টল
দিঘা, না দার্জিলিঙ?
তাই থেকে মুখ দেখাদেখি নেই!
মানে, না থাকাই উচিত ছিল। কিন্তু এক বাড়িতে বাস করে এক খাবার-ঘর এক সিঁড়ি এক বারান্দায় চলতে ফিরতে হলে তা আর কী করে সম্ভব?
তার বদলে বাক্যালাপ তাই বন্ধ।
বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনে আজ প্রায় এক হপ্তা ধরে রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার অবস্থা চলেছে। মনান্তর চরমে উঠে বৈদেশিক দূতাবাসে তালা-চাবি পড়বার পর তৃতীয় শক্তির মারফত যেমন কথা চালাচালি হয় আমাদের চলছে তাই।
কার সঙ্গে এ সম্পর্কচ্ছেদ?
না, বাহাত্তর নম্বরে বিপর্যয়ের খবর শুনলেই যা হয় তা এবার নয়। ঘনাদা সম্বন্ধে ভাবিত হবার কিছু নেই। এবার গৃহযুদ্ধের মহড়া যা চলেছে তা আমাদের নিজেদের মধ্যে। একদিকে শিশির আর শিবু, আর একদিকে গৌর আর আমি। আমাদের দুই জোটের মধ্যে এখন সব সম্পর্ক ছিন্ন।
সম্পর্ক ঘুচিয়ে ফেলতে চাইলেও একই আস্তানার বাসিন্দা হিসাবে খবর দেওয়া-নেওয়া আর সুযোগমতো খোঁচা দেওয়ার কাজটা তো চালাতে হয়। তার জন্য মধ্যস্থ কাউকে না হলে চলে না।
খাবার ঘরে জমায়েত হবার সময় অবশ্য পুরনো ঠাকুর রামভুজ আমাদের ভরসা।
গৌরের হয়তো নুনের বাটিটা দরকার। আর দরকার থাক বা না থাক, বাটিটা যখন শিশিরদের টেবিলে তাদের পাতের কাছাকাছি তখন গলাটা একট তেতো করে বলতেই হয়, এ ঘরে একটা নোটিশ টাঙাতে হবে, বুঝেছ, রামভুজ?
হাঁ, বাবু! বুঝুক না বুঝুক, রামভুজ তৎক্ষণাৎ এক কথায় সায় দেয়। আমাদের গৃহযুদ্ধের ঝামেলা এড়াবার এই সোজা ফিকির সে বার করে ফেলেছে।
কী নোটিশ আবার? আমিই কৌতূহলটা প্রকাশ করে প্রসঙ্গটা চালু রাখি।
এই বলে নোটিশ যে, গৌর আমাকে বোঝাবার জন্যে গলাটা প্রায় গলির ওপার পৌঁছোবার মতো ছড়িয়ে দিয়ে বলে, বাহাত্তর নম্বরের এজমালি কোনও জিনিস কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়।
ওপক্ষের পালটা জবাবটা সঙ্গে সঙ্গেই শোনা যায়।
শিশির যেন শুধু শিবুকে শোনাতেই মাইক-ফাটানো গলায় বলে, ক-দিন ধরে ভাবছি বাহাত্তর নম্বরের একটা নতুন নিয়ম করলে কী রকম হয়।
নিশ্চয়! নিশ্চয়! শিবু সমর্থনের উৎসাহে সজোরে টেবিল চাপড়ে আমাদের থালাবাটিগুলো ঝনঝনিয়ে তোলে, একটা কেন! এখানে সব নিয়ম এবার নতুন হওয়া দরকার!
টেবিল চাপড়ে থালা-বাটি কাঁপানোর জবাবে চোখা চোখা ক-টা বাক্যবাণ জিভের ডগায় এলেও শিশিরের প্রস্তাবিত নিয়মটা জানবার কৌতূহলে নিজেদের সামলে রাখতে হয় তখনকার মতো।
তেলে-বেগুনে জ্বালিয়ে তোলবার মতো নতুন নিয়মটা ঘোষণা করতে শিশিরের। দেরি হয় না। যেন তেঁড়া পেটার মতো গলায় সে ঘোষণা করে, বাহাত্তর নম্বরে ঠুটোদের জায়গা নেই!
গৌর ও আমি দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। আমাদের বলে কিনা ঠুটো! মানে— নুনের বাটিটা হাত বাড়িয়ে নেবার ক্ষমতা আমাদের নেই?
অ্যাপলোর বদলে একটা ভোস্টক ছাড়বার পায়তাড়াই তারপর কষতে হয়। মাঝে থেকে খাওয়ার পালাটাই মাটি। পাতে কী পড়ে আর পেটে কী যায় তা খেয়ালই থাকে না।
এমনই চলছে আজ প্রায় এক হপ্তা। হিসেব করে বললে, পাক্কা ছ-দিন। এই শনিবারেই হপ্তা ঘুরে আসবে।
আরম্ভ হয়েছিল কীসে?
কীসে আর? শিশির-শিবুর একগুঁয়ে আহাম্মকিতে।
আমরা তো কাজ প্রায় পনেরো আনা হাসিল করে এনেছিলাম। শুধু টিকিট কটা কিনলেই হয়। টাইম টেবল দেখে ক-টার ট্রেন স্টেশনে কখন পৌঁছবে, নেমে কী করব, কোথায় যাব সব ঠিক করা হয়ে গিয়েছিল। যাঁর জন্য এত তোড়জোড় তিনিও
তো সায়ই দিয়েছিলেন বলা যায়।
চুপ করে থাকা মানেই তাই নয় কি? তিনি মুখ বুজে ভুরু-টুরু কুঁচকে বেশ মন দিয়েই সমস্ত পরিকল্পনাটা শুনেছিলেন। ভুলেও একবার কই উলটো কিছু তো বলেননি।
শিবু-শিশির কী কাজে কে জানে বেরিয়েছিল। তারা ফিরে আসতেই বিজয়গর্বে আহ্লাদে আটখানা হয়ে খবরটা তাদের শুনিয়েছিলাম।
এমন একটা সুসংবাদে কোথায় নেচে উঠবে আনন্দে, না দুজনেই চোখ পাকিয়ে মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, কী? কোথায় যাবেন ঘনাদা?
দিঘা! সমস্বরে সোল্লাসে জানিয়েছিলাম আমি আর গৌর।
দিঘা! দিঘা যাবেন ঘনাদা তোমাদের সঙ্গে? শিশির-শিবু হেসেই খুন হয়েছিল। এমন আজগুবি মজার কথা কেউ যেন কখনও শোনেনি।
মেজাজ এতে গরম হয় কি না!
তবু নিজেদের সামলে যথাসাধ্য গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ঘনাদা আমাদের সঙ্গে দিঘা যাচ্ছেন তাতে হাসবার কী আছে?
না, হাসবার আর কী আছে! শিবু ব্যঙ্গ করেছিল, টালার ট্যাঙ্কে ইলিশের গাঁদি লেগেছে বললেও হাসবার কিছু নেই।
তার মানে কী, বলতে চাও কী? এবার গলা না চড়িয়ে পারা যায়নি, ঘনাদা দিঘা যাচ্ছেন না?
না, যাচ্ছেন না। শিশির মুচকে হেসে যেন সরকারি গেজেট থেকে পড়ে শুনিয়েছিল, কারণ তিনি যাচ্ছেন দার্জিলিঙ।
দার্জিলিঙ! ঘনাদা যাচ্ছেন দার্জিলিঙ! এবার আমাদের হাসবার পালা! তোমাদের সঙ্গে নিশ্চয়! ব্রেজিলের পেলে খেলচেন বেনেপুকুরের বি টিমে!
হাসাহাসি তো নয়, একেবারে আদা-জল-খাওয়া রেষারেষি।
ঘনাদাকে যেমন করে তোক আমাদের সঙ্গে দিঘা নিয়ে যেতেই হবে।
মৌ-কাটা খুব ভাল পাওয়া গিয়েছিল। ছুটি-টুটির সময় নয়, কিন্তু কী সব বোমা ফাটাফাটি হয়ে স্কুল কলেজের পরীক্ষা-টরিক্ষা সব বন্ধ। রাস্তার হাঙ্গামা সামলাতে পুলিশ বাড়ন্ত বলে খেলার মাঠের রেফারি লাইনসম্যানেরা সব মার খেয়ে খেয়ে ধর্মঘট করেছে। কলকাতা শহরের অরুচির মুখটা ক-দিনের জন্য বদলে আসার এই সুবর্ণ সুযোগ।
ঘনাদার নিজের মুখেই তার একটু ইশারা একদিন পেয়ে উৎসাহটা আরও বেড়ে গিয়েছিল।
কাগজ খুললেই তো এখানে বোমা, ওখানে কাঁদানে গ্যাস, সেখানে গুলি। কোন এলাকায় কখন যে কী বাধবে কেউ জানে না।
ঘনাদা ক-দিন ধরে তাঁর সান্ধ্যভ্রমণটি বাতিল করেছেন।
সকালবেলা খবরের কাগজটির প্রথম পাতার শিরোনামা থেকে শেষ পাতার তলায় মুদ্রাকরের নাম ঠিকানা পর্যন্ত খুঁটিয়ে পড়া তাঁর প্রতিদিনের রুটিন।
সন্ধেবেলার বেড়ানো হঠাৎ বন্ধ করার সঙ্গে সকালের কাগজ পড়ার বিশেষ সম্পর্ক আছে বলেই আমাদের সন্দেহ।
ঘনাদা বিকেল না হতে কদিন ধরে আমাদের বৈঠকি ঘরই অলংকৃত করছেন। কিন্তু ওই দর্শন দেওয়া পর্যন্তই। আমাদের কপালে কণ্ঠসুধা বর্ষণ কিছু হয়নি। টঙের ঘর থেকে যে গড়গড়াটা বনোয়ারিকে দিয়ে নিত্য নীচে বয়ে আনিয়ে আবার যথাসময়ে ওপরে তোলান, শুধু তারই তরল ধ্বনি বেশির ভাগ আমাদের শুনতে হয়।
বুঝেসুঝে মাত্রা মতো একটু খোঁচা দিলে ঘনাদার কণ্ঠ থেকে তার চেয়ে সরস যদি কিছু ঝরে এই আশায় সে দিন একটু বাঁকা সুরেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বিকেলের বেড়ানো বুঝি ছেড়ে দিলেন, ঘনাদা? তা, যা দিনকাল, বাড়ি থেকে বেরুবার বিপদও আছে।
বিপদ! ঘনাদার মনে গিয়ে লেগেছিল কথাটা। বেশ একটু চিড়বিড়িয়ে বলেছিলেন, বিপদ আছে তো হয়েছে কী? বিপদের জন্য কি বেড়ানো ছেড়েছি?
ঠিক! ঠিক! শিবু-শিশিরের দু জোড়া চোখ আমায় যেন ঘৃণায় ভস্ম করতে চেয়েছিল, বিপদের ভয় করবেন ঘনাদা? কলম্বাসের ভয় নালা ডিঙোতে! নেপোলিয়ন কাঁপবেন ঘোড়ায় চড়তে!
গৌর সঙ্গে সঙ্গে যেন আমার বেয়াদপির জন্য মাপ-চাওয়া মিহি গলায় জিজ্ঞাসা করেছিল, সত্যি বেড়ানোটা বন্ধ করলেন কেন বলুন তো?
কেন করলাম? ঘনাদা আমাদের আর সেই সঙ্গে সমস্ত কলকাতা শহরের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে বিষোদগার করে বলেছিলেন, এ শহরে বেড়াবার জায়গা আছে কোথাও? ওই তো তোমাদের গড়ের মাঠের উঠোন থেকে লেকের খিড়কি পুকুর! তাও গিজগিজ করছে যত বেতো, হাঁপানি আর অম্বুলে রুগিতে। বুক ভরে দম নেবার, পায়ের খিল ছাড়িয়ে ছোটবার, আকাশ ছাড়িয়ে চোখ মেলবার আছে কোনও জায়গা?
ব্যস! আর কিছু শোনার দরকার হয়নি। ওইটুকু ইশারাই আমাদের যথেষ্ট।
তৎক্ষণাৎ কাজে লেগে গেছি। দুজনে এক কামরারই বোর্ডার বলে প্রথমে গৌরের সঙ্গেই পরামর্শটা হয়েছে। শিশির শিবুকে তারপর জানাতে গিয়ে খুঁজে পাইনি। না পেলেও ভাবনা হয়নি কিছু। এমন একটা মতলব শোনামাত্র তারা যে লুফে নেবে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ তখন আমাদের নেই।
পছন্দমতো জায়গার নামটাও জলদি মাথায় এসে গেছে খবরের কাগজের পাতা ওলটাতে ওলটাতে, সেই ঝাউগাছ মার্কা ছবিটা দেখে।
দিঘা! এর চেয়ে জুতসই জায়গা আর হতে পারে না। শুধু ঘনাদাকে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেবার জন্যই যেন জায়গাটা এতদিন ধরে তৈরি হয়ে আছে।
বুক ভরে নিশ্বাস নেবেন ঘনাদা? তা নিন না! সমস্ত বে অফ বেঙ্গলের হাওয়াই তিনি ভরে নিন না ফুসফসে!
পায়ের খিল ছাড়িয়ে ছুটবেন? তা কেয়া আর ঝাউ ঝোপ বাঁচিয়ে ছুটুন না বালির চড়া ধরে সেই কন্যাকুমারী অবধি।
আর দিগন্ত ছাড়িয়ে চোখ মেলতে চান? তা বঙ্গোপসাগর ছাড়িয়ে প্রশান্ত মহাসাগরই পার হয়ে যাক না তাঁর দৃষ্টি।
না, দিঘা যেন আমাদের ওপর দৈবের দয়া!
টুরিস্ট অফিসের পুস্তিকা-টুস্তিকা জোগাড় করে টাইম টেবল দেখে-টেখে প্রথমেই টঙের ঘরে উঠে ঘনাদাকে সুসংবাদটা জানিয়েছি।
গড়গড়ার টান দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে ঘনাদা বেশ মনোযোগ দিয়েই প্রস্তাবটা শুনেছেন। শুনে হুঁ হাঁ কিছু করেননি। অবশ্য তা করবেন-ই বা কেন? আনন্দ যতই হোক, তাতে ধেই-নৃত্য করা তো আর তাঁর সাজে না!
কবে কোন গাড়িতে রওনা হব তাঁকে জানিয়ে সঙ্গে কী কী নেওয়া হবে তারই একটা ফিরিস্তি করতে আমরা নীচে নেমে গেছি।
সেই নীচে নামতেই শিশির শিবুর সঙ্গে দেখা আর তারপর থেকেই গৃহযুদ্ধ শুরু—দার্জিলিঙ, না দিঘা!
শিশির-শিবু ঘনাদাকে নিয়ে যাবে-ই দার্জিলিঙ।
আমরাও নাছোড়বান্দা। তাঁকে দিঘায় না নিয়ে ছাড়ব না।
প্রথমে তর্কাতর্কি ঠাট্টা টিটকিরি, তারপর বাক্যালাপই বন্ধ।
দিঘা ছেড়ে যারা দার্জিলিঙ যেতে চায় তারা কি কথা বলার যোগ্য!
পারতপক্ষে এক জায়গায় এক সঙ্গে থাকি না। খাবারঘরে মাঝে মাঝে যা বাধ্য হয়ে পরস্পরের সঙ্গ সহ্য করতে হয়। ঠারেঠোরে ঠোকাঠুকিটা তখনই বাধে।
তা না হলে এ জোট ও জোটের ছায়াই মাড়ায় না। আসরঘরে ওরা ঢেকে তো আমরা বেরিয়ে যাই। টঙের ঘরের সিঁড়ি দিয়ে ওরা নামে তো আমরা উঠি।
হ্যাঁ, টঙের ঘরে সুবিধা পেলেই গিয়ে হাজিরা দিতে হয় বই কী!
শুধু হাতের হাজিরা নয়, সঙ্গে থাকে এবেলা ওবেলা হরেক রকম প্রণামী। সকালে যদি হিঙের কচুরির থালা হয় তো বিকেলে জিরের জলের বাটি বসানো ফুচকার কাঁসি।
প্রণামী আবার বাজারের হাওয়া বুঝে বদলাতেও হয়। ওরা কড়া পাক আমদানি করেছে বলে যদি আঁচ পাই তো আমরা তালশাঁসের রেকাবি সাজিয়ে তার ওপর টেক্কা দিই। ওদের কবিরাজি কাটলেটকে কানা করতে আমরা খোদ পার্ক স্ট্রিটের সেরা দোকানের সসেজ-রোল না আনিয়ে ছাড়ি না।
তা, এমন তোয়াজ না পেলে ঘনাদা ঘাড় কাত করবেন কেন? বাজিমাত আমরা তাইতে এক রকম করেই ফেলেছি। শনিবার সকালে শুধু তাঁকে স্টেশনে নিয়ে গিয়ে তোলার অপেক্ষা।
শিশির-শিবুর মুখজোড়ায় তখন কেমন ছাই মেড়ে দেয় শুধু তাই দেখবার আশাতেই প্রহর গুনছি।
দার্জিলিঙ! দিঘা ছেড়ে ঘনাদাকে কেমন দার্জিলিঙে নিয়ে যেতে পারে এবার দেখব! দার্জিলিঙ লে দূর, শিয়ালদাতেই নয়, ট্যাক্সি যখন যাবে সোজা হাওড়ায় তখনই ওদের চক্ষু সব কী চড়কগাছ-ই না হবে!
ঘনাদাকে সমস্ত প্রোগ্রামটা ক-দিন ধরেই শুনিয়ে দিয়েছি। প্রোগ্রাম আর সেই সঙ্গে দিঘা-প্রশস্তি।
একেবারে স্বপ্নের রাজ্য, বুঝেছেন ঘনাদা! গৌর নিজেই মধুর আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে বর্ণনা করতে গিয়ে, ঝাউ বনগুলো যেন কোনও রূপকথার দেশের নার্শারি থেকে স্পেশ্যাল অর্ডার দিয়ে আনানো। আর সমুদ্রের তীরের বালি? সে তো বালি নয়, যেন পরীদের হাসি-গুড়োনো ট্যালকম পাউডার।
হুঁ-উ? ঘনাদা বনোয়ারির সযত্নে বয়ে আনা চায়ের ট্রের রং-বেরং-এর পেষ্ট্রি সাজানো প্লেট থেকে পুরুষ্টু ক্রিম রোলটিই প্রথম তুলে অর্ধেক মুখে পুরে গৌরের দিকে যেন সবিস্ময়ে তাকিয়েছেন।
উৎসাহিত হয়ে গৌর আরও অনেক কিছুই বলে গেছে তারপর। জন্মে কখনও দিঘার ধারে কাছে যায়নি বলে তার কল্পনাকে হোঁচট খেতে হয়নি কোথাও।
ক্রিম রোলের পর প্লেটের অর্ধেক পেস্ট্রি সাবাড় করে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে ঘনাদা কোনওবার হয়তো বলেছেন, কিন্তু দীঘার জল নাকি ভাল নয়!
জল ভাল নয়! আমরা একেবারে আকাশ থেকে পড়েছি। তারপর উঠেছি। চিড়বিড়িয়ে, কে বলেছে? ওই ওরা বুঝি? ওই দার্জিলিঙওয়ালারা?
খানিকক্ষণ ঘনাদার কোনও জবাব পাওয়া যায়নি। প্লেটের বাকি পেষ্ট্রিগুলোর সদগতি করে চায়ের পেয়ালাটিতে শেষ চুমুক দিয়ে যেন নেহাত বৈরাগ্যের সঙ্গে ট্রে-টা একটু সরিয়ে রেখে তিনি বলেছেন, হ্যাঁ। ওরা বলছিল দার্জিলিংঙের পাহাড়ি ঝরনার গলানো রুপোর মতো জল যেন স্বর্গের অমৃত!
অমৃত! আমায় ভেংচি কাটতে হয়েছে।
ঘনাদার তক্তপোশের ধারে মেঝেতে নামানো প্লেটে দুটো হলদে গুঁড়ো দেখে আমাদের আগেই শিশির-শিবুর ঘুষটা কী ছিল খানিকটা অনুমান করে মুখ বেঁকিয়ে তারপর বলেছি, বনস্পতি-তে ভাজা ওই অখাদ্য খাবারগুলো যারা আপনাকে এনে খাওয়ায় তারা অমৃতের জানে কী! ওদের দৌড় তো ওই পচা অমৃতি অবধি!
দিঘার জলের মাহাত্ম কীর্তনেই মেতে উঠেছে এবার গৌর। দিঘার জলের মর্ম ওরা কী বুঝবে! কোথা থেকে এ জল উঠছে ওরা জানে? একেবারে হাজার ফুটেরও বেশি গভীর টিউবওয়েল থেকে পৃথিবীর বুকের ভেতরকার লুকোনো জল ওখানে উথলে উঠছে। অমৃত যদি কিছু থাকে তো সে ওই জল। আর জলের জন্য যদি কোথাও যেতে হয় তো সে দিঘা।
দিঘার কাছে দার্জিলিঙের জল! আমায় আবার ধুয়া ধরতে হয়েছে, পায়েসের কাছে আমানি!
দার্জিলিঙ আর তার ঝরনার জলের আদ্যশ্রাদ্ধ করে যা কিছু রোজ দুবেলা তারপর বলি, ঘনাদা যেরকম মনোযোগ দিয়ে তা শোনেন, তাতেই আমাদের দিঘা-ভ্রমণ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছি।
সে নিশ্চিন্ত বিশ্বাস একটু চিড় খেয়েছে একেবারে শনিবার দিন সকালবেলাই।
ট্রেনের জন্য সেই দশটায় বেরুলেও চলবে। তবু সাবধানের বিনাশ নেই বলে বনোয়ারিকে সকাল সাড়ে আটটাতেই হুকুম করেছি ট্যাক্সি ডাকবার জন্য।
জবাবে বনোয়ারি যা বলেছে তাই শুনেই আমরা তাজ্জব।
তব তো দো ট্যাক্সি বোলাকে লাবে!
দো ট্যাক্সি! দুটো ট্যাক্সির কথা কী বলছে আহাম্মকটা?
দুটো ট্যাক্সি কী হবে আমাদের? ধমক দিয়েছি বনোয়ারিকে, তোকে দুটো ট্যাক্সির কথা বলেছি? বলেছি একটা ট্যাক্সি চট করে নিয়ে আসতে!
হাঁ, হাঁ, একঠো আনবে আপলোগের জন্যে, বনোয়ারি আমাদের ধমকে বিচলিত হয়নি, আউর একঠো উ বাবুদের লিয়ে।
উ বাবুলোগ? তার মানে তো শিশির-শিবু? উ বাবুরা আবার ট্যাক্সি আনাচ্ছে নাকি? হঠাৎ এই সকালে ওদের আবার ট্যাক্সির দরকার হল কেন?
ঘনাদাকে বাগাতে না পেরে মনের দুঃখে আগে থাকতেই কোথাও সরে পড়ার ব্যবস্থা করছে? তাদের লবডঙ্কা দেখিয়ে আমাদের চলে যাওয়াটা যাতে চোখে দেখতে না হয়?
কোথায় যাচ্ছে বনোয়ারির কাছে জেনে বেশ একটু খটকা কিন্তু লেগেছে। শিয়ালদা যাবার জন্য ওরা নাকি ট্যাক্সি ডাকাচ্ছে!
মনের দুঃখে যদি যেতেই হয় কোথাও তো শিয়ালদা কেন? ঝাঁকড়দা মাকড়দাও তে গেলে পারত, কিংবা বনবাসের শামিল আর কোনও জায়গা।
তা প্রাণের জ্বালা জুড়োতে যাক যেখানে খুশি। আমাদের আর দেরি করবার সময় নেই।
বনোয়ারিকে তাই তাড়া লাগিয়েছি, শিয়ালদা-টিয়ালদা নয়, আগে তুই হাওড়ার ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে আয়।
কথাটা আর শেষ করতে হয়নি, তার আগেই কানের মধ্যে কে যেন বিষ ঢেলে দিয়েছে।
এখনও দাঁড়িয়ে আছিস, বনোয়ারি? দার্জিলিং মেল শেষকালে ফেল করাবি নাকি? তোর বড়বাবু ওদিকে তৈরি হয়ে বসে আছেন।
দার্জিলিঙ মেল! বড়বাবু! ওরা এসব বলে কী? বড় আশায় ছাই পড়ে সত্যিই খেপে গেল নাকি? ঘনাদাকে এখনও দার্জিলিঙ নিয়ে যাবার খোয়াব দেখছে!
বেচারাদের দিবাস্বপ্নটা ভাঙবার ব্যবস্থা এবার করতেই হয়। গৌরের দিকে চেয়ে হেসে তাকেই যেন শুনিয়ে দিলাম, দিঘায় ঘনাদার সমুদ্র স্নানের জন্যে যা একটা সুইমিং ট্রাঙ্ক নিয়েছি!
কিন্তু আহাম্মকদের শিক্ষা কি সহজে হয়! সুশীল সুবোধ হয়ে হারটা কোথায় মেনে নেবে, না শিশির-শিবু সংবাদ শুরু করে দিলে তৎক্ষণাৎ। শিবু যেন ব্যস্ত হয়ে শিশিরকে জিজ্ঞাসা করলে, ঘনাদার কানঢাকা টুপিটা কিনতে ভুলিসনি তো? পাহাড়ি ঠাণ্ডা থেকে মাথাটা আগে বাঁচাতে হয়।
দিঘায় ওয়েদার এখন চমৎকার! পালটা ঘা দিলে গৌর, আমাকেই যেন শুনিয়ে, ঘনাদাকে ফিরিয়ে আনাই শক্ত হবে।
কিন্তু বনোয়ারি এখনও অমন হাঁদারামের মতো দাঁড়িয়ে কেন?
দু জোড়া গলার ধমক খেয়ে সে কাঁদো কাঁদো গলায় জানতে চাইলে, এক সঙ্গে দুটো ট্যাক্সি যদি না পায় তা হলে আগে কোথাকার জন্য আনবে—হাওড়া না শিয়ালদা?
কোথাকার জন্য আবার? হাওড়া! হাওড়ার জন্য!
শিয়ালদা! ট্যাক্সি পেলেই শিয়ালদার জন্য আনবি।
হাওড়া!
শিয়ালদা!
হাওড়া!
শিয়ালদা!
ঘনাদা শিয়ালদা থেকে ট্রেনে দার্জিলিঙ যাচ্ছেন।
দার্জিলিঙ! ছছাঃ! ঘনাদা যাচ্ছেন দিঘা।
দিঘা! ফুঃ! ঘনাদা দার্জিলিঙ যাবেন নিজে কথা দিয়েছেন!
বিলকুল ঝুট। এবার সরাসরি রুখে দাঁড়াতে হল—ঘনাদা দিঘা ছাড়া কোথাও যাবেন না, নিজে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন।
অসম্ভব! শিশির-শিবুর প্রায় হাতের আস্তিন গুটোবার অবস্থা, তিনি আমাদের কথা দিয়েছেন।
না, আমাদের! গৌর আর আমার গর্জন।
বেশ, হাতে পাঁজি মঙ্গলবার কেন? চলো ঘনাদার কাছে? শিশির-শিবুর তর্জন। চলো? আমরা কি পেছপাও?
কিন্তু সিঁড়ি কাঁপিয়ে টঙের ঘরে গিয়ে ঢুকে চারজনেই হতভম্ব। আমরা যখন দিঘা দার্জিলিঙ যাওয়ার তাড়ায় মাথা ফাটাফাটি করতে যাচ্ছি, ঘনাদা তখন স্রেফ ফতুয়াটি গায়ে দিয়ে তক্তপোশের ধারে বসে গড়গড়ায় কলকেতে টিকে সাজাচ্ছেন!
আমাদের ঝড়ের মতো ঢুকতে দেখে মুখ তুলে একটু শুধু যেন আগ্রহ দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এল?
কার কথা বলছেন? কে আবার আসবে? আমরা ভ্যাবাচাকা।
কেটে নয়, আসবে একটা টেলিগ্রাম। এখনও তা হলে আসেনি বুঝতে পারছি। ঘনাদা সাজানো শেষ করে টিকে ধরানোতে মন দিলেন।
কোখেকে টেলিগ্রাম আসবে?? গৌর মেজাজটা খুব ঠাণ্ডা রাখতে পারলে না, আর যেখান থেকেই আসুক, আপনাকে এখন তো দিঘা যেতে হবে।
দিঘা নয়, দার্জিলিঙ! শিশির দেরি করলে না সংশোধন করতে।
বেশ সেইটেই আগে ঠিক হোক! গৌরের গলায় রসকষ নেই, দিঘা, না দার্জিলিঙ কোথায় উনি যাবার কথা দিয়েছেন, ঘনাদা নিজের মুখেই বলুন।
জবাবের বদলে ঘনাদার মুখ থেকে ধোঁয়াই বার হল। সেই সঙ্গে যেন চাপা হাসির মতো গড়গড়ার ভুরুক! ভুরুক!
কিন্তু এবার আমরা নাছোড়বান্দা।
দিঘা, না দার্জিলিঙ বলতেই হবে ঘনাদাকে! গৌরের সঙ্গে শিবুও যেন শমন ধরাবার গলা ছাড়ল।
বলতেই হবে? আমাদের আজগুবি আবদারে ঘনাদার ধৈর্যের বাঁধ বুঝি ভেঙে পড়ে, কিন্তু বলে লাভটা কী? তাতে লাভ হবে কিছু? এখন এখান থেকে আমার নড়বার উপায় আছে?
নড়বার উপায় নেই? কেন? সমস্বরে আমরা জানতে চাইলাম।
টেলিগ্রামটা যদি আসে! ঘনাদার গলায় এবার অজানা কোনও ভয়ংকর সম্ভাবনার আভাস!
কীসের টেলিগ্রাম? কোথা থেকে? বিস্মিত যেমন আমরা সবাই তেমনই বেশ সন্দিগ্ধও।
কোথা থেকে জেনে আর কী হবে! ঘনাদা যেন নিয়তির বিধান মেনে নেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, কিন্তু এলে যেমন আছি সেই অবস্থায় তৎক্ষণাৎ রওনা হতে হবে।
এমন জরুরি টেলিগ্রাম? শিবুর গলার সুরটা একটু বাঁকা, নিকসন কি ব্রেজনেভের বোধহয়।
সে যারই হোক, চুনি গোস্বামীকে যেন কোন টিমের জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। এমনই একটু করুণার হাসি হেসে ঘনাদা বললেন, ও টেলিগ্রাম অমান্য করবার তো উপায় নেই। যদি আসে, কখন আসবে, তারই অপেক্ষায় তটস্থ হয়ে থাকতে হচ্ছে তাই।
তা হঠাৎ টেলিগ্রামের এমন জরুরি তলব কী জন্যে? আমরা আজ সহজে ছাড়বার পাত্র নই, কী করতে হবে আপনাকে?
কী করতে হবে? ঘনাদা যেন সদ্য জঙ্গল-থেকে-ধরে-আনা গণ্ডাখানেক বাঘের খাঁচায় একলা শুধু হাতে ঢুকতে যাবার মতো মুখ করে বললেন, খোঁজ করতে হবে, বেশি কিছু নয়, শুধু এক ফোঁটা জলের।
এক ফোঁটা জলের খোঁজ! আমাদের হাসি চাপাই তখন দায় হল, তার জন্য এত ভাবনা?
দিঘায় চলুন না। পাতাল থেকে অফুরন্ত জলের ফোয়ারা উঠছে সেখানে! গৌর জপাবার সুযোগ ছাড়লে না।
দার্জিলিঙ রয়েছে কী করতে! শিশির ঝটপট উলটো গাইলে, পাহাড়ি ঝরনায় অনর্গল হিমালয়ের চূড়ার তুষারগলা জল!
হুঁ, জল! ঘনাদা একটু যেন দুঃখের নিশ্বাস ছাড়লেন, জল হলে তো সত্যিই ভাবনার কিছু ছিল না। এ ঠিক জল নয়, বরং টল বলা যায়!
টল? আমাদের সকলের চোখ এবার সত্যি ছানাবড়া।
হ্যাঁ জল-টল থেকে টল শব্দটা নিলে দোষ নেই। ঘনাদা ব্যাখ্যা করলেন একটু, টল হল জলের একেবারে আপন জাতভাই, গাঞী গোত্র পর্যন্ত সব এক। তফাত শুধু চেহারা-চরিত্রে।
তার মানে ভারী জল! আমার বিদ্যে জাহির করলাম, যার নাম ডিউটেরিয়াম অক্সাইড? যা থেকে হাইড্রোজেন বোমা হয়?
না। ঘনাদা করুণাভরে মাথা নাড়লেন, ভারী জল নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু। ভারী জলের সঙ্গে টল-এর আকাশপাতাল তফাত। এমন তফাত যে দুনিয়ায় মাত্র একটি কি দুটি ফোঁটাই হয়তো এখন কোথাও কেউ জমাচ্ছে সন্দেহ করে পৃথিবীর বড় বড় চাঁইদের চোখে আর ঘুম নেই।
টেলিগ্রাম এলে এই টলের ফোঁটা খুঁজতে আপনাকে ছুটতে হবে? আমাদের সবিস্ময় প্রশ্ন, খুঁজে পেলে করবেন কী?
সেবার প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে যা করেছিলাম! ঘনাদা গড়গড়ার নলে একটা লম্বা টান দিয়ে তাঁর কথার নমুনা হিসেবেই যেন এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, শুরু করেছিলাম খোদ নিউইয়র্কে, সেখান থেকে প্লেন-এ পেরুর লিমা হয়ে ভাড়া করা সুলুপ-এ গ্যালাপ্যাগস দ্বীপ। গ্যালাপ্যাগস থেকে একটা স্কুনার-এ হাওয়াই, হাওয়াই থেকে ব্রিগ্যানটাইন-এ সামোয়া, সামোয়া থেকে একটা কেচ-এ রারাটোঙ্গা, রারাটোঙ্গা থেকে একটা ইয়ল-এ ফিজি, ফিজি থেকে আবার একটা.সুলুপ-এ নিউগিনির পোর্ট মোরেস-বি।
ঘনাদা দম নিতে একটু থামতেই শিবু ফোড়ন কাটলে, গোটা প্রশান্ত মহাসাগরটাই ঘোল-মওয়া করে ফেললেন যে, যা কিছু জলে ভাসে তাই দিয়ে!
হ্যাঁ। ঘনাদা নিজেই স্বীকার করলেন, জেলে ডিঙি থেকে যাত্রী জাহাজ, প্রায় সব কিছুতে সমস্ত প্যাসিফিক এসপার ওসপার করে অস্ট্রেলিয়ার উত্তরের ডারউইন বন্দরে নেমে সেখান থেকে একটা জিপে দক্ষিণের আধা মরুর দেশ অ্যালিস ম্প্রিংস-এর দিকে রওনা হয়েও দেখি জোঁকটা ঠিক সঙ্গে লেগে আছে। পেরুর লিমা থেকে গ্যালাপ্যাগস যাবার সময়ই তাকে প্রথম লক্ষ করেছিলাম। তাকে ছাড়াবার জন্যই পাসিফিকটা তারপর অমন এলোমেলোভাবে ঘুরতে হয়েছে। কিন্তু লাভ কিছু, হয়নি।
ডারউইন থেকে বেরিয়ে আধা মরুর মধ্যে বিশ মাইল না যেতে যেতেই ধুধু তেপান্তরের ওপর একটা ছোট ধুলোবালির ঘূর্ণিকে ছুটে যেতে দেখে বুঝেছি, জোঁকটা-ই সঙ্গে লেগে আছে এতদূর পর্যন্ত।
তবে এবার চালটা একটু বদলে পেছনে নয়, সামনেই আছে অপেক্ষা করে।
খানিক বাদে ধুলোবালির চলন্ত মেঘটা থিতিয়ে যাবার পর জোঁকের বাহনটাও দেখা গেছে। আমার মার্কিন জিপ, আর তার বিলেতি ল্যান্ডরোভার। কায়দা করে আগে থাকতে একটু এগিয়ে গিয়ে, আমার জন্য এই নির্জন তেপান্তরে সে যে অপেক্ষা করছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
আমার কাজ যা জরুরি আর গোপন তাতে তাকে আর-একবার এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করাই উচিত ছিল। কিন্তু এবারে আমার চালও আমি বদলালাম।
সোজা জিপটা ফুলস্পিডে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে তার রোভারটায় দিলাম ধাক্কা।
কাছাকাছি যাবার পর আমার একবগ্ন খ্যাপার মতো চালাবার ধরনে মতলবটা বুঝে ফেলে রোভারটায় স্টার্ট দিয়ে সে যতদূর সম্ভব ধাক্কাটা বাঁচাবার চেষ্টা অবশ্য করেছিল। কিন্তু তখন একটু দেরি হয়ে গেছে। সাংঘাতিক দুর্ঘটনা কিছু না ঘটলেও দুটো গাড়িই জখম হল বেশ। ল্যান্ডরোভারটাই বেশি।
রোভার-এর ড্রাইভারের সিট থেকে নেমে যে আমার দিকে এবার দাঁত কিড়মিড়িয়ে ছুটে এল, সে মানুষ না অকারণে-খুঁচিয়ে-খ্যাপানো খাঁচা-ভাঙা একটা মানুষখেকো বাঘ তা বলা শক্ত।
আমি তখন জিপের ড্রাইভিং হুইলটায় হাত রেখে মুগ্ধ চোখে মরু প্রান্তরের দৃশ্য দেখতে যেন তন্ময়।
আয়! নেমে আয় কালা নেংটি!
কানের পাশেই বজ্রগর্জন শুনে একটু যেন অবাক হয়ে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে বললাম, আমায় কিছু বলছেন?
হ্যাঁ, তোকেই বলছি, শুটকো মর্কট! ইষ্টনাম যদি কিছু থাকে তো জপ করে নিয়ে নেমে আয় চটপট! আমার পিছু নেওয়ার মজা আজ তোকে বোঝাচ্ছি!
জোঁকটা বলে কী! আমি তার পিছু নিয়েছি! একটু হেসে বললাম, এ রকম শিক্ষা পাওয়া তো আমার সৌভাগ্য, কিন্তু কার পিছু নিয়ে সৌভাগ্যটা হল একটু যদি জানতে পারতাম!
কার পিছু নিয়েছিস তা তুই জানিস না? বিচ্ছু শয়তান! খ্যাপা বাঘ যেন তখুনি আমায় কামড়ে ছিঁড়ে খাবে, সেই নিউইয়র্ক থেকে কিছু না জেনে তুই এঁটুলির মতো সঙ্গে লেগে আছিস! না যদি জেনে থাকিস তো এই অন্তিমকালে জেনে নে। তোর সাক্ষাৎ শমনের নাম হল ক্যাপ্টেন ডোনাট। আজ তোর সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করবার জন্যই এখানে গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, কিন্তু তুই এসে যখন বিনা কারণে ধাক্কা দিয়েছিস তখন তোর নিয়তিই তোকে আজ ডেকেছে। নেমে আয় এখুনি, চিমসে চামচিকে, আজ তোকে নিংড়ে এই খাঁ খাঁ বালির তেষ্টা যেটুকু পারি মিটিয়ে যাব।
তা পারবেন কি? আমি যেন দরদ জানিয়ে বললাম, অত লম্বা মুখসাপাটি করলে রাগের আঁচই যে পড়ে যায়!
কী! গর্জন করে উঠলেন আবার জোঁক মশাই ক্যাপ্টেন ডোনাট। গর্জনটা একটু তবু ফাঁকা!
না, বলছিলাম, প্রতিজ্ঞা রাখবার পর আপনার একটু অসুবিধে হবে বোধহয়। গাড়িটা তো আপনার অচল হয়ে গেছে। যাবেন কী করে?
ধাক্কা-দিয়ে-ভাঙা গাড়িটার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়াতে ক্যাপ্টেন ডোনাট উথলে-ওঠা শোকে সত্যিই নতুন করে খেপে উঠলেন। কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান হারিয়ে লাফ দিয়ে উঠে আমার হাত ধরে দিলেন এক প্রচণ্ড হেঁচকা টান।
সে টানে ডিগবাজি খেয়ে মাটিতে গিয়ে পড়লাম ঠিকই, কিন্তু ক্যাপ্টেন ডোনাট তখন আরও অনেক দূরে মরুর বালিতে উবুড় হয়ে যেন দণ্ডি কাটছেন।
কাছে গিয়ে একটার বেশি ধোবির পাট দেবার দরকার হল না। তারপর তাঁর ল্যান্ড-রোভারের গায়েই হেলান দিয়ে বসিয়ে জামার কলারটা ধরে বললাম, এবার বলুন তো, জোঁক মহাশয়, সেই নিউইয়র্ক থেকে আমার পেছনে কেন লেগে আছেন? কে-ই বা পাঠিয়েছে আপনাকে?
আমি লেগে আছি আপনার পেছনে? ক্যাপ্টেন ডোনাটের গলায় হতভম্ব একটা আন্তরিক সুরই যেন পাওয়া গেল, না, যার জন্য আমার এই হয়রানির টহল, সেই দাসের সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার পর চরগিরি করবার জন্য আপনি গোড়া থেকে আমার পিছু নিয়েছেন? দাস যে এ পর্যন্ত আমায় দেখা দেননি, বুঝতে পারছি সে শুধু আপনার বাগড়ার জন্যই।
এবার হতভম্ব হওয়ার পালা আমার। প্রায় ধরা গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, কার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা বলছেন?
কার সঙ্গে যেন আপনি জানেন না? ক্যাপ্টেন ডোনাট এই অবস্থাতেও এবার খেঁকিয়ে উঠলেন, দাসের সঙ্গে, জি দাস!
জি দাস-কে আপনি চেনেন? দেখেছেন কখনও? তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ক্যাপ্টেন ডোনাটের দিকে তাকালাম।
দেখিনি কখনও।ক্যাপ্টেন ডোনাট একটু যেন লজ্জিত হয়ে বললেন, তবে তাঁর। কীর্তিকলাপ অনেক শুনেছি। পৃথিবীর এক আশ্চর্য মানুষ!
শিশির ধমকাল গোরাকে, গোরা আমাকে, আমি শিবুকে, শিবু আবার শিশিরকে।
তা হঠাৎ ওরকম ছোঁয়াচে কাশির প্রাদুর্ভাবে পরস্পরকে ধমকাতেই হয়।
কাশি থামলে ঘনাদা কিন্তু নির্বিকারভাবেই আবার শুরু করলেন।
ক্যাপ্টেন ডোনাটকে কড়া গলাতেই এবার জিজ্ঞাসা করতে হল, দাসের সঙ্গে দেখা হলে কী করতেন?
তা আপনাকে বলব কে? ভাঙলেও ক্যাপ্টেন ডোনাট মচকাতে রাজি নয়।
হেসে এবার বললাম, যদি বলি—এক ফোঁটা জল, তবুও কি আমায় বলবেন না?
দাস! আপনিই তা হলে দাস? আমার মুখে কোডওয়ার্ড শুনে ক্যাপ্টেন ডোনাট যেমন উচ্ছ্বসিত তেমনই লজ্জিত হয়ে উঠলেন, ছি, ছি, কী ভুলই করেছি!
এরপর আর বেশি কিছু বলার নেই। যে ধান্ধায় বেরিয়েছিলাম আরেক তরফের পাঠানো ক্যাপ্টেন ডোনাটের কাছে তার আরও নতুন হদিস পেয়ে শেষ পর্যন্ত এক ফোঁটা জল মানে টল সত্যিই খুঁজে বার করলাম মধ্য অস্ট্রেলিয়ার বাঁজা পাহাড় ম্যাকডোনেল রেঞ্জের একটা চোরা উপত্যকায়। জলের ফোঁটাই পেলাম, কিন্তু আসল পাপী তখন পালিয়েছে। জলের ফোঁটা টুল যা পেয়েছিলাম তার উপযুক্ত ব্যবস্থাই করা হয়েছে। কিন্তু তাতেও শান্তি তো নেই। ফেরারি সেই পাপী আর কোথাও লুকিয়ে একটি ফোঁটা টল-ও যদি জমিয়ে ফেলে, পৃথিবীর তা হলে কী সর্বনাশ যে হতে পারে কেউ জানে না।
এক ফোঁটা জল, থুড়ি আপনার ওই টল-এ পৃথিবীর একেবারে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে! কী সর্বনাশ? আমরা রীতিমত সন্দিগ্ধ।
কী সর্বনাশ বুঝতে গেলে টল বস্তুটা কী তা বুঝতে হবে। ঘনাদা আমাদের প্রতি করুণা করে একটু বিস্তারিত হলেন, টল আমাদের জলেরই জাতভাই, তবে জলের চেয়ে শতকরা চল্লিশ ভাগ ভারী আর দশ গুণ আঠালো। রাসায়নিক ফরমুলা তার H2 ০-ই বটে, কিন্তু তার অণুগুলি এমন লম্বা শেকল বাঁধা যে তার চেহারা-চরিত্র একটু তরল গোছের আঠালো রবারের মতো। বৈজ্ঞানিকদের অনেকেরই ভয় যে, কোনওরকমে মেশামেশির সুযোগ থাকলে আমাদের সব সাধারণ জল ওই ছোঁয়াচ লেগে টল হয়ে উঠে পৃথিবীকে শুক্রগ্রহের মতো এমন অসহ্য গরম করে তুলবে যে তাতে প্রাণের অস্তিত্বই হবে অসম্ভব। টল সম্বন্ধে এত ভাবনা তাই। এ-জল প্রথম তৈরি করেন দুজন রুশ বৈজ্ঞানিক। সেই ১৯৬১-তে। তারপর এতদিন বাদে অস্ট্রেলিয়ার দুজন বৈজ্ঞানিক হঠাৎ ঘটনাচক্রে এ-জল তৈরি করে ফেলেছেন। এঁদের কাছ থেকে নয়, ভয় পাছে উটকো কোনও বৈজ্ঞানিক হঠাৎ এ-জলের ফোঁটা জমিয়ে ফেলে সারা দুনিয়াকে ব্ল্যাকমেল করে। সে-বিপদের জন্য সজাগ পাহারায় তাই থাকতেই হয়।
দিঘা কি দার্জিলিঙ কোথাও যে যাওয়া হয়নি তা বলাই বাহুল্য।
পৃথিবী বাঁচাবার দায় নেবার অনুরোধ টেলিগ্রামে যে-কোনও মুহূর্তে যাঁর কাছে আসতে পারে তাঁকে সামান্য শখের বেড়ানোর কথা কি বলা যায়!