লীগ অব নেশন্স নামে গঠিত বিশ্ব সংস্থার দুঃখজনক ব্যর্থতার পরিনামে বিশ্বের বুকে নেমে আসা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ অভিশাপ মোচন করা জন্য বিশ্ববাসীকে যুদ্ধ এবং অশান্তি থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতিসংঘ। কেটে গেছে ৭৫ টি বছর। জাতিসংঘে এ দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে পারস্পারিক শান্তি, সংঘাত ও যুদ্ধমুক্ত বিশ্ব নির্মাণের যে ব্রত ছিল তা শুধু স্বপ্নই রয়ে গেছে, ব্যবহৃত হয়েছে আধিপত্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ।
জাতিসংঘে সনদের মূল কথা ছিলো সকল রাষ্ট্রের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি ও সকল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে। কেউ অন্য রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের উপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। কোন রাষ্ট্রের সাথে অপর কোন রাষ্ট্রের বিরোধ দেখা দিলে তা জাতিসংঘের মাধ্যমে সমাধান হবে এবং জাতিসংঘের সেই সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে৷ যদিও বাস্তব প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন ।
অপরদিকে নিরাপত্তা পরিষদের সাথে জড়িয়ে আছে একটি বিতর্কিত বিষয়। আর সেটি হলো পাঁচটি স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের (যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স) ভেটো ক্ষমতা। অর্থাৎ কোনো একটি সিদ্ধান্তের বিষয়ে যতই সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত থাকুক না কেন সেখানে যদি ১৫টি সদস্যের মধ্যে ১৪টি সদস্য রাষ্ট্রও সমর্থন থাকে একপক্ষে আর একটি মাত্র স্থায়ী সদস্য দেশও যদি সেখানে বিপক্ষে ভোট প্রদান করে কিংবা ভোটদান থেকে বিরত থাকে তাহলে সেই প্রস্তাব পাশ হবে না ।
নিরাপত্তা পরিষদে ভোটদান
মূলত এই ভেটো ক্ষমতার সকল রাষ্ট্রের সমানাধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে। জাতিসংঘ কখনোই এই পাচঁটি রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বরং জাতিসংঘই তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। এর পিছনে রয়েছে জাতিসংঘের অর্থ সংকটও। যে সদস্য রাষ্ট্র যত বেশি চাঁদা দেয় সেই রাষ্ট্র তত বেশি ক্ষমতা খাটিয়ে নিজ স্বার্থ হাসিল করে নেয়।
প্রকৃত অর্থে জাতিসংঘ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ঠিক কতটা সুদুরপ্রসারি ভূমিকা রাখতে পেরেছে? যুদ্ধ ও অশান্তির অবসানে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ কি পেরেছে বিশ্বের শান্তি বজায় রেখে সকল যুদ্ধের অবসান ঘটাতে? জাতিসংঘ কি পেরেছে সকল দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে?
জাতিসংঘের ব্যর্থতার কিছু চিত্র :
শুরু করছি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় মুহুর্তে জাতিসংঘের ভূমিকা দিয়ে৷ পাক বাহিনী যে গণহত্যাযজ্ঞ শুরু করে সম্ভবতঃ উহারই অগ্রিম আভাস পাইয়া উ থান্ট তৎপূর্বে ঢাকায় কর্মরত জাতিসংঘের কর্মচারীদের ঢাকা ত্যাগের অনুমতি প্রদান করেন। এই সময় বঙ্গবন্ধু উ থান্টকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিয়াছেন, জাতিসংঘের কর্মচারীদের ঢাকা ত্যাগের অনুমতি দানের মধ্যে জাতিসংঘ সেক্রেটারী জেনারেলের কর্তব্য শেষ হইয়া যায় না। শক্তিমত্ত জঙ্গী শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের প্রতি জাতিসংঘের যে দায়িত্ব রহিয়াছে উহা বিস্মৃত হইলে চলিবে না।
কিন্তু ইহাতেও জাতিসংঘের চৈতন্যোদয় হয় নাই। যদি হইত বাংলাদেশে মানব সভ্যতার ভয়াবহতম ট্রাজেডির বিভীষিকা সম্ভবতঃ অপেক্ষাকৃত কম হিংস্রতা লইয়া দেখা দিতে পারিত। তবুও টনক নড়েনি জাতিসংঘের । বিজয় যখন সুনিশ্চিত তখন নিরাপত্তা পরিষদে একের পর এক যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব আসছিলো। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে পেরে উঠেনি ৷ কিন্তু জাতিসংঘ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি, এমন ভয়াবহ নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পরেও একটি নিন্দা প্রস্তাব পর্যন্তও পাশ করতে পারেনি জাতিসংঘ৷ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়েও কোনো অগ্রগতি ছিলো না জাতিসংঘের। অর্থাৎ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কুটনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে জাতিসংঘ পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা শিবির
রোহিঙ্গা ইস্যুতেও পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিগত নিধন ও ভয়াবহ নির্যাতন এবং সহিংসতা থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার হৃদয়বিদারক চিত্র পুরো বিশ্ব তাকিয়ে দেখেছে।
সেদিন বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিলে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গার জীবন বিসর্জন দিতে হতো। তবুও জাতিসংঘের ভূমিকা ছিল নিরব দর্শকের মতো । জাতিসংঘের দুই শক্তিশালী বলয়ের প্রভাবে এখনও পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করে রোহিঙ্গাদের নিজভূমিতে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে পারেনি জাতিসংঘ। এর দায় অবশ্যই জাতিসংঘকেই নিতে হবে।
১৯৪৮ সালেও জাতিসংঘে কাশ্মীরের গণভোট হয়েছিল এবং সেই গণভোটের ফলাফলের ভিত্তিতেই কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণ হওয়ার কথা ছিল। অথচ জাতিসংঘের সেই সিদ্ধান্ত আজও বাস্তবায়িত হয়নি বৃহৎ শক্তিসমূহের অনীহার কারণে।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতেও জাতিসংঘ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তিনিদের ওপর চালিয়ে আসা নৃশংস বর্বরতা ও পাশবিক নির্যাতনের বিপক্ষে জাতিসংঘ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এখনও পর্যন্ত যতবার জাতিসংঘে শান্তিমূলক প্রস্তাব এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতার ফলে বারবার সেটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
লিবিয়া, ইয়েমেন এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বন্ধে ও জাতিসংঘ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৪৮ সালে বার্লিন সমস্যা, ১৯৬২ সালে কিউবার মিসাইল ক্রাইসিস নিরসনে জাতিসংঘ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। কসোভো ও বসনিয়া হার্জেগোভিনার যুদ্ধ বন্ধের ক্ষেত্রেও জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন একতরফা হামলায়জাতিসংঘ দর্শকের ভূমিকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি।
জাতিসংঘের কিছু সুদূরপ্রসারী সফলতার চিত্র :
জাতিসংঘের শুধু ব্যর্থতার আলাপ করলে সেটি বোধহয় অপলাপই হবে। জাতিসংঘ তার নীরব কূটনীতির মাধ্যমে ৮০টিরও বেশি আসন্ন যুদ্ধ এড়াতে সক্ষম হয়েছে। জাতিসংঘের বলিষ্ঠ ভূমিকায় লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচীন, নামিবিয়া প্রভৃতি দেশগুলো স্বাধীনতা অর্জন করে। কংগো, কোরিয়া, ইরাক, বসনিয়া সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে শান্তি স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। তা ছাড়া ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল সঙ্কট, ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধ, ১৯৪৮, ১৯৬৭, ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, এবং ১৯৯৫ সালে বসনিয়ার যুদ্ধ অবসানে জাতিসংঘ ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এক কোটি মানুষ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। ১ কোটি শরণার্থীর ভার বহনের জন্য ভারতকে এক বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয়েছিল। বিভিন্ন দেশ শরণার্থীদের জন্য ভারত ও বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে যে অর্থ সাহায্য করেছেন তার পরিমাণ ভারতীয় টাকায় মাত্র ৫০ কোটি রুপি। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতকে ব্যয় করতে হয়েছে ২৬০ কোটি টাকা। মোট ব্যায়ের হিসাব ধরা হয়েছিল ৫৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতিসংঘ রাজনৈতিক ও কুটনৈতিকভাবে ব্যর্থ হলেও মানবিকতায় ছিল উদার।
সর্বোপরি, জাতিসংঘের সকল সফলতা ও ব্যর্থতার বিশ্লেষণে জাতিসংঘের ব্যর্থতার পাল্লাটাই বেশি ভারী। প্রত্যেকটি ব্যর্থতার পিছনের বড় কারন শক্তিশালী দুই বলয়। জাতিসংঘকে একের পর এক ব্যবহার করা হচ্ছে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে ও আধিপত্য বিস্তারে। জাতিসংঘের এখনই সময় মেরুদন্ড শক্ত করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সুদৃঢ় অবস্থান জানান দেওয়ার৷ অন্যথায় ‘লীগ অব নেশনসর মতো অদূর ভবিষ্যতেই এই শান্তিকামী বিশ্ব সংস্থাটির বিলীন হয়ে যেতে হতে পারে।