রেলপথ ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও সংস্কারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তদুপরি, মঙ্গোলিয়ার খনিজ সম্পদ উত্তোলন এবং দেশটিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জাপান ব্যাপকভাবে জড়িত। জাপানি মঙ্গোলীয় সম্পর্কের তাৎপর্য বুঝাতে মঙ্গোলীয় সরকার জাপানকে তাদের ‘প্রথম তৃতীয় প্রতিবেশী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের বাইরে বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গেও মঙ্গোলিয়া সুসম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে মঙ্গোলিয়ার নিকটবর্তী কাজাখস্তান উল্লেখযোগ্য। মাত্র ৩৭ কি.মি. ভূমি মঙ্গোলিয়াকে কাজাখস্তান থেকে পৃথক করেছে। কাজাখস্তানের সঙ্গে মঙ্গোলিয়া ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে এবং বহু মঙ্গোলীয় ছাত্রছাত্রী কাজাখস্তানে পড়াশোনা করে। তদুপরি, কাজাখস্তানের সঙ্গে মঙ্গোলিয়ার ঘনিষ্ঠ জাতিগত ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক বিদ্যমান। কাজাখস্তানও মঙ্গোলিয়ার মতো চীন ও রাশিয়া দ্বারা বেষ্টিত, সুতরাং কাজাখস্তানও মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে ইচ্ছুক। বিগত ৩০ বছরে রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে ৫০টিরও বেশি সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
চীনা–ভারতীয় ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে ভারতও মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ভারত ছিল মঙ্গোলিয়াকে স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রথম অ–কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। কিন্তু ভারতীয়–মঙ্গোলীয় সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে সৌহার্দ্যপূর্ণ হলেও তাদের মধ্যকার বাণিজ্যিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ এখন পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে সীমিত। অনুরূপভাবে, ইরান ও তুরস্কের সঙ্গে মঙ্গোলিয়া সুসম্পর্কে গড়ে তোলার আগ্রহ দেখিয়েছে। ইরান মঙ্গোলিয়া থেকে মাংস আমদানি করে এবং ইরানি পারমাণবিক প্রকল্পের প্রেক্ষাপটে মঙ্গোলিয়ার ইউরেনিয়াম মজুদের দিকেও ইরানের দৃষ্টি রয়েছে। তদুপরি, মঙ্গোলিয়া চীনা কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে ইরানি তেল আমদানি করে থাকে। অন্যদিকে, তুরস্ক মঙ্গোলিয়ায় বেশকিছু উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেও মঙ্গোলিয়ার ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। মঙ্গোলিয়ার অবকাঠামোর উন্নয়নের ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরীয় কোম্পানিগুলো বেশ সক্রিয়। এছাড়া, দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রায় ৩৩,০০০ মঙ্গোলীয় নাগরিক বসবাস করে, এবং এটি বহির্বিশ্বে অবস্থানরত বৃহত্তম মঙ্গোলীয় অভিবাসী সম্প্রদায়। এই রাষ্ট্রগুলোর বাইরে হাঙ্গেরি, ব্রাজিল প্রভৃতি রাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গেও মঙ্গোলিয়া সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে।
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করে নেয়া দরকার। রাশিয়া বা চীনকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিস্থাপন করা মঙ্গোলিয়ার ‘তৃতীয় প্রতিবেশী’ নীতির উদ্দেশ্য নয়। মঙ্গোলিয়ার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এই রাষ্ট্র দুইটিকে উপেক্ষা করা তার পক্ষে অসম্ভব। এজন্য মঙ্গোলিয়ার ‘তৃতীয় প্রতিবেশী’ নীতির মূল উদ্দেশ্য চীন ও রাশিয়ার ওপর থেকে মঙ্গোলিয়ার পরিপূর্ণ অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা অন্তত আংশিকভাবে হলেও হ্রাস করা, মঙ্গোলীয় অর্থনীতিকে বহুমুখী করা এবং ভবিষ্যতে মঙ্গোলিয়া যদি কখনো চীনা (বা ব্যতিক্রম কোনো ঘটনায়, রুশ) আগ্রাসনের সম্মুখীন হয়, সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক সহায়তা ও সহমর্মিতা লাভ করা। চীন বা রাশিয়ার যদি মঙ্গোলিয়াকে ‘গ্রাস’ করার কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থেকেও থাকে, মঙ্গোলিয়ায় মার্কিন, জাপানি, দক্ষিণ কোরীয় ও অন্যান্য বিনিয়োগ হুমকির সম্মুখীন হবে এবং সেক্ষেত্রে এই রাষ্ট্রগুলো মঙ্গোলিয়ার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করবে। এটি নিশ্চিত করাই মঙ্গোলিয়ার ‘তৃতীয় প্রতিবেশী’ সন্ধানের মূল লক্ষ্য।
ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা নিঃসন্দেহে কঠিন একটি কাজ। সেই রাষ্ট্রটির যদি রুশ ভাল্লুক এবং চীনা ড্রাগনের মতো প্রতিবেশী থাকে, তাহলে এই কাজ আরো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় ‘তৃতীয় প্রতিবেশী নীতি’র অনুসরণ মঙ্গোলিয়ার জন্য আংশিকভাবে হলেও স্বল্পমেয়াদী স্বস্তি নিয়ে এসেছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় আরেকটা প্রবাদ আছে, ‘জলে নেমে কুমিরের সঙ্গে ঝগড়া করতে নেই’। সুতরাং মঙ্গোলিয়া তার প্রথম ও দ্বিতীয় প্রতিবেশী এবং তৃতীয় প্রতিবেশীগুলোর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারবে কিনা, সেটিই দেখার বিষয়।