নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি এখন এখন বেশ বৃহৎ আকৃতির হলেও এর পেছনে রয়েছে অনেক ইতিহাস। খুব সহজেই হয়নি শহীদ মিনারের পূর্ণাঙ্গ রূপ। অনেক আন্দোলন সংগ্রামের পর ১৯৮৫ সালে শহীদ মিনারটি স্থাপন করা হয়।
নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বি নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নিয়ে লিখেছেন তথ্যনির্ভর একটি ইতিহাস। সেটা হুবহু তুলে ধরা হলো – বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবী ও অকুতোভয় ভাষাসৈনিক ছিলেন বরিশালের মোশারফ হোসেন নান্নু। ‘ধ্রুবতারা নামে এক ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রে ১৯৯৯ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সংখ্যায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে যেটা বলা হয়ে থাকে যে, ১৯৪৮ সালে তমুদ্দিন মজলিসে প্রফেসর আবুল কাশেমই প্রথম ভাষা আন্দোলনের প্রবক্তা, কিন্তু এটার মধ্যে একটু ভুল আছে, সে প্রবক্তা ঠিকই, সে অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে এটাকে সামনে নিয়ে এসেছেন; কিন্তু এর আগে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার ওপারে একটি প্রেস ছিল। বিজলী প্রেস। সে সময়ে বিজলী প্রেস থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় প্রবন্ধ বেরোয় ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা কেন?’ প্রবন্ধটি অসমাপ্ত ছিল এবং পরবর্তী দুই সংখ্যায় এটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মুসলিম লীগ সরকার প্রেসটি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেয়। নারায়ণগঞ্জের এই ছোট্ট প্রেসের ছোট্ট কাগজই যে ভাষা আন্দোলন বিষয়ে প্রথম পুস্তিকা এতে সন্দেহ নেই। যে পত্রিকাটির কথা মোশারফ হোসেন নান্নু উলেখ করেছেন তার নাম ছিল ‘স্ফূলিঙ্গ।
সাতচল্লিশের সে পত্রিকা থেকে শুরু করে বায়ান্নের ফেব্রুয়ারি-পরবর্তী সময় পর্যন্ত ভাষার দাবীতে আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা সর্বজন বিদিত। অথচ পরিতাপের বিষয় যে, বায়ান্নের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদ মিনার গড়ে উঠতে থাকলেও নারায়ণগঞ্জে এর ৩৩ বছর পর পর্যন্ত কোন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে উঠেছে। এমনকি কিছু কিছু পাড়া মহল্লায়ও গড়ে উঠেছে এবং ভেঙ্গেছে। শহীদ মিনার গড়ে ওঠা ও ভাঙ্গার প্রক্রিয়াটি হতে পারে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি গবেষণার বিষয়। কোনও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার না থাকাতে তখন তোলারাম কলেজের শহীদ মিনারেই শহীদ দিবস ও বিভিন্ন দিবসে নারায়ণগঞ্জবাসীকে শহীদদের উদ্দেশ্যে পুষ্পস্তবক অর্পণের জন্য সমবেত হতে হতো।
১৯৮১ খৃষ্টাব্দের পহেলা বৈশাখ নারায়ণগঞ্জের কয়েকটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের জন্ম। এর এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ১৯৮২ এর ২৪ মার্চ হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন এবং দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। ১৯৮৩ এর ফেব্রুয়ারির শুরুতে এরশাদের কিছু সাম্প্রদায়িক বক্তব্য ছাত্র-জনতা ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের উত্তেজিত করে তোলে।
শহীদ মিনারে ফুল দেয়া
তিনি বলেন, ‘শহীদ মিনারে ফুল দেয়া মুসলিম সংস্কৃতি বিরুদ্ধে। এতে ফুল দেয়া যাবে না। কোরআন-খানি হবে’ ইত্যাদি। বিভিন্ন সংগঠন এর প্রতিবাদে কর্মসূচি গ্রহণ করে। ঢাকার প্রায় সবক’টি সাংস্কৃতিক, সাহিত্য ও নাট্য সংগঠন সম্মিলিতভাবে ‘একুশ উদ্যাপন কমিটি’ গঠন করে।
এর পরের বছর এসে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটে রূপলাভ করে। নারায়ণগঞ্জে আমরাও তখন সম্মিলিত কর্মসূচি গ্রহণ করি। সরকার তখন শিক্ষা সংকোচনের উদ্দেশ্যে মজিদ খান শিক্ষা কমিশনের আলোকে একটি বিতর্কিত শিক্ষানীতি চালু করার উদ্যোগ নিলে ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্র অভ্যুত্থান ঘটে। শিক্ষা ভবন ঘেরাও করতে গেলে সামরিক বাহিনীর গুলিতে বহু ছাত্র-ছাত্রী হতাহত হয়। জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দিপালী সাহা সহ ছয়জন মৃত্যুবরণ করেন। ১৫ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ সংঘর্ষ চলে। ১৯৮৩ এর একুশে হয়ে ওঠে তাৎপর্যপূর্ণ এবং একে কেন্দ্র করে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে গোটা জাতি।
আমরা নারায়ণগঞ্জে তখন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের শূণ্যতা তীব্রভাবে অনুভব করি। নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনে ১৮ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচদিনব্যাপী অনুষ্ঠানে আমরা নারায়ণগঞ্জের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দাবীটি আনুষ্ঠানিক ভাবে উত্থাপন করি। ১৯৮৪ সালে একুশের অনুষ্ঠানের ঘোষণাতেও আমরা শহীদ মিনারের দাবীটি সামনে নিয়ে আসি এবং পরবর্তীতে তৎকালীন জেলা প্রশাসক আহমদ মাহমুদুর রাজা চৌধুরীর সাথে দেখা করে আমরা শহীদ মিনারের দাবীটি জানালে তিনি জায়গা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন এবং কোথায় করতে চাই সে জায়গাটি প্রস্তাব করতে বলেন। আমরা তখন বিভিন্ন বিবেচনা থেকে চাষাঢ়ার মোড়ে অবস্থিত নার্সারিটিতে শহীদ মিনারের পরিকল্পনা গ্রহণ করি।
এ জায়গাটি নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার। আমরা নব নির্বাচিত পৌর চেয়ারম্যান নাজিমউদ্দিন মাহমুদের সাথে দেখা করে এ জায়গাটির অবস্থা জানতে চাই এবং সেখানে শহীদ মিনার গড়ার প্রস্তাব করি। আমরা জেলা প্রশাসককেও এ জায়গাটি সম্পর্কে অবহিত করলে তিনি প্রথমে এ জায়গাতে শহীদ মিনার করার বিষয়ে রাজি হলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সাথে আলাপ করে তিনি এ জায়গাটির ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন। পরে শহীদ মিনারের জায়গা নিয়ে জেলা প্রশাসকের ওখানে একটি সভাও হয়। সে সভায় তিনি এবং তাঁর সাথে নারায়ণগঞ্জের কেউ কেউ চাঁদমারীর ওখানে শহীদ মিনার করার বিষয়ে খুব জোরালো বক্তব্য রাখেন। আমরাও চাষাঢ়াতে শহীদ মিনার করার বিষয়ে অনড় থাকি।
নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা জায়গাটি খালি করার জন্য উদ্যান উন্নয়ন বোর্ডকে পর পর কয়েকটি চিঠি প্রদান করে। কিন্তু উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড সে জায়গাটি যথারীতি তাদের দখলে রেখে দেয়। আমরা ৮৪ এর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে পুনরায় শহীদ মিনার স্থাপনের প্রস্তাব গ্রহণ করি। প্রস্তাবে বলা হয়, ‘আজকের এ সভা বহুবার সাংস্কৃতিক জোট থেকে বলার পরও স্থানীয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রসঙ্গে প্রশাসনের ঔদাসীন্যের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছে এবং অবিলম্বে নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার স্থাপনের জোর দাবী জানাচ্ছে।
১৯৮৪-এর বিজয় দিবস উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন অধ্যাপক বুলবুল চৌধুরী এবং আমি রফিউর রাব্বি ছিলাম সদস্য সচিব। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের পরদিন অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর বুলবুল চৌধুরীর স্বাক্ষরিত প্রস্তাবটি আমরা জেলা প্রশাসক ও পৌর চেয়ারম্যানকে প্রদান করি। এর পরে পৌরসভা থেকে উদ্যান উন্নয়ন বোর্ডকে চাষাঢ়া মোড় থেকে নার্সারি তুলে নেয়ার জন্য আবার একটি চিঠি প্রদান করে।
আমরা একুশ উদ্যাপনের জন্য পৌর পাঠাগারের অফিস কক্ষে সভা করি ১৯৮৫-এর ২৪ জানুয়ারি সকালে। সে সভায় একুশ উদযাপন কমিটি গঠিত হয়। এর আহ্বায়ক কাশেম হুমায়ূন ও আমি সদস্য সচিব। সে সভা শেষ করেই আমরা দুপুরে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভায় যাই। পৌরসভা ও নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের মধ্যে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভাতে আমরা চেয়ারম্যান নাজিমউদ্দিন মাহমুদের কাছে একুশের আগেই শহীদ মিনার গড়ে তোলার বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানাই। আমরা ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সে জায়গাটিতে ‘কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্ধারিত স্থান লেখা একটি সাইনবোর্ড স্থাপনের দাবী জানাই।
আমরা ৩ ফেব্রুয়ারি পৌর চেয়ারম্যানকে জোটের পক্ষ থেকে মফিজুল ইসলাম সারু সাক্ষরিত একটি চিঠি প্রদান করি। তাতে বলা হয়, ‘গত ২৪জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ প্রসঙ্গে পৌর কর্তৃপক্ষ ও নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আগামী ৫ ফেব্রুয়ারিতে চাষাঢ়াস্থ উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড নার্সারি স্থানে শহীদ মিনারের নির্ধারিত স্থানের নামফলক স্থাপন করার জন্য আপনি আশ্বাস প্রদান করেন। আমরা আশা করি নির্ধারিত দিন উক্ত কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ শুরু করে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা নারায়ণগঞ্জবাসীর দীর্ঘদিনের চাহিদা পূরণে সফল হবে।’
কিন্তু পরিতাপের বিষয় পৌরসভা ৫ ফেব্রুয়ারি সাইনবোর্ডটি লাগাতে পারেনি। অবশেষে ১০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পৌর পাঠাগারে নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে আমি নারায়ণগঞ্জের সর্বস্তরের জনতার একটি প্রতিনিধি সভার আহ্বান করি। সে সভায় ভাষাসৈনিক শফি হোসেন খান সভাপতিত্ব করেন।
সভায় পরবর্তী দিন অর্থাৎ ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে নার্সারি উদ্যানে ‘কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্ধারিত স্থান’ লেখা নামফলক স্থাপনের এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় ‘কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বাস্তবায়নের জন্য স্বাধীনতার স্ব পক্ষীয় প্রগতিশীল, রাজনৈতিক, ছাত্র-যুবক, কৃষক, শ্রমিক, মহিলা, শিক্ষক সংগঠন ও সর্বসাধারণের সহযোগিতায় নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট নেতৃত্ব দেবে।’
এর দু’বছর আগে যেহেতু ১৪ ফেব্রুয়ারি দেশে এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটি ছাত্র অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছিল সেহেতু আমরা ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের জন্য ঐ দিনটিকেই বেছে নিলাম। ১১ ফেব্রুয়ারি আমরা পৌর পাঠাগার থেকে মিছিল করে চাষাঢ়া নার্সারি উদ্যানে যেয়ে ‘শহীদ মিনারের নির্ধারিত স্থান’ লেখা নামফলকটি স্থাপন করি এবং উদ্যান কর্তৃপক্ষকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জায়গাটি ছেড়ে দেয়ার দাবী জানাই। সেদিন সন্ধ্যার পূর্বেই উদ্যান কর্তৃপক্ষ চাষাঢ়ার জায়গাটি ছেড়ে চলে যায়।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের বিষয়ে শহরে ব্যাপক মাইকিং করা হয় এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পৌর পাঠাগারে সর্বস্তরের প্রতিনিধিদের জোটের পক্ষ থেকে আমি আরেকটি সভায় মিলিত হওয়ার অনুরোধ জানাই। সে সভায় জোটের পক্ষ থেকে আমরা সভাপতিত্ব করার জন্য ভাষা সৈনিক একে এম শামসুজ্জোহার নাম প্রস্তাব করি এবং দেলোয়ার হোসেন চুন্নু এটি সমর্থন করেন। সে সভাতে একেএম শামসুজ্জোহা ও শফি হোসেন খান যৌথভাবে শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করবেন বলে
আমরা ঐকমত্য হই। পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি সকালে পৌর পাঠাগারের সামনে সর্বস্তরের জনতার সমাবেশ ঘটে। জোট থেকে ‘একটি শহীদ মিনারের জন্ম লগ্নে শিরোনামে একটি লিফলেট প্রকাশিত হয়।
লিফলেটটি ছিল- ‘একটি শহীদ মিনারের জন্ম লগ্নে একুশে ফেব্রুয়ারী বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালীর সংস্কৃতির সকল জীর্ণতা ছিন্ন করে মুক্ত ধারা প্রবাহের এক উজ্জ্বল নির্দেশিকা। যা আমাদের স্বাধীনতার মতো বিজয়কেও সম্ভব করেছিল। তাই বাঙ্গালীর রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে শহীদ মিনার এক বিশাল অবয়ব। যার ব্যাপ্তি সমগ্র বাংলাদেশ, যার অস্তিত্ব প্রতিটি বাঙ্গালীর হৃদয়ে।
৫২ থেকে ’৮৫, দীর্ঘ তেত্রিশ বছর পর বাঙ্গালী আজ যখন গণতন্ত্রের জন্যে সোচ্চার তখন নারায়ণগঞ্জে আমাদের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের জন্ম। নারায়ণগঞ্জের ছাত্র, শিক্ষক, যুবক, শ্রমিক, কৃষক, মহিলাসহ আমাদের সর্বসাধারণের দীর্ঘদিনের আকাঙ্খা আজ আমরাই বাস্তবায়িত করলাম। এই শহীদ মিনার আমাদের আজ সর্ব শোষণ থেকে মুক্তির প্রেরণা যোগাবে। নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট ১৪ ফেব্রুয়ারী ’৮৫ সকাল ১১টার দিকে ‘শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট’ লেখা ব্যানার নিয়ে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটি গাইতে গাইতে আমরা চাষাঢ়া নার্সারি উদ্যানে যাই।
একেএম শামসুজ্জোহা ও শফি হোসেন খান যৌথভাবে শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। দুপুরে আমাদের এ শহীদ মিনারের সমর্থনে তোলারাম কলেজের ছাত্রদের একটি মিছিল কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন ভিপি শামীম ওসমানের নেতৃত্বে চাষাঢ়া গোল চত্বরে এসে অবস্থান গ্রহণ করে। আগে থেকে শহীদ মিনারের কোন মডেল তৈরি না থাকাতে তখন আমরা নিজেরাই সেখানে একটি মডেল ঠিক করে নেই। সোনারগাঁয়ের সাংসদ মোবারক হোসেন একটি মডেলের কথা বললে আমরা তাঁর মডেলটি গ্রহণ করি। একই সাথে সারাদিনে এইটির একটি কাঠামো তৈরি করা হয়। দুই দিকে কালো ও মাঝখানে লাল রঙ লাগিয়ে দেয়া হয়।
রাতে এই শহীদ মিনারটি কে বা কারা ভেঙে ফেলতে পারে এরকম একটি সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা রাতে এটিকে পাহারা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। রাত ১১টা পর্যন্ত সেখানে দেলোয়ার হোসেন চুন্নু, আনোয়ার হোসেন, মফিজুল ইসলাম সারু, মোবারক হোসেন, আবদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। পরে আমি ও মীর ওয়াহিদ সিদ্দিক সারা রাত পাহারায় ছিলাম। তখন শহীদ মিনারের এ কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন আনোয়ার হোসেন, মোহাম্মদ আলী মন্টু, মফিজুল ইসলাম সারু, কাশেম হুমায়ূন, বুলবুল চৌধুরী, দেলোয়ার হোসেন চুন্নু, মাহবুব কামরান, আবদুর রহমান, সুশান্ত সাহা, আসাদুজ্জামান, বিমান ভট্টাচার্য, মীর ওয়াহিদ সিদ্দিক, মোবারক হোসেন, সবুর খান সেন্টুসহ অনেকেই।
এরপর এ শহীদ মিনারটিকে পূর্ণাঙ্গ করার জন্য আমরা পৌরসভাকে একটি চিঠি দেই এবং বিটিভির তৎকালীন চিফ ডিজাইনার শিল্পী আনোয়ার হোসেনকে দিয়ে শহীদ মিনারের একটি ডিজাইন তৈরি করে পৌরসভায় জমা দেই। তখন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে শহীদ মিনারের ব্যাপারটি চাপা পড়ে যায়। এরপর ৮৮ সালে পৌর নির্বাচনের নতুন তফসিল ঘোষিত হলে ওয়ার্ড বিভক্তিকে কেন্দ্র করে কতিপয় ব্যক্তিবর্গের মামলা দায়েরের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেলে সরকার পৌর প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে পৌর কার্য পরিচালনা করতে থাকে। অবশেষে ২০০৩ এ
পৌরসভায় বহুদিন পর নির্বাচিত প্রতিনিধি এলে পৌর চেয়ারম্যান ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে আমরা নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে এ শহীদ মিনারটি পূর্ণাঙ্গ করার দাবী জানাই এবং আমাদের দিক থেকে সার্বিকভাবে তাঁকে সহযোগিতার আশ্বাস দেই। তিনি আন্তরিকতার সাথে আমাদের এ দাবীর প্রতি তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেন। পৌরসভায় জমা দেয়া পূবের ডিজাইনটি ইতিমধ্যে হারিয়ে যাওয়ায় নতুন একটি ডিজাইন করিয়ে পৌরসভা শহীদ মিনারের কাজটি শুরু করে। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারটি পৌরসভার নিজস্ব অর্থায়নে একটি পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনারে রূপ লাভ করে।