রাচীন এক ধর্মবিশ্বাসীদের নাম ইয়াজিদি সম্প্রদায়। পারস্যের জরাথ্র“স্টের অগ্নি উপাসনার ধারণা থেকে একাদশ শতকে উম্মায়েদ শেখ এই ধর্মবিশ্বাসের গোড়াপত্তন করেন। জরাথ্র“স্ট, খ্রিস্টান ও ইসলাম- এই তিন ধর্মবিশ্বাসের সংমিশ্রণে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাদান সমৃদ্ধ হয়েছে। সব মিলিয়ে পৃথিবীতে অ-আব্রাহামিক ধর্ম বলে পরিচিত। ইয়াজিদি সম্প্রদায় একই সঙ্গে আলো ও অন্ধকারের পূজা করে। তবে বিশেষভাবে সূর্যের উপাসনা করা তাদের ধর্মের অন্যতম অনুষঙ্গ। তাদের মধ্যে পশু কুরবানি ও লিঙ্গ খৎনা করার প্রথাও প্রচলিত। জন্মগ্রহণ ছাড়া এই ধর্মের মানুষ হওয়া যায় না। অন্য ধর্ম গ্রহণ করাও নিষেধ। ইয়াজিদিরা ইয়াজদানকে তাদের প্রভু বলে বিশ্বাস করে। তবে সরাসরি সেই প্রভুর প্রার্থনা করা যায় না। ইয়াজদানের সাতজন দেবতা। এদের মধ্যে সবেচেয়ে মহান হচ্ছেন ময়ূর-দেবতা। ময়ূর-দেবতা ইয়াজিদিদের কাছে মালেক তাউস নামে পরিচিত।
সারা পৃথিবীতে ইয়াজিদি ধর্মবিশ্বাসের প্রায় সাত লাখ মানুষ রয়েছে। তবে এদের সিংহভাগের বসবাস উত্তর ইরাকে। ঐতিহাসিকভাবে জরাথ্র“স্ট, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের কাছে অগ্রহণযোগ্য ইয়াজিদিরা নৃতাত্ত্বিকভাবে ইরাকের কুর্দিশ সম্প্রদায়ভুক্ত। বহুবছর ধরে চাপ, নিপীড়ন ও হুমকির মধ্যে তারা সিনজার পর্বতের আশপাশে বাস করে আসছেন।
১৮ ও ১৯ শতকে অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধীনে ইয়াজিদিরা অন্তত ৭২ বার হামলা ও গণহত্যার শিকার হয়। ২০০৭ সালে উত্তর ইরাকে গাড়ি বোমা হামলায় কয়েকশ ইয়াজিদি নিহত হয়। ইরাক রেড ক্রিসেন্টের মতে নিহতের সংখ্যা ৮০০। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের পর এটাই সর্বোচ্চ নিহত হওয়ার ঘটনা। আইএসের আক্রমণের শিকার হওয়ার আগে আল কায়দা তাদের হত্যার হুমকি দিয়েছিল। বার বার আক্রমণের মুখে ইরাকের ৭০ হাজার ইয়াজিদি (মোট ইয়াজিদি জনগণের ১৫ শতাংশ) ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছে।
উত্তর ইরাকের নিনেভে বসবাসকারী ইয়েজিদিরা সম্ভবত এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম ধর্মীয়গোষ্ঠী।রহস্যময় এই সম্প্রদায়ের উৎপত্তি নির্ণয় খুব একটা সহজসাধ্য নয়।তবে এটা নিশ্চিত যে,এরা আদৌ ইসলামের কোন উপগোষ্ঠী বা শাখা নয়।
ইয়েজিদিদের ইতিহাস আজও রহস্যাবৃত। তবে এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে,তারা এক সুপ্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। জার্মান গবেষক Philip Kreyenbroek এর মত অনেকেই মনে করেন যে, ইয়েজিদিদের ধর্মীয় বিশ্বাস অত্যন্ত প্রাচীন।তবে বহুকাল যাবত এই সম্প্রদায় সম্পর্কে একটি ভুল ব্যাখ্যা প্রচলিত রয়েছে,তা হল ইয়েজিদিরা হচ্ছে ‘শয়তানের পূজারী’। ইসলামে শয়তানের ধারনা রয়েছে,যা ইবলিশ হিসেবে খ্যাত। ইসলামীয় ব্যাখ্যা অনুযায়ী ইবলিশ হল পতিত স্বর্গীয় পুরুষ,কারন সে আল্লাহের আদেশ অগ্রাহ্য করেছিল। একই ভাবে ইয়েজিদিদের ধর্মীয় বিশ্বাসে এক সর্ব শক্তিমানের কল্পনা করা হয়েছেএবং সমগ্র বিশ্বব্যাপী তাঁর অবস্থান।ইয়েজিদিদের শ্রুতি ঐতিহ্যে বিশ্ব সৃষ্টির যে বর্ণনা রয়েছে তা আবার বাইবেলের সাথেও সাযুজ্যপূর্ণ। তাঁরা বিশ্বাস করে যে, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বিশ্ব সৃষ্টির পর তাঁর দূত রূপে ‘তাওসি মেলেক’কে প্রেরন করেন এবং পরবর্তীতে তাঁকে সহায়তা করার আরও ছয় জন দুতকে প্রেরন করা হয়।
অধুনা উত্তর ইরাকের অন্তর্গত নিনেভ প্রদেশের সিঞ্জার পর্বতে ‘তাওসি মেলেক’ এক অপূর্ব সুন্দর ময়ূর রূপে অবতরণ করেন ও নিজের সাতটি রঙের রুপান্তর ঘটিয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলের সৃষ্টি করেন।তবে এরপর তাওসি মেলেক ঈশ্বরের আদেশ অগ্রাহ্য করলে, ঈশ্বর তাঁকে নরকে নিক্ষেপ করে আগুনের কারাগারে বন্দী রাখেন। পরে তাওসি মেলেক গভীর অনুতপ্ত হন ও শেষ পর্যন্ত তাঁর অশ্রুবিসর্জনে আগুন নিভে যায়।পরবর্তীতে ঈশ্বর পুনরায় তাঁকে পৃথিবীতে বাকি ছয় দেবদূতের প্রধান রূপে প্রেরন করেন। ইয়েজিদিরা বিশ্বাস করে যে একজন মানুষের মধ্যে তাওসি মেলেকের মত শুভ-অশুভ এই দুই সত্ত্বারই অস্তিত্ব থাকে।আসলে মানুষকে প্রকৃত শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যেই সে দুই প্রকার রূপ ধারন করেছিল। তবে বিধর্মী মুসলিমরা সর্বশক্তিমানের আদেশ অমান্য করায় তাওসি মেলেক’কে শয়তান বলেই গণ্য করে আর এই কারনেই ইয়েজিদিরা শয়তানের পূজারী।
ইয়েজিদিদের শ্রুতি ঐতিহ্যের সাথে বাইবেলের বেশ কিছু সামঞ্জস্য রয়েছে।যেমন ইয়েজিদি লোকগাঁথায় এডেন উদ্যানের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া আদম ও ইভের প্রসঙ্গ দুই ধর্মেই রয়েছে।সর্বোপরি পতিত দেবদূতের কথাও উভয় দর্শনে রয়েছে। একসময় খৃষ্টান মিশনারিরাও ইয়েজিদিদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেই প্রয়াসও খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। এরপরই মিশনারিরা ইয়েজিদিদের মতাদর্শকে কার্যত নস্যাৎ করে দিয়ে খ্রিস্টীয় মতের অংশ রূপে অভিহিত করেন।
পাশাপাশি মুসলিমদের ন্যায় তাঁরাও ইয়েজিদিদের শয়তানের পূজারী রূপে অভিহিত করতে শুরু করে এবং খৃস্ট ধর্মের পতিত দেবদূত লুসিফারের সাথে তাওসি মেলেকের তুলনা করা হয়। এই সংকীর্ণ মানসিকতাই পরবর্তীকালে পশ্চিমী ঐতিহাসিকদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। কারন তাঁরা ইয়েজিদি ইতিহাস রচনার প্রেক্ষিতে খ্রিস্টীয় চেতনায় অনুপ্রানিত হয়ে প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করে ফেলছেন। এদের মধ্যে অনেকেই আবার নিজেদের মন মত করে দুই খণ্ডে বিভক্ত ইয়েজিদি ধর্মগ্রন্থ সংকলন করে ফেলেন, যেখানে পদে পদে এই স্বকীয় বিশ্বাসকে হেয় করে বাইবেলের শ্রেষ্ঠত্ব উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে জার্মান ঐতিহাসিকরা প্রায় নিরপেক্ষভাবেই এই প্রাচীন মূর্তিপূজারী গোষ্ঠীর ইতিহাস তুলে ধরেছেন,তা স্বীকার করতেই হবে।
দীর্ঘকাল ব্যাপী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও ইয়েজিদিরা নিজদের অতীত ঐতিহ্যকে তেমনভবে ক্ষুণ্ণ হতে দেয়নি।ইয়েজিদি শ্রুতি অনুযায়ী তাঁরাই সর্বপ্রথম এডেন উদ্যানে আবির্ভূত হয়েছিল। উত্তর ইরাকের লালিশ নামক এক সুন্দর পাহাড়ঘেরা গ্রামে ইয়েজিদিদের প্রধান মন্দির অবস্থিত। তাঁরা বিশ্বাস করে যে লালিশ ও তাঁর সন্নিবিষ্ট অঞ্চলেই একসময় এডেন উদ্যানের অস্তিত্ব ছিল। লালিশের মন্দির নিয়েও প্রচুর ধোঁয়াশা রয়েছে। দ্বাদশ শতকের প্রাক্কালে শেখ আদি বিন মুসাফির নামক একজন সুফি সন্ত ইয়েজিদি দর্শনকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। অনেকের মতে,তিনি আবার ছিলেন উম্মায়েদ খলিফা মারওয়ান ইবন আল হাকামের বংশধর। মুসাফির ইয়েজিদিদের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তিনি ইয়েজিদিদের ধর্মীয় পরিকাঠামোর বেশ কিছু সংস্কার সাধন করেছিলেন।
তাই তাঁকে তাওসি মেলেকের অবতার হিসেবে গণ্য করা হয় এবং লালিশের মন্দিরে মুসাফিরের সমাধি রয়েছে। এবার সমস্যা শুরু হল এখান থেকে,কারন ইসলামীয় ধর্মগুরুরা লালিশের মন্দিরের প্রাচীনত্ব নস্যাৎ করে দেন এবং এই মতাদর্শকে ইসলামের বিপথগামী শাখা রূপে উল্লেখ করতে থাকেন।অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইয়েজিদি মতাদর্শে সুফি মতের কিছুটা প্রভাব রয়েছে। তবে কখনই ইয়েজিদিদের ইসলামের শাখা হিসেবে গণ্য করা যায় না এবং ইসলামের চেয়েও এই মতাদর্শ অনেক প্রাচীন। নিছক সাদৃশ্যের প্রেক্ষিতে যারা ইসলাম ও ইয়েজিদি দর্শনকে সমজাতীয় রূপে গণ্য করেন,তাদের আদতে পশ্চিম এশিয়ার প্রাচীন ধর্মমত গুলি সম্পর্কে তেমন ধারনা নেই।
ইয়াজিদিরা আইএসের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হওয়ার কারণ তাদের ধর্মবিশ্বাস। আইএসের ধারণা, ইয়াজিদিরা ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার (৬৪৭-৬৮৩) বংশধর। ইয়াজিদ উমাইয়াদের কাছে ঘৃণিত ব্যক্তি। এছাড়া ইয়াজিদিরা দৈনিক পাঁচবার যে মালেক তাউসের প্রার্থনা করে সেই মালেক তাউসের অন্য নাম শয়তান। আরবিতে যার অর্থ অশুভ আত্মা। তাই আইএসের ধারণা ইয়াজিদিরা শয়তানের আনুগত্য করে।
তবে আধুনিক গবেষকরা বলছেন, ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার সঙ্গে ইয়াজিদিদের সম্পর্ক নেই। এই শব্দটি এসেছে ফারসি শব্দ ইজিদিস থেকে। যার অর্থ ঈশ্বরের পূজারি। ইরাক ছাড়াও ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের লোকরা সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিম ও তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকায় বসবাস করে।