সেল সেল…
দুশত টাকায় সিল্কের শাড়ী…
সারা বাজারে কোথাও খুঁজে পাবেন নাকো নারী..
আরো আছে হরেক রকম শাড়ী…
একটা কিনে নিয়ে যাও তুমি বাড়ী…
” সেল সেল” বলে চিৎকার করছে বছর বারোর একটা ছেলে | ওর চিৎকারের চোটে লোকে এক বার হলেও অম্বিকা বস্ত্রালয়ের দিকে দৃষ্টি নিবেশ করছে ,কেও এগিয়ে এসে শাড়ী কিনে নিয়েও যাচ্ছে | এমনিতেই এই বছর অম্বিকা বস্ত্রালয়ের বৃহঃস্পতি তুঙ্গে,তাছাড়া বিট্টুর ছড়ার চিৎকারে দোকানে বিক্রির বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে |
“বিট্টু, যদি দোকানে তুই এমনি সেল করতে পারিস তোকে আরো দুশো টাকা বেশি দেব ” বিট্টুর মাথায় বিলি কেটে বললো দোকানের মালিক বিমল |
বিট্টুর মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠলো ,বললো ” কাকু ,কেমন কবিতা বানিয়েছি বলো ?”
“খাসা হয়েছে রে,নয়টা বাজে এখনো বাজারে কি ভীড় দেখেছিস…ওই দেখ কাস্টমার আসছে শাড়ী দেখা ”
কাস্টমার দুটো শাড়ী নিয়ে চলে গেলো ..ঘড়িতে তখন নয়টা বেজে দশ..
” কাকু ,আমি আজ এখন বাড়ী যাবো?ইউনিট টেস্ট শুরু হয়েছে ,কাল অঙ্ক পরীক্ষা,ঘরে গিয়ে পড়তাম | যদি কিছু না পারি মা তো উত্তম মধ্যম দেবেই,সেই সাথে কাজটাও ছাড়িয়ে দেবে ” কাচু মাচু মুখে বললো বিট্টু |
“ঠিক আছে,তবে শুধু আজকের দিনটাই
কিন্তু,আমি তোর বাবাকে ফোন করে দিচ্ছি | কাল পাঁচটার মধ্যে চলে আসিস ”
” ঠিক আছে ”
বাবার সাইকেলে চেপে গল্প করতে করতে বাড়ী যাচ্ছিলো বিট্টু | ওর বানানো ছড়াটা বাবাকে শোনানোও হলো | ঘরে গিয়ে খেয়েই পড়তে বসলো বিট্টু ,ওকে যে ভালো করে পড়াশোনা করে বড় হতেই হবে,অনেক দায়িত্ত্ব ওর কাঁধে | ওর মাও ওর সাথে জেগে রইলো..
ও বিট্টু,মা বাবার একমাত্র সন্তান | ওর বাবা রং মিস্ত্রির কাজ করে | ওদের জীবন খুব বেশি স্বচ্ছল না হলেও অভাব শব্দটা ওদের সংসারে নেই,তাও কেন বিট্টু সেলের বাজারে দোকানে কাজ করে সেটাই এবার বলি|
বিট্টুর যখন পাঁচ বছর ,একদিন ও ওর মায়ের সাথে রোডের ধারে দোকানে গিয়েছিলো ,পাঁচ বছরের অবুঝ বাচ্চা তখন ও,তাই ওর মায়ের কোল থেকে নেমে বল ধরতে রাস্তায় ছুটছিল ছুঁটছিলো,ওই পাশ থেকে একটা ট্রাক দ্রুত গতিতে ধেয়ে আসছিলো,..যখন আসে পাশের লোক জন “গেল গেল” করে উঠলো,তখন অন্নপূর্ণা ঝাপিয়ে ওকে বাঁচায়,ওর কেটে ছেড়ে গেলেও ,অন্নপূর্ণার হাতটা এতটাই জখম হয় যে হাতটা কনুই এর নিচ থেকে বাদ দিতে হয় | এমনিতেও নিঃসন্তান অন্নপূর্ণা স্বামীর বোঝা ছিল ,আর এই অবস্থায় তো ওকে ছেড়ে চলে যাওয়া শ্রেয় মনে করলো | মাস এক বিট্টু দের ঘরে কাটিয়ে ,অন্ন ফিরে গেলো ওর নিজের আস্তানায় | বিট্টুর মা অনেক ভাবেই আটকে ছিল,অন্ন থাকেনি ,ও বলেছিলো
” বড় হলে বিট্টুকে বলো আমাকে দেখতে ”
বিট্টুও পাঁচ বছর থেকে এই ঘটনাটা শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছে ..বছর দুই আগে প্রচন্ড জ্বরে পড়ে অন্নপূর্ণা | খবর পেয়ে ছুঁটে যায় বিট্টুর মা, কিছু ফলের সাথে পাঁচ শত টাকা গুঁজে দেয় অন্নর হাতে | ফল গ্রহণ করলেও টাকা নিতে অস্বীকার করে অন্ন,বলে ” আমার যদি কোনো ঋণ থাকে সেটা শুধু মাত্র বিট্টুর কাছে,ও যখন রোজকার করবে তখন আমি হাত পেতে নেবো,তার আগে না ” |
কথাটা মনে দাগ কাটে দশ বছরের বিট্টুর,বাড়ি আসতে আসতে ওর মাকে বলে ” মা আমি যদি রোজকার করি,তাহলে তো অন্ন দিদিকে(বয়েসে বিস্তর ফারাক হলেও অন্ন কে দিদি বলতো ও ) টাকা দিতে পারবো? ”
” এখন তুই কি করবি ,বড়ো হলে করিস ”
“আমি চৈত্র সেলে অনেককে কাজ করতে দেখেছি ,আমিও করবো ”
” তুই কি পাগল হলি? লোকে কি বলবে ?”চিৎকার করে ওঠে বিট্টুর মা | তবে ওর জেদের কাছে ,ওর মা হার মেনেছিল ,ওর বাবা বলেছিলো ” আহা! সৎ পথে করুক না ”
শর্ত হয়েছিল সেলে পনেরো দিন বিট্টু কাজ করবে,যাই টাকা পাবে সব অন্নকে দেবে | পাড়ায় এক লোক পরিচিত দোকানে ঢোকায় বিট্টুকে …এই দুই বছর পুজো আর চৈত্র সেলে বিকেল পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে দশ টা অবধি কাজ করে বিট্টু |
আজ পহেলা বৈশাখ ,বিট্টু স্নান করে দোকানে গেলো পাওনা টাকা নিতে ,টাকা নিয়ে প্রফুল্ল চিত্তে পৌছালো অন্নর বাড়ি …
“আই ভাই আইই,এই দেখ আমি তোর জন্য নারকেল নাড়ু বানিয়েছি ”
আত্মসন্মানে ভরপুর অন্নর ,দু ঘর রান্না করে কোনো রকমে দিন গুজরান হয় |
“অন্ন দিদি ,এই দেখো শাড়ী” বলে দু হাজার টাকা সমেত প্যাকেটটা অন্নর হাতে ধরিয়ে দেয় |
” এই দিদির জন্য এই বয়েসে তোকে কত কষ্ট সহ্য করতে হয় বল?” প্যাকেট টা খুলতে খুলতে অন্ন বললো |
” আমি বড় হয়ে আরো ভালো শাড়ী কিনে দেব ”
” তা দিস,তবে এখানে দুটো শাড়ী কেন রে ?”
” আসলে মালিক খুশি হয়ে আমাকে দু শত টাকা বেশি দিয়েছে ,তাই মায়ের জন্য একটা নিলাম ,তোমার যেটা পছন্দ তুমি নাও | একটা আমার জীবন যাত্রী দাত্রী আর একটা আমার জন্ম দাত্রী মায়ের জন্য” এক দমে কথা গুলো বলে থামলো বিট্টু |
পরিস্থিতি বোধহয় মানুষকে বড় করে দেয়,ভাবে অন্নপূর্ণা | মুখে বলে ” যা দে গা তোর মাকে,খুব খুশি হবে ”
” আমি এখন যায় অন্ন দিদি,তুমি সাবধানে থেকো দিদি,দরকার হলেই ডাকবে ” বলে চলে গেলো বিট্টু |
অন্নপূর্ণা ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো ….