মারাদোনা: বামধারার রাজনীতি সংগ্রাম আর ফুটবল

মারাদোনা: বামধারার রাজনীতি সংগ্রাম আর ফুটবল

আসুন এক ফুটবলারের কথা বলি, যিনি ফুটবলে খুঁজে পেয়েছিলেন রাজনৈতিক দর্শন। আসুন, আলোচনা করে দেখা যাক এক ফুটবলারের জীবন নিয়ে, যিনি একান্তভাবেই নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন তৃতীয় বিশ্বের অগণিত দরিদ্রের দরদী বন্ধু হিসেবে। ফুটবল ছিল যার ভাষায়, মানুষের জন্মগত অধিকার।’

ম্যারাডোনা

দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা, জন্ম আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসে। সেই বুয়েনোস আইরেস, যেখান থেকে স্প্যানিশ অভিযাত্রীরা খুঁজতে বেরিয়েছিলেন সিয়েরা লা প্লাতা (রুপোর পাহাড়)। তারা সাথে করে স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য এনেছিলেন মৃত্যু, দারিদ্র্য আর গঞ্জনার অনেকগুলি শতাব্দী। সেই বুয়েনোস আইরেস, যেখানকার কর্তাদের অঙ্গুলি হেলনে উড়োজাহাজ থেকে নদীতে ছুড়ে দেওয়া হত তরুণ যুবকদের জীবিত দেহ। গম, মাংস এবং খনিজ রপ্তানির মোটা টাকায় পকেট ভরে উঠতো লোভী শাসক ও দোসরদের।

মারাদোনার ফুটবলীয় কীর্তি নিয়ে পাঁচটা কথা বলতে পারবে না, এমন ফুটবল ভক্ত এই পৃথিবীতে নেই বললেই চলে। কে না জানে তার ঈশ্বরের হাত দিয়ে করা সেই গোল কিংবা ছয়জন ইংরেজকে কাটিয়ে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম জাদুগোলের কথা? ইতালীর অজশহর নেপলসকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে আসার কথাও তো অজানা নেই কারো। অজানা নেই তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের লম্বা ফিরিস্তি। কোকেন, এয়ার গান ছুড়ে সাংবাদিক জখম, উদ্দাম জীবন-যাপন, কর জমা দেওয়ার বিতর্ক কিংবা উৎকট পারিবারিক কলহ নিয়েও তো কম কাগজ খরচ করা হয়নি। ওসব পাশ কাটিয়ে দেখা যাক লোকটির রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে।

আর্জেন্টিনা: বৈষম্য আর বৈপরীত্য

ইন্টারনেটে বুয়েনোস আইরেসের ছবি খুঁজুন। সারবন্দী জাকারান্ডা ছাওয়া চমৎকার এক শহরের দেখা মিলবে। মস্ত অট্টালিকা, স্পেনীয় ধাচের বনেদী সব প্রাসাদ, অপূর্ব ভাস্কর্য আর অত্যাধুনিক বন্দরসমেত এক চমৎকার শহর। ভেতরটা অবশ্য অত ঝলমলে নয়। লাতিন আমেরিকা এক বিচিত্র অঞ্চল। বৈষম্য আর বৈভব এখানে হাত ধরাধরি করে চলে। এজন্য রিও এর বিরাট দালানসারির পাশেই মুখব্যাদান করে থাকে বিস্তৃত নগ্ন ইটের ফ্ল্যাভেলা। লিমার সুরম্য বিচের ধারেই রয়েছে দরিদ্র ইন্ডিয়ান হকারদের সারি। চিলি কিংবা কলম্বিয়া, ব্রাজিল কিংবা মেক্সিকো; লাতিন দেশগুলির ইতিহাস মূলত শত বছরের বঞ্চনা, বিশ্বাসঘাতকতা আর সংঘাতের ইতিহাস। অপহরণ, মাদক, রাজনৈতিক গুণ্ডামি, সামরিক অভ্যুত্থান, গৃহযুদ্ধ, তাবেঁদার সরকার, বিপ্লব আর দমন-পীড়নের ইতিহাস। আর্জেন্টিনাও এর ব্যাতিক্রম নয়।

বুয়েনোস আইরেসের একটি দরিদ্র মহল্লা

বিশ্বের সপ্তম ধনী দেশ ছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির বিচিত্র দুর্বিপাকে পড়ে ১৯২০ এর পর থেকে ম্লান হতে থাকে তার অর্থনীতি। মে এর বিপ্লবরূপী সূর্যটা পতাকার মাঝে জ্বলজ্বল করলেও লাখ লাখ আর্জেন্টাইনের ভাগ্যটা অত প্রসন্ন ছিল না। শহরগুলিতে দেখা দিতে থাকে ঘিঞ্জি মহল্লা আর বস্তি। মারাদোনার জন্ম এমনই এক স্থানে; রাজধানীর ভিয়া ফিওরিতোতে।

কাগজের বল দিয়ে যে ছেলেটা ফুটবল খেলতো, সে কী দেখেনি কিভাবে ধনী-দরিদ্রের আকাশপাতাল ব্যবধান রচিত হচ্ছে তার চারপাশে? ভারী মালপত্র টেনে ক্লান্ত বাবা যখন কাঁধে-পিঠে বরফ ঘষে একটু স্বস্তি পাচ্ছিলেন তখন পৃথিবীর অবিচার সম্বন্ধে ঝাপসা অথচ সত্য একটা জিজ্ঞাসা মনে আসাই স্বাভাবিক। মারাদোনার জীবনে অর্থকড়ি কম আসেনি, কিন্তু লাতিন আমেরিকার চিরাচরিত অসাম্যের ইতিহাস তার মনে দাগ একটা ফেলেছিল। পরবর্তী জীবনে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়। ওদেশে এই অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই এর একটাই বৈধ হাতিয়ার: ফুটবল।

কাবেচিতা নেগ্রা; অর্থ ‘কালোমাথা। আর্জেন্টাইন দরিদ্রদের রাণী ইভা পেরন এ নাম দিয়েছিলেন দেশের খেটে খাওয়াদের। মারাদোনা নিজেকে কাবেচিতা নেগ্রা হিসেবেই পরিচিত করতে ভালোবাসতেন। তার ফুটবলীয় জীবন শুরু হয়েছে নোংরা, ভাঙ্গাচোরা গলিতে। অন্ধকার দারিদ্র্যের মধ্যে। বস্তির কঠিন জীবন পার করে আসা একজন মানুষ, যে আরো অনেকের মত ভুলে যায়নি তার শ্রেণীর সংগ্রাম আর লড়াই এর ইতিহাসকে। আর্জেন্টিনায়, লাতিন আমেরিকার বাকি দেশগুলির মতোই, দরিদ্রদের শেষ ভরসা ফুটবল। শিক্ষা নেই, সুযোগ-সুবিধা নেই; ফুটবলে কিছু করে দেখাতে পারলে জীবনে মেলে কিছুটা স্বস্তি। ফুটবল সেখানে জীবন সুন্দরভাবে গড়ে নেওয়ার মই বিশেষ। কেও মই এর সর্বোচ্চ ধাপে উঠে ভুলে গিয়েছে অতীতকে, কেও মনে রেখেছে নিচের ভয়ংকর বাস্তবতা। মারাদোনা ছিলেন এমন একজন। ছোট্ট এল পিবে; রাস্তার টোকাই। বিত্তবৈভব এলেও সেই অতীত ভোলেননি। তাইতো আর্জেন্টাইনরা তাকে স্থান দিয়েছে হৃদয়ে। মারাদোনা সেদেশে ঈশ্বর।

জাতীয়তাবাদী সৈনিক: প্রতিশোধপরায়ন আর আবেগী

সত্তরের দশক। আর্জেন্টিনা পিষ্ট হচ্ছে সামরিক জান্তার বুটের নীচে। চলছে অপারেশন কন্ডোর। সিআইএ এর মদতে বামতন্ত্রীদের ওপর চলছে দমন-পীড়ন। ওদিকে বাড়ছে দারিদ্র্য আর ব্যবধান। জনগণ ক্ষুব্ধ। আসলো ১৯৮২। স্বৈরশাসক জেনারেল গালতিয়েরি তখত বাঁচাবার ছলে মস্ত এক চাল চাললেন। আক্রমণ করে বসলেন ফকল্যান্ড দ্বীপপূঞ্জ। ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলে উড়লো নীল-সাদা পতাকা। তীব্র জাতীয়তাবাদের আবেগে ভেসে গেল আর্জেন্টিনা। দেড়শো বছর পর তারা ফিরে পেয়েছে ফকল্যান্ড।

ফকল্যান্ড যুদ্ধক্ষেত্র

কিন্তু লৌহমানবী থ্যাচার তা মানবেন কেন? আটলান্টিকে দেখা দিল ব্রিটিশ রণতরী। আর্জেন্টাইনরা হেরে গেল। শত শত যুবা মারা পড়লো যুদ্ধে। গালতিয়েরি পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। যুদ্ধে পরাজয় মানে মারাত্মক অপমান। সামরিক বিচারে আর্জেন্টিনা না জিতলেও প্রতিশোধের সুযোগ এল চার বছর পর; মেক্সিকোয়। অ্যাজটেকায় মঞ্চস্থ হল বিখ্যাত সেই ঈশ্বরের গোল। ‘খেলার সাথে রাজনীতি না মেশানোর হাস্যকর যুক্তিকে তুড়ি মেরে মারাদোনা জানালেন, তিনি নিয়েছেন ফকল্যান্ডের প্রতিশোধ। জাতীয়তাবাদ? নিশ্চয়। তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র একটি দেশের একজন খেলোয়াড়ের পক্ষে পরাশক্তিকে একহাত দেখে নেওয়ার আর কোন সুযোগটাই বা ছিল?

নেপলস,চাভিসমো আর চুরুট

একবিংশ শতাব্দী শুরু হয়েছে। বামতন্ত্রের জোয়ারে ভাসছে ব্রাজিল, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা। ভেনেজুয়েলা চালাচ্ছেন হুগো শ্যাভেজ। লুলা ব্রাজিলে আর ইভো বলিভিয়ায়। বামধারার এই ‘গোলাপী বিপ্লব এর নেতাদের সাথে বিচিত্র সখ্য গড়ে ওঠে তার। সঙ্গে কিউবা তো আছেই। দাড়িওয়ালা, চুরুটখেকো ফিদেল যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় বসে সমাজতন্ত্র চালাচ্ছেন সেই ষাটের দশক থেকে। বারংবার এই বাম নেতাদের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন মারাদোনা, জানিয়েছেন আন্তরিক ভালোবাসা। টাকার লোভ নয়, রাজনৈতিক দর্শন থেকে এসেছে এই সখ্য। ‘ন্যায়পরায়ন মিডিয়া আর ‘আদর্শ গণতান্ত্রিক দেশ গুলি এসব ব্যক্তিকে সুনজরে না দেখলেও মারাদোনা থোড়াই কেয়ার করেছেন ওসব উঁচুতলার ছুৎমার্গকে। প্রয়াত শ্যাভেজ একনায়ক আখ্যা পেলেও মারাদোনা ছিলেন তার ভক্ত। কারণ শ্যাভেজ ব্যর্থ করেছেন মার্কিন সমর্থিত অভ্যুত্থান, ভেনেজুয়েলার দরিদ্রদের জন্য চালু করেছিলেন বিপুল সরকারি সেবা-সাহায্য। পরবর্তীতে শ্যাভেজের উত্তরসূরী নিকোলাস মাদুরোকেও দিয়েছেন সমর্থন।

ক্যাস্ট্রোর সাথে

কিউবার পাশাপাশি গোটা লাতিন আমেরিকা জুড়েই জনমনে একটা বিশিষ্ট আসন দখল করে আছেন এর্নেস্তো চে গুয়েভারা। অনেকেই তাকে সন্ত আখ্যা দিয়েছেন। চে স্বয়ং আর্জেন্টাইন। মারাদোনা দরিদ্র শ্রেণী থেকে উঠে এসে এই বাম বিপ্লবীকে স্মরণ করবেন না তা কী হয়! এজন্য তার ডান হাতে ছিল গুয়েভারার উল্কি। কোকেনের নেশা থেকে বাঁচতে গেলেন কিউবা। ঐতিহাসিক সেদেশের সংগ্রামের কাহিনী। ফিদেলের ভক্ত হলেন, ঈশ্বর আর ফিদেল তার কাছে এক হয়ে গেল। শরীরে আরেকটা উল্কি স্থান পেল, অবশ্যই ফিদেলের।

ম্যারাডোনা

প্রথাগত কোন বাম দর্শনের চর্চা মারাদোনার জীবনে ছিল না। তিনি আদ্যন্তই ছিলেন আবেগী আর উড়নচণ্ডী। শ্রমিক শ্রেণী থেকে উঠে আসার কারণেই তাদের প্রতি ছিল বুকভরা ভালোবাসা। ফুটবলীয় দক্ষতায় অর্জিত বিত্ত তাকে সেই কাতার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে; এই বোধটাও পীড়া দিত বোধহয়। এজন্যেই শ্যাভেজ, চে বা ফিদেলের প্রতি অমন ভক্তি। ভক্ত ছিলেন বামধারার আর্জেন্টাইন প্রেসিডেন্ট নেস্তর আর ক্রিস্টিনা কির্চনারের। আবার স্বদেশী ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রিকে দেখতেন বিষনজরে। জর্জ বুশ আর্জেন্টিনায় এলে তাকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘আবর্জনা হিসেবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা সবকিছুর প্রতিই পোষণ করতেন ঘৃণা। জনতুষ্টিবাদী আচরণ বটে, কিন্তু অরাজনৈতিক একজন চরিত্র আর কী-ই বা করতে পারে? ঠিক যেমন ইতালীর অজশহর নেপলসকে কুলীন ক্লাবের বিরুদ্ধে লড়াই এ জয়ী করেছেন বারবার। নামীদামী খেলোয়াড়েরা যে ক্লাবে খেলার কথা ভাবতেই পারতেন না সেই অপরাধপ্রবণ শহরের অখ্যাত ক্লাবকে সেরাদের কাতারে আনার পেছনে এই মনোভাব যে কাজ করেনি তা নিশ্চিত ভাবে বলা কঠিন। খেলতেন ফুটবল, তবে সাম্রাজ্যবাদ আর দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশে কার্পণ্য করেনি। ফিফার বাণিজ্য আর পোপতন্ত্রের অহেতুক আড়ম্বর নিয়ে বারবার সোচ্চার হতে দেখা গিয়েছে এই চরিত্রকে। বিকিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বড়োই আপত্তি ছিল বিতর্কিত মানুষটির।

অতঃপর?

বিশ্ব ক্রমেই বড় একঘেয়ে, বড় সরল হয়ে পড়েছে। আজকের ভদ্রপাড়ায় খেলার সাথে রাজনীতি মেশানো চলে না, কথা বলা হয় মেপে। তারকাদের জামা, প্রেমিকা, গাড়ি আর চুলের স্টাইল নিয়ে ভরপুর থাকে পত্রিকার পাতা। অথচ একটা সময় ছিল যখন খেলোয়াড়েরা শুধু খেলোয়াড় নন, ছিলেন বঞ্চিতদের মুখপাত্র। জনতুষ্টিবাদের জোয়ারে ভাসলেও তাতে ছিল মানবতা, অধিকার আর সমতার গন্ধ। আজ অবশ্য বিত্ত আর নিরাপত্তা সর্বস্ব আমাদের তারকা জগৎ। দুর্ধর্ষ ফুটবলার আরো বহু আসবে-যাবে। কিন্তু ফুটবলকে খেলার বাইরেও লড়াই এর হাতিয়ার করে তোলা, কর্পোরেট পুঁজি বা সাম্রাজ্যবাদের বাড়বাড়ন্তের বিরুদ্ধে চাছাছোলা কথা বলার মত কাওকে হয়তো আর পাওয়া যাবে না। খ্যাপাটে ঈশ্বর দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনার জমানা আজ অতীত।

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত