বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত প্রহরের দুই দিন পর ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তৈরি করেন প্রথম শহীদ মিনার। সাঈদ হায়দার ছিলেন ওই শহীদ মিনারের নকশাকার। তিনি জানাচ্ছেন প্রথম শহীদ মিনার গড়ে ওঠার কাহিনি
প্রথম শহীদ মিনার, ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২।
প্রথম ‘শহীদ মিনার- এর গায়ে সাঁটা কাগজের ফলকে এর পরিচয় লেখা ছিল শহীদ ‘স্মৃতিস্তম্ভ’। মিনার বলি আর স্তম্ভই বলি, এ ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ক্রান্তিলগ্নে নির্মিত এক ঐতিহাসিক স্থাপনা যে পাষাণের অন্তর্নিহিত অমিতশক্তিতে ভীত হয়ে মুসলিম লীগ সরকার অচিরেই একে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে শেষ প্রস্তরখণ্ডটিও অপসারণ করে। মাত্র তিন দিনের কম আয়ু নিয়ে এসেছিল প্রথম শহীদ মিনার। কিন্তু ৬৫ বছর আগের সেই স্থাপনাটির উত্তরসূরি আজকের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বছরের পর বছর স্মরণ করিয়ে দেয় বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিকে। স্মৃতির পটে ভেসে ওঠে শান্তিপ্রিয় নিরস্ত্র সেই কয়েকজন তরুণের মুখচ্ছবি, যাঁরা সেদিন নিজেদের মাতৃভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় ব্রতী ছিলেন বলে বৈরী সরকারের পেটুয়া বাহিনীর বুলেটের আঘাতে প্রাণ বিসর্জন দিতেও পরোয়া করেননি। আজও মানুষ জাতীয় জীবনের সমস্যা ও সংকটে, উৎসবে, আনন্দে, প্রিয়জনের চিরবিদায়ের বেদনায় শহীদ মিনারের পাদদেশেই ছুটে যায় সমাধানের প্রত্যাশায়, শান্তির অন্বেষায়।
প্রথম শহীদ মিনারের পূর্বাপর কাহিনি একাধারে বিস্ময়কর ও হৃদয়গ্রাহী। নির্দেশ দেওয়া অবয়বের মধ্যে নিবন্ধকে সীমিত রাখার তাগিদে আন্দোলনের যে প্রেক্ষাপটে শহীদ মিনারের সৃষ্টি, তার ইতিহাসকে বর্ণনা করছি অতি সংক্ষিপ্তাকারে।
ভাষা আন্দোলনে আরও স্পষ্ট করে লিখলে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এই দিনটির সক্রিয়তা আন্দোলনে শুধু এক নতুন মাত্রাই যোগ করেনি, একে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই দিনের কর্মসূচি ছিল পূর্ণ হরতাল, কলাভবন চত্বরে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের সমাবেশ এবং সভা শেষে মিছিল করে অধিবেশনরত প্রাদেশিক আইন পরিষদে গিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিপত্র পেশ।
২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের কর্মসূচি বানচাল করার উদ্দেশ্যে সরকার ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। এই নতুন পরিস্থিতিতে ২০ তারিখ রাতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটির একটি সভা আহ্বান করে। এই সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙা নয়, মেনে চলা এবং আন্দোলনের কর্মসূচি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত হয় ১১-৩ ভোটে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে যে তিনটি ভোট পড়ে, তা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিন, যুবলীগের অলি আহাদ ও মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের ভিপি গোলাম মওলার। ভোটাভুটির পরেও উত্তপ্ত বাগ্বিতণ্ডা ও তর্কবিতর্ক চলে। অবশেষে ঠিক হয় পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কলা ভবনের সামনের আমতলায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের সভা হবে এবং এই সভায় নেওয়া হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
একুশে ফেব্রুয়ারির সভায় সভাপতিত্ব করে সুঠামদেহী ছাত্র গাজীউল হক। আওয়ামী মুসলিম লীগের সেক্রেটারি শামসুল হকের যুক্তি ছিল যে ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করলে এর সুযোগ নিয়ে সরকার দেশব্যাপী আসন্ন সাধারণ নির্বাচন স্থগিত করে দেবে। তবে তার যুক্তি হালে পানি পেল না। এর বিপরীতে আবদুল মতিন সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়ে সভায় উপস্থিত ছাত্র-জনতাকে জিজ্ঞেস করে, তারা কী চায়। উপস্থিত চার-পাঁচ হাজার তরুণকণ্ঠের প্রত্যয়ী প্রত্যুত্তর, ‘১৪৪ ধারা মানি না, মানব না রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই চলো চলো অ্যাসেম্বলিতে চলো।
বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজ-স্কুলের ছেলেরা বেরিয়ে আসে ছোট্ট দলে, বাইরে দাঁড়ানো হাফপ্যান্ট পরা পুলিশ তাদের কয়েকজনকে ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যায় তাদের কণ্ঠে তখনো সেই স্লোগান, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। প্রথমে দুটি দল বেরিয়েছিল গৌরবর্ণ দীঘলদেহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাবিবুর রহমান শেলী ও মেডিকেলের ছাত্র আলী আজমলের নেতৃত্বে। পুলিশের বাধা এড়িয়ে অন্য সবারও চলে একই গন্তব্যে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা; শুরু হয় হাতাহাতি, ধস্তাধস্তি।
মিছিল থেকে উপচে পড়া ছাত্র-জনতার একাংশ যখন ব্যারাক হোস্টেলের প্রান্তরে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, এমন এক উত্তেজক পরিস্থিতিতে অনুমানিক পৌনে তিনটায় শালবল্লা আর কাঁটাতারে ঘেরা বিস্তৃত হোস্টেল এলাকায় ফুলার রোডের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করে পুলিশ। বিনা প্ররোচনায় হঠাৎ করে গুলি ছুড়তে থাকে। প্রথমে ভেবেছিলাম জনগণকে সরিয়ে দিতে ফাঁকা গুলি, কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারি এক পূর্বপরিকল্পিত ইচ্ছাকৃত মানুষ খুনের ঘটনা— আন্দোলনকে নস্যাৎ করার এ এক কূট কারসাজি। রাইফেলের গুলিতে একুশের প্রথম শহীদ রফিকের (২০) মাথার খুলি উড়ে গিয়ে মস্তিষ্ক ছিটকে পড়ে। বরকতের (২৪) ঊরু বুলেটবিদ্ধ হওয়ায় প্রধান ধমনিটাই ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, আবদুল জব্বারের (২৮) তলপেট বুলেটবিদ্ধ হওয়ায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে মৃত্যু হয়। গুরুতর আহত আবদুস সালাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেড় মাস চিকিৎসার পর মারা যায়।
শহীদদের মৃত দেহগুলো অন্যদের চোখের আড়ালে হাসপাতালের একাধিক ওয়ার্ডে রাখা হয়েছিল। আলমগীরসহ মেডিকেল কলেজের কতিপয় ছাত্রের ওপর এদের পাহারা দেওয়ার ভার ছিল। ইচ্ছা ছিল আমরাই মৃতদেহগুলোর শেষকৃত্য সমাপণ করব। কিন্তু মধ্যরাতের পরে কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে একুশের শহীদদের লাশ পুলিশ গোপনে নিয়ে যায় এবং আজিমপুর কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন করে।
২২ ফেব্রুয়ারিও ১৪৪ ধারা ভেঙে বিক্ষিপ্তভাবে শহরের নানা স্থানে ছোট ছোট মিছিল হয়েছে। টহল দেওয়া পুলিশ ও ইপিআর সদস্যদের গুলিতে আহত-নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এদিন হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান রমনা থেকে সদরঘাট অভিমুখে সাইকেলে আসার পথে, নয় বছর বয়সী বালক
ওহিউল্লাহ নবাবপুর রোডে খোশমহল রেস্তোরাঁর সামনে এবং রিকশাচালক আবদুল আওয়াল পুলিশের বুলেটের আঘাতে মৃত্যুবরণ করে।
এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা উল্লেখ করি। মেডিকেল কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি ঢাকার ছেলে শরফুদ্দিন একুশে ফেব্রুয়ারির আগে একদিন সন্ধ্যায় আলিম চৌধুরীসহ আরও কতিপয় সতীর্থ ছাত্রকে নিয়ে পুরান ঢাকার সরদারদের নেতা কাদের সরদারের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর ফলে ঢাকাইয়ারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে সমর্থন দিতে রাজি হয়নি বটে, কিন্তু আমাদের আন্দোলনের বিরোধিতা করবে না এবং একুশের মিছিলে বাধা দেবে না—এ বিষয়ে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন কাদের সরদার। তাই আমরা দেখি, একুশে ফেব্রুয়ারিতে গুলি চলার পরে পুরান ঢাকার অধিবাসীরা ভাষা আন্দোলনের শুধু সমর্থকই ছিল না, তারা এই আন্দোলনকে সফল করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। মনে রাখতে হবে, প্রথম শহীদ মিনারের নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ করেছিল যে প্রিয় মানুষটি এবং যে ওস্তাগার গড়েছিল এই স্থাপনা, তারা উভয়েই ছিল ঢাকাইয়া।
২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ ইউনিয়নের তত্ত্বাবধানেই হোস্টেল প্রাঙ্গণে ভাষাশহীদদের গায়েবানা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন কাগজে লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করা হলেও আমার মনে হয় জানাজায় উপস্থিত জনগণের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি হবে না। জানাজা শেষে এক দীর্ঘ মিছিল আমাদের হোস্টেল থেকে বেরিয়ে পুরান ঢাকা হয়ে সদরঘাটে পৌঁছে শেষ হয়।
আমাদের চোখের সামনে হোস্টেল প্রাঙ্গণে নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর নুরুল আমিন সরকারের সশস্ত্র বাহিনীর গুলিবর্ষণের পর আন্দোলনের পুরো আবহটাই পাল্টে যায় এবং কেমন করে জানি আমাদের হোস্টেলই হয়ে ওঠে আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। এ সময় আমাদের কলেজ ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছাত্রকর্মীরা যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিল, তার ভেতর প্রাধান্য পায়: ১. পুলিশের গুলিতে আহত-নিহত ব্যক্তিদের হোস্টেল ও হাসপাতালের মাঝের গলিপথ দিয়ে হাসপাতালে স্থানান্তর ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। ২. আন্দোলনে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মূল নেতাদের পুনরায় একত্রকরণ।
২০ ফেব্রুয়ারি রাতে নিজেদের সিদ্ধান্তেই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অলি আহাদ ও আবদুল মতিনের প্রস্তাবনায় গোলাম মওলাকে আহ্বায়ক করে নতুন কমিটি গঠন করে আন্দোলনকে জিইয়ে রাখা এবং আরও বেগবান করা। ৩. ২০ নম্বর ব্যারাকের ১ নম্বর কক্ষে পূর্বাহ্নে স্থাপিত কন্ট্রোলরুম থেকে প্রচার-প্রচারণার কর্মকাণ্ড এবং বর্তমান সময়ের কর্মসূচিকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজকে আরও শক্তিশালী করা। আন্দোলনের বক্তব্য যাতে অ্যাসেম্বলির সদস্যদের কানে সরাসরি পৌঁছায়, তার ব্যবস্থা নেওয়া। পরিতাপের বিষয়, ২২ তারিখ সন্ধ্যার পূর্বমুহূর্তে পুলিশ ও সামরিক বাহিনী কন্ট্রোল রুমে প্রবেশ করে; তারা এর কাজ বন্ধ করে এবং মাইক্রোফোনসহ সব যন্ত্রপাতি ও নথিপত্র নিয়ে যায়। ৪. প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ।
যেভাবে গড়ে উঠল শহীদ মিনার
২৩ ফেব্রুয়ারি দিনটি ছিল অপেক্ষাকৃত শান্ত; শ্রান্তি নিরসনের। তবে এখানে-ওখানে ছোটখাটো জটলা-আন্দোলন এগিয়ে নিতে আর কী করা যায়, তারই আলোচনা। ‘শহীদস্মৃতি অমর হোক— এই নতুন স্লোগানের কথা আগেই বলেছি। আমি ৫ নম্বর ব্যারাকের বোর্ডার, ওই ব্যারাকের বারান্দায় মওলা ও শরফউদ্দীনকে ঘিরে বেশ একটা ছোটখাটো জটলা। উল্লিখিত স্লোগানের প্রভাবেই হোক বা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হোক, সামনে এল একটা প্রস্তাব, শহীদদের শেষকৃত্য যখন আমাদের করতে দিল না, তাহলে তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের হোস্টেল অঙ্গনেই একটা স্মৃতিস্তম্ভ বানাই না কেন? ভিপি, সেক্রেটারিসহ উপস্থিত সবাই প্রস্তাবটি সমর্থন করল— একে স্বাগত জানাল। ঠিক হলো যে শোরগোল করে নয়, যথাসম্ভব নীরবে-নিভৃতে ২৩ ফেব্রুয়ারির এক রাতেই নির্মাণকাজটি সমাধা করতে হবে।
অনানুষ্ঠানিক এই সিদ্ধান্তের কথা ব্যাপ্ত হয়ে যায় সব ব্যারাকের প্রতিটি ঘরে রাজনীতিসচেতন বিদ্যার্থীর মধ্যে। আর এরই প্রতিধ্বনি জাগে মেডিকেল ছাত্রাবাসের প্রতিটি ছাত্রকর্মীর হৃদয়ে। ওই রাতেই নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা তো এক অসম্ভব কাজ। নকশা নেই, মজুর নেই, ইট, সিমেন্ট, নির্মাণসামগ্রী নেই; কিন্তু যা আছে, সেই মুহূর্তে তারই তো প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি— মানসিক প্রস্তুতি আর দৃঢ় সংকল্প।
নকশা আঁকার ভার দেওয়া হয়েছিল বদরুল আলমের ওপর। এ কাজে তার দক্ষতা ও সক্ষমতা দুই-ই ছিল। সে যে নকশা নিয়ে আসে, শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় তা অতীব সুন্দর; কিন্তু দুটি বাঁক থাকায় ঢালাইয়ের প্রয়োজন হবে বলে এক রাতে শেষ করা যাবে না। এই পরিস্থিতিতেই আমি জড়িয়ে পড়ি কাজটার সঙ্গে। আমি একটা মোটামুটি নকশা দেখালাম বরুকে (বদরুল আলমের ডাকনাম)। খুব সাদামাটা একটা স্থাপত্য পরিকল্পনা একটা বড়সড় ছয়তলাবিশিষ্ট কিউব বা ঘনক্ষেত্র (৬ র্ × ৬ র্ × ৬ র্) ; এর বারোটা কিনারা একেকটা ৬ ফুট পরিমাপের এবং ছয়টা তল বা সারফেসের মাপ ৬ র্ × ৬ র্। এই কিউবটার নিম্নতল বসানো থাকবে আরেকটা স্থাপনার ওপরে, যা মূল স্তম্ভের বেদি হিসেবে কাজ করবে এবং সব পাশে প্রধান কিউবটাকে ছাড়িয়ে যাবে।
বেদি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য এটা মাটির ওপরে থাকবে এক ফুট এবং মাটিতে প্রোথিত থাকবে পাঁচ ফুট। প্রধান কিউবটার উপরিতলকে ইটের মাপের ওপর নির্ভর করে দুটি ছোট ভাঁজ দিয়ে নিয়ে এসে স্তম্ভের সর্বনিম্ন অংশ তৈরি করবে। এখন এই ছোট করে আনা উপরিতলের ওপরে একটা প্রলম্বিত পিরামিড থাকবে, যা ক্রমেই শীর্ণ হয়ে এগারো ফুটে গিয়ে শেষ হবে। এই সহজ-সরল প্ল্যানটা শুধু ইট-সিমেন্টেই শেষ হবে বলে সহজসাধ্য। বদরুল আলম বরুরও পছন্দ হলো। আমরা উভয় চূড়ান্ত ড্রয়িংটা শেষ করে নিয়ে এলে ছাত্র ইউনিয়নের নেতারাসহ ছাত্রকর্মী সবারই পছন্দ হয়।
প্রথম শহীদ মিনারের স্থাপত্য ছিল সহজ-সরল, কিন্তু স্থাপনাটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বা বক্তব্যটিও ছিল হৃদয়গ্রাহী। নিম্নাংশের বৃহদায়তন গুরুভার কিউবটা অবশ্যই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বলিষ্ঠ চরিত্রটাকেই প্রকাশ করে—প্রকাশ করে বিপদের সম্মুখীন থেকে ভাষাশহীদদের নির্ভীক সাহসিকতা। ঊর্ধ্বাংশে মিনারে উঁচু চূড়া সবাইকে এই বার্তা দেয় যে শত বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও অন্যায়-অবিচারের সামনে মাথা নোয়ানো যাবে না কর্তৃপক্ষের নিষ্ঠুর-নৃশংস অত্যাচারের মুখেও অন্যায়-অসংগত আদেশ মেনে নেওয়া যাবে না শির থাকবে উঁচু-অবিচল। সেই মাসের মেস ম্যানেজার আহমেদ ফজলুল মতিন সন্ধ্যার পরপরই টেবিলে রাতের খাবার পরিবেশনের কাজটি করেছিল ১৪৪ ধারার বাধার মুখেও, যাতে ছাত্রকর্মীরা যথাসময়ে শহীদ মিনারের কাজ শুরু করতে পারে। ছাত্র ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারির ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা ছিল, তার সার্বিক তত্ত্বাবধানেই নির্মাণকাজ আরম্ভ হয়। দিনেই নির্মাণ স্থানটা নির্বাচিত হয়েছিল ১২ নম্বর ব্যারাকের পাশে ছাত্রাবাসের নিজস্ব রাস্তার পাশে, যেখানে গুলিতে নিহত হয় প্রথম ভাষাশহীদ।
মাত্র একজন পারদর্শী রাজমিস্ত্রির কুশলী হাতে নকশা মোতাবেক কাজ শুরু হলো, মিস্ত্রির একজন হেলপার ছিল বটে। কিন্তু আমাদের ছাত্রকর্মীরাই তো সেদিন সবচেয়ে সক্রিয় জোগালে। মাত্র কয়েক মিনিটেই আল হাসিম ও মনজুরের সবল হাতে কোদালের কোপে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পাঁচ ফুট গভীর মাটি কাটা শেষ হলো। কলেজ ভবন সম্প্রসারণের জন্য সেখানে স্তূপাকারে রক্ষিত ইট ছাত্ররাই লাইনে দাঁড়িয়ে হাতে হাতে নিয়ে এল, বালু আর বস্তাভরা সিমেন্ট এল ছাত্রকর্মী আসগরের তৎপরতায় কন্ট্রাক্টর পিয়ারু সরদারের স্বতঃস্ফূর্ত বদান্যতায়।
হোস্টেল প্রাঙ্গণে নানা স্থানে অবস্থিত ট্যাপ থেকে বালতিতে করে পানি বয়ে এনেছে ছাত্ররাই। তারাই ইট ভিজিয়েছে, বালু-সিমেন্টের মর্টার বানিয়েছে, নির্মাণসামগ্রী মিস্ত্রির হাতের নাগালে পৌঁছে দিয়েছে। ব্যারাকবাসী সব বিদ্যার্থীই নির্মাণকাজে হাত লাগিয়েছে। প্রথম শহীদ মিনার মেডিকেল কলেজ ছাত্রদের একান্ত নিজস্ব চিন্তা-চেতনার প্রকাশ, তাদের যৌথ শ্রমের ফসল। কোনো রাজনৈতিক দল অথবা বিশ্ববিদ্যালয় বা বিদ্যালয়ের ছাত্র বা কর্মী এই মিনার নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। সেই রাতে নির্মাণস্থানের প্রায় পাশেই রাস্তায় আর্মি টহল দিচ্ছিল। তাদের কুপ্রভাব ও হস্তক্ষেপ এড়িয়ে নির্মাণকাজ সমাপ্ত করার কাজটি যাতে নির্বিঘ্নে করা যায়, সে জন্য আহমদ রফিক সতত ক্রিয়াশীল ছিল।
সেদিনের সেই রাতভর কর্মরত ছাত্রকর্মীদের অনেকেই আজ প্রয়াত অথবা বার্ধক্যপীড়িত। এই নিবন্ধের অন্যত্র যাদের কথার উল্লেখ করেছি, তাদের ছাড়া এই মুহূর্তে আর যেসব ছাত্রকর্মীর নাম এক্ষনে মনে আসছে, তাদের মধ্যে রয়েছে আসাদুজ্জামান, জাহেদ, মামুনুর রশীদ, আবদুর রশীদ, সিরাজ জিন্নাত, কবির, রাব্বি, প্রধান, বরকত, হাই, রাকিব, জোরো প্রমুখ প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক মেডিকেল শিক্ষার্থী। চব্বিশের ভোরে প্রথম শহীদ মিনার, যখন মাথা উঁচু করে মানুষের দৃষ্টিগোচরে এল, ত্বরিত গতিতে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ল শহরময়। সেদিনের ছোট্ট ঢাকার সব পথ এসে মিলল ফুলার রোডে। দলে দলে ছুটে এল মানুষ—বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া, ছোট্ট শিশুর দল— সবাই এল শহীদ মিনারের পাদদেশে শহীদদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা জানাতে। আমাদের হোস্টেল প্রাঙ্গণ লোকে লোকারণ্য, যেন এক পবিত্র তীর্থক্ষেত্র ফুলে ফুলে ঢেকে গেল প্রতিবাদের প্রতীক সেই প্রথম শহীদ মিনার। এই প্রথম শহীদ মিনার এক অসাধ্য সাধন করল—যে আন্দোলন মূলত শুধু ছাত্রদের আন্দোলন, তাকে উৎসারিত করে দিল এক গণ-আন্দোলনে—এখানেই এর তাৎপর্য।
নিবেদন ইতি
নিবন্ধের শেষ প্রান্তে ৯১ বছর বয়স পেরোনো এক প্রবীণ নাগরিকের ছোট্ট নিবেদন, কয়েক সপ্তাহ আগে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ২০তম জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করতে শহীদ মিনারে গিয়েছিলাম। শহীদ মিনারের আবিল পরিপার্শ্ব, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আমাকে দুঃখ দিয়েছে, বেদনাক্লিষ্ট হয়েছি, লজ্জা পেয়েছি। শহীদ মিনার এক বিশিষ্ট ঐতিহাসিক স্থাপনা, যা দেখতে দেশি-বিদেশি পর্যটক আর দেশের শিক্ষার্থীরা নিয়ত আসে এখানে। আদি নকশামাফিক এর পরিমার্জন, পরিবর্ধন না-ও করতে পারি— আমরা একে ছায়ানিবিড়
সবুজের উদ্যানঘেরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিনন্দন নিরাপদ স্থাপনায় রূপ দিতে কি পারি না? এ প্রশ্ন সরকার, গণমাধ্যম ও চিন্তাশীল সবার কাছে।