নারীদের প্রতি অমানবিক ৬টি বর্বরতার ইতিহাস

নারীদের প্রতি অমানবিক ৬টি বর্বরতার ইতিহাস

জকের দিনে পত্রপত্রিকা খুললে কিংবা টেলিভিশনের অন করলে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি পীড়া দেয়, তা হলো নারীদের প্রতি সহিংসতা। সারা বিশ্বেই চলছে একই অবস্থা; কোথাও কম, কোথাও বেশি- পার্থক্য কেবল এখানেই। তবে নারীদের সাথে এমন সহিংস আচরণের শুরু হয়েছে অনেক আদিকাল থেকেই। প্রাচীন রোম, গ্রীস, মিশরের মতো সভ্যতাগুলোতে এর প্রমাণ খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

প্রাচীন বিশ্বে নারীদের প্রতি সহিংসতার তেমনি ৬টি দুঃখজনক ইতিহাস নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের লেখা।

১) সদ্যোজাত কন্যাসন্তানের দুর্ভাগ্য

প্রাচীন এথেন্সে যদি কোনো কন্যাসন্তান জন্ম নিতো, তাহলে প্রায় সময়ই তাকে বন-জঙ্গলে ফেলে রেখে আসতো পাষাণ বাবা, উদ্দেশ্য সেখানেই যেন অনাহারে কিংবা বন্যপশুর আক্রমণে মারা যায় নিষ্পাপ মেয়েটি। তখনকার দিনের খুবই সাধারণ ঘটনা ছিলো এটি। এই চর্চার তারা নাম দিয়েছিলো শিশুকে ‘প্রকাশিত করা’! এক গ্রীক লেখকের লেখনি থেকে জানা যায়, “পুত্রসন্তানের জন্ম হলে নিজেরা গরীব হলেও যেকোনো বাবা-মা তাকে বড় করে তুলতে চাইতো। অন্যদিকে কন্যাসন্তানের জন্ম হলে ধনী পরিবারের সদস্যরা পর্যন্ত তাদেরকে ‘প্রকাশ করে’ দিত।এমন ঘটনা রোমেও ছিলো বেশ সাধারণ, বিশেষত দরিদ্র সমাজে। প্রাচীন নথিপত্র ঘেঁটে দরিদ্র এক রোমান লোকের চিঠি পাওয়া গিয়েছে, যিনি তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে চিঠিতে লিখেছেন, “একটি কন্যাসন্তান বোঝা ছাড়া আর কিছুই নয়, আর আমাদের অত টাকাও নেই। যদি তুমি মেয়ের জন্ম দাও, তাহলে আমাদের তাকে মেরে ফেলতে হবে।”

এমনকি প্রাচীন মিশরে, যেখানে নারীরা অন্যান্য অনেক সভ্যতার তুলনায় পুরুষের কাছাকাছি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত, প্রায় সময়ই সদ্যোজাত কন্যাসন্তানকে রেখে আসা হতো মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষায়। একবার তৎকালের এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে লিখেছিলো, “যদি আমি ফিরে আসার আগেই তোমার সন্তানের জন্ম হয়ে যায়, তাহলে ছেলে হলে তাকে বাঁচিয়ে রেখ, আর মেয়ে হলে তাকে ‘প্রকাশিত করে’ দিও।”

২) ঋতুমতী নারী অস্পৃশ্য

রোমান দার্শনিক প্লিনি দ্য এল্ডার লিখেছেন, “এমতাবস্থায় একজন নারীর আগমনে দুধও টক হয়ে যাবে”। ঋতুমতী নারী যার দিকে তাকাবে, সে-ই মারা যাবে বলে মতবাদ ব্যক্ত করেছিলেন তিনি। এমনকি তিনি বলেছিলেন, “এক ঝাঁক মৌমাছির দিকেও যদি সে তাকায়, তাহলে তারাও সাথে সাথেই মারা যাবে।”

প্রাচীন মিশরে ঋতুচক্র চলাকালে নারীরা আলাদা একটি স্থানে গিয়ে থাকতো, যেখানে কোনো পুরুষের প্রবেশাধিকার ছিলো না। এমন কুসংস্কার অন্যান্য আরো সভ্যতাতেও প্রচলিত ছিলো। ইহুদীরা তো এ সময় একজন নারীকে স্পর্শও করতো না। তারা মনে করতো, এ সময় যে জিনিসেই নারীর শরীরের ছোঁয়া লাগবে, সেটাই অপবিত্র হয়ে যাবে। হাওয়াইয়ে ঋতুমতী নারীদের জন্য আলাদা করে রাখা ঘরে যদি কোনো পুরুষ প্রবেশ করতো, তবে তার মৃত্যুর পরোয়ানা পর্যন্ত জারির সম্ভাবনা ছিলো!

পাপুয়া নিউগিনির লোকেরা তো ছিলো আরো এক কাঠি সরেস। তারা মনে করতো, কোনো পুরুষ যদি কোনো ঋতুমতী নারীকে স্পর্শ করে, তাহলে তার রক্ত কালো হয়ে যাবে, বুদ্ধিনাশ হবে এবং সর্বোপরি ধীরে ধীরে সে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে!

৩) সতীত্ব হারানো ছিলো মৃত্যু পরোয়ানার নামান্তর

প্রাচীন এথেন্সে যদি কোনো বাবা জানতে পারতেন যে তার মেয়ে অবিবাহিতা অবস্থায় অন্য কোনো পুরুষের শয্যাসঙ্গী হয়েছে, তাহলে তিনি তাকে দাসী হিসেবে বিক্রি করে দিতে পারতেন।

স্ত্রীর সতীত্বের ব্যাপারে সামোয়ার অধিবাসীরা নিজেরা যেমন নিশ্চিত হতে চাইতেন, তেমনি তারা আর সবাইকেও সেই ব্যাপারে জানাতে চাইতেন। সেখানকার কোনো বিয়ের সময় গোত্রপতি সবার সামনেই আঙুল দিয়ে নববধূর হাইমেন ছিড়ে দেখাতেন এটা প্রমাণ করতে যে, মেয়েটি পবিত্র!

প্রাচীন রোমে দেবী ভেস্টার কোনো পূজারিণী যদি ৩০ বছর বয়সের আগে কুমারীত্ব হারাতেন, তাহলে তাকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো।

৪) নববধূর অপহরণ

ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত শোনালেও এটাই সত্যি যে, ইতিহাসে নববধূকে অপহরণের ঘটনার বহু নজিরই রয়েছে। গত শতকের চল্লিশের দশক পর্যন্ত চীনে নববধূকে অপহরণ করা হয়েছে। জাপানে এমনটা সর্বশেষ ঘটেছিলো ১৯৫৯ সালে। আঠারো শতকে আয়ারল্যান্ডে অন্যতম দুশ্চিন্তার বিষয় ছিলো এই অপহরণের বিষয়টি।

রোমের ইতিহাসের সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে নববধূ অপহরণের কালিমা। তাদের কিংবদন্তীর সূচনাই হয়েছে বলা যায় রোমান পুরুষরা স্যাবাইন (ইতালির এক গোত্র) নারীদের অপহরণের মধ্য দিয়ে। গল্পে আছে, রমুলাস নারীদের বলছেন, অপহৃত হওয়ায় তাদের গর্ববোধ করা উচিত। কারণ তারা সম্মানজনক বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছেন।

৫) সন্তান হত্যায় বাধ্য করা

নাড়িছেঁড়া ধন সন্তানকে একজন মা কতটা ভালোবাসেন, সেটা আর নতুন করে না বললেও চলে। প্রতিনিয়ত এর নিদর্শন আমরা আমাদের চোখের সামনেই দেখে চলেছি। কোনো কোনো ভালোবাসা আবার কালোত্তীর্ণ হয়ে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাসের বুকে।

এর বিপরীতের কথাও অবশ্য জানা যায় ইতিহাস ঘেঁটে। তবে সেগুলো যে জন্মদাত্রী মা স্বেচ্ছায় করতেন না সেটা না বললেও চলে। জন্মের পর শিশু দুর্বল হলে তাকে মেরে ফেলার চল ছিলো স্পার্টায়। শুধু স্পার্টার কথাই বা বলা হচ্ছে কেন? এমন অমানবিক রীতি এককালে প্রচলিত ছিলো বিশ্বের আরো অনেক দেশেই।

সন্তান যদি জন্মগত ত্রুটি নিয়ে পৃথিবীতে আসতো, তাহলে সবাই এটাই চাইতো যেন মা তার সন্তানকে হত্যা করে ফেলে। এমনকি রোমে তো এটা আইন হিসেবেই চালু ছিলো, যেখানে উল্লেখ করা ছিলো- “ভয়ঙ্করভাবে বিকৃতি নিয়ে জন্ম নেয়া শিশুকে যত দ্রুত সম্ভব হত্যা করতে হবে।” মায়ের হাতে তখন ২টি পথ খোলা থাকতো- হয় নিজ হাতে গলা টিপে সন্তানকে হত্যা করতে হবে, নতুবা সন্তানকে পরিত্যাগ করতে হবে। তৎকালে এ ঘটনা অহরহ ঘটতো। এভাবে ঠিক কতজন শিশু মারা গিয়েছিলো তার সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও ইতিহাসবিদগণ ধারণা করেন, প্রতি চারজন রোমান শিশুর একজনই এক বছর বয়সের আগে এ প্রথার কারণে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতো!

শুধুমাত্র এই বর্বরতাকে কেন্দ্র করে ইতিহাসে অনেক স্থানই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে আছে। ইসরায়েলের এক শহরের পয়ঃনিষ্কাষণ প্রণালীতে এ প্রথার বলি হিসেবে শতাধিক শিশুর দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো।

৬) বাক-স্বাধীনতা হরণ

প্রাচীন গ্রীস ও রোমে বাড়িতে কোনো পুরুষ অতিথি আসলে তাদের সামনে গিয়ে কথা বলা কিংবা তাদের সাথে বসা নারীদের জন্য একপ্রকার নিষিদ্ধই ছিলো বলা যায়। এটা করা হতো এই আশঙ্কায় যে, নারীদের উপস্থিতি না আবার পুরুষদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়!

এককালে ডেনমার্কে যদি কোনো নারী অবাধ্য হয়ে কাউকে গালাগালি করতো কিংবা কোনোভাবে রাগ প্রকাশ করতো, তাহলে তার অবস্থা হতো খুবই করুণ। তাকে ‘বদমেজাজির ভায়োলিন’ নামক একটি যন্ত্রের সাহায্যে শাস্তি দেয়া হতো। কাঠের তৈরি এ জিনিসটি দেখতে ছিলো অনেকটা ভায়োলিনের মতো। এজন্যই এমন নামকরণ। এখানে সেই নারীর দু’হাত আর মুখ আটকে দেয়া হতো। এরপর তাকে পুরো নগরী ঘুরিয়ে বেড়ানো হতো। প্রকাশ্যে রাগ দেখানোয় রাস্তার জনগণ তাকে তখন দুয়ো দিতে থাকতো।

ইংরেজ নারীদের অবস্থা হতো আরো খারাপ। তারা প্রকাশ্যে বদমেজাজ দেখালে একধরনের ধাতব মুখোশ পরানো হতো, যেটার মুখের দিকে কাটার মতো অংশ এবং একটি ঘণ্টা লাগানো থাকতো। ঘণ্টার শব্দ শুনে আশেপাশের লোকজন জড়ো হতে থাকতো আর সেই মহিলাকে নিয়ে সবাই মজা করতো।

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত