পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকের কথা l ইংরেজদের আক্রমণে বিপর্যস্ত ফ্রান্স l সৈন্যহীন , শক্তিহীন যুবরাজ ডফিন পিছনে সরতে সরতে ফ্রান্সের দক্ষিণ চিনন শহরে
আশ্রয় নিলেন l পরাজয় যখন অনিবার্য , সে সময় আকষ্মিকভাবেই পুরুষের পোশাক পরিহিত এক কিশোরী এসে উপস্থিত l সে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চায় l
মেয়েটির কথা শুনে সকলেই বিস্মিত l অনেকে হেসেও উড়িয়ে দিলেন l কিন্তু যুবরাজ ভাবলেন মেয়েটির কথা মতো একবার শেষ চেষ্টা করে দেখিই না l
জোয়ান অব আর্ক , ফ্রান্সের মুক্তিদাত্রী l ফরাসী কবি ল্যামারটাইন বলেছেন , ” জোয়ান এক দিকে বীরাঙ্গনা অন্যদিকে সন্ন্যাসিনী l একদিকে ফ্রান্সের গৌরব ,
অন্যদিকে লজ্জা l ” …. কেন লজ্জা সে প্রসঙ্গে পরে আসছি l
ফ্রান্সের একটি ছোট গ্রাম ডমবেমিতে জোয়ানের জন্ম l বাবা ছিলেন কৃষক l বাড়ির সামনে বিস্তীর্ণ মাঠে ভাইদের সাথে মেষের পাল নিয়ে বেরোতেন l সারাদিন মাঠে
মাঠে ঘুরে সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে সেলাই শিখতেন , সুতো কাটতেন l কখনওবা গীর্জায় যেতেন l
মাত্র সতের বছর বয়সেই তার মনোজগতে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা দিল l যুদ্ধে কোণঠাসা ফ্রান্সের অবস্থা তাঁকে বিচলিত করল l গ্রামের কচি মেয়ে যুদ্ধে যেতে
চায় শুনে সবাই বাধা দিলেন l বাবা মা কত বোঝালেন , কিন্তু জোয়ান দৃঢ়প্রতিজ্ঞ l পাশে ছিলেন একমাত্র কাকা l কাকা আর ভাইকে নিয়ে সেনাপতি রবার্টের দুর্গের দিকে
যাত্রা করলেন জোয়ান l সেনাপতি তাঁকে অবিশ্বাস করলেও জোয়ানের সুন্দর চেহারা আর বুদ্ধিদীপ্ত কথায় যুবরাজ ডফিনের বিশ্বাস হল l
চার হাজার সৈন্য এগিয়ে চলল অর্লিয়েনসের দিকে l মধ্যে কালো ঘোড়ায় চেপে পুরুষের পোশাক , কোমরে তলোয়ার আর হাতে সাদা পতাকা নিয়ে জোয়ান l চারদিকে
ছড়ানো হল ফ্রান্সের রাজবংশের প্রতীক আইরিশ ফুল l জোয়ান আর তাঁর সৈন্যদের অতর্কিত আক্রমণে ইংরেজ সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গেল l সেনাদল এগিয়ে
চলল l একটার পর একটা শহর দখল করল l এরপর patay এর প্রান্তরে এসে বিশাল ইংরেজ বাহিনীর সামনে পড়েও মনোবল হারাননি জোয়ান l মরণপণ লড়াইয়ের পর
জয়ী হয়ে যুবরাজ ডফিনের রাজপ্রাসাদে ফিরে এলেন l ডফিন তাঁর পারিষদ নিয়ে অপেক্ষাতেই ছিলেন l অভিনন্দনের জোয়ার বয়ে গেল l কিন্তু কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন
জোয়ান l যুদ্ধের বিভৎসতা তাঁকে মানসিকভাবে আহত করল l এত মৃত্যু এত রক্ত তিনি সইতে পারলেন না l
ফ্রান্সের প্রাচীন রেইম শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে যুবরাজ ডফিনকে সম্রাট ঘোষণা করা হল l তাঁর নতুন নামকরণ হল , সপ্তম চার্লস l
জোয়ান এবারে বিদায় নিতে চাইলেন l সম্রাটকে বোঝালেন সবুজ বনানীতে ঘেরা তাঁর গ্রাম তাঁকে ডাকছে l তাঁর মা – বাবা – ভাইদের কাছে তিনি ফিরে যেতে চান l কিন্তু
সম্রাট নারাজ l রাজধানী প্যারিস ও ফ্রান্সের কিছু অঞ্চল তখনও ইংরেজের দখলে ছিল l সম্রাট সেসব উদ্ধার করতে চাইলেন জোয়ানের সহায়তায় l নিরুপায় জোয়ান
আবার যুদ্ধে গেলেন l কিন্তু ইংরেজ ও বার্গানডির ডিউকের সম্মিলিত বাহিনীর কাছে পরাজিত হলেন চার্লস l সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেল ফ্রান্সের মানুষ l এ পরাজয়ের জন্য
তারা জোয়ানকেই দায়ী করলেন l যুদ্ধে তবু শেষ চেষ্টা করেছিলেন জোয়ান l কিন্তু তিনি ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ে যান এবং বন্দী হন বার্গানডির ডিউকের সেনাপতি
লুক্সেম্বার্গের হাতে l জোয়ানের বয়স তখন মাত্র ঊনিশ l
জোয়ানের মাথার দাম দশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা , ইংরেজরা আগেই ঘোষণা করেছিলেন l সেই লোভে লুক্সেম্বারগ ইংরেজদের কাছে জোয়ানকে বিক্রী করে দেন l শুরু হল
বিচারের নামে প্রহসন l তাতে সামিল হলেন ধর্মযাজকরা , বিভিন্ন কলেজের অধ্যাপকরা l কারণ মেয়ের বয়সী জোয়ানকে তাঁরা হিংসা করতেন l জোয়ানের জনপ্রিয়তা
তাঁরা মানতে পারেন নি l মোট বাহাত্তর ( ! ) টি অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে আনা হল l যেমন , জোয়ান ডাইনী , সে ধর্মীয় অনুশাসন অস্বীকার করেছে , সে ব্যভিচারিণী
ইত্যাদি ইত্যাদি l একা জোয়ান বিচারকদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন l কেউ তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি l চীরকালই মেরুদন্ডহীন সপ্তম চার্লস সেদিনও মেরুদন্ডহীনই রইলেন
l অকৃতজ্ঞ সম্রাট একটা কথাও বলেননি জোয়ানের হয়ে l তিনি যদি সচেষ্ট হতেন হয়ত জোয়ানের মৃত্যুদণ্ডটা এড়ানো যেত l ইংরেজরা জোয়ানকে পুড়িয়ে মারার
সিদ্ধান্ত নিলেন l
জোয়ান বিশ্বাস করতে পারেননি তাঁর ঊনিশ বছরের শরীরটা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে l বিচলিত জোয়ান পুরুষের পোশাক ছেড়ে নারীর পোশাকে আকুতি জানান , তিনি
বাঁচতে চান l সে আকুতি কারোর কানে পৌঁছয়নি l দুদিন সাংঘাতিক মনোকষ্টের পর মনে জোর পান জোয়ান l প্রকাশ্য রাস্তায় একটা মঞ্চের ওপর তাঁকে বাঁধা হল l
শেষবারের মতো তাঁকে প্রার্থনা করতে দেওয়া হল l এরপর তাঁর গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হল l লেলিহান শিখায় আবৃত হয়ে গেলেন সাহসিনী জোয়ান অব আর্ক l
একটা ঊনিশ বছরের মেয়ে , যাকে পুড়িয়ে মারল বাবার বয়সী মানুষেরা l আর সপ্তম চার্লস ? তাঁর ভূমিকাটা কি ছিল ? জোয়ানের নৃশংস মৃত্যুর পরেও সিংহাসনে বসতে
একবারও তাঁর বুক কাঁপেনি ? নির্লজ্জতার চূড়ান্ত উদাহরণ এই মানুষগুলো l যে অবিচারের শিকার জোয়ানকে হতে হল , তা সমগ্র মানব জাতির লজ্জা !
কিন্তু অনুতাপ এক সাংঘাতিক মানসিক প্রতিক্রিয়া l জোয়ানের শরীরটা পুড়ে শেষ হয়ে গেল আর অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হতে লাগল সপ্তম চার্লসের অন্তর l তাঁরই
উদ্যোগে আরও চোদ্দো বছর পরে পোপ জোয়ানের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ পুনর্বিচারের আদেশ দিলেন l প্রতিটি কাগজপত্র , জবানবন্দী খুঁটিয়ে দেখে বিচার করা
হল l দেখা গেল জোয়ানের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যে l
পৃথিবীর ইতিহাসে দাগ রেখে যাওয়া বীরাঙ্গনা জোয়ান অব আর্ক , 6th January যাঁর জন্মদিন ছিল l আগুনে পোড়ালেই ইতিহাস শেষ হয় না l একটা ঊনিশ বছরের
জীবন সে কথাই প্রমাণ করেছে l কুর্নিশ জানাই এই তেজস্বিনীকে l