ফিনিক্স পাখি: শুধুই কী গল্প নাকি এর পিছে সত্যতাও আছে?

ফিনিক্স পাখি: শুধুই কী গল্প নাকি এর পিছে সত্যতাও আছে?

ফিনিক্স একটি কাল্পনিক পাখি যা প্রতিটি সংস্কৃতি এবং প্রতিটি যুগের মানুষের কাছে সমান ভাবে পরিচিত।বিভিন্ন পুরাকথা মতে যখন ফিনিক্স পাখির মৃত্যু হয়,পাখিটি আগুনের লেলিহান শিখায় সম্পূর্ণ ভাবে বিদ্ধস্ত হয়ে যায় এবং এরপর এটির তার নিজের ছাই থেকে আবার পুনর্জন্ম হয়,যা তাকে অমর করে তোলে। এই পাখির প্রতিটি জীবন ৫০০ থেকে ১ হাজার বছরের হয়ে থাকে। উজ্জ্বল লাল,গলাপি (ক্রিমসন) এবং সোনালী রঙে এই প্রাণীর সর্বাধিক চিত্র আঁকা হয়,তবে নীল বা বেগুনির মতো অন্যান্য রঙও কিছু কিছু স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে।

একটি ময়ূরের আকর্ষণীয়তা এবং ঈগলের আকারের সাথে এই পাখির তুলনা করা হয়৷ এই পাখি সৌন্দর্য এবং শক্তির প্রতীক। বলা হয় ফিনিক্স পাখির কান্নার আওয়াজ মনোমুগ্ধকর, যা শুনতে অনেকটা গানের মত শ্রুতিমধুর। এর সৌন্দর্য এবং অস্বাভাবিক মৃত্যুর সব কল্পকাহিনির মধ্য দিয়ে ফিনিক্স পাখি অমরত্ব, পুনর্নবীকরণ এবং পুনর্জন্মের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

ফিনিক্সের পৌরাণিক কাহিনী কিভাবে শুরু হয় তা নিশ্চিতভাবে কেউই জানে না, এই কাহিনীগুলো বাইবেলের সময়কাল থেকে চলে আসছে এবং পৃথিবীর প্রতিটি মহাদেশে এই কাহিনীর ভিন্ন ভিন্ন প্রচলন দেখা যায়। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে এর রহস্যময় কাহিনীগুলো শুরু হয়েছিল এমন কিছু কাল্পনিক পাখি থেকে যার দেখা মানুষ সত্যই পেয়েছিল। তবে ফিনিক্সের সব রহস্যময় কাহিনীর সঠিক ইতিহাস কেউ জানেন না। আর সম্ভবত, কেউ কখনও জানতে পারবেও না।

ফিনিক্সের সব কল্পকাহিনির শুরু কবে থেকে?

ইতিহাস থেকে জানা যায়, বর্তমানে একটি পাখির ফিনিক্সের সাথে তুলনা বা এর ফিনিক্সের সাথে কোন যোগ সুত্র আছে বলে মনে করা হয়। সে পাখিটি হলো ফ্লেমিংগো। ফ্লেমিংগো পাখি তাদের বাসা বাধে এমন স্থানে যা উত্তপ্ত এবং লবণাক্ত, এমন পরিবেশকে  আগুনের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। আগুনে মৃত্যু আর আগুন থেকেই সৃষ্টি কাহিনীর জন্য ফিনিক্স পাখিও আগুনের সাথে সম্পর্ক রাখে। তা ছাড়াও ফ্লেমিংগো পাখির বৈজ্ঞানিক নাম ফোয়েনিকপটেরিদাই (Phoenicopteridai) যার আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় ফিনিক্স- উয়িংড (Phoenix-winged)।

Flamingo Bird

আরও একটি বিশ্বাস হল, এই সকল কাহিনীর উৎপত্তি হয়েছে ময়ূর থেকে, যার আকার এবং সৌন্দর্য ফিনিক্স পাখির সাথে মেলে। যদিও বেশিরভাগ বিবরণ থেকে জানা যায় ফিনিক্স পাখির সবচেয়ে বেশি মিল পাওয়া যায় সোনালী ফেসেন্ট পাখির সাথে।  যদিও ফিনিক্সের আকার থেকে সোনালী ফেসেন্টের আকার অনেক ছোট। ফিনিক্সের আকার অনেকে ঈগলের আকারের সাথে তুলনা করেন। তবে সোনালি ফেসেন্টের সৌন্দর্য, এর লম্বা লেজ ঠিক ফিনিক্সের মতই। এদের একই রকম সৌন্দর্য এবং এই দুই পাখি একই রঙের। কিছু কিছু ফেসেন্টের গায়ে নীল এবং বেগুনি রঙ রয়েছে ঠিক ফিনিক্স পাখির মত।

Pheasant Bird

ফিনিক্স পাখি নিয়ে যত সব কল্পকাহিনি আছে এর সুচনা কোথায়? 

বলা হয় ফিনিক্স পাখি অন্যান্য আরও পাখির মতই পৃথিবীতে ঘুরে বেরাতো। এমনই এক সাধারণ দিনে ঘটে এক অসাধারণ ঘটনা। ফিনিক্স পাখির সৌন্দর্য আর মনোমুগ্ধকর কন্ঠস্বর সূর্য দেবতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সূর্য দেবতা ফিনিক্স পাখির সোনালী লেজ আর লাল ঝুটি দেখে বিশ্বাসই করতে পারেন না এত সুন্দর কিছু পৃথিবীর বুকে আছে কিভাবে। সূর্য দেবতা তার আসন থেকে নিচে নেমে আসেন ফিনিক্সের সৌন্দর্য আরও কাছ থেকে দেখার জন্য। ফিনিক্স পাখি সূর্য দেবতার এই মুগ্ধতা দেখে আপ্লুত হলো, এবং সে তার নিজের মিষ্টি কন্ঠে গান গাইতে শুরু করে।

সূর্য দেবতাকে ফিনিক্সের এই রূপ আর কন্ঠ এতটাই ছুয়ে যায় যে তিনি সিদ্ধান্ত নেন তিনি ফিনিক্স পাখিকে অমর করে দিবেন। ফিনিক্স পাখি তারপর থেকে সূর্য দেবতাকে খুশি করার জন্য তাকে গান শোনাতো আর তার সাথে সময় কাটাতো। তবে ফিনিক্স পাখির গুণ আর সৌন্দর্যের এই আয়ু ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। প্রায় ৫০০ বছর পর ফিনিক্স পাখির উড়াল ধীর হয়ে আসে আর তার গানের স্বরও ধীরে ধীরে কর্কশ হতে শুরু করে।

সূর্য দেবতার থেকে ফিনিক্স পাখির এই কষ্ট লুকনো ছিল না। সূর্য দেবতা ফিনিক্স পাখির উপর দয়া করলেন আর একদিন বললেন পাখিটি যাতে নিজের জন্য একটি নীড় তৈরী করে। সূর্য দেবতার কথা মত ফিনিক্স পাখি দারুচিনি আর মচির গাছের ডাল দিয়ে নিজের জন্য একটি বাসা তৈরী করে। ফিনিক্স যখন নিজের বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছিলো সূর্য দেবতা তার সম্পূর্ণ আলো পাখিটির বাসায় ফেললো, তৎক্ষনাৎ ফিনিক্সের বাসা সহ তার পুরো শরীর আগুনে ঝলসে উঠলো। ফিনিক্সের বাসাটিতে ছিল তার একটি অফুটন্ত ডিম, সূর্যের আলোর প্রবল তাপের কারনে ডিম ফুটে তার থেকে ফিনিক্সের একটি ছোট ছানা জন্ম হয়, এটি দেখতে ছিল ঠিক আগের ফিনিক্সের মতই।

তার পর থেকেই প্রতি ৫০০ থেকে ১ হাজার বছর পর পর ফিনিক্স তার নিজের বাসা তৈরী করে দারুচিনি আর মরিচ গাছের ডাল দিয়ে, সূর্য দেবতার কৃপার অপেক্ষায়।

ফিনিক্স পাখিকে কিসের প্রতীক মনে করা হয়? 

ফিনিক্সের এই বিস্ময়কর কাহিনীর শুরু থেকে আজ পর্যন্ত এটিকে পুনর্জাগরণের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত করা হয়। বিভিন্ন পশ্চিমা সংস্কৃতিতে অনেক নারী পুরুষ এই ফিনিক্সের ট্যাটু নিজের শরীরে করেন নিজেদের জীবনের নতুন শুরুর প্রতীক হিসেবে। ড্রাগ বা অন্য কোন আসক্তি কাটিয়ে উঠার প্রতীক, নতুন করে জীবন শুরু করার প্রতীক, কোন পিছুটান কাটিয়ে নিজের মত বেঁচে থাকার প্রতীক। বিশেষ করে ফিনিক্সের নতুন করে জীবন শুরু করার এই কাহিনী অনেকের জন্য এটি মায়া এবং সাহসীকতার প্রতীক।

আবার অনেকে মনে করেন পাখির প্রতিটি অংশই আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের প্রতীক। শরীর দয়ার প্রতীক, ডানা সমৃদ্ধি এবং এর মাথা নির্ভরযোগ্যতার প্রতীক। কেউ কেউ ফিনিক্স পাখিকে যীশু খ্রিস্টের প্রতিনিধিত্বকারীও মনে করেন, ফিনিক্সের পুনর্জন্ম আর যীশুর পুনরুত্থানের ইতিহাসের কারনে। ফিনিক্স পাখির এই রহস্যময় পুরাকাহিনী নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বই, উপন্যাস, গল্প, নাটক এবং সিনেমা নির্মাণ হয়েছে। হলিউডের বিখ্যাত সিরিজ হ্যারি পটার থেকে শুরু করে দি ফিনিক্স বার্ড এবং দি বাইবেল।

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত