পৃথিবীর জটিলতম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথা

পৃথিবীর জটিলতম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথা

দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বলকান উপদ্বীপের দেশ বসনিয়া এবং হার্জেগোভিনায় রয়েছে জাতিগত বিভক্তি, রাজনৈতিক বিভেদ, জটিল প্রশাসনিক কাঠামো ও ক্ষমতাকে ঘিরে পৃথক সরকারব্যবস্থার লড়াই। এইসব জটিল হিসাব-নিকাশের মধ্য দিয়ে সে দেশটিতে নেতা নির্বাচনের জন্য ভোটের আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইতিহাসের দেশটি বসনিয়া নামেই বেশি পরিচিত। বলা হয়ে থাকে, বসনিয়া হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে জটিল নির্বাচনের দেশ। আজকে আমরা আলোচনা করছি ইউরোপের বিশেষ এই দেশের জটিল নির্বাচন এবং একইসাথে সেদেশের অতীত ইতিহাসের কিছু পর্যায় নিয়ে।

ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এই দেশটিতে কেন্দ্র, দুই স্বতন্ত্র সরকার, ক্যানটন ও ডিস্ট্রিক্ট অব ব্রিচকোতে জাতীয় নির্বাচন হয়ে থাকে। কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্ট (তিনজন), কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট, দুই অংশের অ্যাসেম্বলি, ব্রিচকো ও সার্ব স্বতন্ত্র অংশ রিপাবলিকা স্রেপ্সকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

বলকান উপদ্বীপে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ত্রিভুজ আকৃতির। বসনিয়া অঞ্চলটি উত্তরে পাহাড় ও গভীর বনবেষ্টিত। বিশাল এলাকাজুড়ে অমসৃণ ও সমতল কৃষিভূমির হার্জেগোভিনা অঞ্চলটি দক্ষিণে, এর রয়েছে সংকীর্ণ উপকূল। দেশটির আয়তন ৫১ হাজার ১২৯ বর্গকিলোমিটার, লোকসংখ্যা ৩৫ লাখ ২৬৩৬ জন। রাজধানীর সারায়েভো, দেশটির মুদ্রার নাম মার্কা।

অন্য দেশের মতো বসনিয়ায় একজন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন না। বসনীয়, সার্ব ও ক্রোয়েট এই তিন জাতির সমন্বিত প্রেসিডেন্সি পর্ষদ রয়েছে সেখানে। প্রেসিডেন্সি পর্ষদের নেতৃত্বে বা চেয়ারম্যান পদে আট মাস পরপর পর্যায়ক্রমে পরিবর্তন আসে। দেশটিতে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় ১৯৯৬ সালে। সরকারের মেয়াদ চার বছর।

বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় দুটি স্বতন্ত্র পক্ষ রয়েছে। একটি দ্য ফেডারেশন অব বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, যেটিতে মুসলিম বসনিয়াক ও ক্রোয়েটদের আধিপত্য বেশি। অপরটি হচ্ছে সার্বদের পরিচালিত রিপাবলিকা স্রেপ্সকা। দেশটির পার্লামেন্ট দুই কক্ষবিশিষ্ট। দ্য হাউস অব পিপলস এবং দ্য হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ। হাউস অব পিপলসে ১৫ জন সদস্য রয়েছেন। এর দুই–তৃতীয়াংশ ফেডারেশন অব বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার এবং এক-তৃতীয়াংশ স্রেপ্সকার। অর্থাৎ বসনিয়াক (বসনিয়ার মুসলিম), ক্রোয়েট ও সার্বদের পাঁচজন করে সদস্য রয়েছেন এতে। হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে রয়েছেন ৪২ জন সদস্য। এর দুই-তৃতীয়াংশ ফেডারেশন থেকে এবং এক-তৃতীয়াংশ স্রেপ্সকা থেকে ভোটারদের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। এর বাইরে দুই অংশের আলাদা প্রেসিডেন্ট, সরকার, সংসদ, পুলিশ ও পৃথক কর্তৃপক্ষ রয়েছে।

সব মিলিয়ে দেশটিতে চারজন প্রেসিডেন্ট, পাঁচটি পার্লামেন্টারি হাউস এবং ১০টি ক্যানটন অ্যাসেম্বলি (শাসনতান্ত্রিক বিভাগ) রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য ভোটাররা তিন সদস্যের প্রেসিডেন্সি পর্ষদ ও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত করে। ১৯৯৫ সালের পরবর্তীতে ভয়াবহ যুদ্ধের অবসানের মধ্য দিয়ে কথিত দুই স্বতন্ত্র পক্ষের এই সরকার গঠন হয়।

সার্বদের পরিচালিত রিপাবলিকা স্রেপ্সকার (আরএস) ভোটাররা তাদের একজন প্রেসিডেন্ট ও দুজন ভাইস প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি এমপিদের নির্বাচিত করে। আর মুসলিম-ক্রোয়েট ফেডারেশন তাদের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের জন্য দুজন প্রেসিডেন্ট ও দুজন ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে। মুসলিম-ক্রোয়েট ফেডারেশনের ১০টি ক্যানটনের জন্যও ভোটাররা ভোট দিয়ে থাকে।

এত জটিল হিসাব–নিকাশের পর যে–কারও মাথায় একটি প্রশ্ন আসতে পারে যে তাহলে বসনিয়ার নেতৃত্ব প্রকৃতপক্ষে কে দেয়। এর উত্তর এক কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। জাতীয় বা কেন্দ্রীয় সরকার সামরিক বাহিনী, বিচার বিভাগ, রাজস্ব নীতি প্রণয়ন, বৈদেশিক বাণিজ্য ও কূটনীতির বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত। এর চেয়ে দুটি স্বতন্ত্র অংশই তুলনামূলক বেশি কেন্দ্রীভূত। তাদের আলাদা পুলিশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে।

দুই স্বতন্ত্র অংশের বিভেদ দেশটির শাসনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয় বারবার। বসনিয়াক বা মুসলিমরা চায় কেন্দ্র শক্তিশালী হোক। অন্যদিকে, সার্বরা কোনো অবস্থায় স্বতন্ত্র শাসন সমর্পণ করতে রাজি নয়। আর ক্রোয়েটদের মধ্যে বিভক্তি আরও বেশি। তাঁদের অনেকে আশা করেন, ক্রোয়েটদেরও স্বতন্ত্র শাসন তৈরি হবে।

দেশটির মন্ত্রিপরিষদের আকার আরো অবাক করার মতো। দেশটিতে ১৮০ জন মন্ত্রী আছেন। অর্থাৎ ২০ হাজার লোকের জন্য মন্ত্রী একজন। দেশটির আয়তনের সঙ্গে যদি জার্মানির তুলনা করা যায়, তাহলে এ সংখ্যা অনুসারে জার্মানির মন্ত্রী থাকা উচিত চার হাজার। দেশটিতে সরকারি কর্মচারী রয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুসারে, দেশটির রাজস্বের এক-তৃতীয়াংশ চলে যায় সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতন দিতে গিয়ে।

বিশ্লেষকদের মতে, বসনিয়ার অতীত ইতিহাস থেকে বোঝা যায়, সেখানে শান্তি বজায় রাখা কঠিন ব্যাপার। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা রক্তাক্ত হয়েছে বারবার। প্রাচীনকালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে বলা হতো ইলিরিকাম। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে এই অঞ্চল রোমানরা জয় করে নিজেদের প্রদেশ ডালমেশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করে। চতুর্থ ও পঞ্চম খ্রিষ্টাব্দে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ওই অঞ্চল দাবি করলে জার্মানির গথরা রোমান সাম্রাজ্যকে অস্বীকৃতি জানিয়ে ওই অংশ দখল করে। ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত সেটি তাদের দখলে ছিল। পূর্ব ইউরোপের জাতি স্লাবরা সপ্তম শতাব্দীতে ওই অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বসনিয়া হাঙ্গেরির কাছ থেকে স্বাধীনতা পায় এবং এর পরের ২৬০ বছরের মধ্যে এটি স্বাধীন খ্রিষ্টান রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে।

বলকানে অটোমান সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের ফলে ওই অঞ্চলে ভিন্ন সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ধর্মীয় অবকাঠামো গড়ে ওঠে। ১৩৮৯ সালে কসোভোতে আলোচিত সেই যুদ্ধে তুর্কিরা সার্বদের পরাজিত করে। তারা ১৪৬৩ সালে বসনিয়া জয় করে। আনুমানিক সাড়ে চারশ বছর বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় অটোমান সাম্রাজ্যের শাসন ছিল। ওই সময় অনেক খ্রিষ্টান স্লাব মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে। বসনিয়ার মুসলিম সম্প্রদায় ধীরে ধীরে প্রভাবশালী হতে থাকে এবং তুর্কিদের পক্ষে তারা দেশ শাসন করতে থাকে। অটোমান সাম্রাজ্যে সংকুচিত হতে থাকলে উনিশ শতকে বলকানের অন্য মুসলিমরা বসনিয়ায় চলে যেতে থাকে। একই সময়ে বসনিয়ায় ইহুদি জনসংখ্যা বাড়তে থাকে।

১৪৯২ সালে স্পেন থেকে বিতাড়িত হয়ে অনেক ইহুদি সারায়েভোতে আশ্রয় নিয়েছিল। ওই শতকে সব ধর্মবিশ্বাসের মানুষকে বরণ করে নেয় বসনিয়া। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিয়ে ওই সময় খুব অস্বাভাবিক ছিল না।

১৯৪১ সালে জার্মানি যুগোস্লাভিয়ায় হামলা চালালে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা নাৎসি–নিয়ন্ত্রিত ক্রোয়েশিয়ার অংশ হয়ে যায়। জার্মান ও ইতালীয়দের দখলে থাকার সময় বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার বাসিন্দারা ক্রোয়েশিয়ার ফ্যাসিবাদী বাহিনির বিরুদ্ধে তুমুল গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে, যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট নেতা মার্শাল টিটোর অধীনে একক রাষ্ট্র হিসেবে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা আরও ছয়টি প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে একীভূত হয়। জোড়াতালি দেওয়া জাতির মধ্যে জাতিগত শত্রুতা নিয়ন্ত্রণে রাখে তাঁর কর্তৃপক্ষ। টিটো ১৯৮০ সালে মারা যান।

কঠিন আবরণ খসে যাওয়ায় এবং ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক অসন্তোষের মুখে যুগোস্লাভিয়া ভাঙতে শুরু করে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয় বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) স্বীকৃতি চাওয়া হয়। ১৯৯২ সালের মার্চে এক গণভোটে বসনিয়ার ভোটাররা স্বাধীনতা বেছে নেয়। বসনিয়ার বাসিন্দাদের মধ্যে মুসলিম ৪৪ শতাংশ, সার্ব ৩১ শতাংশ ও ক্রোয়েট ১৭ শতাংশ। এই তিন জাতির প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারব্যবস্থা গড়ে ওঠে সেখানে। তবে স্বাধীন হয়েও সেখানে শান্তি ফিরে আসেনি, শুরু হয় জাতিগত যুদ্ধ। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর দিক থেকে জটিল এই দেশের নির্বাচন যে কোনো পাঠকের কাছে একইসাথে চমকপ্রদ এবং আগ্রহের এক বিষয় হিসেবে পঠিত হবে।

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত