আজব সব নিয়মের দেশ উত্তর কোরিয়া

আজব সব নিয়মের দেশ উত্তর কোরিয়া

বর্তমান বিশ্বে ইন্টারনেট আর মোবাইলের ব্যাপক বিস্তারের কারনে সারা বিশ্বের এক দেশের সাথে অন্য দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত থেকে আরও উন্নত হয়েছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি আজকের দিনেও এমন দেশ আছে যা কি-না বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো থেকে একেবারেই আলাদা এবং যাদের অন্য দেশিদের সঙ্গে নেই কোন যোগাযোগও। এই দেশের মানুষ বসবাস করছে স্বৈরতান্ত্রিক সমাজে এবং তাদের স্বৈরশাসক বিশ্বের অন্যতম নামকরা একজন ব্যাক্তি। তিনি তার প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রায়শই আক্রমণের হুমকি দেন আর বিশেষ বন্ধুত্ব রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন কোন দেশের কথা বলছি। জ্বি! উত্তর করিয়া এবং এর স্বৈরশাসক কিম জং উন।

উত্তর করিয়ার অনেক কিছু উদ্ভট হলেও এর কিছু কিছু ব্যাপার বিশ্বের অন্য সাধারণ দেশগুলো থেকে একেবারেই আলাদা। চলুন দেখে আসি এমনই কিছু উদ্ভট নিয়ম উত্তর করিয়া সম্পর্কে।

১) আইসোলেশন নেশন

কোরিয়ান উপদ্বীপ দীর্ঘদিন ধরেই নিকটবর্তী বিশ্ব শক্তিদের জন্য একটি যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত জাপান কোরিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে৷ জাপানের আত্মসমর্পণের পর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এই দেশটিকে ৩৮তম অক্ষরেখা বরাবর সমান্তরালভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণাঞ্চলকে পরিচালনা করতো এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন উত্তরটি নিয়ন্ত্রণ করছিল।

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ পুনর্মিলন সংক্রান্ত আলোচনায় ব্যর্থ হওয়ার পর এই বিভক্তি স্থায়ী হয়ে যায়। উত্তর করিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি কিম ইল সুং ক্ষমতায় আসার পর স্বনির্ভরতার নীতি ঘোষণা করেন। এই নীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল উত্তর করিয়ার বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো থেকে একেবারে সরে আসা, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে অন্যান্য দেশ থেকে সকল সম্পর্ক বন্ধ করে দেওয়া।

এটি স্বনির্ভরতার একটি নিদর্শন। এর মূল ধারণাটি হল উত্তর কোরিয়ার জনগণকে কেবল নিজেদের উপর নির্ভর করতে হবে। কিম ইল সুং এর এই নিয়ম অনুসারে উত্তর কোরিয়ার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা, এমনকি ১৯৯০-এর দশকের দুর্ভিক্ষের মধ্যেও তারা নিজেদের এই নিয়ম থেকে বের হয়ে আসেননি। উত্তর করিয়ার একটি শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করার দরকার ছিল এবং তারা সেটা করেছে।

২) মিথিক্যাল লিডার

উত্তর কোরিয়ার শাসক রাজবংশের সবাই সবসময় নিজেদের কিছুটা অতিপ্রাকৃত বলে দাবি করেন। প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল সুং কোরিয়ার “সূর্য  হিসাবে পরিচিত ছিলেন এবং তিনি দাবি করতেন তিনি আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তার পুত্র কিম জং ইলের জন্মদিনের পাশাপাশি, কিম ইল সুং এর জন্মদিনেও জাতীয় ছুটি ঘোষণা করা হয়। তার মৃত্যুর পর, সুং এর মরদেহটি যত্নসহকারে রেখে দেওয়া হয় যা এখনও পিয়ংইয়ং-এ রয়েছে।

কিম জং ইলের গল্প এর চেয়ে কম বিস্তৃত নয়। তার জন্মকে প্রচারকরা স্বর্গীয় বলে আখ্যায়িত করেছিল এবং রাষ্ট্রীয় মিডিয়া প্রায়শই কিম জং ইলের অসম্ভব কাজকে সম্ভব করার মত খবরও প্রকাশ করে। খবর অনুসারে প্রথমবার যখন কিম জং ইল বোলিং খেলার চেষ্টা করেন, তিনি একবারেই নিখুঁত ৩০০ রান অর্জন করেছিলেন এবং প্রথমবার গল্ফ খেলে একবারেই তিনি পাঁচটি বল গর্তে ফেলে রেকর্ড করেন। ২০১১ সালে তার মৃত্যুর সময়, উত্তর কোরিয়ার পবিত্র পর্বত পাইকতুয়ের আকাশ লালচে আভায় জ্বলে উঠেছিল এমন খবরও পাওয়া যায়।

কিম জং ইলের পুত্র এবং উত্তসূরি কিম জং উনের এখানো এতটা বিস্তৃত ইতিহাস তৈরী হয়নি তবে সংবাদ মাধ্যমগুলো তাদের নেতাকে স্বর্গীয় বলে দাবি করে। ২০১২ সালে উত্তর করিয়ার রাষ্ট্রিয় গণমাধ্যম একটি ‘বিশেষ ঘোড়া আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছে যা দেখতে আক্ষরিকভাবে একটি ইউনিকর্ণের মত এবং এটিতে চড়ে বসে ছিল তাদের প্রাচীন পৌরাণিক প্রতিষ্ঠাতা টোংমুয়োং।

৩) ন্যাশনাল প্রিজন

উত্তর কোরিয়ার স্বৈরশাসকদের সম্পর্কে সমস্ত কল্পিত এবং মজার কল্পকাহিনী একটি বিরক্তিকর সত্যকে আবৃত করে।  দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের অনুমান অনুসারে প্রায় ১,৫৪০০০ উত্তর কোরিয়ান জণগণ জেলখানার শিবিরে বাস করে। অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে এই সংখ্যা ২ লাখের কাছাকাছি।

বিদ্যুতায়িত কাঁটাতারের চারপাশে ছয়টি শিবির রয়েছে। “ইস্কেপ ফ্রম ক্যাম্প-১৪: ওয়ান ম্যানস রিমার্কেবল ওডিসি ফ্রম নর্থ করিয়া টু ফ্রিডম ইন দি ওয়েস্ট (ভাইকিং ১২)” অনুসারে দুটি ক্যাম্পে কিছু ‘পুনর্বাসন’ব্যবস্থা রয়েছে এবং তারা কিছু বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার অনুমতি দেয়। বাকিরা তাদের সারা জীবনের জন্য কারাগারে বন্ধি।

“ইস্কেপ ফ্রম ক্যাম্প-১৪ শিং ডং হুক নামের এক ব্যক্তির গল্প যিনি কি না ইতিহাসের প্রথম এবং শেষ ব্যক্তি যে সেই কারাগার থেকে পালাতে এবং বাইরের দুনিয়ায় বের হয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন৷ শিংয়ের জন্ম হয় সেই শিবিরের ভেতর। তার বাবাকে কয়েক দশক আগে কারাবন্দী করা হয় কারণ তার বড় ভাই দক্ষিণ কোরিয়ায় বসবাস করার জন্য উত্তর করিয়া ছাড়ে৷

এই চিত্রটি আঁকেন উত্তর করিয়ার কারাগারে বন্ধি থাকা এক ব্যক্তি। ছবিতে তাদের উপর নির্যাতনের একটি ছোট্ট বর্ণনা মিলে।

নির্যাতন, নিপিড়ন, দাসত্ব, জনসম্মুখে ফাঁসি, এই সবই সেই কারাগারের দৈনন্দিন ঘটনা। স্যাটেলাইটের দ্বারা সংগৃহীত ছবির থেকে এইসব ঘটনার সত্যতাও পাওয়া যায়। ২০১১ সালের অ্যামেনেসটি ইন্টারন্যাশনালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী কারাগারে থাকা শতকরা ৪০ শতাংশ ব্যক্তি অপুষ্টিতে ভুগে মারা যায়।

 ৪) উত্তর করিয়ার প্রতিদিনের জীবন

উত্তর কোরিয়ার গোপনীয়তার বিষয়টি বিবেচনা করে, এই দেশের দৈনন্দিন জীবন আসলে কী রকম তা কল্পনা করা কঠিন। “নাথিং টু এ্নভি: অর্ডিনারি লাইভস ইন নর্থ কোরিয়া (স্পিগেল অ্যান্ড গ্রাউ, ২০০৯) বইটিতে সাংবাদিক বারবারা ডেমিক দক্ষিণ কোরিয়ায় পালিয়ে আসা উত্তর কোরিয়ানদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তারা পরিবারে আবদ্ধ একটি সমাজকে বর্ণনা করে। ১৯৯০-এর দশকের দুর্ভিক্ষের সময়, পরিবারের বাবা-মা এবং দাদা-দাদীরা প্রথমে অনাহারে মারা যায় কারণ তারা তাদের বাচ্চাদের জন্য খাবার বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। বইটি সেই সময় প্রচুর প্রপাগাণ্ডার সৃষ্টি করে। ডেমিক লিখেছিলেন, “১৯৮৪ সালে কল্পনা করা ভবিষ্যত নিয়ে অরওয়েল এমন এক পৃথিবীর কথা লিখেছিলেন যেখানে প্রপাগাণ্ডা ছাড়া অন্য কোন খবরে কেউ বিশ্বাসই করবে না। উত্তর কোরিয়ায় এখন এমনই ঘটনা ঘটছে।”

উত্তর করিয়ার মানুষজনদের কাছে এইসব খবর ঠিক কতটা প্রভাব ফেলে তা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা না থাকলেও চায়নায় বসবাসরত উত্তর করিয়ানদের সাথে নিউইয়র্ক টাইমস এর সাক্ষাৎকারের ভিডিও চোরাচালান করে উত্তর করিয়ার মানুষের হাতে পৌঁছায়, তারা নিজেদের গন্ডির বাইরের পৃথিবী আসলে কেমন তার কিছুটা আভাস পেয়েছে।

সম্প্রতি, পিয়ংইয়ংয়ের তত্ত্বাবধানে ভ্রমণে বিদেশী সাংবাদিকদের মোবাইল ফোনে ৩জি সংযোগের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে সাংবাদিকরা উত্তর করিয়ার প্রতিদিনের শহরের জীবনের রিয়েল-টাইম ছবি প্রকাশ করতে সক্ষম হয়।

 ৫) ব্ল্যাক মার্কেট

উত্তর কোরিয়া কমিউনিস্ট নীতি মাথায় রেখে দেশ পরিচালনা শুরু করলেও, দ্য ইকোনমিস্টের মতে সরকারী ক্র্যাকডাউন সত্ত্বেও কিছু পুঁজিবাদী ব্ল্যাক মার্কেট এরই মধ্যে নিজেদের কাজ চালু করেছে। কিছু কালো বাজারের ব্যবসায়ী চীন থেকে সীমান্তের ওপারে পণ্য পরিবহন পরিচালনা করে। তারা খাদ্য ও কাঁচামাল নিয়ে আসে যা উত্তর করিয়ার কাজকর্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পাচার হওয়া দক্ষিণ কোরিয়ার ডিভিডিগুলো কিম সরকারের প্রচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে।

ইস্কেপ ফ্রম ক্যাম্প-১৪ অনুসারে উত্তর কোরিয়ায় যানবাহনের মালিকানা কেবলমাত্র সামরিক বাহিনী ও সরকারের পক্ষে অনুমোদিত করা হয় এবং এতে নাগরিকদের ভ্রমণ চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ। তবে ১৯৯০-এর দশকে দুর্নীতিগ্রস্থ সামরিক ও দলীয় উচ্চবিত্ত লোকজন যানবাহন নিবন্ধকরণ এবং তারপরে বেসরকারী ড্রাইভারদের নিয়োগের এই প্রথা গড়ে তোলেন, এবং তারা বেসরকারী ট্যাক্সি সংস্থা তৈরি করেছিলেন যা সারা দেশে পাচারের অভিযানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।

 ৬) ইন্টারনেট লকডাউন

উত্তর করিয়ায় কেবলমাত্র অনুমোদিত এবং সরকারি কতৃপক্ষের জন্য ইন্টারনেট অ্যাক্সেসযোগ্য। এর বাইরে এই দেশের সাধারণ জনগণের জন্য ইন্টারনেট সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ। প্রধান শহরগুলোতে বসবাসকারী লোকেরা যাদের নিজেদের কম্পিউটার আছে তারা প্রাথমিকভাবে একটি ক্লোজ ডমেস্টিক নেটওয়ার্ক  ‘কিয়োংমিয়োং সঞ্চালন করতে পারেন।

২০১২ সাল পর্যন্ত উত্তর করিয়ায় ভ্রমণকারী সাংবাদিকদের তাদের মোবাইল ফোন বর্ডারে জমা দিয়ে দেশে প্রবেশ করার নিয়ম ছিল।  তবে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সরকার শুধু মাত্র বিদেশি পর্যটকদের ৩জি অ্যাক্সেস দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে।

৭) সমন্বয় না থাকা

বাইরের বিশ্বের সাথে এতটা দূরত্ব থাকায় উত্তর করিয়ার মানুষ অনেক কিছুর সাথে সমন্বয় করতে হিমসিম খেয়ে যান। অনেককেই সবসময় এক ধরনের দুশ্চিন্তায় থাকতে দেখা যায়, এটি তাদের একদম ছোট বয়স থেকে নিজেদের বাড়ি থেকেই শিক্ষা দেওয়া হয় কেননা যে কেউ, যে কোন সময় মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তাদের হাজতে পাঠাতে পারে। কিছু মানুষ আছে যারা অপুষ্টির কারনে নিজেদের শারীরিক কর্মক্ষমতা হারিয়েছে। এমন মানুষও আছে যারা উত্তর করিয়ার প্রপাগাণ্ডা ছাড়া অন্য দেশ বা বিশ্ব সম্পর্কে কিছুই জানে না৷

উত্তর করিয়ার এক বোর্ডিং স্কুলের অধ্যক্ষ জুয়াক জং-মুন “ইস্কেপ ফ্রম ক্যাম্প ১৪ এর লেখক ব্লেইন হার্ডেনকে জানিয়েছে, “উত্তর করিয়ার পড়াশোনা, দক্ষিণ কোরিয়ার জীবন যাপনের জন্য অকেজো। একজন মানুষ যখন ক্ষুধার্ত থাকে তখন তার স্কুলে যেয়ে পড়তে বা পড়াতে কোনটাই ভালো লাগে না। আমাদের অনেক শিক্ষার্থী চায়নাতে পলাতক অবস্থায় আছে যারা শিক্ষার থেকে অনেক দূরে আছে। উত্তর কোরিয়াতে বাচ্চারা গাছের বাকল খেয়ে বড় হয় এবং ভাবে এটিই স্বাভাবিক খাবার। হার্ডেনের মতে উত্তর করিয়ায় আত্মহত্যার হার দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় আড়াই শতাংশ বেশি।

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত