সাম্প্রতিক বিশ্বের একটি অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে সিরিয়ায় চলমান রুশ সামরিক অভিযান। ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে সিরীয় গৃহযুদ্ধে সিরীয় সরকারের পক্ষে হস্তক্ষেপ করে এবং বিভিন্ন সিরীয় মিলিট্যান্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান (anti-terror operation) শুরু করে। রুশরা অবশ্য সিরিয়ায় ব্যাপক হারে স্থলসৈন্য (ground troops) মোতায়েন করে নি। বরং সিরীয় যুদ্ধে রুশরা এয়ারস্ট্রাইক ন্যাভাল স্ট্রাইক স্পেশাল ফোর্সেস অপারেশন্স মিলিটারি পুলিস প্যাট্রোল ইন্টেলিজেন্স অপারেশন্স ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং অনুরূপ বিশেষায়িত যুদ্ধকৌশলের বিস্তৃত ব্যবহার করেছে। এক্ষেত্রে তারা সিরীয় সশস্ত্রবাহিনী, সিরীয় ও ইরানি–নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন মিলিশিয়া এবং হিজবুল্লাহের সঙ্গে তাদের কার্যক্রম সমন্বিত করেছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১১ সালে বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ‘আরব বসন্ত নামে যে তীব্র সরকারবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল, তারই প্রেক্ষাপটে ‘লেভান্ট অঞ্চলের আরব রাষ্ট্র সিরিয়াতে ২০১১ সালের মার্চে গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হয়। ১৯৬০–এর দশক থেকে প্রোটো–সমাজতন্ত্রী ও ধর্মনিরপেক্ষ ‘আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টি সিরিয়ায় ক্ষমতাসীন, এবং ১৯৬৯ সাল থেকে হাফেজ আল–আসাদ কর্তৃক ক্ষমতা দখলের পর ‘আলাউয়ি মতাবলম্বী আল–আসাদ পরিবার সুন্নিপ্রধান সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। ২০১১ সালে সিরীয় রাষ্ট্রপতি বাশার আল–আসাদের পতনের দাবিতে সিরিয়ায় গণবিক্ষোভ শুরু হয় এবং ক্রমশ এটি একটি ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে রূপ ধারণ করে। সিরীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মিলিট্যান্ট গ্রুপ যুদ্ধরত, যেগুলো মধ্যে আল–কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘জাবহাত ফতেহ আল–শাম ও ‘সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া, সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এবং সিরিয়া ও ইরাক জুড়ে সক্রিয় ‘ইসলামিক স্টেট (আইএস) মিলিট্যান্ট গ্রুপও এই যুদ্ধে অংশ নেয়। মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলো সিরীয় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পাশাপাশি নিজেদের মধ্যেও সংঘর্ষে লিপ্ত।
সিরীয় গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ পশ্চিমা বিশ্ব এবং সৌদি আরব, কাতার ও তুরস্কসহ স্থানীয় রাষ্ট্রগুলো বিভিন্ন সিরীয় মিলিট্যান্ট গ্রুপকে সহায়তা প্রদান করতে শুরু করে। অন্যদিকে, ইরান ও হিজবুল্লাহ সিরীয় সরকারের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, এবং রাশিয়া সিরিয়াকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করতে থাকে। ২০১২ সাল থেকে তুরস্ক সিরীয় সরকারের সঙ্গে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে লিপ্ত, এবং পরবর্তীতে তারা উত্তর সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালিয়েছে। ২০১৪ সালে মার্কিন–নেতৃত্বাধীন একটি জোট ‘আইএসকে দমন করার উদ্দেশ্যে সিরিয়ায় সামরিক অভিযান শুরু করে, এবং সময়ে সময়ে তারা সিরীয় সরকারি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়েছে৷ ইসরায়েলও সিরিয়ায় স্থাপিত ইরানি ও হিজবুল্লাহ ঘাঁটি ও অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর বহুসংখ্যক আক্রমণ চালিয়েছে।
২০১৫ সালের প্রথমদিকে সিরীয় সরকারি বাহিনী বেশ কয়েকটি ফ্রন্টে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় এবং বিশ্লেষকরা ধারণা করতে থাকেন যে, সিরীয় সরকারের পতন নিশ্চিত। এমতাবস্থায় ২০১৫ সালের জুলাইয়ে সিরীয় রাষ্ট্রপতি বাশার আল–আসাদ ‘মিলিট্যান্ট দের হাত থেকে তাঁর রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য রাশিয়ার নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক সহায়তা প্রার্থণা করেন। ইরানি ‘ইসলামি বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর স্পেশাল ফোর্স ‘কুদস ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল কাসেম সুলাইমানি গোপনে মস্কো সফর করেন এবং রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিরিয়ায় সম্ভাব্য রুশ অভিযান নিয়ে আলোচনা করেন। ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রুশ আইনসভার উচ্চকক্ষ ‘ফেডারেশন কাউন্সিল সর্বসম্মতিক্রমে সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালানোর প্রস্তাব গ্রহণ করে, এবং একই দিনে রুশ অ্যারোস্পেস ফোর্সেস সিরিয়ায় বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর ওপর বিমান হামলা চালাতে শুরু করে।
সিরিয়ায় রুশ সামরিক হস্তক্ষেপ সিরীয় গৃহযুদ্ধের গতিকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সিরিয়ার মাত্র ১৯,০০০ বর্গ কি.মি. অঞ্চল সিরীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল, যেখানে সিরিয়ার মোট আয়তন ১,৮৫,১৮০ বর্গ কি.মি.। ২০২০ সালের মার্চের হিসাব অনুযায়ী, সিরীয় সরকার সিরিয়ার প্রায় ১,১৬,০০০ বর্গ কি.মি. অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে৷ সর্বোপরি, সিরীয় সরকারের পতন ঘটার এখন আর কোনো সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রতিটি রাষ্ট্রই তার নিজস্ব স্বার্থ অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, রাশিয়া কেন সিরীয় সরকারকে রক্ষা করার জন্য সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালাচ্ছে?
প্রথমত, সিরিয়ায় রুশ অভিযানের মূল কারণ মানবিক বা নৈতিক নয়। সিরিয়ায় হস্তক্ষেপের পিছনে রাশিয়ার মূল স্বার্থ ভূরাজনৈতিক, এবং এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘জ্বালানি রাজনীতি (energy politics) ও তৎসংশ্লিষ্ট ‘পাইপলাইন রাজনীতি (pipeline politics)। রাশিয়ায় বিপুল পরিমাণ খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে, অন্যদিকে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো তাদের জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। রাশিয়ার রপ্তানি আয়ের অর্ধেকের বেশি আসে জ্বালানি রপ্তানির মাধ্যমে।
রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহকারী পাইপলাইন
কিন্তু ১৯৯৯ সালে রুশ শান্তি প্রস্তাব উপেক্ষা করে যুগোস্লাভিয়ার ওপর ন্যাটোর বোমাবর্ষণের পর থেকেই ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়া ক্রমশ তীব্র ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত। স্বভাবতই পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে (ও সামরিকভাবে) দুর্বল করে ফেলতে আগ্রহী। এর জন্য একটি চমৎকার উপায় হচ্ছে ইউরোপে হাইড্রোকার্বন রপ্তানির মাধ্যমে রাশিয়া যে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করছে, সেটি বন্ধ করে দেয়া বা উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস করা। তদুপরি, ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এই ভীতিও রয়েছে যে, জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর তাদের নির্ভরশীলতাকে রুশরা তাদেরকে ‘রাজনৈতিক ব্ল্যাকমেইল করার জন্য কাজে লাগাতে পারে।
এজন্য পশ্চিমা বিশ্ব বিকল্প জ্বালানির উৎসের সন্ধান করছিল, এবং বিপুল পরিমাণ জ্বালানি সম্পদে সমৃদ্ধ পশ্চিমাপন্থী রাষ্ট্র কাতার ছিল তাদের জন্য একটি আদর্শ বিকল্প। কিন্তু ইউরোপ থেকে কাতার অনেক দূরে, এবং কাতার থেকে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ করতে হলে কাতার থেকে সিরিয়া ও তুরস্কের মধ্য দিয়ে পাইপলাইন নির্মাণ করতে হবে। ২০০৯ সালে সিরীয় সরকার সিরিয়ার মধ্য দিয়ে পাইপলাইন নির্মাণের একটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল, কারণ এর মধ্য দিয়ে তারা তাদের মিত্র রাষ্ট্র রাশিয়ার ক্ষতি করতে ইচ্ছুক ছিল না। বিশ্লেষকদের মতে, এজন্যই সিরীয় সরকারকে উৎখাত করার জন্য পশ্চিমা বিশ্ব ও স্থানীয় রাষ্ট্রগুলো সক্রিয় হয়েছিল।
গৃহযুদ্ধে যদি সিরীয় সরকারের পতন ঘটত, তাহলে সিরিয়ার মধ্য দিয়ে পাইপলাইন নির্মাণের আর কোনো বাধা থাকত না। স্বভাবতই নিজেদের জ্বালানি বাণিজ্য ও অর্থনীতির (এবং পরোক্ষভাবে সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের) প্রতি এই গুরুতর হুমকির মোকাবেলা করার জন্য রুশরা সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে।
স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবিতে তারতুস নৌঘাঁটি
দ্বিতীয়ত, ভূকৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে রাশিয়ার একটি গুরুতর সমস্যা হচ্ছে – বিশ্বের বৃহৎ সমুদ্রগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার সরাসরি কোনো সংযোগ নেই। ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের জন্য রুশদেরকে কৃষ্ণসাগর অতিক্রম করতে হয়, কিন্তু কৃষ্ণসাগর থেকে ভূমধ্যসাগরের প্রবেশমুখ ‘বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালী দ্বয় ন্যাটো সদস্য তুরস্কের নিয়ন্ত্রণাধীন। এই পরিস্থিতিতে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী বিভিন্ন রাষ্ট্রে তাদের নৌ উপস্থিতি বজায় রেখেছিল, কিন্তু ক্রমশ সেই উপস্থিতি হ্রাস পেতে থাকে। বর্তমানে সিরিয়ার তারতুস বন্দরে রুশ নৌবাহিনীর একমাত্র ভূমধ্যসাগরীয় নৌঘাঁটি অবস্থিত, এবং ভূকৌশলগত দিক থেকে এটি রুশদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যদি সিরীয় গৃহযুদ্ধে সিরিয়ার বর্তমান সরকারের পতন ঘটত, সেক্ষেত্রে রুশরা নিশ্চিতভাবে ভূমধ্যসাগরে তাদের সর্বশেষ সামরিক ঘাঁটি হারিয়ে ফেলত৷ এই পরিস্থিতি ঠেকানোর জন্য রুশদেরকে সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালাতে হয়েছে। রুশ হস্তক্ষেপের ফলে তারতুসের রুশ নৌঘাঁটিই শুধু রক্ষা পায় নি, বরং হিমেইমিমে একটি স্থায়ী রুশ বিমানঘাঁটিও স্থাপিত হয়েছে।
তৃতীয়ত, রুশ সরকারের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য অনুযায়ী, সিরিয়ায় রাশিয়ার মূল উদ্দেশ্য বাশার আল আসাদকে রক্ষা করা নয়, বরং সিরিয়ার ‘রাষ্ট্রত্ব রক্ষা করা। সিরীয় সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে তদস্থলে আইএস বা অন্য কোনো মিলিট্যান্ট গ্রুপ সিরিয়ার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারত, কিংবা সিরিয়া কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে যেতে পারত। রুশদের আশঙ্কা, এই পরিস্থিতিতে সিরিয়া ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদে’র একটি কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে পারত। এটি ভুলে গেলে চলবে না যে, সিরিয়া রাশিয়ার সীমান্ত থেকে খুব বেশি দূরে নয়। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়ার রাজধানী মস্কো থেকে রাশিয়ার মুসলিম–অধ্যুষিত প্রান্তিক প্রজাতন্ত্র চেচনিয়ার দূরত্ব প্রায় ১,৮৩৫ কি.মি., যেখানে সিরিয়া থেকে চেচনিয়ার দূরত্ব প্রায় ১,৫৭৬ কি.মি.। অর্থাৎ, চেচনিয়া ভৌগোলিকভাবে রাশিয়ার কেন্দ্র থেকে সিরিয়ার অধিক নিকটবর্তী!
দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধের সময় রুশ সৈন্যরা চেচেন মিলিট্যান্টদের ওপর গোলাবর্ষণ করছে
এমতাবস্থায় রাশিয়ার নিকটবর্তী অঞ্চলে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদে র একটি ঘাঁটি মস্কোর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য মোটেই কাম্য নয়। ইতোপূর্বে ১৯৯০ ও ২০০০–এর দশকে চেচনিয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে রাশিয়া দুইটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, এবং এই দুইটি যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আরব মিলিট্যান্টরা চেচনিয়ায় গিয়ে রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। রুশ সরকার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দিতে নারাজ, এবং সিরিয়ায় রুশ অভিযানের এটি একটি অন্যতম কারণ।
চতুর্থত, ১৯৯০–এর দশক থেকে রাশিয়ার উত্তর ককেশাস অঞ্চলের মুসলিম–অধ্যুষিত প্রজাতন্ত্রগুলোতে, বিশেষত চেচনিয়া, ইঙ্গুশেতিয়া ও দাগেস্তানে, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাসবাদ ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। বর্তমানে রুশ সরকার এই অঞ্চলের পরিস্থিতি বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে, কিন্তু অঞ্চলটিতে পুনরায় অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়তে পারে, এই আশঙ্কা রুশ নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বিদ্যমান। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার রুশ নাগরিক আইএসসহ বিভিন্ন মিলিট্যান্ট গ্রুপে যোগ দেয়ার জন্য সিরিয়ায় গিয়েছে। মস্কোর আশঙ্কা, এই মিলিট্যান্টরা রাশিয়ায় ফিরে আসতে পারে এবং সিরীয় যুদ্ধে অর্জিত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করতে পারে।
এই পরিস্থিতি রোধ করাও সিরিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। রুশ সরকারের উদ্দেশ্য, এই মিলিট্যান্টরা রাশিয়ায় ফিরে যাওয়ার আগে সিরিয়ার মাটিতেই তাদের শেষ করে দেয়া। এই উদ্দেশ্য রুশ বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘এসভিআর সিরিয়ায় তাদের অতি গোপনীয় স্পেশাল ফোর্স ‘জাসলন’ ইউনিটকে মোতায়েন করেছে, যাদের একটি দায়িত্ব হচ্ছে সিরিয়ায় অবস্থানরত রুশভাষী মিলিট্যান্টদের খুন করা।
তাজিকিস্তানের ‘ওমন’ স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডার গুলমুরোদ খালিমভ সিরিয়ায় পালিয়ে গিয়ে আইএসে যোগ দিয়েছেন
পঞ্চমত, কেবল রাশিয়া থেকেই নয়, মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো থেকেও প্রায় ৭,০০০ মিলিট্যান্ট সিরিয়ায় বিভিন্ন মিলিট্যান্ট গ্রুপে যোগ দিয়েছে। মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে, বিশেষত তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তানে, সন্ত্রাসবাদ একটি বড় সমস্যা, এবং সিরিয়া থেকে অভিজ্ঞ এই মিলিট্যান্টরা মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে ফিরে সেখানে বিশৃঙ্খলা, এমনকি গৃহযুদ্ধও শুরু করতে পারে এরকম একটি সম্ভাবনা ছিল। তদুপরি, মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকরা সহজেই রাশিয়ায় প্রবেশ করতে পারে, ফলে এই মিলিট্যান্টরা রাশিয়ায় প্রবেশ করে সেখানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারত।
রাশিয়া মধ্য এশীয় রাষ্ট্রগুলোকে ‘নিকট বিদেশ (near abroad) ও নিজস্ব প্রভাব বলয়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে, এবং এই রাষ্ট্রগুলো রাশিয়া ও অস্থিতিশীল মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর (আফগানিস্তান, পাকিস্তান প্রভৃতি) মধ্যে ‘বাফার (buffer) হিসেবে কাজ করে। এজন্য এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ও নিজস্ব প্রভাব বজায় রাখা মস্কোর পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। এজন্য রাশিয়া থেকে আসা মিলিট্যান্টদের মতো মধ্য এশিয়া থেকে আসা মিলিট্যান্টদের নিশ্চিহ্ন করাও সিরিয়ায় রুশ অভিযানের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য।
ষষ্ঠত, ২০১৪ সালে রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয়, এবং ফলশ্রুতিতে পশ্চিমা বিশ্ব ও পশ্চিমাপন্থী রাষ্ট্রগুলো রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মার্কিন–নেতৃত্বাধীন জোট রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘একঘরে করে রাখার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু সিরিয়ায় রুশ হস্তক্ষেপের পর পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়, কারণ উভয় পক্ষই সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালাচ্ছে এবং পারস্পরিক যোগাযোগ না থাকলে উভয় পক্ষের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘর্ষের সম্ভাবনা ব্যাপক, যা বড় আকারের যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এমতাবস্থায় পশ্চিমা বিশ্বকে বাধ্য হয়েই সিরিয়ায় রুশদের সঙ্গে অন্তত আংশিক সমন্বয় সাধন করতে হয়।
সিরিয়ায় একটি যৌথ টহলের পর রুশ সামরিক পুলিশ ও তুর্কি সৈন্যরা করমর্দন করছে
তাছাড়া, সিরিয়ায় রুশ সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে স্থানীয় রাষ্ট্রগুলো, বিশেষত তুরস্ক, ইসরায়েল ও সৌদি আরব, রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়, এবং ইরান ও ইরাকের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। অর্থাৎ, ইউক্রেনে হস্তক্ষেপের ফলে রাশিয়া আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যেরকম কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল, সিরিয়ায় হস্তক্ষেপের ফলে সেই পরিস্থিতিতে বহুলাংশে পরিবর্তন আসে। এটিও সিরিয়ায় অভিযান পরিচালনার পশ্চাতে মস্কোর একটি লক্ষ্য ছিল বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
সপ্তমত, সিরীয় গৃহযুদ্ধের ফলে সিরিয়ার অবকাঠামো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এবং যুদ্ধ শেষে এই অবকাঠামোর পুনঃনির্মাণের জন্য সিরিয়াকে শত শত কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হবে। রাশিয়া যেহেতু সিরীয় সরকারকে রক্ষার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, স্বভাবতই রুশ কোম্পানিগুলো এই পুনঃনির্মাণ প্রকল্পগুলোর একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ লাভ করবে এবং এর ফলে পশ্চিমা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্ত রুশ অর্থনীতি আংশিকভাবে হলেও লাভবান হবে। সিরিয়ায় অভিযান পরিচালনার সময় রুশ নীতিনির্ধারকরা এই দিকটিও বিবেচনায় রেখেছেন বলেই প্রতীয়মান, কারণ ইতোমধ্যেই বেশকিছু রুশ কোম্পানি সিরিয়ায় বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণের কাজ পেয়েছে।
অষ্টমত, সিরিয়ায় পরিচালিত সামরিক অভিযানটি হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর বাইরে পরিচালিত প্রথম সামরিক অভিযান। এই অভিযানের ফলে রুশ সৈন্যরা আধুনিক যুদ্ধবিগ্রহের ক্ষেত্রে বিপুল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, যেটি রুশ সশস্ত্রবাহিনীর জন্য অত্যন্ত লাভজনক। তদুপরি, রাশিয়া এই পর্যন্ত কয়েক শত নতুন সামরিক সরঞ্জাম সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে পরীক্ষা করেছে, এবং এর ফলে রাশিয়ার অস্ত্র রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বলাই বাহুল্য, রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম প্রধান অস্ত্র রপ্তানিকারক রাষ্ট্র। এটিও মনে রাখা জরুরি যে, সিরিয়া রুশ অস্ত্রের অন্যতম বৃহত্তম ক্রেতা, এবং এই হস্তক্ষেপের মাধ্যমে রাশিয়া পরোক্ষভাবে নিজস্ব একটি অস্ত্রের বাজারও রক্ষা করেছে।
সিরিয়ায় মোতায়েনকৃত অত্যাধুনিক ‘এস–৪০০’ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম
এছাড়াও, রুশ মার্সেনারি গ্রুপ বা সিকিউরিটি কোম্পানিগুলো, বিশেষত ‘ওয়াগনার গ্রুপ সিরীয় যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে পরিচিতি অর্জন করেছে এবং রুশ সরকার বিশ্বের অন্যান্য বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে এই মার্সেনারিদের ব্যবহার করে নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করছে। সিরিয়ার বাইরে লিবিয়া, সুদান, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার ও ভেনেজুয়েলায় রুশ সরকার নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্য এই মার্সেনারিদের মোতায়েন করেছে। অর্থাৎ, নিজস্ব অস্ত্র বাণিজ্যের সুরক্ষা ও বিস্তৃতিও সিরিয়ায় রুশ অভিযানের একটি গৌণ, কিন্তু পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, অংশ।
সর্বোপরি, রুশ সরকার সাধারণভাবে পশ্চিমা–সমর্থিত অভ্যুত্থান বা পশ্চিমা সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে কোনো রাষ্ট্রের সরকার পরিবর্তনের ঘোর বিরোধী। এজন্যই মস্কো ইউক্রেন, জর্জিয়া, কিরগিজস্তান ও ভেনেজুয়েলায় পশ্চিমা–সমর্থিত ‘বিপ্লব এবং ইরাক ও লিবিয়ায় পশ্চিমা আক্রমণের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের তীব্র বিরোধিতা করেছে। এরই অংশ হিসেবে মস্কো সিরিয়ায় পশ্চিমা–সমর্থিত ‘বিপ্লবের বিরোধিতা করেছে, এবং সিরিয়ায় যেন ইরাক বা লিবিয়ার মতো পশ্চিমা আক্রমণ না ঘটে, সেজন্য সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছে। পশ্চিমা বিশ্ব ‘বিপ্লবের মাধ্যমে রুশপন্থী বা নিজেদের অপছন্দনীয় সরকারগুলোকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায়, এবং রুশরা এই প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিতে আগ্রহী। এরই অংশ হিসেবে রুশরা সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছে।
রুশ মুসলিমদের প্রধান মুফতি তালগাত তাজউদ্দিন সিরিয়ায় রুশ অভিযানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন
সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের ফলে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ ঐক্যও জোরদার হয়েছে। রাশিয়ার প্রধান বিরোধী দলগুলো (কমিউনিস্ট পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, আ জাস্ট রাশিয়া প্রভৃতি) এই অভিযানকে সমর্থন করেছে। রুশ জনসাধারণ সাধারণভাবে বহির্বিশ্বে রুশ প্রভাব ও মর্যাদা বৃদ্ধিকে ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করে, এবং সিরিয়ায় রুশ অভিযানকে তারা সমর্থন জানিয়েছে। রুশ মুসলিমরাও সাধারণভাবে এই যুদ্ধকে সমর্থন জানিয়েছে, এবং রুশ খ্রিস্টান ও মুসলিম ধর্মীয় নেতারা এই যুদ্ধের সমর্থনে বক্তব্য রেখেছেন। সিরিয়ায় মোতায়েনকৃত রুশ সৈন্যদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ধর্মগতভাবে মুসলিম। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, বৈদেশিক যুদ্ধবিগ্রহ কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঐক্যকে জোরদার করতে পারে, এবং সিরিয়ায় অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে রুশ সরকার এই বিষয়টি যে মাথায় রাখে নি, এমন নয়।
সামগ্রিকভাবে, সিরিয়ায় রুশ সামরিক হস্তক্ষেপ কোনো ‘মানবিক আদর্শিক বা নৈতিক বিবেচনায় সংঘটিত হয় নি, বরং ভূরাজনৈতিক, ভূকৌশলগত, সামরিক, অর্থনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিবেচনাই এক্ষেত্রে প্রাধান্য লাভ করেছে। কিন্তু সিরিয়ার যুদ্ধ এখনো শেষ হয় নি, সুতরাং এই যুদ্ধে মস্কোর উদ্দেশ্যগুলো কতটুকু পূরণ হবে সেটি সম্পর্কে এখনো প্রশ্নসাপেক্ষ।