নায়াগ্রা ফলস সম্পর্কে আমরা সকলেই কম বেশি জানি। আমেরিকায় নায়াগ্রা জলপ্রপাত বিখ্যাত এক পর্যটন কেন্দ্র। উত্তর আমেরিকার নিউইয়র্ক ও কানাডার অন্টারিও প্রদেশের সীমান্তে এই নায়াগ্রার অবস্থান। ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’ যেমন আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিচিতির চিহ্ন ঠিক তেমনি ২৮ অক্টোবর ১৮৮৬ সালের আগে নায়াগ্রাই ছিল এখানকার প্রধান আকর্ষণ।
দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ছুটে আসেন প্রকৃতি সৃষ্ট এই জলপ্রপাতের সৌন্দর্য দেখার আশায়। নায়াগ্রার দুটো অংশ। মাঝখানে রয়েছে গোটা আইল্যান্ড। এই আইল্যান্ডের যুক্তরাষ্ট্রের অংশে রয়েছে আমেরিকান ব্রাইডাল ভেল ও কানাডার অংশে রয়েছে হর্স শু জলপ্রপাত। এই তিনটি জলপ্রপাত নিয়ে তৈরি সমগ্র নায়াগ্রা অঞ্চল।
অনুমান করা হয়, আজ থেকে প্রায় দশ হাজার নয়শ বছর আগে এই জলপ্রপাতকে প্রথম চিহ্নিত করা হয়েছিল। পর্যটকদের কাছে এক ভয়ংকর সুন্দর নায়াগ্রা জলপ্রপাত। জলপ্রপাতের দিকে তাকালে একদিকে যেমন ভয়ে আপনার বুক কেঁপে উঠে তেমনি কিছুতেই এর মোহময় আকর্ষণকে আপনি উপেক্ষা করতে পারবেন না।
এই আকর্ষণই অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষকে টেনে আনে নায়াগ্রাকে ছুঁয়ে দেখার কিংবা তার উপর হেঁটে যাওয়ার এক অদম্য বাসনা নিয়ে। এমনি কিছু দুঃসাসী অভিযাত্রীর গল্প দিয়ে সাজানো আজকের এই লেখা।
১৮২৯ সালের অক্টোবরের দিকে স্যাম পেচ নামের এক দুঃসাহসী অভিযাত্রী ঝাঁপ দিয়েছিলেন নায়াগ্রায়। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ঝাঁপ দেয়ার পরও এই ভদ্রলোক কিন্তু বেঁচে গিয়েছিলেন। স্যামের এই অদ্ভুত কাণ্ড আরও অনেক মানুষকে দু:সাহসী করে তোলে। তা ধারাবাহিকতায় রূপ নেয়। স্যামের দেখানো পথ ধরেই হেঁটে চলেছেন নায়াগ্রার নায়করা।
কেউ দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে ভয়ংকর এই জলপ্রপাত পার হয়েছেন, কেউ নিজেদের একটা ব্যারেলে ভরে নিয়ে ভেসে গিয়েছেন জলপ্রপাতের উত্তাল জলস্রোতের মধ্যে, ব্যারেলসুদ্ধ আছড়ে পড়েছেন ১৭৩ ফিট উচ্চতা থেকে। এদের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ফাঁনামবুলিস্ট’।
পরবর্তীতে জানা যায় নায়াগ্রাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে এসব দুঃসাহসী অভিযান করা হয়েছিল। পর্যটকদের মনোরঞ্জনই ছিল যার লক্ষ্য। এজন্য দড়ির উপর দিয়ে হেঁটেও কোন কোন অভিযাত্রী নায়াগ্রা পার হয়েছেন। যেসব নায়ক দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে নায়াগ্রা পার হয়েছেন, তাদের মধ্যে সেরা জাঁ ফ্রাঁসোয়া গ্রাভলো বা দ্যা গ্রেট ব্লঁদ্যা। যিনি ১৮৫৯ থেকে ৬০ সালের মধ্যে মোট ২৩ বার নায়াগ্রা পারাপার করেছিলেন। তার পরেই আছেন সিগনর ফেরিনি, হ্যারি লেসলি, অ্যান্ড্রু প্রোফেসর জেঙ্কিন্স, হেনরি বেলেনি, স্টিফেন পিয়র, জেমস হার্ডিরা। নারীও আছেন একজন, মিসেস এ্যানী টেইলর। এদের সাথে এবার যুক্ত হল নিক ওয়ালান্ডার নাম।
তারা সকলেই চেষ্টা করতেন, দড়ির উপর দিয়ে শুধু না হেঁটে মাঝপথে কিছু কায়দাকানুন করে দেখাতে। এ ব্যাপারে সকলকে টেক্কা দিয়েছিলেন ব্লঁদ্যা। তিনি যখনই নায়াগ্রা পার হতেন, সকলের রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা থাকত, এবার কি খেল দেখতে পাওয়া যাবে!
প্রথমবার এই কাণ্ড দেখতে জড়ো হয়েছিল প্রায় ১০ হাজার দর্শক। তারপর সকলের কাছে ব্লঁদ্যার নায়াগ্রা পার হওয়া নিয়ে কোনো সংশয়ই ছিল না। দর্শক মনোরঞ্জনের জন্য কখনো তিনি ঝুলন্ত তারের উপর দিয়ে দৌঁড়াতেন, একপায়ে দাঁড়িয়ে পড়তেন, উল্টো মুখে হাঁটতেন, কখনো আবার ইচ্ছে করে পড়ে গিয়ে তার ধরে ঝুলে দর্শকদের আতঙ্ক বাড়িয়ে দিতেন। সবচেয়ে রুদ্ধশ্বাস যাত্রা ছিল, যেদিন ইংল্যান্ডের প্রিন্স অফ ওয়েলস অ্যালবার্ট এডোয়ার্ড এসেছিলেন তার খেলা দেখতে। প্রিন্সকে কাঁধে নিয়েই নায়াগ্রা পার হতে চেয়েছিলেন। স্বভাবতই প্রিন্স রাজি হন নি। তখন নিজের ম্যানেজার কলকর্ডকে তিনি আদেশ করেন, তার পিঠে চড়তে। কলকর্ডকে কাঁধে নিয়ে তিনি হেঁটেছেন, যাত্রাপথে ৭ বার থেমেছেন।
সাতবারই কলকর্ডকে পিঠ থেকে নামিয়েছেন। আবার নতুন করে কাঁধে তুলেছেন। আরেক দিনের গল্প ছিল এমন, ব্ল্ঁদ্যা একটা রান্নার স্টোভ নিয়ে তারের উপর দিয়ে হেঁটে মাঝপথে থেমে যান। তারপর স্টোভ জ্বালিয়ে অমলেট বানিয়ে খেলেন। এরপর নায়াগ্রা পার হন। রাতের অন্ধকারেও একাধিক বার তিনি নায়াগ্রা পার হয়েছিলেন।
তার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছিলেন আর একজন ব্যক্তি। নাম তার সিগনর ফেরিনি। এই দুজনের মধ্যে ছিল তীব্র প্রতিযোগিতা। একজন নতুন কিছু করে দেখালেই অন্যজন চেষ্টা করতেন, তার চেয়েও আরও বেশি কিছু করতে। কাঁধে লোক নিয়ে বা অমলেট না বানিয়ে ফেরিনি একটা ওয়াশিং মেশিন নিয়ে গিয়ে নিচে প্রচণ্ড তেজে বয়ে চলা নায়াগ্রা থেকে জল তুলে মেয়েদের কয়েকটা রুমাল কেচেছিলেন।
১৮৫৯ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত এরকম উপায়ে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় নায়াগ্রা পার হওয়া একটা নেশায় পরিণত হয়েছিল। মার্কিন গৃহযুদ্ধের কয়েকটা বছর পর এই খেলা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তারপর আবার শুরু হয়। তখন নায়াগ্রা ফলসকে জয় করার জন্য আরও যেসব খেলা দেখানো হত তা হল, ব্যারেলের মধ্যে ঢুকে জল প্রপাতের সঙ্গে নিচে আছড়ে পড়া, বোটে চেপে জল প্রপাত বেয়ে নিচে নামা বা কোনও কিছুর সাহায্য ছাড়াই জলে ঝাঁপ দিয়ে ভেসে গিয়ে আছড়ে পড়েও বেঁচে ফিরে আসা। স্বভাবতই সকলে বেঁচে ফেরেন নি। অনেকে আবার ভয় পেয়ে মাঝ পথে ফিরেও এসেছেন। এমন খবরও পাওয়া যায়, দারিদ্র্যের হাত থেকে বাঁচতে, নায়াগ্রা পার হতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে অনেকে নিজের প্রাণ দিয়েছেন। ক্রমে নায়াগ্রা পার হওয়া নিষিদ্ধ হয়ে যায়। অনুমতি চেয়েও অনেকদিন অনেকেই হতাশ হয়েছেন। পরবর্তীতে নায়াগ্রা পার হওয়ার জন্য অনুমতি নিতে হত।
এরপর একরকম বন্ধই হয়ে ছিল নায়াগ্রা পার হওয়া। তবে ২০১২ সালের ১৫ জুন, নিক ওয়ালান্ডা নামের এক মার্কিন নাগরিক দুই ইঞ্চি তারের উপর দিয়ে হেঁটে নায়াগ্রা জল প্রপাত পার হয়েছিলেন। কিন্তু নিককে এজন্য কর্তৃপক্ষের কিছু শর্ত মানতে হয়। যেমন: নায়াগ্রা পার হওয়ার জন্য তার শরীরের সঙ্গে সেফটি বেল্ট বাঁধা থাকতে হবে, যাতে নিচে পড়ে গেলেও টেনে তোলা যায়।
কিন্তু সেকালের নায়কদের শরীরে এই বেল্ট থাকত না। তবে নিক যেখান দিয়ে এই জলপ্রপাত পার হয়েছিলেন, সেটি হর্স শু জলপ্রপাতের একেবারেই উপর দিয়ে। ব্লঁদ্যারা পার হতেন জলপ্রপাতের মুখ থেকে খানিকটা সরে গিয়ে, নদীর উপর দিয়ে। কারণ, গোট আইল্যান্ডের কোনও পাথরে তাদের তার বাঁধতে দিতে অস্বীকার করেছিলেন আতঙ্কিত গোট আইল্যান্ডের মালিকরা।
তবে প্রশ্ন জাগে, ব্লঁদ্যা কি পারতেন যেখান দিয়ে নিক নায়াগ্রা পার হয়েছিলেন, ঠিক সেখান দিয়েই পার হতে? ব্লঁদ্যা সম্পর্কে যারা জানেন, তাদের মতে, বেঁচে থাকলে তিনি নিকের এই চ্যালেঞ্জকে প্রত্যাখ্যান করতেন। সেটাই ছিল তার স্বভাব। তিনি চাইতেন, অন্যরা তাঁর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুক, তিনি নন। নিক ওয়ালান্ডা তাই বলেছেন, “আমি ওর উত্তরাধিকারকে বহন করতে চেষ্টা করেছি। আমি চেয়েছি এই শহরের নামের সঙ্গে আমার নামটা চিরকালের জন্য যুক্ত হয়ে যাক”।
দড়ির উপর দিয়ে হাঁটা নিশ্চয় নতুন কিছুই নয়। আমাদের গাঁ- গঞ্জের মেলাতে এরকম দৃশ্য হরহামেশাই দেখা যায়। মানুষের প্রকৃতিকে জয় করার নিয়ত বাসনা থেকেই ভয়ংকর নায়াগ্রা জলপ্রপাত পার হওয়ার এই দীর্ঘ ইতিহাস।