মধ্যযুগের ভয়ঙ্কর ১২ মৃত্যুদণ্ড

মধ্যযুগের ভয়ঙ্কর ১২ মৃত্যুদণ্ড

মধ্যযুগের ভয়ঙ্কর ১২ মৃত্যুদণ্ড

মধ্যযুগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ভয়াবহভাবে হত্যা করা হতো। হত্যাকাণ্ডের পদ্ধতিগুলো এতই পৈশাচিক ছিলো, যা নির্মমতার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। তাই বর্তমানেও নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে তুলনা করা হয় মধ্যযুগের বর্বরতার সঙ্গে। তখনকার সেই হত্যাকাণ্ডের কথা শুনলে যে গা শিউরে ওঠে। মধ্যযুগের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে হত্যাকাণ্ডের ১২ পদ্ধতি নিয়ে আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় পর্ব।

স্কাফিজম (Scaphism) : স্কাফিজম খুবই যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুদণ্ড পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে আসামির মৃত্যু হতে লাগতো অন্তত দুই সপ্তাহ। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে শুইয়ে রাখা হতো। তারপর তাকে প্রচুর পরিমাণে মধু ও দুধ খাওয়ানো হতো, যতক্ষণ না তার ভয়াবহ ডায়রিয়া শুরু হয়। এরপর কোনো একটি ডোবার ধারে গাছ বা শক্ত খুঁটির সঙ্গে তাকে বেঁধে রাখা হতো। তখন বন্দির পুরো শরীরে মধু মাখিয়ে দেওয়া হতো।

মধু মাখানোর ফলে বন্দির শরীরের প্রতি কীটপতঙ্গ আকৃষ্ট হতো। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির গায়ের চামড়া ভেদ করে বাসা বাধতো কীটপতঙ্গ। এভাবে ডায়রিয়া, গ্যাংগ্রিন ও মরণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়ে অনাহারে দীর্ঘ যন্ত্রণায় মারা যেত দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি। পার্সিয়ানদের মধ্যে স্কাফিজম (Scaphism) মৃত্যদণ্ড প্রচলিত ছিলো।

রক্ত ঈগল (Blood Eagle) : ফিনল্যান্ডে এ পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ডের প্রথা চালু ছিলো। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির মেরুদণ্ড বরাবর কেটে তার বুকের পাজরের হাড় ভেঙে পিঠের দিক দিয়ে বের করে ঈগলের পাখার মতো মেলে রাখা হতো। এরপর পেছন থেকে ফুসফুস বের করে বাইরে ঝুলিয়ে লবণ মাখিয়ে দেওয়া হতো। তীব্র যন্ত্রণাভোগ ও রক্তক্ষরণে মৃত্যু হতো সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির।

দ্যা রিভলভিং ড্রাম (Revolving Drum) : দ্যা রিভলভিং ড্রাম গা শির শির করা এক মৃত্যুদণ্ড। এটি কাঠের ফ্রেমের মধ্যে একটি অসংখ্য কাঁটা লাগানো হাতল ওয়ালা মেশিন। হাতলটির সাহায্যে ড্রামটি ঘোরানোর ব্যবস্থা ছিলো। দণ্ডপ্রাপ্তকে ড্রামের সঙ্গে উল্টো করে বেঁধে তার মাথা কাঠের ফ্রেমের সামনে গোলাকার গর্তে ঢোকানো হতো। পা দুটি আটকানো হতো পেছন দিকের ফ্রেমে। দণ্ডপ্রাপ্তকে এমনভাবে বাঁধা হতো, যাতে তার পেটটি ড্রামের সাথে লাগানো থাকে। জল্লাদ ড্রামটিকে ঘোরালে দণ্ডপ্রাপ্তের নাড়ি-ভুড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতো। এতে প্রচণ্ড যন্ত্রণা ভোগ করে মারা যেত দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি।

ন্যায়ের ঝাকি (Upright Jerker) : মৃত্যুদণ্ডের এ পদ্ধতিটি প্রথম চালু হয় আমেরিকায়। কিন্তু আমেরিকাতে পদ্ধতিটি নিষিদ্ধ হলেও এখন ইরানে এ পদ্ধতিতেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে গলায় দড়ি পরিয়ে দড়িটি উপরে দিকে টেনে তোলা হয়। দড়িটি তোলার সময় খুব জোরে একটি ঝাঁকি দেওয়া হয়, যেন আসামির ঘাড় ভেঙ্গে যায়। দড়িটি তুলতে ক্রেন ব্যবহার করা হয়।

বাঁশের নির্যাতন (Bamboo Torture) : বাঁশের ব্যবহারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের কষ্টদায়ক এ পদ্ধতিটি এশিয়ার দেশগুলোতে প্রচলন ছিলো। এ পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে একটি বাঁশ বনে বেঁধে রাখা হতো। নতুন বাঁশ গজাচ্ছে এমন স্থানে হাত-পা শক্ত করে বেঁধে রাখা হতো দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে। বাঁশ দ্রুত বৃদ্ধি পায় (দৈনিক সর্বোচ্চ এক ফুটের মতো), তাই ধীরে ধীরে বাঁশ দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির দেহ ফুঁড়ে বের হয়ে যেত। এটি খুব ধীর প্রক্রিয়া। একারণে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিটি মারা যাওয়ার আগে অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করতো।

মাজাটেল্লো (Mazzatello) : মাজাটেল্লো অত্যন্ত বীভৎস মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ

্তকে শহরের একটি উঁচু মঞ্চে হাত-পা বেঁধে রাখা হতো। এরপর তার মাথায় কাঠের তৈরি হাতুড়ি দিয়ে জোরে আঘাত করা হতো। এভাবে আঘাত করে দণ্ডপ্রাপ্তের মাথা থেতলে দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো। অষ্টাদশ শতকের দিকে পোপের আইন চালু হওয়া দেশগুলোতে এভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতো।

জাফরি (The Gridiron) : এ পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত জ্বলন্ত কয়লার বিছানার উপর চাপ দিয়ে ধরে রাখা হতো। এ পদ্ধতিতে মৃত্যু হতো অনেক দেরিতে। শরীরের চামড়া পুড়ে সম্পূর্ণ কালো হয়ে যেত। মারা যাওয়ার আগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি নরক যন্ত্রণা ভোগ করতো।

বেস্টিয়ারাই (Bestiarii) : বেস্টিয়ারাই মৃত্যুদণ্ড আদি রোমান সাম্রাজ্যের একটি ক্রীড়া। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে হিংস্র প্রাণির সঙ্গে লড়াইয়ে নামিয়ে দেওয়া হতো। ক্ষুধার্ত হিংস্র প্রাণিগুলো ওই ব্যক্তিকে খেয়ে ফেলতো। এই বীভৎস মৃত্যু দেখতে যাওয়া দর্শক উল্লাসে ফেটে পড়তো। অনেক সময় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্রও দেওয়া হতো। হিংস্র পশুদের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতো ওই ব্যক্তি। এতে দর্শকদের উল্লাস আরো বাড়ত। কিন্তু মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেত না ওই ব্যক্তি।

নিষ্পেষণ (Oppressed) : এটি এক আজব পদ্ধতি। শুধু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রেই ব্যবহার হতো তা নয়। এ পদ্ধতি আমেরিকা থেকে শুরু করে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। কোনো সাধারণ ব্যক্তি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির দ্বারা দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে ধরে মাটিতে শোয়ানো হতো। এরপর তার শরীরের ওপর একটি কাঠের পাটাতন রাখা হতো। ওই পাটাতনের উপর ভারী বস্তু রেখে দোষ স্বীকার করানো হতো। দোষ স্বীকার না করা পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে ওজন বাড়ানো হতো, যতক্ষণ না সে মারা যায়। তবে দোষ স্বীকার করলেও যে মুক্তি পাবে তা নয়, সেই দোষের জন্য ও সবাইকে মিথ্যা বলার দায়ে সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো।

কাঠের তক্তার ওপর মৃত্যুদণ্ড (On The Board) : এ পদ্ধতিতে একটি কাঠের তক্তার উপর দিয়ে হাঁটিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতো জলদস্যুরা। ক্যারাবিয়ান অঞ্চলে এ পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতো। জলদস্যুরা কোনো জাহাজ আক্রমণ করলে, সে জাহাজের সব মালামল লুটে নিতো। তখন যারা প্রতিরোধ করতে চাইতো, তাদেরকে এ শাস্তি দেয়া হতো। এক্ষেত্রে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে শুধুমাত্র তক্তার উপর দিয়ে হাঁটিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হতো। ভাসমান জাহাজের চারপাশে ঘুরে বেড়ানো হাঙ্গর তাকে খেয়ে ফেলতো কিংবা সাগরে ডুবে মারা যেত ওই ব্যক্তি।

রিপাবলিকান বিয়ে (Republican Marriage) : রিপাবলিকান বিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার এক অদ্ভূত পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে একজন পুরুষ ও একজন নারীকে নগ্ন অবস্থায় মুখোমুখি করে একসঙ্গে বেঁধে দেওয়া হতো। তারপর ওই দুজনকে নদীতে ফেলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো। শুধু ফ্রান্সে এ পদ্ধতি চালু ছিলো। মৃত্যুদণ্ডের এ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন জঁ-কেরিয়ার।

গিলোটিন (Guillotine) : গিলোটিনে মুণ্ডচ্ছেদ বা শিরকর্তন পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর চালু হয় ১৭০০ শতকে। ওই সময়য়ের বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে- দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির কষ্ট কম হয়! তাই তখন অনেক দেশ এই পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে থাকে। শিরোশ্ছেদ করার ধারালো যন্ত্রটিকে বলা হতো গিলোটিন (Guillotine)।

১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে ডা. জোশেফ ইগনেস প্রথম গিলোটিনের প্রবর্তন করেন। ফরাসি বিপ্লব চলার সময় দোষীকে শাস্তি দিতে তিনি এ অভিনব যন্ত্রটির সুপারিশ করেন। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গে বন্দুকের আওয়াজের মধ্যে ফরাসি বিপ্লবের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। তার ২ বছর পর, ১৭৯১ সালের ২০ বা ২১ জুনে ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই ছদ্মবেশে ভার্নেতে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন। তার ঠিক ১৯ মাসের মাথায় ১৭৯৩ সালের ২১ জানুয়ারি রাজা ষোড়শ লুইকে গিলোটিনে চড়িয়ে হত্যা করা হয়। এ জন্যই ফরাসি বিপ্লবের অবিচ্ছেদ্য অংশ গিলোটিন।

১৭৯২ সালের ২৫ এপ্রিল ডি গ্রিভ শহরের উন্মুক্ত প্রান্তরে গিলোটিন যন্ত্রটি স্থাপন করা হয় ও প্রথমবারের মতো একজন `হাইওয়ে ম্যান`-এর শিরশ্ছেদ করা হয়। ওই বছর প্যারিসের ডি-লা কনকর্ডে প্রায় ৪ হাজার বন্দির শিরশ্ছেদ করা হয়।

এরমধ্যে ১৭৯৩ সালের জানুয়ারি রাজা ষোড়শ লুইকে হত্যার পর, ১৬ অক্টোবর রানি মারি আঁতোয়ানে, ৩১ অক্টোবর জিরদঁযাদ, ৮ নভেম্বর মাদাম রোঁলা, ১৭৯৪ সালে ৩০ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিলের মধ্যে জর্জ দাঁত ও তার অনুসারীদের গিলোটিনে হত্যা করা হয়।

তবে দাঁতে ও তার সমর্থকদের গিলোটিনে পাঠানোর মূল হোতা বিপ্লবী নায়ক ব্যারিস্টার মেক্সিমলিয়ান মারি ইশিদর দ্য রোবসপিয়েরকেও নিমর্মভাবে গিলোটিনে জীবন দিতে হয়। ভাগ্যক্রমে গিলোটিনের আবিষ্কারক জোশেফ ইগনেসও অল্পের জন্য গিলোটিনের মৃত্যু থেকে বেঁচে যান।

ফ্রান্সে গিলোটিনে শেষ মৃত্যু হয় ১৯৭৭ সালে। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যেই গিলোটিনে মৃত্যুর হার কমে যায়। ১৯৮১ সালে ফ্রান্সে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ হওয়ার পর শিরশ্ছেদও বন্ধ হয়ে

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত