হালাকু খানের বাগদাদ ধ্বংসের কাহিনী

হালাকু খানের বাগদাদ ধ্বংসের কাহিনী

মোঙ্গল শাসক হালাকু খান কর্তৃক বাগদাদ আক্রমণ ও ধ্বংস ইতিহাসের একটি বেদনাদায়ক ঘটনা। পারস্যের গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের ক্ষমতা বিলোপ করার পর ১২৫৬ খৃস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে হালাকু খান বাগদাদ অবরোধ করেন। এ সময় বাগদাদের খলিফা ছিলেন আল-মুস্তাসিম বিল্লাহ। খলিফা গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় দমনের ব্যাপারে হালাকু খানকে সাহায্য প্রদানে বিরত ছিলেন। এতে হালাক খান খলিফার প্রতি ক্রুদ্ধ হল এবং এটাই তার বাগদাদ আক্রমণের কারণ ছিল।

গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়কে দমন করার পর হালাগু খান বাগদাদের দিকে দ্রুত ধাবিত হন। পথিমধ্যে তিনি বাগদাদের বহিঃপ্রাচীর ধ্বংস করে খলিফাকে অবিলম্বে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। খলিফা এতে কর্ণপাত না করলে বাগদাদ নগরী অবরুদ্ধ হয়। মোঙ্গলবাহিনী একযোগে পূর্ব ও পশ্চিম দিক হতে আক্রমণ চালায়। খলিফার ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী হালাকু খানের বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে বাগদাদ রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে খলিফা পুত্র পরিজন ও অনুচরবর্গসহ জীবন রক্ষার জন্য আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। কিন্তু এতে বাগদাদ নগরী হালাক খানের প্রমত্ত ধ্বংসকান্ড হতে পরিত্রাণ পায়নি। হালাক খান বাগদাদ নগরীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে খলিফা ও খলিফার আত্মীয় পরিজনসহ নগরীর অসংখ্য নরনারীকে হত্যা করেন।

প্রাণভয়ে ভিত বাগদাদের অগণিত নারী-পুরুষের করুণ আর্তিকে উপেক্ষা করে মোঙ্গলবাহিনী বিভৎস হত্যালীলা ও অত্যাচারের একটি নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করলো। শুধু জীবননাশের মধ্য দিয়েই মোঙ্গলবাহিনীর অত্যাচার শেষ হয়নি, তাদের হাতে যুগ যুগ লালিত মুসলিম সাহিত্য-শিল্প ও সংস্কৃতিরও বিলুপ্ত ঘটে। তাদের আক্রমণের প্রচন্ডতায় মুসলিম জাতির গৌরবকীর্তি, মুসলিম জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির উজ্জললতম নিদর্শন বাগদাদ নগরী এক মহাশ্মশানে পরিণত হয়। এভাবে ‘আরব্য রজনীর স্বপ্নপুরী’ বাগদাদ তার সর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে প্রতিপক্ষের জিঘাংসার পরিতৃপ্তি ঘটালো। বাগদাদ ধ্বংসের নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে ব্রাউন বলেন, ‘সম্ভবত কখনোই এত বড় ও সমৃদ্ধশালী একটি সভ্যতা এত দ্রুত অগ্নিশিখায় বিধ্বস্ত ও রক্তধারায় নিশ্চিহ্ন হয়নি।’ মোঙ্গলদের নিষ্ঠুর আক্রমণে অসংখ্য মসজিদ, প্রাসাদ, অট্টলিকা প্রভৃতি নিশ্চিহ্ন হলো। কেবল মুষ্টিমেয় শিল্পী, চিত্রকর প্রভৃতি এই আক্রমণের কবল থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিল।

ইসলামের ইতিহাসে বাগদাদ ধ্বংসের ফলাফল সুদূর প্রসারী। এ সম্বন্ধে পি, সাইকস বলেন, ‘যে ভয়ংকর ধ্বংসলীলা মুসলিম রাজ্যসমূহের এবং পরোক্ষভাবে সমগ্র দুনিয়ার অগ্রগতিকে রুদ্ধ করে দিয়েছিল, তার প্রকৃতি অনুধাবন করা কষ্টকর এবং অতিরঞ্জিত করা অসম্ভব।’ আমীর আলীর মতে, ‘বাগদাদ আক্রমণে যে ধ্বংসলীলা অনুষ্ঠিত হয় তা থেকে অন্যান্য শহরে কি ঘটেছিল তার আভাস পাওয়া যায়। তিনদিন ধরে শহরের পথে রক্তের স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল এবং তাইগ্রিস নদীর পানি মাইলের পর মাইল রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল।

ইবনে খলদুনের মতে, মোঙ্গলদের আক্রমণের ফলে ১,৬০,০০০ লোক প্রাণ হারায়, মতান্তরে ২০,০০,০০০ অধিবাসীদের ১৬,০০,০০০ লোক মারা যায়। এই আক্রমণের ফলে বাগদাদ মোঙ্গলদের অধিকারভুক্ত হয় এবং মুসলিম বিশ্ব কিছুকালের জন্য খলিফা শূন্য হয়ে পড়ে। এই আক্রমণের ধ্বংসলীলায় অসংখ্য নরনারী, আত্মাহুতি দেয়। বাগদাদের আক্রমণের ভয়াবহ পরিণাম সম্বন্ধে ঐতিহাসিক ইবনুল আমীর বলেন, ‘পৃথিবীর এবং বিশেষত মুসলমানদের ওপর যে সব বিরাট বিপর্যয় ও ভয়াবহ ধ্বংসলীলা সংঘটিত হয়েছিল তার মধ্যে তাতার জাতির আক্রমণ অন্যতম।’

বাগদাদ আক্রমণের ফলে বহু স্মৃতিসৌধ, প্রাসাদ ও মসজিদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অসংখ্য বইপুস্তক বিনষ্ট হয় এবং বহু প্রখ্যাত পন্ডিত ও বৈজ্ঞানিক নিহত হন এভাবে মুসলিম বিশ্বের স্বপ্নরাজ্য বাগদাদে জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির যে দীপশিখা প্রজ্জলিত হয়েছিল তা মুহূর্তে নির্বাপিত হলো। তৎকালীন বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও শিক্ষা-সংস্কৃতির তীর্যক্ষেত্র বাগদাদ ধ্বংস সম্পর্কে তাই বলা যায়, এটা শুধু মুসলিম বিশ্বের নয়, সারাবিশ্বের অগ্রগতিকেও ব্যাহত করেছিল।

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত