চেঙ্গিস খানের দেশ মঙ্গোলিয়া। বিশ্বমানচিত্রে আজকের মঙ্গোলিয়া একটি ডিমের আকারের দেশ। এর অবস্থান মধ্য এশিয়ায়। চীন ও রশিয়ার মাঝখানে। আয়তনে আলাস্কার দ্বিগুণ। মঙ্গোলিয়ার বেশির ভাগই ঘাসে ঢাকা শুকনো মালভূমি। সোজা কথায় পর্বতের ওপর অপেক্ষাকৃত সমতল ভূমি। এর পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ পাহাড়ি এলাকা। দক্ষিণাংশের চীন সীমান্ত এলাকায় রয়েছে দুর্গম গোবি মরুভূমি। মোটামুটিভাবে দেশটির ১ শতাংশেরও কম ভূূমি চাষাবাদের উপযোগী।
আজকের দিনে মঙ্গোলিয়ায় গেলে দেখা যাবে এর বেশির ভাগ এলাকায়ই জনবসতি নেই। কোথাও কোথাও এখনো হঠাৎ করে চোখে পড়তে পারে যাযাবর রাখালগোত্রের লোকেরা তাদের পশুচারণ করে অতি কষ্টের জীবন যাপন করছে। ধূলিঝড়, খরা, প্রবল শীত তাদের নিত্যকষ্টের কারণ। প্রকৃতপক্ষে এরা আজ যে ধরনের জীবন যাপন করছে, তা শত বছর আগের তাদের পূর্বপুরুষদের জীবন যাপনের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। তার পরও একটা সময় ছিল, যখন এই বিচ্ছিন্ন নির্জন মঙ্গোলিয়া ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভূমিসাম্রাজ্য। আর ইতিহাস খ্যাত অনন্যসাধারণ সামরিক ব্যক্তিত্ব চেঙ্গিস খান ছিলেন সে সাম্রাজ্য গড়ে তোলার কারিগর।
চেঙ্গিস খানের জন্ম ১১৬২ সালে। মা হো’য়েলুন। বাবা ইয়েসুগি। ইয়েসুগি ছিলেন মোঙ্গলদের এক গোত্রপ্রধান। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় তেমুজিন। কারো মতে, তেমুসিন। স্থানীয় ভাষায় তেমুজিন শব্দের অর্থ ‘আয়রন ওয়ার্কার’ বা ‘ব্ল্যাকস্মিথ’। আমরা যাকে বলি কর্মকার। তেমুজিন অর্থাৎ চেঙ্গিস খানের জন্ম এমন সময় হয়, যখন গোটা মঙ্গোলিয়ায় ছিল শুধু উপজাতীয় যাযাবর পশুপালক কিছু গোত্রের বাস। তখন সবচেয়ে শক্তিশালী গোত্রটির নাম ছিল বোরজিগিন। এ গোত্রের প্রধান ছিলেন সাহসী যোদ্ধাব্যক্তিত্ব কাবুল খান। ‘খান’ তার উপাধি, এর অর্থ ‘নেতা’। কাবুল খানের পুত্র ইয়েসুগি। ইয়েসুগি বোরজিগিনেরই একটি উপগোত্র ‘কিয়াত’-এর প্রধান। বলা হয়, ১১৬২ থেকে ১১৬৭ সালের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে ইয়েসুগির ঘরে জন্ম নেন তেমুজিন।
১১৭৫ সালের দিকে তেমুজিন তখন ১৩ বছর বয়েসী এক বালক। ইয়েসুগি ঘোষণা দিলেন, তেমুজিনকে একজন পাত্রী খুঁজে বের করে বিয়ে করতে হবে। বাবা ও ছেলে বের হলেন পাত্রীর খোঁজে। কয়েক দিন ভ্রমণের পর এরা খোঁজ পেলেন মোঙ্গলদের অতিথিপরায়ণ এক উপজাতির। অল্প দিনেই তেমুজিন এ গোত্রের সরদারের মেয়ে বর্তির খোঁজ পান। বর্তি হন তার বাগদত্তা। সেখান থেকে ফিরে আসার সময় উপজাতীয় তাতার গোষ্ঠীর লোকেরা ইয়েসুগিকে বিষ খাইয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। পূর্ব-মঙ্গোলীয় শুষ্ক তৃণময় প্রান্তরে তাতারেরাই মোঙ্গলদের চরম শক্তিধর প্রতিপক্ষ। তেমুজিন শপথ নেন এর প্রতিশোধ নেবেন। সে লক্ষ্যেই বাগদত্তা বর্তিকে ছেড়ে চলে আসেন নিজ গোত্রে। নিজেকে ঘোষণা করেন গোত্রের নেতা।
উপজাতীয় জ্যেষ্ঠ নেতারা এই বালককে নেতা মানতে অস্বীকার করেন। শুধু তাই তার পরিবারের লোকজনসহ নির্জন তৃণভূমিতে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়। পরবর্তী কয়েক বছর চরম অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটাতে হয় বনের ফলমূল খেয়ে। শিকার করা পশুর মাংস খেয়ে। একদিন শিকার নষ্ট করে দেয়ায় ঝগড়াঝাঁটি করে তেমুজিন তার বৈমাত্রেয় ভাই বেখতারকে হত্যা করে। জীবন যাপন এতটাই কষ্টকর হয়ে উঠেছিল যে, খাবার চুরির জন্য সে নিজের ভাইকেও হত্যা করেছে।
১১৮২ সালের হামলার
১১৮২ সালের দিকে এক হামলার ঘটনায় তেমুজিন বন্দী হন তার বাবার সাবেক মিত্র তায়িচুয়েটের হাতে। এক প্রহরীর সহায়তায় সেখান থেকে পালাতেও সক্ষম হন। এ প্রহরীর ছেলে বিলুয়ান পরে এক সময় চেঙ্গিস খানের বাহিনীর একজন জেনারেল হন। তায়িচুয়েটের কাছ থেকে পালানোর পর তেমুজিনের বীরত্বের কথা চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সবাই জানতে পারে চেঙ্গিস খান এক দুর্ধর্ষ মানুষ। এর কিছু দিন পর একদল হামলাকারী সামান্য খাবার ও একটি ঘোড়া রেখে বাকি সব লুটে নিয়ে যায়। চেঙ্গিস খান তাদের তাড়া করে ধরতে পারেননি। এই তাড়া করার সময় তার দেখা হয় বগোরচি সামের এক ধনীর সন্তানের সাথে। এরা পরস্পরকে ভ্রাতৃত্ববোধে আলিঙ্গন করেন। বগোরচি তাকে চুরি যাওয়া ঘোড়াগুলো উদ্ধার করে দেয়। কিন্তু হামলাকারীদের ধরতে পারেননি। এর চার বছর পর বর্তিকে বিয়ে করেন চেঙ্গিস খান।
ফঙ্কিরাত সম্প্রদায়ের সরদারের কন্যা বর্তির সাথে বিয়ে হওয়ার সময় তেমুজিনের বয়স ১৬। বর্তির ঘরে তেমুজিনের ছিল চার পুত্র : জোচি (১১৮৫-১২২৭), চাগাতাই (?- ১২৪৯), ওগোদি (?- ১২৪১) এবং তলুই (১১৯০-১২৩২)। তেমুজিনের অন্য স্ত্রীদের ঘরে তার আরো সন্তান ছিল। একসময় বর্তিকে মারফিট নামে অন্য এক গোত্রের লোকেরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। চেঙ্গিস খান পরে তাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন। সে যা-ই হোক চেঙ্গিসে খানের ব্যক্তিজীবন কম বৈচিত্র্যময় ছিল না। একসময় নানা ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তিনি মোঙ্গলদের ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত করেন। শুরু হয় তার বিজয় পর্বের।
মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তার বিজয় পর্বের শুরু। তখন তেমুজিন ও তগরুলের কথা দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এদের আহ্বানে সব মোঙ্গল ঐক্যবদ্ধ হয়। হাজার হাজার মোঙ্গল অস্ত্র, খাবার ও পরিবার-পরিজন নিয়ে সমবেত হয়। এভাবে হাজার হাজার মানুষ তার কমান্ডের আওতায় আসে। তার যোদ্ধাবাহিনী সুসংগঠিত হয়। এদের ১০ জনের, ১০০ জনের, হাজার জনের, ১০ হাজার জনের দরে ভাগ করা হয়। ১১৮৩ সালে তেমুজিন একুশ বছরের এক টগবগে যুবক। তোঙ্গলদের এক সমাবেশে তাকে তাদের ‘গ্রেট খান’ ঘোষণা করে নাম দেয়া হয় চেঙ্গিস খান। তেমুজিন হয়ে ওঠেন চেঙ্গিস খান। চেঙ্গিস খানের নামের আড়ালে হারিয়ে যায় তার তেমুজিন নামটি। চেঙ্গিস কিংবা গেঙ্গিস নামের অর্থ কারো মতে ‘দামি যোদ্ধা’, কারো মতে ‘আলোর চেতনা’। প্রত্যেক সৈনিক তার নিজের রসদ বহন করত। গুঁড়োদুধ ও অন্যান্য শুকনো খাবার ছিল তাদের রসদ। খাবারের অভাব হলে ঘোড়ার শিরা কেটে রক্ত পান করত এরা।
গ্রেট খান
চেঙ্গিস খান মোঙ্গলদের ‘গ্রেট খান’ ঘোষণার পরও তাদের মধ্যে কিছু বিভাজন থকে যায়। তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে চেঙ্গিস খানকে বেশ কয়েকটি অভিযান চালাতে হয়। কেরেইট সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব ছিল চেঙ্গিসের ছোটবেলার বন্ধু জামুগার হাতে। চেঙ্গিস তাকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়। জামুগা এ প্রস্তাবে রাজি না হলে কয়েকটি যুদ্ধ হয়। দুই-তিন বছরে কয়েকটি যুদ্ধের পর ১২০৩ সালের শেষ যুদ্ধে কেরেইট বাহিনী পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। জামুগার অনুরোধে তাকে রক্তপাত না ঘটিয়ে কম্বল জড়িয়ে দম বন্ধ করে মারা হয়। বিদ্রোহী মোঙ্গলদের সবশেষ গোষ্ঠীর পরাজয় হয় ১২০৪ সালে। ১২০৬ সালে চেঙ্গিস খানকে অভিহিত করা হয় ‘খান অব খানস’ বা ‘কিং অব কিংস’। এ সময় সব মোঙ্গল তার নিয়ন্ত্রণে আসে। এবার চেঙ্গিস খান মন দেন সাম্রাজ্য সম্প্রসারণে।
১২০৭ সালে তিনি ক্রুসেড ঘোষণা করেন চীনাভূমি বিজয়ের। তখন চীন বিভক্ত ছিল তিনটি আলাদা সাম্রাজ্যে। উত্তরে ছিল কিন ও তেনগুত সাম্রাজ্য। দক্ষিণে ছিল সুং সাম্রাজ্য। চেঙ্গিস নিজে তেনগুত রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানে নেতৃত্ব দেন। এটি বর্তমানে উত্তর-পূর্ব চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ। চেঙ্গিস খানের স্বপ্ন ছিল গোটা চীনকে নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করা। তবে তার নাতির আমলের আগে অর্থাৎ ১২৭৯ সালের আগে পর্যন্ত তার সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
সে যা-ই হোক উত্তর চীনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর তার অভিযান চলে পশ্চিম অভিমুখে। ১২১৮ সালে খাওয়ারজমের (আজকের উজবেকিস্তানের) শাহ দ্বিতীয় মোহাম্মদ একটি মোঙ্গল মরুযাত্রীদলের লোকদের মেরে ফেলে। চেঙ্গিস খান এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শাহ মোহাম্মদের কাছে বার্তা পাঠান এরা মোঙ্গলদের কাছে বশ্যতা স্বীকার না করলে খাওয়ারজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে। খওয়ারজম সে প্রস্তাব গ্রহণ না করলে যুদ্ধ বেধে যায়। চেঙ্গিস খান ৯০ হাজার সৈন্য নিয়ে উত্তর দিক থেকে হামলা শুরু করেন। পূর্ব দিক থেকে হামলার জন্য ৩০ হাজার সৈন্য দিয়ে পাঠালেন এক জেনারেলকে। বিপরীতে মোহাম্মদ শাহ বাহিনীতে ছিল চার লাখ সৈন্য। তার পরও চেঙ্গিস খান যুদ্ধে জয়ী হন। তার দখলে আসে পুরো খাওয়ারজম সাম্রাজ্য।
এরপর ২০ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী পাঠানো হলো রাশিয়া অভিমুখে। এ ছাড়া ৮০ হাজার সৈন্য নিয়ে এক ভাগের নেতৃত্বে থাকেন চেঙ্গিস খান নিজে। এ অংশ অগ্রসর হয় আফগানিস্তান হয়ে ভারত আক্রমণে। অন্য অংশটি এগিয়ে যায় ককেশাস অঞ্চল রাশিয়া অভিমুখে। চেঙ্গিস খান যখন তার সৈন্যদের পার্সিয়া ও আর্মেনিয়ায় জড়ো করে মঙ্গোলিয়া ফিরে আসছিলেন, তখন ২০ হাজার সৈন্যের দ্বিতীয় বাহিনীটি জেনারেল জুবে ও সাবুতাইয়ের নেতৃত্বে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের গভীরে ঢুকে যায়। মোঙ্গলেরা জার্জয়া ধ্বংস করে। তছনছ করে ক্রিমিয়ার জিনেজ বাণিজ্য-দুর্গ।
ফেরার পথে দলটি আরো নানা যুদ্ধের মুখোমুখি হয়। চেঙ্গিস খান তখন সাবুতাইয়ের বাহিনীকে ফিরে আসার আদেশ দেন। সমরখন্দ থেকে ফিরে আসার সময় পথে মারা যান জুবে। তখন জুবে ও সাবুতাইয়ের অশ্বারোহী বাহিনীর গৌরবগাথা বিখ্যাত হয়ে ওঠে। ফিরে আসার পথে এরা নানা যুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করে। মোঙ্গলদের এই বিজয়ে ইউরোপবাসী বিস্মিত হয়। ১২২৫ সালে উভয় দল ফিরে আসে মঙ্গোলিয়ায়। নানা অঞ্চল আর দেশ জয়ের পর চেঙ্গিস খানের অভিযান তার উত্তরাধিকারীর হাতে শেষ হয় ১২৪০ সালের দিকে।
মানুষ মনে করে মোগল সাম্রাজ্যের পুরো এলাকা চেঙ্গিস খান তার দখলে এনেছিলেন। আসলে তিনি তা করতে সক্ষম হননি। ১২২৭ সালে তার মৃত্যুর আগে মোঙ্গল সাম্রাজ্য কাস্পিয়ান সাগর থেকে জাপান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তার মৃত্যুর পর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তার সাম্রাজ্যের প্রসার অব্যাহত ছিল। তার উত্তরাধিকারী ওগেজি খানের আমলে মোঙ্গল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বেশি সম্প্রসারণ ঘটে। মোঙ্গল বাহিনী পার্সিয়া দখল করে নিয়েছিল। দখল করে নেয় জি জিয়াও রাজ্য। চীনের সং রাজবংশের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব বাধে। চেঙ্গিস খান মৃত্যুর আগে এক লাখ ২৯ হাজার সৈন্যের এক বাহিনী রেখে যান। ২৮ হাজার সৈন্য দেয়া হয় তার ভাই ও পুত্রদের। তার সবচেয়ে কনিষ্ঠ পুত্র তলুই পায় এক লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী। মোঙ্গলদের প্রথা অনুযায়ী সবচেয়ে ছোট পুত্র পায় বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ। জোচি, ওগেদি খান ও কুলানের পুত্র গিলিজিয়ান প্রত্যেকেই পায় চার হাজার করে সৈন্য। তার মা ও ভাইদের প্রত্যেকেই পায় তিন হাজার করে সৈন্য।
প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে মারা গেলেন চেঙ্গিস খান? তিনি ছিলেন সুদক্ষ ঘোড়সওয়ার। ঘোড়া দৌড়ানোর নানা কৌশল জানা ছিল। তাকে বলা হতো ‘মাস্টার হর্স রাইডার’। কিন্তু সেই তিনি শিকার করার সময় ঘোড়ার ওপর থেকে পড়ে মারাত্মক আহত হন এবং আহত হওয়ার অল্প কিছুক্ষণ পরই তিনি মারা যান। আবার এমন কথাও চালু আছে, তিনি মারা যান ম্যালেরিয়ায়। তখন তার বয়স ৬০। অপর দিকে কেউ বলছেন, তিনি মারা যান ১২২৭ সালের ১৮ আগস্ট পশ্চিম জিয়া সাম্রাজ্যে আক্রমণ চালানোর সময়। এ হামলা চালানোর সময় তিনি ঘোড়া থেকে পড়ে আহত হয়ে মারা যান।
অতএব তার মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে জানা যায়নি। এর একটি বড় কারণ তার মৃত্যুর ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল। তবে মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে তার পুত্রদের তিনি বলে গিয়েছিলেন : ‘স্বর্গীয় সহায়তায় আমি তোমাদের জন্য বিজয় করে রেখে গেলাম এক বিশাল সাম্রাজ্য। কিন্তু গোটা দুনিয়া জয় আমি করতে পারিনি। কারণ আমার জীবনটা খুবই ছোট।’
চেঙ্গিস খান বলে গিয়েছিলেন তাকে কোথায় সমাধিস্থ করা হবে তা যেন কাউকে জানানো না হয়। মারা যাওয়ার পর তার লাশ ফিরিয়ে আনা হয় মঙ্গোলিয়ায়। ধরে নেয়া হয় তাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল তার জন্মস্থান উলান বাতুরের উত্তর-পূর্বে খেন্তি আইম্যাগে। এই স্থানটি ওনন নদীর তীরের কাছাকাছি। এমন কথাও প্রচলিত আছে, তাকে সমাহিত করার জন্য যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন পথে যাকেই পাওয়া গিয়েছিল তাকেই তার সৈন্যরা হত্যা করে, যাতে করে কেউ জানতে না পারে তাকে কোথায় কবর দেয়া হয়েছে। যেসব শ্রমিক তার কবর খনন করেছিল, খনন শেষে তাদেরকেও মেরে ফেলা হয়। তারও পর যেসব সৈন্য তাদের হত্যা করেছিল, তাদেরকেও হত্যা করা হয়। ‘চেঙ্গিস খান সমাধি’ তার স্মৃতিস্মারক, তার কবর নয়। সেখানে তাকে কবর দেয়া হয়নি। প্রচলিত রূপকথা বলে, একটি নদী তার কবরে এসে দুই ভাগ হয়ে গেছে, যাতে করে কবরটা চেনা মুশকিল হয়। বলা হয়ে থাকে একই ঘটনা ঘটেছিল উরুকের সুমেরীয় বাদশা গিলগামেশের কবর নিয়েও। আরো শোনা যায় তার কবরের ওপর দিয়ে ঘোড়া চড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে এরপর কবর এলাকায় গাছ লাগিয়ে দেয়া হয়। তা ছাড়া তাকে যে এলাকায় কবর দেয়া হয়েছিল, সে স্থানটি ছিল একটি চিরহিমায়িত অঞ্চল। এর ফলে তার লাশ লুকানোটা অনেকটা সহজ হয়েছিল।
The Erdent Tobchi (১৬৬২) দাবি করেন, চেঙ্গিস খানের কফিন যখন মঙ্গোলিয়ায় পৌঁছে, হতে পারে তখন এটি খালি ছিল। একইভাবে the Altan Tobchi (১৬০৪) মনে করেন শুধু তার শার্ট, তাঁবু ও বুটজুতা কবর দেয়া হয়েছিল Ordos-G (Ratchnevsky, p 143f)| অপর দিকে Tumbull (2003, p. 24) জানান চেঙ্গিস খানকে নিয়ে আরেক কল্পকথা। তিনি বলেন, চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর ৩০ বছর পর তার কবর আবিষ্কার করা হয়। তার কল্পকাহিনী মতে, একটি উটের বাচ্চাও কবর দেয়া হয়েছিল চেঙ্গিস খানের সাথে। এবং পরে দেখা গেছে এই বাচ্চা উটের মাকে কবরের পাশে গিয়ে কান্না করতে।
চেঙ্গিস খানের কবর
মার্কো পলো লিখেছেন, এমনকি ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এসেও মোঙ্গলেরা জানত না চেঙ্গিস খানের কবরের স্থান কোথায়। দ্য সিক্রেট হিস্ট্রি অব মোঙ্গলস-এ চেঙ্গিস খানের মারা যাওয়ার সনের কথা উল্লেখ আছে, কিন্তু কোনো তথ্য নেই তার কবরের স্থান সম্পর্কে। ট্র্যাভেলস অব মার্কো পলো বইয়ে তিনি উল্লেখ করেন, ‘এটি ছিল একটি অভিন্ন প্রথা যে, সব গ্র্যান্ড খান ও চেঙ্গিস খানের সব প্রধানকে সমাহিত করার জন্য বহন করে নিয়ে যাওয়া হতো একটি নির্দিষ্ট অত্যুচ্চ পাহাড়ে, আর এই পাহাড়ের নাম আলতাই। এদের মৃত্যু যেখানেই হোক, সে মৃত্যু হতে পারে ১০০ দিনের পথ দূরত্বের কোনো স্থানে। তার পরও তাদের নিয়ে যাওয়া হতো সেই স্থানাভিমুখে।’
মার্কো পলো আরো লিখেছেন, চেঙ্গিস খান মারা যান একটি দুর্গে বন্দী থাকা অবস্থায়। এই দুর্গের নাম ছিল তাইজিন। তার হাঁটুতে এসে একটি তীর লাগে, আর সেই আঘাতেই তিনি মারা যান। এবং তাকে আলতাই পাহাড়ে সমাহিত করা হয়। কোনো উৎস মতে, তাকে সমাহিত করা হয়েছিল বুরখান খলদুন পাহাড়ে। এই পাহাড়ের ভৌগোলিক অবস্থান মোটামুটি ৪৮ ডিগ্রি ৩০ মিটার উত্তর ১০৮ ডিগ্রি ৪২ মিটার পূর্ব অক্ষাংশ/৪৮ ডিগ্রি উত্তর ১০৮ ডিগ্রি ৭ মিটার পূর্ব অক্ষাংশ। বুরখান খলদুন পাহাড় এলাকার কাছাকাছি জায়গাটাকে বলা হতো ইখ খোরিগ বা গ্রেট ট্যাবো। এই ২৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিষিদ্ধ করে রেখেছিল মোঙ্গলেরা। যারা এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করত তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো। মাত্র এই ২০ বছরের সময়ের মধ্যে এই এলাকাটি খুলে দেয়া হয়েছে পাশ্চাত্যের প্রত্নতত্ত্ববিদদের জন্য।
২০০৪ সালের ৬ অক্টোবরে দাবি করা হয়, ‘চেঙ্গিস খান প্রাসাদ’ আবিষ্কার করা হয়েছে। এর ফলে তার কবরের স্থানও চিহ্নিত করা সম্ভব হতে পারে। শৌখিন প্রত্নতত্ত্ববিদ মাউরি ক্র্যাভিটজ বিগত ৪০ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন চেঙ্গিস খানের কবরের জায়গা খুঁজে বের করার জন্য। পঞ্চদশ শতাব্দীর এক ফরাসির বর্ণনায় তিনি দেখতে পান এক প্রাচীন যুদ্ধের। সে সময় চেঙ্গিস খান পরিচিত ছিলেন তেমুজিন নামে।
সেই যুদ্ধে চেঙ্গিস খান চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেন। এই সূত্র মত, তিনি খেরলিন ও ব্রুচি নদীর সঙ্গমস্থলটি বেঁচে নেন, যার ডান পাশেই আছে বুরখান খলদুন তার চিরদিনের প্রিয় স্থান হিসেবে। ক্র্যাভিটজ সত্য বলে ধরে নিয়েছিলেন, এই যুদ্ধক্ষেত্রের কাছেই হবে তেমুজিনের কবর। তিনি চেষ্টা করেন ব্রুচি নদী খুঁজে পেতে, যা মানচিত্রকরদের জ্ঞানের বাইরে চলে গিয়েছিল। তিনি তা করতে সক্ষম হন। তিনি আবিষ্কার করেন এর দৈশিক নাম। ‘বারুন ব্রুচ’, যার অর্থ ‘পশ্চিম ব্রুচ’। ২০০৬ সালে এসে শুরু করেন খননকাজ। মোটামুটি বুরখান খলদুনের ১০০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে চলে এ খননকর্ম।