ইতিহাসের ভয়াবহ সাত সিরিয়াল কিলার

ইতিহাসের ভয়াবহ সাত সিরিয়াল কিলার

সিরিয়াল কিলার, খুনি, মার্ডারার, নাম যাই হোক সবার মধ্যে যে একটা জিনিস মিলে যায় তা হলো এরা সবাই ভিন্ন ভিন্ন সময় দুই বা তার বেশি মানুষকে খুন করেছে। কেউ যদি একজন মানুষেরও মৃত্যুর কারণ হয় তবুও এটি একটি দণ্ডনীয় অপরাধ, আর কিছু কিছু ব্যক্তি খুন করাকেই তাদের নেশা করে তোলে। এই ধরনের ঘটনাগুলো যতটা না প্রশাসনের টনক নাড়ায় তার চেয়ে বেশি এরা মিডিয়া আর আমজনতার মনোযোগ কাড়ে।

বিভিন্ন নিউজ, প্রিন্ট এবং অনলাইন মিডিয়া এই খুনগুলোর রহস্য আর কারণ উদঘাটনের চেষ্টা করে, আর সিরিয়াল কিলার, তাদের পরিবার, ব্যক্তি জীবন এবং তাদের মনমানসিকতা নিয়ে চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ। অনেক সময় এই মার্ডারারদের খুন করার প্রক্রিয়া আর লাশ লুকানোর বা এর থেকে রেহাই পাওয়ার ধরন থাকে অত্যন্ত ভয়ংকর। এদের এমন হত্যাকাণ্ডের পিছনের আসল কারণ জানলে আপনিও অবাক হবেন।

এমনই ইতিহাসের অন্যতম ভয়ানক সাত নরপিশাচ সিরিয়াল কিলার নিয়ে আমাদের আজকের আর্টিকেল। মানুষ এতটা নির্মম হত্যাকাণ্ড চালাতে পারে তা সত্যিই অকল্পনীয়!

  ৭.জ্যাক দি রাইপার

গা ছমছমে এই সিরিয়াল কিলার তার জীবনে পাঁচটি খুন করেছে। এই হত্যাকাণ্ডের শিকার প্রত্যেকেই ছিলেন নারী এবং এরা সবাই ছিলেন যৌন কর্মী। জ্যাক দি রাইপার- এই নাম এই সিরিয়াল কিলারের ছদ্মনাম আর অবিশ্বাস্য কথা এই যে এর আসল নাম এখনও পর্যন্ত কেউ জানে না এবং এটিও কারো জানা নেই এই নামের পিছনে মানুষটি আসলে কে।

এই মহিলা ছিলেন জ্যাক ডি রাইপারের একমাত্র শিকার যাকে তিনি অঙ্গচ্ছেদ করেননি, কেননা এই হত্যাকাণ্ডের পর তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলার জন্য লোকজন জড়ো হয়ে যায়।

কেননা এই খুনি এখনও পর্যন্ত পুলিশের ধরা ছোয়ার বাইরে। এই ব্যক্তি ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার। তিনি তার প্রত্যেকটা খুন লন্ডনের ওয়াইট চ্যাপল অঞ্চলে করে। ১৮৮৮ সালে এই সিরিয়াল কিলার তৎপর হয়ে উঠে এবং ধারণা করা হয় এই ব্যক্তি ছিলেন একজন সার্জন, কশাই বা এমন কেউ যে ছুরি বা এই ধরনের ধারালো অস্ত্রের সাথে সম্পর্ক রাখে। তিনি তার প্রত্যেকটা হত্যাকাণ্ডের পর সেই লাশগুলোর অঙ্গচ্ছেদ করে তাদের বিকৃত করে ফেলতেন শুধু তাই না এই খুনি পুলিশ এবং সেই অঞ্চলের বাসিন্দাদের ব্যাঙ্গ করে তাদের কাছে চিঠি পৌঁছাতেন যাতে তিনি তার খুন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিতেন সাথে এ-ও বলতেন কিভাবে সে খুন থেকে শুরু করে পুরো প্রক্রিয়াটি চালায়। তদন্ত চলাকালীন অনেক ব্যক্তির নাম এই সিরিয়াল কিলারের সাথে যুক্ত হলেও শেষ পর্যন্ত আসল ব্যক্তিকে পুলিশ খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়।

৬.জেফ্রি দাহমার

জেফ্রি দাহমার এই ব্যক্তির আসল নাম আর সৌভাগ্যক্রমে দেরিতে হলেও পুলিশ একে ধরতে সফল হয়। তবে চিত্রটি হয়তো এমন হতো না যদি না তার কব্জা থেকে তার এক শিকার পালাতে ব্যর্থ হতেন।

জেফ্রি তার প্রথম খুনটি করেন ১৯৭৮ সালে, তার বয়স তখন মাত্র আঠারো। তিনি তার ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অত্যন্ত চুপচাপ একজন সমকামী লোক যাকে দেখতে আর দশজন স্বাভাবিক ব্যক্তির মতই। তবে তার জীবন দশজন স্বাভাবিক কিশোররের মত কাটেনি, তিনি পুলিশের কাছে গ্রেফতার হওয়ার পর তার এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান সবসময়ই তিনি নিজেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করতেন, তার আচরণও অন্য দশজনের থেকে ছিল আলাদা এবং ছোট কালেই তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর থেকে তিনি তার দাদির কাছে বড় হোন আর সেই বাড়িতেই তিনি কয়েক বছর পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ড চালান এবং লাশ পচিয়ে তার অপরাধের প্রমাণ মেটান। ১৯৯১ সালে তার কব্জা থেকে তার একজন শিকার পালাতে সক্ষম হোন এবং তিনি’ই পুলিশ নিয়ে আসে জেফ্রির আপার্টমেন্টে।

পুলিশ এসে যা দেখে তার বর্ণনা পুরো ব্রিটেনকে স্তম্ভিত করে দেয়। তার সারা আপার্টমেন্ট জুড়ে ছিল মানুষের ক্ষতবিক্ষত লাশ, কাটা হাত, পা, গলা সহ দেহের বিভিন্ন অংশ। ড্রাম ভর্তি এসিডে ডুবন্ত মানুষের পচে যাওয়া দেহ। সব মিলিয়ে জেফ্রি মোট ১৭ টি খুন করে, আর তার বেশিরভাগ শিকার ছিল কৃষ্ণাঙ্গ সমকামী পুরুষ। জেফ্রি তার জীবনে দুইবার হাজতে গিয়েছিল, প্রথম বার যৌন হয়রানি, আর দ্বিতীয় বার খুনের অভিযোগে। ১৯৯৪ সালে তাকে জেলখানাতেই অন্য আরেক কারাবন্দী হত্যা করে।

৫.হ্যারোল্ড শিপম্যান

হ্যারোল্ড শিপম্যানের আরেক নাম ‘ডঃ দেথ। ধারণা করা হয় তিনি মোট ২১৮ টি খুন করেছেন যার আসল সংখ্যা ২৫০ বা তার বেশিও হতে পারে। এই নরপিশাচ ডাক্তার লন্ডনে ১৯৭২ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন হাস্পাতালে কর্মরত ছিলেন এবং এর সবগুলোতেই তিনি একই ভাবে তার হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।

তিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত ধরা না পরার কারণ বেশিরভাগ মানুষ ভাবতেন রোগীরা স্বাভাবিক কারনেই মৃত্যু বরণ করছিল। তিনি মানুষের সন্দেহের কাতারে তখন আসেন যখন হাস্পাতালের অন্যান্য ডাক্তারদের থেকে তার রোগীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু দিন দিন বারতেই থাকে। এমনকি যেই ব্যক্তি হাস্পাতালের মৃতদের সৎকারের কাজ করতেন তিনিও এই ডাক্তারের রোগীদের অস্বাভাবিক আর এতটা নিয়মিত মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তার শিকার বেশিরভাগই ছিলেন বয়স্ক মহিলা যারা সবাই দিনের বেলায় মারা গেছেন এবং একজনও রাতে মৃত্যু বরণ করেনি।

অনেকদিন পর্যন্ত হ্যারোল্ড তার হত্যাকাণ্ড চালিয়ে গেছে শুধু মাত্র পুলিশের হেলাফেলার কারনে। তবে শেষে হ্যারোল্ড মানুষের জান নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন না, তার আরও বেশি কিছুর প্রয়োজন ছিল এবং লোভে পরে তিনি এক বৃদ্ধার দলিল তার নিজের নামে করে নিতে চায়। এই ঘটনার পর সেই বৃদ্ধা মহিলার মেয়ের সন্দেহ হয় এবং তিনি হ্যারোল্ডের নামে মামলা করেন। তার পর পরই বের হয়ে আসতে থাকে হ্যারোল্ডের লোমহর্ষক সব হত্যার ঘটনা। ২০০০ সালে অবশেষে তার কারাদণ্ড হয় এবং ২০০৪ সালে তিনি জেলে অবস্থানরত আত্মহত্যা করে।

 

৪.জন ওয়েইন গেসি

একজন নির্মাণ শ্রমিক জন ওয়েইন গেসি তার প্রতিবেশী এবং বন্ধুমহলে পরিচিত ছিল তার সদা হাস্যজ্বল মানসিকতার জন্য। তিনি রাজনীতির সাথেও যুক্ত ছিলেন, শুধু তাই না তিনি এতটাই রসিক ছিলেন যে বাচ্চাদের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তাকে প্রায়শই ক্লাউনের সাজে দেখা যেত।

তবে তার আসল চরিত্র মটেও ক্লাউনের মত ছিল না। গেসিকে প্রথম সন্দেহ করা হয় ১৯৭৮ সালে যখন এক ১৫ বছর বয়সী কিশোরকে শেষ বারের মত তার সাথে দেখতে পাওয়া যায়। সেবারই গেসির উপর প্রথম আঙ্গুল উঠে তা না, এর আগেও অল্প বয়সী ছেলেদের বাবা মায়েরা গেসিকে দোষারোপ করেছিল। তবে ১৫ বছর বয়সী সেই কিশোরের নিখোঁজ হওয়ার পর পরই গেসির বাড়ি তল্লাশি করার জন্য সার্চ ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়। পুলিশ তার বাড়িতে যা পায় তা ছিল লোমহর্ষক, ভয়ানক আর অবিশ্বাস্য! তিরিশটিরও বেশি লাশের গন্ধে গেসির বাড়ির বাতাসও যেন ন্যায় বিচারের জন্য আকুতি করছিল। তার বাড়ির নিচে বেসমেন্টে চার ফুট গভীর একটি জায়গা সে করেছিল, যার পুরোটা ছিল বিভিন্ন বয়সী কিশোরদের লাশে ভরা। হত্যার আগে তিনি ছেলেগুলোর উপর অমানুষিক নির্যাতন এবং ধর্ষণ করে। তার উপর ৩৩ টি খুনের অভিযোগ দায়ের করা হয়, তার সাথে নির্যাতন আর ধর্ষণেরও মামলা করা হয়। আদালতের আদেশ অনুযায়ী ১৯৯৪ সালে তাকে বিষাক্ত ইঞ্জেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে মেরে ফেলা হয়।

৩.এইচ এইচ হোমেস

আমেরিকার মাটিতে অনেকগুলো সিরিয়াল কিলারের জন্ম, তবে হোমেসের মত মারাত্মক হয়তো একটিও নেই। তিনি ছিলেন একজন ফার্মাসিস্ট যিনি একটি তিন তালা হোটেলকে গোড়ে তুলেছিলেন এক জীবন্ত টর্চার সেলে। ১৮৯৩ সালে হোমেস শিকাগোতে এসে নিজের তিন তালা এক হোটেলের কাজ শুরু করেন। তিনি এটিতে সব ধরনের নির্যাতনের জিনিসপত্র রেখেছিলেন, কি নেই এখানে!  গ্যাস লাইন, গোপন প্যাসেজ,ট্র‍্যাপডোর, একটি হলওয়ে যাতে তিনি সারিবদ্ধ ভাবে লাশের মিছিল তৈরী করতেন, বেসমেন্টে ছিল টর্চার সেল এবং এই পুরো জায়গাটি ছিল সাউন্ড প্রুফ প্যাডিং করা।

গোপন গ্যাস লাইনের মাধ্যমে তিনি তার হোটেলে আসা মেহমানদের উপর ক্ষতিকারক গ্যাস প্রয়োগ করে তাদের অজ্ঞান করতেন, তারপর তাদের সাথে যা হতো তা কোন হলিউড হরোর সিনেমা কেও হার মানায়। তিনি তার শিকারদের সার্জিকাল টেবিলের উপর রেখে অমানবিক নির্যাতন করতেন, তারপর তাদের মেরে ফেলে সেই কংকাল বিক্রি করতেন মেডিকেলে পড়া ছাত্র ছাত্রীদের কাছে। এর পাশাপাশি তিনি একটি ভুয়া ইন্সুইরেন্স কোম্পানীও চালাতেন, তিনি ধরা পরেন যখন তারই আরেক ইন্সুইরেন্স কোম্পানীর সহযোগী তার উপর অর্থ আত্মসাৎ এর অভিযোগ আনেন। ১৮৯৬ সালে তার ফাঁসি হয়।

২.পেড্র লোপেজ

বিশ্বের অন্যতম ভয়ানক সিরিয়াল কিলার পেড্র লোপেজ হয়তো এখনও বাহিরে কোথাও ঘুরে বেরাচ্ছে নির্বিঘ্নে। এই ব্যক্তি ৩০০ টিরও বেশি খুনের জন্য অভিযুক্ত। পেড্র মূলত তার এলাকা কলম্বিয়া, ইকুয়েডর আর পেরুর উপজাতি মহিলাদের টার্গেট করতেন। অবশেষে তাকে ১১০ টি মহিলার খুনের দায়ে গ্রেফতার করা হয়, ১৯৮০ সালে তার গ্রেফতারের পর পুলিশ ৫০ টির বেশি কবরের সন্ধান পায়। গ্রেফতারের পর আরও ২৪০ টি মার্ডারের কথা পেড্র নিজেই স্বীকার করে। তবে এই পাষণ্ড ২০ বছরেরও কম সময় কারাগারে কাটায়, ১৯৯৮ সালে তার ভালো আচরণের জন্য তাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর পর এতগুলো বছর অতিক্রম হলেও পেড্রর আর কোন খবর পাওয়া যায়নি।

১.টেড বান্ডি

টেড বান্ডিকে বলা হয় আমেরিকার অন্যতম জনপ্রিয় সিরিয়াল কিলার। তিনি তার অর্জিত এই জনপ্রিয়তা অনেক বেশি উপভোগ করতেন বলে শোনা গেছে। পশ্চিম আমেরিকা ছিল টেড বান্ডির শিকারের মূল কেন্দ্রস্থল। তিনি নিজ হাতে ঠিক কতগুলো মার্ডার করেছেন তার সঠিক হিসাব নেই, মূলত কিশোরী কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা ছিল তার প্রথম নিশানা। ওয়াশিংটন, অরিগন থেকে ইউটা আর কলরাডো ছিল খুন করার জন্য তার পছন্দের এলাকা। বান্ডিকে একবার কলরাডো থেকে গ্রেফতার করা হয় কিডন্যাপিংয়ের অভিযোগে, পরে তিনি সেইখান থেকে পালাতে সক্ষম হোন এবং চলে যান ফ্লোরিডাতে, সেখানে তিনি আরও কয়েকজনকে খুন করেন। বান্ডির শেষ বারের গ্রেফতার সকলের মনোযোগ আকৃষ্ট করে, বিশেষ করে যখন তিনি  আদালতে লড়াই করেন নিজের উকিল হয়ে৷ তার এই মার্ডার ট্রায়েল ইতিহাসের প্রথম ট্রায়েল ছিল যা টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। ১৯৮৯ সালে তাকে ইলেকট্রনিক চেয়ারে বসিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়৷

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত