পাইরামাস-থিসবি: গ্রিক মিথলজির এক অপূর্ণ প্রেমের গল্প

পাইরামাস-থিসবি: গ্রিক মিথলজির এক অপূর্ণ প্রেমের গল্প

মানব সভ্যতার প্রথম দিকের কথা। গুহাবাসী মানুষের মনে তখনো লাগে নি কোন বিজ্ঞানের স্পর্শ। গুহার বাহিরে তাকিয়ে তারা যা কিছু দেখতে পায় সব কিছু নিয়েই তাঁদের কৌতূহলের অন্ত নেই। ঝড়ো বাতাস কিভাবে আসে? কেন রাত হয়? শীত কেন দ্রুত নামে? নিজের শরীর নিয়েও কৌতূহলের কমতি ছিল না তাদের। কেন মানুষ বুড়ো হয়? মারা গেলে কোথায় যায় ?

কেন রোগ হয়? এসবের উত্তর খোঁজার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবে নিজের কাছে যা যৌক্তিক মনে হত তাই তারা বিশ্বাস করত। এভাবেই যুগের পর যুগ মানুষ নানা ধরনের গল্প তৈরি করেছে। এক্ষেত্রে অন্য সবার চেয়ে আলাদা ছিল প্রাচীন গ্রিকরা। গ্রিকরা ছিল সাহিত্য প্রতীভা সম্পন্ন প্রাণবন্ত মানুষ। সেই সময়ে তাঁরা এই ধরনের গল্পকে বলতো “মিথোজ। এটি একটি গ্রিক শব্দ। এর অর্থ “রূপকথা বা “গল্প। এই “মিথোজ থেকেই পরবর্তীতে এসেছে “মিথোলোজি শব্দটি।

গ্রিকরা খুবই গুরুত্বের সাথে এসব গল্প গুলো গ্রহণ করেছিল। তারা পৌরাণিক কাহিনী হতে বর্ণিত দেব-দেবীদের খুশি করতে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করত। এমনকি দেব দেবীদের তুষ্টির জন্য তারা গড়ে তুলেছিল বিভিন্ন মন্দির। এভাবেই পৌরাণিক কাহিনী গুলোকে ঘিরে গড়ে উঠছে একটি ধর্ম।

অন্য সব মিথলজি কম বেশি এই ধারনার উপর গড়ে উঠলেও গ্রিকগণের  বিশ্বাস  ছিল একটু ভিন্ন ধরনের। তাদের চিন্তামতে “বিশ্ব ব্রক্ষ্মাণ্ডই সৃষ্টি করেছে দেবতাবৃন্দকে । তবে প্রথম পিতা মাতা ছিলেন স্বর্গ ও ধরনী। তাদের সন্তান হলেন টাইটানরা। আর টাইটানদের সন্তান সন্তুতি ছিলেন দেবতারা। গ্রিক মিথলজি বিখ্যাত তার অনন্য ট্রাজিডি আর বীর সেনানীদের উপাখ্যানের জন্য। এ ছাড়াও গ্রিক মিথলজির একাংশ দখল করে আছে প্রেমের অসাধারন সব কাহিনী যার কিছুর বিরহপূর্ণ ও কিছুর আনন্দময় সুখ সমাপ্তি ঘটেছে। প্রিয় পাঠক এই ধারাবিক পর্বে তুলে ধরা হবে সে সকল স্বল্প প্রচলিত বা অপ্রচলিত গল্প গুলো যা উঠে এসেছে গ্রিক মিথলজিতে।

পাইরামাস এবং থিসবি

সে অনেক আগের কথা। মালবেরি গাছের গাঢ় লাল ফল গুলো ছিলে তুষার সাদা। তবে হঠাৎ করেই এর রং পরিবর্তনের সাথে জড়িয়ে আছে এক করুণ কাহিনী।

রানী সেমিরামিসের শহর ব্যবাবিলন। সেই শহরে বাস করত তখনকার সবচেয়ে সুদর্শন যুবক ও সবচেয়ে সুন্দরী যুবতী। যুবকের নাম পাইরামাস আর যুবতী থিসবি। প্রাচীন ব্যাবিলনের বাড়ী গুলো ছিল লাগোয়া। ফলে বেশির ভাগ বাড়ি গুলোই একটি দেয়ালকে দুটি ঘরের সাধারন দেয়াল হিসেবে ব্যবহার করত। তেমনি এক বাড়ীর দুই ঘরে বাস করত পাইরামাস আর থিসবির পরিবার। এত কাছাকাছি বড় হতে হতে তারা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলে। স্বাভাবিক ভাবেই তারা অন্য সব প্রেমিক যুগলের মত স্বপ্ন দেখছিল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার। কিন্ত তাদের প্রেমে বাধা হয়ে দাড়াল তাদের পরিবার।

কিন্ত তাদের প্রেম দমিয়ে রাখার মত ছিল না। যে দেয়ালটি তাদের পৃথক করে রেখেছিল তাই হয়ে দাড়াল তাদের যোগাযোগের মাধ্যম। দেয়ালের মাঝে ছিল খুবই সরু এক ছিদ্র। এই ছিদ্রের ভেতর দিয়েই তারা এক পাশ থেকে অন্য পাশে কথা বলত। এক পাশে পাইরামাস অন্য পাশে থিসবি।

প্রতিদিন সকালে যখন সূর্য তাপে ঘাসের উপর জমে থাকা শিশির বিদায় নিতে শুরু করত, তারা দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের ভালোবাসার কথা প্রকাশ করে যেত। কিন্তু একদিন ধৈর্য্যের বাধ ভেঙ্গে গেল। তারা ঠিক করল দুরে কোথাও পালিয়ে যাওয়ার। নগরী ছেড়ে নির্জন কোন স্থানে ঘর বাঁধবে তারা। সেই রাতেই পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা হলো। ঠিক হলো “নিনাসের সমাধী নামের এক স্থানের এক বেরি গাছের নিচে মিলিত হবে তারা।

রাতের অন্ধকারে চুপিসারে থিসবি বেরিয়ে পড়ল। পুর্ব নির্ধারিত স্থানে পৌছানোর পর দেখলো যে পাইরামাস তখনো আসে নি। থিসবী তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। পূর্ণ চাঁদের আলোয় থিসবি দেখতে পেল এক সিংহী তেষ্টা নিবারনের জন্য ঝরনায় পানি খেতে এসেছে। সিংহীটি মাত্রই শিকার করে এসেছিল এবং সেটির মুখ ছিল রক্তাক্ত। যথেষ্ট দুরে হওয়ায় থিসবী সিংহীর অজ্ঞাতসারে পালিয়ে গেল আরো দুরে। কিন্ত ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! থিসবির ওড়না পথে পড়ে গেল। গুহায় ফেরার পথে সিংহী ওড়নাটি মুখে করে এনে ছিন্ন ভিন্ন করে রাস্তায় ফেলে চলে গেল। কয়েকমিনিট পর পাইরামাস সেখানে এসে থিসবির রক্ত মাখা ওড়নার ছিন্ন ভিন্ন অংশ আর ধুলোর মাঝে হিংস্র সিংহীর পদচিহ্ন দেখতে পেল। উপসংহার ছিল পরিষ্কার।

পাইরামাসের এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ ছিল না যে থিসবি আর বেঁচে নেই। প্রেমিকার এই করুণ পরিণতির জন্য সে নিজেকেই দায়ী করতে লাগল। তার জন্যই থিসবি এই বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে এলো তবুও সে থিসবিকে রক্ষা করতে পারে নি। কাতর কন্ঠে সে বার বার বলতে লাগল “আমিই তোমাকে হত্যা করেছি। মালবেরি গাছের কাছে যেয়ে পাইরামাস তরবারি বের করল। এখন তুমিও আমার রক্ত পান করবে এই বলে সে তরবারী চালাল নিজের শরীরেই। ফিনকি দিয়ে রক্ত উঠে সাদা শুভ্র বেরি ফল গুলোকে রাঙ্গিয়ে তুলল গাঢ় লাল রঙে।

সিংহীর ভয়ে ভীত হলেও অবশেষে সাহস জোগাড় করে থিসবি ফিরে গেল সেই স্থানে। কিন্ত একি! যেখানে শুভ্র বেরি ফলের ভারে নুয়ে যাওয়া মালবেরি গাছ থাকার কথা ছিল সেটিতে এখন সামান্য সাদা রঙের ছিটফোটাও নেই। চাঁদের আলোয় গছের কাছে কিছু একটা নড়ে উঠতে দেখলো থিসবি। এগিয়ে গেল সে। গাছের কাছে পড়ে ছিল তারই প্রেমিক পাইরামাস। থিসবি ছুটে গিয়ে দু হাতে জড়িয়ে ধরলো তাঁকে। “এই তো আমি তোমার থিসবি, তোমার প্রিয়তমা। পাইরামাস তার নামের উচ্চারণে চোখ খুলে তাকালো একবার। এরপর মৃত্যু এসে সে চোখ বন্ধ করে দিল চিরতরে।

থিসবি দেখতে পেল পাইরামাসের তরবারিটি তার হাত থেকে নিচে পড়ে আছে। ঠিক পাশেই রয়েছে থিসবির শতছিন্ন ওড়নাটি। “তুমি নিজ হাতে নিজকে এবং আমার জন্য তোমার ভালবাসাকেও হত্যা করলে। আমিও ভালোবাসতে পারি।কেবল মৃত্যুরই ক্ষমতা আছে আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করার। এটিরও এখন সেই ক্ষমতা থাকবে না। এই বলে সে তরবারি বসিয়ে দিল নিজের শরীরে ।

প্রেমিক যুগলের এরূপ পরিনতিতে দেবতারা সহানুভূতিশীল হলেন। সাদা রঙের মালবেরি ফল রূপান্তরিত হলো রক্ত লালে। আজো যা পাইরামাস আর থিসবির স্মৃতি বহন করে চলছে। পাইরামাস ও থিসবির এই প্রেম উপাখ্যান পাওয়া যায় শুধু মাত্র ওভিদের রচনাতেই (Ovid’s Metamorphoses)। মজার ব্যাপার হলো অনেক কালজয়ী সাহিত্য রচিত হয়েছে এই প্রেম কাহিনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। বিখ্যাত নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়রের  A Midsummer Night’s Dream  এর অন্তর্গত রোমিও এবং জুলিয়েট রচনা করেছেন পাইরামাস এবং থিসবির কাহিনী অবলম্বনে। যদিও অসংখ্য বিষয় তিনি পরিবর্তন করেছেন তবুও মূল কাহিনী ওভিদের রচনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ১৯৬৪ সালের এপ্রিলে ইংলিশ ব্যান্ড দা বিটলস (The Beatles) তাদের একক অনুষ্ঠান “ Around the Beatles” এ হাস্যরসাত্নক ভাবে পাইরামাস এবং থিসবির কাহিনী উপস্থাপন করেন। উক্ত অনুষ্ঠানে পল ম্যাককার্টনি পাইরামাস, জন লেনন থিসবি, রিংগো স্টার সিংহ চরিত্রে অভিনয় করেন।

The Beatles Bible

বিখ্যাত কার্টুন সিরিজ সিম্পসনেও ২০১২ সালে উঠে এসেছে পাইরামাস এবং থিসবির কথা। সেটি প্রচারিত হয় “Daughter who rises“ নামের এপিসোডে যা ছিল ২৩ তম সিজনের ১৩ তম এপিসোড। খ্রিষ্ট ধর্ম বিকাশের সাথে সাথে মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলে প্রাচীন দেব দেবীদের  উপর থেকে। তবুও প্রাচীন এসব কাহিনী, গল্প হারিয়ে যায়নি কিংবা একেবারে বিলুপ্তও হয়ে যায়নি। যার কারনে আজও আমরা হোমারের  ইলিয়াড ওডিসি পড়ি। সিনেমা ,গল্প, কবিতা এমনকি হাজারো ইংরেজী এবং রোমান শব্দের উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক মিথলজী থেকে। হয়তো আজ হতে হাজার বছর পরেও মানুষ একই ভাবে গ্রিক ট্রাজিডির মর্মস্পর্শী আখ্যান পড়ে ব্যাথিত হবে।

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত