ক্ল্যাশ অফ দ্য এম্পায়ার্স: আফ্রো ইউরেশিয়ায় রুশ তুর্কি প্রক্সি যুদ্ধের বিস্তার

ক্ল্যাশ অফ দ্য এম্পায়ার্স: আফ্রো ইউরেশিয়ায় রুশ তুর্কি প্রক্সি যুদ্ধের বিস্তার

রাশিয়া ও তুরস্ক ইউরেশিয়ার দুইটি বৃহৎ রাষ্ট্র। রাশিয়া ও তুরস্ক উভয়ের ভূখণ্ডই ইউরোপ ও এশিয়া উভয় মহাদেশে অবস্থিত। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষদিকে মস্কোভি ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যের মধ্যে প্রথম কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। পরবর্তী পাঁচ শতাব্দীব্যাপী রুশ ও তুর্কিদের পারস্পরিক সম্পর্কের ইতিহাস অত্যন্ত জটিল। এই রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে মোট ১২টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে (১৫৬৮–১৫৭০, ১৬৭৬–১৬৮১, ১৬৮৬–১৭০০, ১৭১০–১৭১৩, ১৭৩৫–১৭৩৯, ১৭৬৮–১৭৭৪, ১৭৮৭–১৭৯২, ১৮০৬–১৮১২, ১৮২৮–১৮২৯, ১৮৫৩–১৮৫৬, ১৮৭৭–১৮৭৮ এবং ১৯১৪–১৯১৮)। স্বাভাবিকভাবেই রুশ–তুর্কি সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে শত্রুভাবাপন্ন। অবশ্য, সময়ে সময়ে রাষ্ট্র দুইটি পরস্পরের প্রয়োজনে একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতাও করেছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে রুশ ও ওসমানীয় সাম্রাজ্যদ্বয়ের বিলুপ্তি ঘটে এবং তদস্থলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের সৃষ্টি হয়। ১৯২০–এর দশকের প্রথমদিকে তুর্কি ও সোভিয়েতরা পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলে, কিন্তু তুরস্ক ক্রমশ পশ্চিমা বিশ্বের দিকে ঝুঁকে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তুরস্ক মার্কিন–নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটে যোগদান করে, এবং স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে তুরস্ক সবচেয়ে তীব্র সোভিয়েতবিরোধী রাষ্ট্রগুলোর একটিতে পরিণত হয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও রাশিয়ার অবক্ষয়কে তুরস্ক নিজস্ব ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য একটি ‘সুবর্ণ সুযোগ’ হিসেবে বিবেচনা করে এবং প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোতে, বিশেষত ককেশাস ও কাস্পিয়ান অঞ্চলে, নিজস্ব প্রভাব বলয় সৃষ্টির জন্য সক্রিয় হয়।

একবিংশ শতাব্দীতে রাশিয়ার রাজনীতিতে প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ভ্লাদিমির পুতিনের উত্থান ঘটে এবং তাঁর অধীনে রুশ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাবের পুনরুত্থান ঘটে। অন্যদিকে, একই সময়ে তুরস্কের রাজনীতিতে রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের উত্থান ঘটে এবং তাঁর অধীনে তুরস্ক একটি সক্রিয় ও বলিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে।

 মানচিত্রে রুশ ফেডারেশন এবং তুরস্ক প্রজাতন্ত্র

পুতিন এবং এরদোয়ানের মধ্যে বেশকিছু সাদৃশ্য রয়েছে। উভয়েই নিজ নিজ রাষ্ট্রে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন। উভয়েই পশ্চিমা বিশ্বের একাধিপত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বহুমুখী ও বাস্তববাদী নীতি গ্রহণ করেছেন৷ উভয়েই নিজ নিজ রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য বলপ্রয়োগ করেছেন। সর্বোপরি, উভয়েই পশ্চিমা উদারনৈতিকতাবাদ বা ‘লিবারেলিজম’কে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং নিজস্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছেন। আদর্শগতভাবে উভয়ের অবস্থান পশ্চিমা বিশ্বের বিপরীতে, সুতরাং তাঁদের মধ্যে এক ধরনের মিত্রতা গড়ে ওঠাই ছিল যৌক্তিক।

কার্যত রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রয়েছে। রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যেকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে; তুরস্কের আমদানিকৃত জ্বালানির একটি বিরাট অংশ আসে রাশিয়া থেকে; তুরস্কের মধ্য দিয়ে নির্মিত ‘ব্লু স্ট্রিম’ ও ‘তুর্কস্ট্রিম’ পাইপলাইনদ্বয়ের মাধ্যমে রাশিয়া ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোতে জ্বালানি রপ্তানি করে; প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ রুশ তুরস্কে বেড়াতে আসে; রুশ সহায়তায় তুর্কি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে; এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে ‘এস–৪০০’ বিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্র ক্রয় করেছে। তদুপরি, বিভিন্ন আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যুতে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে নিয়মিত কূটনৈতিক যোগাযোগ হয়ে থাকে।

কিন্তু এই সহযোগিতার পাশাপাশি রাষ্ট্র দুইটি তীব্র প্রতিযোগিতায়ও লিপ্ত। তুরস্ক এখনো মার্কিন–নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের সদস্য, এবং ন্যাটো ও রাশিয়া বর্তমানে কার্যত একটি নতুন স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত। তাছাড়া, রাশিয়া ও তুরস্কের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ পরস্পরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, বরং পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এমতাবস্থায় বিভিন্ন অঞ্চলে মস্কো ও আঙ্কারা একে অপরের বিরুদ্ধে ‘প্রক্সি’র (proxy) মাধ্যমে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে রুশ ও তুর্কিদের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষও হয়েছে। অবশ্য রাশিয়া ও তুরস্ক উভয়েই সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হতে অনাগ্রহী এবং এজন্য ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ (proxy warfare) হয়ে উঠেছে তাদের প্রতিযোগিতার বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম।

সিরিয়ার ইদলিবে একটি যৌথ টহলের পর রুশ সামরিক পুলিশ ও তুর্কি সৈন্যরা করমর্দন করছে

চলুন, দেখে নেয়া যাক রুশ–তুর্কি প্রক্সি যুদ্ধের ভৌগোলিক ব্যাপ্তি।

সিরিয়া

২০১১ সাল থেকে সিরীয় সরকার এবং বিভিন্ন মিলিট্যান্ট গ্রুপ এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। তুরস্ক (এবং পশ্চিমা বিশ্ব, সৌদি আরব ও কাতার) প্রথম থেকেই বিভিন্ন সিরীয় মিলিট্যান্ট গ্রুপকে সমর্থন প্রদান করেছে, এবং আঙ্কারার লক্ষ্য ছিল সিরিয়ায় একটি তুর্কি–নিয়ন্ত্রিত সরকার প্রতিষ্ঠা করা। অন্যদিকে, ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়া সিরিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই রাশিয়া (এবং ইরান ও হিজবুল্লাহ) সিরিয়াকে রাজনৈতিক, আর্থিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করেছে। এর ফলে সিরিয়ায় রাশিয়া ও তুরস্কের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।

২০১২ সাল থেকে সিরিয়া ও তুরস্ক বিক্ষিপ্ত সীমান্ত সংঘর্ষে লিপ্ত। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে রাশিয়া সিরীয় সরকারের পক্ষে সিরীয় গৃহযুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ করে এবং সিরীয় সরকারকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করে। ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর তুর্কি বিমানবাহিনী সিরীয় আকাশসীমায় একটি রুশ বোমারু বিমানকে ভূপাতিত করলে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে গুরুতর দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় এবং রাশিয়া তুরস্কের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরবর্তীতে তুর্কি সরকার এই ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। অন্যদিকে, ২০১৬ সাল থেকে তুরস্ক সিরিয়ার অভ্যন্তরে সিরীয় কুর্দি মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলো ও সিরীয় সরকারের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সামরিক অভিযান চালিয়েছে এবং বর্তমানে উত্তর সিরিয়ার প্রায় ৮,০০০ বর্গ কি.মি. ভূমি তুর্কি সামরিক নিয়ন্ত্রণাধীন।

একদল সিরীয় সৈন্য এবং উত্তর ককেশাস থেকে আগত রুশ সামরিক পুলিশ

রাশিয়া, ইরান ও তুরস্ক সিরীয় গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্যে ব্যাপক কূটনৈতিক আলোচনা চালিয়েছে, কিন্তু ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিরীয় সরকার তুর্কি–সমর্থিত মিলিট্যান্টদের কাছ থেকে ইদলিব প্রদেশ পুনরুদ্ধারের জন্য নতুন একটি অভিযান শুরু করলে সিরিয়ায় রুশ–তুর্কি প্রক্সি যুদ্ধ চরমে ওঠে৷ ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রুশ ও সিরীয় এয়ারস্ট্রাইকে ইদলিবের বালিউনে ৫০ থেকে ১০০ জন তুর্কি সৈন্য নিহত হয়। প্রত্যুত্তরে তুর্কি সশস্ত্রবাহিনী ও তুর্কি–সমর্থিত সিরীয় মিলিট্যান্টরা সিরীয় সরকারের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন স্প্রিং শিল্ড’ আরম্ভ করে। এই অভিযানে ১৯৭ জন সিরীয় সৈন্য নিহত হয় এবং প্রচুর সিরীয় সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংস হয়, অন্যদিকে ৮ জন তুর্কি সৈন্য ও ৪০ জনের বেশি সিরীয় মিলিট্যান্ট প্রাণ হারায়। ২০২০ সালের ৬ মার্চ পুতিন এবং এরদোয়ান মস্কোয় একটি যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করেন।

২০২০ সালের অক্টোবরে তুর্কিরা ইদলিবে তাদের বেশ কয়েকটি ‘অবজার্ভেশন পোস্ট’ থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। ২৬ অক্টোবরে রুশ এয়ারস্ট্রাইকে ইদলিবের কাফ্রা তাখারিমে ৭৮ থেকে ১০০ জন তুর্কি–সমর্থিত ‘ফাইলাক আল–শাম’ মিলিট্যান্ট নিহত হয় এবং ১০০ জনের বেশি আহত হয়। ধারণা করা হচ্ছে, উভয় পক্ষই সিরিয়ায় নতুন এক দফা প্রক্সি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

বর্তমানে সিরিয়ায় সিরীয় সরকার ও সরকার–সমর্থিত বিভিন্ন মিলিশিয়া, ইরান ও ইরানি–সমর্থিত বিভিন্ন মিলিশিয়া এবং হিজবুল্লাহ রাশিয়ার প্রক্সি হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু সিরিয়ায় রাশিয়া ও ইরানের স্বার্থ সম্পূর্ণ এক নয়, এবং রাশিয়া ও সিরিয়াও সকল বিষয়ে একমত নয়। অন্যদিকে, ‘সিরীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ এবং এর অধীনস্থ বা এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত ‘সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি ইউনাইটেড তুর্কমেন আর্মি ফাইলাক আল–শাম জাবহাত ফাতেহ আল–শাম’ প্রভৃতি মিলিট্যান্ট গ্রুপ সিরিয়ায় তুরস্কের প্রক্সি হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু তুরস্কের এই প্রক্সি গ্রুপগুলোর নিজেদের মধ্যেও অন্তর্দ্বন্দ্ব বিদ্যমান।

লিবিয়া

২০১৪ সাল থেকে লিবিয়ায় কার্যত দুইটি সরকার ক্ষমতাসীন এবং এদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলছে। এদের মধ্যে ত্রিপোলিকেন্দ্রিক ‘গভর্নমেন্ট অফ ন্যাশনাল অ্যাকর্ড’ (জিএনএ) মূলত পশ্চিম লিবিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে, এবং তবরুককেন্দ্রিক ‘হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ (এলএনএ) মূলত পূর্ব লিবিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তুরস্ক ও কাতার এই যুদ্ধে জিএনএ–কে সমর্থন দিয়েছে, অন্যদিকে রাশিয়া, ফ্রান্স, মিসর, আমিরাত ও সৌদি আরব এই যুদ্ধে এলএনএ–কে সমর্থন দিয়েছে। রুশ মার্সেনারি সংগঠন ‘ওয়াগনার গ্রুপ যেটি রুশ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত, সক্রিয়ভাবে এলএনএ–এর পক্ষে যুদ্ধ করছে।

২০১৯ সালে ত্রিপোলি অভিমুখে রওনা হওয়া একদল এলএনএ সৈন্য

২০১৯ সালের এপ্রিলে এলএনএ পশ্চিম লিবিয়ায় আক্রমণ চালায় এবং ত্রিপোলি অবরোধ করে, কিন্তু তাদের অভিযানটি গতি হারিয়ে ফেলে। ২০১৯ সালের নভেম্বরে তুরস্ক ও জিএনএ–এর মধ্যে একটি সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং এর ফলে তুরস্ক জ্বালানিসমৃদ্ধ পূর্ব ভূমধ্যসাগরে একটি বিরাট ‘এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন’ লাভ করে। বিনিময়ে তুরস্ক ২০২০ সালের জানুয়ারিতে লিবিয়ায় জিএনএ–এর পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপ করে এবং হাজার হাজার সিরীয় মিলিট্যান্টকে লিবিয়ায় প্রেরণ করে। তুর্কি হস্তক্ষেপের ফলে যুদ্ধের চাকা ঘুরে যায়। ৫ জুনের মধ্যে এলএনএ পশ্চিম লিবিয়া থেকে বিতাড়িত হয় এবং ৬ জুন তুর্কি–সমর্থিত বাহিনী মধ্য লিবিয়ায় অভিযান আরম্ভ করে।

তুরস্কের উদ্দেশ্য ছিল সিরত শহর ও আল–জুফরা বিমানঘাঁটি দখল করা এবং এর মধ্য দিয়ে পূর্ব লিবিয়ার তেলক্ষেত্রগুলোর ওপর তুর্কি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু জিএনএ–এর অগ্রগতি স্তিমিত হয়ে যায়, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে মিগ–২৯ ও সু–২৪ বিমানবহর প্রেরণ করে এবং মিসর সিরত ও আল–জুফরা বিমানঘাঁটির পতন ঘটলে লিবিয়ায় সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের হুমকি দেয়। ২৬ জুন রুশ মার্সেনারিরা পূর্ব লিবিয়ার তেলক্ষেত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়।

২১ আগস্ট মিসরের মধ্যস্থতায় এলএনএ ও জিএনএ–এর মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়, কিন্তু এই যুদ্ধবিরতি কতদিন স্থায়ী হবে সেটি নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বর্তমানে লিবিয়ায় জিএনএ ও জিএনএ–এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মিলিশিয়া এবং সিরীয় মার্সেনারি/মিলিট্যান্টরা তুরস্কের প্রক্সি হিসেবে কাজ করছে। কিন্তু জিএনএ এবং সংশ্লিষ্ট মিলিশিয়াগুলোর স্বার্থ পুরোপুরি এক নয়। অন্যদিকে, হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস/এলএনএ এবং মিসর লিবিয়ায় রাশিয়ার প্রক্সি হিসেবে কাজ করছে। অবশ্য, এলএনএ–এর সঙ্গে রাশিয়ার যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে; এলএনএ পুরোপুরি রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল নয় এবং লিবিয়ায় মিসর ও রাশিয়ার স্বার্থও সম্পূর্ণ এক নয়।

ক্রিমিয়া ও ইউক্রেন

২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সঙ্কট চলাকালে রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় এবং পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন প্রদান করতে আরম্ভ করে। এর ফলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যেকার সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে। তুরস্ক রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া দখলের বিরোধিতা করেছে এবং ইউক্রেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ক্রিমিয়ান তাতারদের একাংশ তীব্র রুশবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং ইউক্রেন ও তুরস্ক এদেরকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করছে।

ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি ভোলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে তুর্কি রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান

বর্তমানে ক্রিমিয়া সম্পূর্ণভাবে রুশ নিয়ন্ত্রণাধীন এবং পূর্ব ইউক্রেনভিত্তিক ‘গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্ক’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী লুহানস্ক’ প্রোটো–রাষ্ট্র দুইটি ইউক্রেনে রাশিয়ার প্রক্সি হিসেবে কাজ করছে। অন্যদিকে, ইউক্রেনীয় সরকার এবং ক্রিমিয়ান তাতার জাতীয়তাবাদীরা এই অঞ্চলে তুরস্কের প্রক্সি হিসেবে কাজ করছে।

দক্ষিণ ককেশাস

১৯৮০–এর দশক থেকে আজারবাইজানি ও আর্মেনীয়দের মধ্যে আজারবাইজানের অন্তর্গত কিন্তু জাতিগত আর্মেনীয়–অধ্যুষিত ‘নাগর্নো–কারাবাখ প্রজাতন্ত্র’ নিয়ে বিরোধ চলে আসছে। ১৯৯২–১৯৯৪ সালের নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধে আর্মেনীয়রা আজারবাইজানকে পরাজিত করে এবং নাগর্নো–কারাবাখ ও এর নিকটবর্তী ৭টি আজারবাইজানি জেলা দখল করে নেয়। তখন থেকেই আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে তীব্র দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিরাজমান।

আর্মেনিয়া রুশ–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘সিএসটিও–এর সদস্য, আর্মেনিয়ায় রুশ সামরিক ঘাঁটি অবস্থিত এবং রুশ সীমান্তরক্ষীরা তুর্কি–আর্মেনীয় ও ইরানি–আর্মেনীয় সীমান্ত পাহারা দেয়। অন্যদিকে, আজারবাইজান ও তুরস্কের মধ্যে ঘনিষ্ঠ জাতিগত, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বিদ্যমান, এবং আজারবাইজান তুরস্কের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে আজারবাইজান তুরস্কের প্ররোচনা ও সক্রিয় সমর্থনে হারানো অঞ্চল পুনর্দখলের জন্য আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে নতুন একটি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তুর্কি সৈন্যরা সক্রিয়ভাবে এই যুদ্ধে আজারবাইজানকে সমর্থন দিচ্ছে, এবং কয়েক হাজার সিরীয় মার্সেনারিকে তুর্কিরা আজারবাইজানে প্রেরণ করেছে। ইতোমধ্যে আজারবাইজান নাগর্নো–কারাবাখের নিকটবর্তী জেলাগুলোর বৃহদাংশ পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়েছে।

সম্প্রতি পুনর্দখলকৃত একটি অঞ্চলে একদল আজারবাইজানি সৈন্য

রাশিয়ার দোরগোড়ায় সংঘটিত এই যুদ্ধ রুশদেরকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে৷ রাশিয়া আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উভয়ের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী, এবং এজন্য আর্মেনিয়াকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করা থেকে রাশিয়া এখন পর্যন্ত বিরত থেকেছে৷ আর্মেনিয়া এই যুদ্ধে রাশিয়াকে জড়িত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিন জানিয়েছেন যে, যুদ্ধ আর্মেনিয়ার ভূখণ্ডে বিস্তৃত না হলে রাশিয়া এই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করবে না। অবশ্য, ২০–২১ অক্টোবরে আর্মেনিয়ার গুমরিতে অবস্থিত রুশ সামরিক ঘাঁটির কাছে রুশ সৈন্যরা ৯টি তুর্কি–নির্মিত ড্রোন ধ্বংস করেছে।

সাম্প্রতিক নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধের ক্ষেত্রে আজারবাইজানকে তুরস্কের এবং আর্মেনিয়াকে রাশিয়ার প্রক্সি হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। আজারবাইজান কার্যত তুরস্কের প্রক্সি হিসেবেই কাজ করছে, কিন্তু রাশিয়ার জন্য এই যুদ্ধটি ঠিক প্রক্সি যুদ্ধ না। নাগর্নো–কারাবাখে মস্কোর কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ নেই, এবং এই যুদ্ধে কোনো এক পক্ষকে সমর্থন করে মস্কো অন্য পক্ষের বিরাগভাজন হতে চায় না। তদুপরি, আজারবাইজানকে পুরোপুরি তুর্কি প্রক্সি বলা যায় কিনা, সেটিও ঠিক স্পষ্ট নয়। আজারবাইজানিদের ব্যবহৃত তুর্কি–নির্মিত ড্রোন এই যুদ্ধের ফলে ব্যাপক প্রচারণা পেয়েছে, কিন্তু কার্যত আজারবাইজানি সশস্ত্রবাহিনীর সিংহভাগ অস্ত্রশস্ত্রই রুশ–নির্মিত। সামগ্রিকভাবে, তুরস্ক (ও আর্মেনিয়া) নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধকে একটি প্রক্সি যুদ্ধে রূপান্তরিত করতে আগ্রহী, কিন্তু রাশিয়া এই যুদ্ধে জড়িত হতে অনিচ্ছুক।

উত্তর ককেশাস

উত্তর ককেশাসের মুসলিম–অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রগুলো, বিশেষত চেচনিয়া, ইঙ্গুশেতিয়া ও দাগেস্তান, তুলনামূলকভাবে রুশ ফেডারেশনের সবচেয়ে অস্থিতিশীল অঞ্চল। ১৯৯০–এর দশক থেকে প্রজাতন্ত্রগুলোতে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় উগ্রপন্থীরা বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। ১৯৯৪–১৯৯৬ এবং ১৯৯৯–২০০৯ সালে চেচনিয়ায় রুশ ও রুশপন্থী চেচেনদের সঙ্গে মিলিট্যান্টদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে। ১৯৯৯ সালে চেচেন ও আরব মিলিট্যান্টরা দাগেস্তানে আক্রমণ চালিয়েছিল। ১৯৯০–এর দশক থেকে উত্তর ককেশাস জুড়ে মিলিট্যান্টরা নাশকতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছিল, কিন্তু ২০১৭ সাল নাগাদ এই কার্যক্রমের মাত্রা বহুলাংশে স্তিমিত হয়ে আসে। অবশ্য এখনো এদের কার্যক্রম পুরোপুরি থেমে যায় নি।

তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থা ১৯৯০–এর দশক থেকেই উত্তর ককেশাসের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিয়ে এসেছে এবং তুর্কি স্বেচ্ছাসেবকরা এই সংঘাতে রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এখনো উত্তর ককেশাস থেকে আগত বহুসংখ্যক বিচ্ছিন্নতাবাদী তুরস্কে বসবাস করে। রুশ গোয়েন্দা সংস্থা তুরস্কে অনুরূপভাবে তুরস্কের অভ্যন্তরে সক্রিয় এবং সময়ে সময়ে তুরস্কে অবস্থানরত উত্তর ককেশীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যা চালিয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালের ২ নভেম্বর রুশ গোয়েন্দারা তুরস্কের ইস্তাম্বুলে প্রাক্তন চেচেন মিলিট্যান্ট আব্দুলভাখিদ এদেলগিরেয়েভকে খুন করে।

২০১৬ সালে ইস্তাম্বুলে রুশ গোয়েন্দারা চেচেন বিচ্ছিন্নতাবাদী আব্দুলভাখিদ এদেলগেরেয়েভকে খুন করে

বর্তমানে উত্তর ককেশাস রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন এবং সেখানে বড় ধরনের কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রম চলছে না। কিন্তু তুরস্ক উত্তর ককেশাসভিত্তিক মিলিট্যান্টদের এতদঞ্চলে নিজস্ব প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে।

তুর্কি কুর্দিস্তান

১৯৮০–এর দশক থেকে তুর্কি কুর্দিস্তানভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী দল ‘পিকেকে’ তুর্কি সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত। পিকেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সোভিয়েত মিত্র সিরিয়ার সমর্থন লাভ করেছিল। ধারণা করা হয়, মস্কো এখনো পিকেকের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখে চলেছে। উল্লেখ্য, তুরস্ক পিকেকে–কে একটি ‘সন্ত্রাসবাদী সংগঠন’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও রাশিয়া এটিকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে না।

২০১৬ সালের ১৩ মে পিকেকে মিলিট্যান্টরা রুশ–নির্মিত ‘এসএ–১৮’ ক্ষেপনাস্ত্র ব্যবহার করে একটি তুর্কি ‘এএইচ–১ সুপারকোবরা’ হেলিকপ্টার ভূপাতিত করে এবং এর ফলে দুইজন তুর্কি বৈমানিক নিহত হয়৷ তুর্কি গোয়েন্দা কর্মকর্তারা এই আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে দায়ী করে। তাদের ধারণা ছিল যে, ২০১৫ সালের নভেম্বরে তুরস্ক কর্তৃক রুশ বিমান ভূপাতিত করার জবাবেই রুশরা কুর্দি মিলিট্যান্টদের দিয়ে এই আক্রমণ করিয়েছে। ২০১৭ সালে তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান অভিযোগ করেন যে, রুশরা কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র সরবরাহ করছে।

ইরাকি কুর্দিস্তানে একদল পিকেকে যোদ্ধা

এখন পর্যন্ত তুরস্ক ও পিকেকের মধ্যে চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটে নি। এই সংঘর্ষে রাশিয়া পিকেকে–কে তুরস্কের বিরুদ্ধে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করছে, এটি ধরে নেয়া যায়। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে পিকেকের সম্পর্ক কতটুকু ঘনিষ্ঠ, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ।

উপসংহার

সামগ্রিকভাবে, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণ ককেশাস এবং উত্তর ককেশাস জুড়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলব্যাপী রাশিয়া ও তুরস্ক প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত। এখন পর্যন্ত রুশ ও তুর্কিরা তাদের এই সংঘাত ‘কম্পার্টমেন্টালাইজ’ (compartmentalize) করেছে এবং নিজেদের মধ্যে সরাসরি সংঘাত থেকে সামগ্রিকভাবে বিরত থেকেছে। রুশ–তুর্কি ভূঅর্থনৈতিক সম্পর্কের ব্যাপকতা তাদের মধ্যেকার ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে প্রশমিত রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে৷ এই ‘সূক্ষ্ম ভারসাম্য’ কতদিন পর্যন্ত বজায় থাকে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত