ডেড সী বা মুতসাগর সম্পর্কিত অনেক রূপক কাহিনী প্রচলিত আছে তবে প্রায় ৯০০ টির মত প্রাচীন তথ্য আবিষ্কার করা হয়েছে ১৯৪৭-১৯৫৬ সালের মধ্যে । এই নথিগুলো থেকে একটি তথ্য পাওয়া যায় যে এই মৃতসাগরটি ১০০ খ্রিষ্টপূর্বের আগে তৈরি হয়েছে হিব্রু ভাষায় কপারশিটে লিখিত কয়েকটি ডকুমেন্ট পাওয়া গেছে । যেগুলোতে রয়েছে কোথায় কোথায় মহামূল্যবান রত্নভান্ডার ছিল সেগুলোর লিস্ট। অনেকেই বিশ্বাস করে যে ডেড সি বা মৃতসাগর থেকে কিছুটা দূরে ১ বিলিয়নেরও বেশী ডলারের স্বর্ন ও রৌপ্য এখানে লুকিয়ে রয়েছে । এই সাগরের আরও কয়েকটা নাম আছে যেমন সি অফ সোডোম, সি অফ লট, সি অফ এ্যাসফ্যান্ট, স্টিংকিং সি, ডেভিলস সি ইত্যাদি ।
এই সাগরটির অবস্থান ইসরাইল , জর্ডান ও সিরিয়ার মধ্যখানে । সী লেভেলের ৪০০ মিটার বা ১৩২০ ফিট নিচে ও ইসরায়েলের পূর্বাংশে অবস্থিত ডেড সী বা মৃতসাগর যা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা নিম্নবর্তী স্থান হিসেবে পরিচিত । ডেড সী বা মৃতসাগরকে মৃত বলার কারণ হচ্ছে এই সাগরে কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক জাতীয় অণুজীব ছাড়া কোন মাছ ও জলজ প্রাণী বাঁচে না । এর উত্তর অংশ জর্ডানের , দক্ষিণ অংশ জর্ডান এবং ইসরাইলের যৌথসম্পত্তি । এর আয়তন ১০২০৪ বর্গকিমি । ডেড সী এর সবচেয়ে মজার এবং
রহস্যজনক ব্যাপার হচ্ছে এই সাগরে কোন জীবিত মানুষ ডুবে যায়না । এর কারন হচ্ছে ডেড সী এর প্রচুর পরিমাণ লবন এর উপস্থিতি । অন্যান্য মহাসাগরের লবনের পরিমান যেখানে ৫-৬% সেখানে ডেড সীতে লবনের পরিমান ২৫-৩০% । লবণে ভরা এমন পানিকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ব্রাইন । লবনের এই অতিরিক্ত উপস্থিতি ডেড সী এর পানির ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয় । তাই মানুষ অনায়াসে এই পানিতে ভেসে থাকতে পারে ।
অপরদিকে জীবিত মানুষের শরীরে যে চর্বি থাকে তার ঘনত্ব ডেড সীর পানির ঘনত্ব অপেক্ষা অনেক কম হয়ে থাকে। মানুষের শরীরের এই কম ঘনত্ব পানির প্লবতা বলকে বাড়িয়ে দেয় । প্লবতা হচ্ছে কোন তরল পদার্থে অন্য কোন পদার্থ নিমজ্জিত করলে তরল পদার্থ কর্তৃক উপরের দিকে এক প্রকার বল প্রয়োগ করে এবং ওই পদার্থের ওজনকে বাঁধা দেয় । এই বাধাদানকারী বলই হচ্ছে প্লবতা বল । যদি বস্তুর ওজন বেশি হয় বস্তু ডুবে যায়, আর যদি প্লবতা বেশী হয় তবে বস্তু ভেসে থাকে । কিন্তু মৃত সাগরের পানির প্লবতা এতই বেশি যে বস্তুর ওজন অনেক বেশি হলেও বস্তুকে ঢুবানো বেশ কঠিন ।
এটি আসলে একটি লবণাক্ত হ্রদ । প্রায় তিন মিলিয়ন বছর আগে জর্ডান নদী, এখনকার যে মৃত সাগর সেই জলাশয় আর লোহিত সাগর- এই ৩টার পানি মিলে প্রতি বছরই এমন বন্যার সৃষ্টি করতো, ওয়াদি আরাবাহ অঞ্চলকে একেবারে ডুবিয়ে ছাড়তো । আর বারবার ডুবতে ডুবতে লোহিত সাগর থেকে এই মৃত সাগর পর্যন্ত একটা সরু সংযোগ তৈরি হয় । কিন্তু দিনে দিনে সেই ডুবে যাওয়া সরু উপত্যকাটাও একটু একটু করে উঁচু হচ্ছিলো। আর প্রায় ১ মিলিয়ন বছর পর সেটা এতোটাই উঁচু হয়ে গেলো, যে লোহিত সাগরের সঙ্গে মৃতসাগরের সংযোগটাই বন্ধ হয়েগেল । মৃতসাগর হয়ে গেল হৃদ ।
ডেড সীর লবণের পরিমাণ প্রায় ১১৬০০০০০০০০ টন ! জর্ডন নদীর পানিও অত্যন্ত লবণাক্ত প্রবাহিত হয়ে এসে পড়েছে এই হ্রদে । এই প্রতি বছর নদীটি আরও ৮৫০০০০ টন করে লবণ এনে ফেলছে ডেডসিতে ।বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মহাসাগরের পানির তুলনায় ডেড সির পানিতে মিশে থাকা খনিজ উপাদানগুলোর পার্থক্য আছে । মৃত সাগরের পানিতে মিশে থাকা লবণে ১৪% ক্যালসিয়াম ক্লোরাইড, ৪% পটাশিয়াম ক্লোরাইড, ৫০% ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড এবং ৩০% সোডিয়াম ক্লোরাইড রয়েছে। এই পানির ঘনত্ব ১.২৪ কেজি।লিটার । এই সকল উপাদানের কারণে ডেড সির পানির প্লবতা শক্তি পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের পানির প্লবতা শক্তি চেয়ে অনেক বেশি ।
২০০১ সালে মৃত সাগর থেকে পাওয়া ব্রাইন দিয়ে ইসরায়েল প্রায় ২ মিলিয়ন টন পটাশ, ৪৪ হাজার ৯শঽ টন কসটিক সোডা, ২০ হাজার ৬শঽ টন ব্রোমিন, ২৫ হাজার টন ম্যাগনেসিয়াম এবং সোডিয়াম ক্লোরাইড উৎপাদন করে! আর এই লবণ তোলার জন্য কাজ করছে প্রায় ১ হাজার ৬০০ মানুষ! প্রাচীনকাল থেকে এই হ্রদটি মিশরের মমি তৈরির জন্য, সার উৎপাদনের জন্য পটাশসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক খনিজ পদার্থের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে । এই হ্রদ থেকে প্রাপ্ত লবণ ও খনিজ পদার্থ বিভিন্ন প্রসাধনী ও সুগন্ধি দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ।ডেড সি তীরবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলে উট, খরগোশ, খেঁকশিয়াল এমনকি চিতাবাঘ দেখতে পাওয়া যায় । অতীতে জর্ডান নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে প্যাপিরাস এবং পাম গাছে সমৃদ্ধ বনভূমি ছিল । রোমান এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সময় ইক্ষু, সিকামোর এবং হেনা এ অঞ্চলের উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিল । জেরিকোতে বেলসাম গাছের রস থেকে প্রস্তুত করা হত উন্নত মানের পারফিউম এবং সুগন্ধি ।
বর্তমানে মৃত সাগর অঞ্চলটি চিকিৎসা শাস্ত্রের গবেষণাস্থল হয়ে উঠেছে । এর মূলে রয়েছে হ্রদের পানিতে খনিজ দ্রব্যাদির বিপুল উপস্থিতি, বাতাসে এলার্জি উৎপাদক দ্রব্য এবং পরাগরেণুর স্বল্পতা, উচ্চ ভূ-মণ্ডলীয় চাপ, সৌর বিকিরণে অতি বেগুনি উপাদানের কম উপস্থিতি। উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় চাপ, শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকা রোগীদের জন্য বেশ উপকারী । চর্মরোগ সোরিয়াসিস (প্সরিঅসিস্) এর জন্য দীর্ঘসময় সূর্যস্নান বেশ উপকারী । এ অঞ্চলে অতি বেগুনি রশ্মির স্বল্পতা সূর্যস্নানের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে বেশ সহায়ক ভূমিকা রেখেছে । এছাড়া রোগটি নিরাময়ে জন্য মৃত সাগরের লবণও বেশ উপকারী বলে বৈজ্ঞানিকদের গবেষণায় দাবী করা হয়েছে ।