‘আরব’ শব্দের সঠিক অর্থ কী তা নিশ্চিত করে বলা যায়না। সেমিটিক শব্দ আরবাহ মানে জংলী, এরেব মানে মিশ্রিত লোকজন, আরবি মানে অসভ্য মানুষ যার কোন সভ্য কোন জ্ঞান নাই, অনেকে আবার, বিশুষ্ক প্রান্তর বা অনুর্বর জমিন বুঝাতে আরব শব্দ ব্যবহার করেন। তবে ৫ BCE থেকে আরব উপদ্বীপ ও এর অধিবাসীদের জন্য ‘আরব’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসার প্রমাণ পাওয়া যায়।
জজিরাতুল আরবের পশ্চিমে- লোহিত সাগর এবং সায়না উপদ্বীপ। পূর্বে- আরব সাগর। দক্ষিণে- ইরাকের বিরাট অংশ এবং আরও দক্ষিণে আরব সাগর যা ভারত মহাসাগরের বিস্তৃত অংশ। উত্তরে- সিরিয়া ও উত্তর ইরাকের একাংশ। সর্বমোট এলাকা- দশ থেকে তের লাখ বর্গমাইল।
জজিরাতুল আরব বহু প্রান্তর ও মরুভূমির প্রতিরক্ষায় ঘেরা থাকার কারণে এর অধিবাসীরা প্রাচীনকাল থেকেই স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর এ বাধার প্রেক্ষিতে প্রতিবেশী বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলো কখনোই তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি।
অবস্থান- আরব উপদ্বীপ তৎকালীন সকল মহাদেশের মাঝখানে ছিল। উত্তর-পশ্চিমে- আফ্রিকা মহাদেশের প্রবেশদ্বার। উত্তর-পূর্বে- ইউরোপ। পূর্বে- ইরান, মধ্য এশিয়া ও দূর প্রাচ্যের প্রবেশ পথ, যে পথে ভারত ও চীন পর্যন্ত যাওয়া যায়।
ভৌগলিক অবস্থানের বিশেষত্বে আরব উপদ্বীপ তৎকালীন ব্যবসা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদির যোগসূত্র ও মিলনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।
ঐতিহাসিকরা আরব জনগোষ্ঠীকে তিনভাগে বিভক্ত করেছেন-
১) প্রাচীন আরব : ‘আদ, সমূদ, তাছাম, জাদিছ, আমালেকা প্রভৃতি জাতিসমূহ যারা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
২) আসল আরব : ইয়ারুব ইবনে ইয়াশজুব ইবনে কাহতানের বংশধর, এদেরকে কাহতানী বলা হয়। এ বংশের নাম এখনো শোনা যায়। এদের আদি বাসস্থান ইয়েমেন। তাদের মধ্যেও অনেক গোত্র আছে তবে প্রধান গোত্র দুটি হল- ক) হেমইয়ার, খ) কাহতান।
হেমইয়ার: বিখ্যাত শাখার নাম- যাইদুল যমহুর কোজা’আহ এবং যাকাসেক।
কাহতান: বিখ্যাত শাখা- হামদান, আনমার, তাঈ, মাযহিজ, কেন্দাহ, লাখম, জুযাম আযাদ, আওস, খাজরায ও জাফনার। সিরিয়ার আশপাশে বাদশাহি প্রতিষ্ঠা ও পরে গাসসান নামে পরিচিতি। ইয়েমেনবাসীদের বাণিজ্যের উপর রোমকদের আধিপত্য বিস্তারকালে এরা ইয়েমেন ছেড়ে আরব উপদ্বীপে বসবাস শুরু করে। কেউ বলেন, হিমইয়ারী গোত্রের সাথে বিবাদের ফলে দেশ ত্যাগী হয়।
দেশত্যাগী কাহতানীরাও আবার চার ভাগে বিভক্ত:
ক। আযাদ: সর্দার ইমরান ইবনে আমর মুযাইকিয়ার পরামর্শে দেশত্যাগ ও পরে উত্তরে অগ্রসর হয়ে বিচ্ছিন্ন বসবাস করে। এদের মধ্যে উপ গোত্র সকল-
ক/ক-ছা’লাবা ইবনে আমর: ইনি হেজাজ অভিমুখে রওয়ানা হয়ে ছা’লাবা ও জিকার-এর মাঝামাঝি অবস্থান করেন। পরে মদীনা গিয়ে সেখানেই বসবাস করেন। ইনার বংশ থেকেই আওস ও খাজরাযের জন্ম; এরা ছিল ছা’লাবার পুত্র হারেছার সন্তান।
ক/খ-হারেছ ইবনে আমর: খোজা’আর সন্তান, হেজাজের বিভিন্ন স্থানে ঘোরাফেরার পর মাররায যাহরানে অবস্থান নিয়ে মদীনায় হামলা করে। মক্কা থেকে বনী জুরহুম গোত্রকে বের করে দিয়ে নিজেরা বসতি গড়ে।
ক/গ-ইমরান ইবনে আমর: আম্মানে বসতি গড়ে, এদেরকে আযদে আম্মান বলা হয়।
ক/ঘ-নাসর ইবনে আযদ: তোহামায় অবস্থান করে, এদের আযদে শানুয়াত বলা হয়।
ক/ঙ-জাফনা ইবনে আমর: ইনি ছিলেন গাসসানী বাদশাহর প্রপিতামহ, হেজাজের গাসসান নামক জলাশয়ের কাছে কিছুদিন থাকেন এবং পরে সপরিবারে সিরিয়ায় বসবাস করেন।
খ। লাখম জুযাম: এ বংশে নসর ইবনে রবিয়া ছিলেন অন্যতম, তিনি হীরার শাসনকর্তাদের (আরে মোনযের) পূর্বপুরুষ ছিলেন।
গ। বনু তাঈ: বনু আযদের পরে এরা উত্তরের আজা ও সালমা নামক দুই পাহাড়ের মাঝে বসবাস শুরু করে, এদের কারণেই পাহাড় দু’টি বিখ্যাত হয়ে উঠে।
ঘ। কিন্দা: প্রথমে বাহরাইনের বর্তমান আল-আহমা নামক স্থানে বসবাস শুরু করে, পরে হাদারামাউত, টিকতে না পেরে নাজদে গিয়ে নিজস্ব সরকার প্রতিষ্ঠা করে এবং ব্যর্থ হয় ও নাম নিশানা মুছে যায়।
কাহতান ছাড়াও হেমইয়ারের আরেকটি গোত্র ছিল- কাজাআ। এর নাম হেমিরি নিয়ে সন্দেহ আছে, এরা ইয়েমেন থেকে বের হয়ে ইরাকের বাদিয়াতুস সামাওয়াতে বসবাস করে।
৩) শংকর আরব: ইসমাঈল ‘আঃ এর বংশধর। এদের আদনানী আরবও বলা হয়।
পূর্বপুরুষ: সাইয়েদুনা ইবরাহীম আঃ। তিনি ইরাকের বিলুপ্ত হওয়া উয শহরের অধিবাসী ছিলেন। দ্বীন প্রচারের জন্য তিনি দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করেন, মিসর সফরকালে ফির’আওন তাঁর স্ত্রী সারা’র প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে দরবারে ডাকে। পরে সারা’র দোয়ার প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ ফির’আওনকে পরাস্ত করেন ও সারা’কে হেফাযত করেন। ফির’আওন এ পুণ্যশীলা রমণীকে চিনতে পেরে নিজ কন্যা হাজেরাকে সারা’র খেদমতে তুলে দেন এবং সারা নিঃসন্তান থাকায় যখন তার সন্তান গর্ভধারণ করার বয়স চলে যায় তখন সন্তানের আশায় হাজেরাকে ইবরাহীম আঃ সাথে বিয়ে দেন।
ফিলিস্তিন সফরকালে হাজেরার গর্ভ হতে ইসমাঈল আঃ এর জন্ম হয়। আল্লাহর হুকুমের কারণে ইবরাহীম আঃ স্ত্রী-সন্তানকে আল হেজাজের বিরান প্রান্তরে নিয়ে আসেন। একটা টিলার মত উঁচু মাটির টিবির পাশে এক গাছের নিচে স্ত্রী ও সন্তানকে রেখে আল্লাহর হাওলা করে ছেড়ে চলে আসেন। বিরান মরু ভূমি প্রান্তরে- সেখানে কোন জন মানুষের বসতি ছিল না, ছিলনা পানির ব্যবস্থা। । তাদের পানি ফুরিয়ে গেলে আল্লাহর রহমতে শিশু ইসমাঈল আঃ পায়ের নিচ থেকে পানির ফুয়ারা বের হয়ে আসে। যাকে এখন যমমের কুপ বলা হয়।
ইয়েমেন থেকে জুরহুমে সানি বা দ্বিতীয় জুরহুম এসে হাজেরার বিবির অনুমতিক্রমে এই যমযম কুপের পাশে বসতি স্থাপন করে। ইবরাহীম আঃ স্ত্রী-পুত্রকে দেখাশোনার জন্য অন্তত চার বার এই উপত্যকা আসেন-
প্রথম বার:- ইবরাহীম আঃ কে আল্লাহ্ স্বপ্নে দেখান যে, তিনি পুত্র ইসমাঈলকে যবেহ করছেন, এটি ছিল একটি নির্দেশ। এতে পিতা-পুত্র উভয়েই রাযী হলেন, প্রস্তুতি নিলেন এবং পিতা পুত্রকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে যবাই করতে উদ্যত হলেন। আল্লাহ্ এ কঠিন পরীক্ষায় ইবরাহীম আঃ কে পুরোপুরি উত্তীর্ণ পেলেন এবং তাঁকে দান করলেন কোরবানির গৌরব।
বাইবেল বলে ইসমাঈল ইসহাকের চেয়ে তের বছরের বড় ছিলেন আর কোরআন কোরবানির ঘটনা বর্ণনার পর ইসহাকের জন্মের সুসংবাদ দেয়। তাই ইসমাঈলের যুবক হওয়া পর্যন্ত ইবরাহীম আঃ মাত্র একবার মক্কা সফর করেন বলে প্রমাণিত হয়।
দ্বিতীয় বার:- ইসমাঈল যুবক হলেন, জুরহাম গোত্র থেকে আরবি ভাষা শিখলেন, তাদের এক কন্যার সাথে বিবাহে আবদ্ধ হন, এরপর হাজেরার ইন্তেকাল ঘটে। এবারের সফরে ইবরাহীম আঃ-এর সাথে পুত্রের সাক্ষাত হয়নি, পুত্রবধূ অভাবের কথা জানালে পিতা পুত্রের জন্য বার্তা রেখে গেলেন যে, ‘সে যেন ঘরের চৌকাঠ পাল্টে ফেলে’। পিতার বার্তা বুঝতে পেরে ইসমাঈল স্ত্রীকে তালাক দেন এবং পরে জুরহাম গোত্রের সর্দার মাজায ইবনে আমরের কন্যাকে বিয়ে করেন।
তৃতীয় বার: এবারেও পুত্রের সাথে দেখা হয়নি, পুত্রবধূকে সাংসারিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি আল্লাহর প্রশংসা করেন। পুত্রবধূর মুখে সংকটেও আল্লাহর প্রশংসা শুনে সন্তানের জন্য বার্তা রাখেন যে, ‘সে যেন তার ঘরের চৌকাঠ ঠিক রাখে’। এরপর তিনি ফিলিস্তিন ফিরে যান।
চতুর্থ বার: এবার পুত্রের সাথে সাক্ষাত হয়।এবারে আল্লাহর নির্দেশে পিতা-পুত্র মিলে পাশের মাটির টিবি খুঁড়ে মাটিতে মিশে যাওয়া কাবা ঘরের ভিত্তি বের করে তার উপর নতুন করে দেয়াল তুলে কা’বা ঘর নির্মাণ করেন এবং ইবরাহীম আঃ সবাইকে হজ্জ পালনের আহ্বান জানান। এরপর থেকে এই জনপদের নাম বাক্কা মক্কা বলে পরিচিত হয়।
প্রাচীন কাল থেকে জজিরাতুল আরব জজিরাতুল আল হেজাজ, জজিরাতুল ইয়েমেন, জজিরাতুল নজফ নামক বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। প্রাচীন নগরের মধ্যে হেজাজে জেদ্দা, মক্কা, মদিনা, ইয়েমেনে সানা, নজফে রিয়াদ প্রভৃতি ছিল। সে সময় যেমন মক্কাকে বাক্কা মদিনাকেও ইয়াতরিব নামে পরিচিত ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকে মক্কাকে মক্কা আল মোক্কারম এবং ইয়াতরিবকে মদিনা-তুন -নবী বা মদিনা আল মনওয়ারা বলে পরিচিতি লাভ করে। মদিনা বলতে যে কোন শহরকে বুঝা তা আরবরা জানে কিন্তু আমরা যারা নন আরব তারা কিন্তু মদিনা বলতে মদিনা তুন নবীকে বুঝে থাকেন। এটি কিন্তু সঠিক নয়।
জেদ্দার অবস্থান হল-লোহিত সাগরের তীরে। এটি একটি বিখ্যাত বন্দর নগরী। বন্দরের মাধ্যমে তখন বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে বাণিজ্যিক জাহাজ আসা যাওয়া করত। এই জেদ্দার পূর্বে ৭৩ কিলোমিটার দূরত্বে মক্কার অবস্থান। আবার মক্কা থেকে উত্তরে ৩৪০ কিলোমিটার দূরত্বে মদিনার অবস্থান।
৯৬৬ খৃঃ থেকে ১৯১৬ খৃঃ পর্যন্ত বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অধীনে মক্কা শরীফ ও মদিনা উপ শরিফের দ্বারা শাসিত হয়ে আসছিল। অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পর আল হেজাজে আবার নিজদের ২য় রাষ্ট্র কায়েম হয়। পরে আব্দুল আজিজ আল সৌদি নামক এক ব্যক্তি জজিরাতুল হেজাজ এবং জজিরাতুল নজদকে এক করে ১৯৩২ খৃঃ আজকের এই সৌদি আরব রাষ্ট্র গঠন করেন।