ডাকাতি’ শব্দটা শুনলেই আমাদের মাঝে বড়সড় এক অজানা আতঙ্ক ভর করে বসে, যতটা না আসে ‘চুরি’ নামক শব্দটির বেলায়। কারণ একটাই; চুরির ঝাল যায় ছোটখাট জিনিসের উপর দিয়ে, অন্যদিকে ডাকাতি মানেই বড় ধরনের কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া।
ইতিহাস বিখ্যাত এমনই পাঁচটি ডাকাতির গল্প শোনাতে আজকের এই আয়োজন। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই ডাকাতদের কেউই পুলিশের হাতে তাদের উল্লিখিত অপরাধের জন্য ধরা পড়ে নি। কিংবা ধরা পড়লেও শেষপর্যন্ত ঠিকই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলো।
১) উইলকক্স ট্রেন ডাকাতি
মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থাকে সহজতর করে তোলার লক্ষ্যে একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুনো পশ্চিমাঞ্চলেও রেলপথে যাতায়াতের প্রচলন ঘটে। বিভিন্ন অপরাধকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ সেই অঞ্চলের দস্যুদের নজর ট্রেনের উপর পড়তে এরপর খুব বেশিদিন লাগে নি। এদের মাঝে অন্যতম ছিলো বাচ ক্যাসিডি, উইলিয়াম কার্ভার, সানডেন্স কিডের মতো দস্যুদের নিয়ে গঠিত ‘দ্য ওয়াইল্ড বাঞ্চ’ গ্যাংটি।
দ্য ওয়াইল্ড বাঞ্চ; Source: Wikimedia Commons
১৮৯৯ সালের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম প্রান্তে পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত ওয়াইওমিং অঙ্গরাজ্য ধরে ছুটে চলেছিলো একটি ট্রেন। দ্য ওয়াইল্ড বাঞ্চের সদস্যরা এই ট্রেনটিকেই থামতে বাধ্য করে। এরপর অস্ত্রের মুখে অর্থকড়ি বহনকারী বগিগুলোকে ট্রেনের মূল ইঞ্জিন থেকে আলাদা করতে নির্দেশ দেয় তারা। জীবন বাঁচাতে সেটাই করে কর্মীরা। এবার ডাকাতেরা সেই বগিগুলোতে ঢুকে হানা দেয় সুরক্ষিত সিন্দুকগুলোতে। সব মিলিয়ে সেদিনের ডাকাতিতে তারা প্রায় ৩৬ হাজার ইউএস ডলার (বর্তমান বাজারমূল্যে, বাংলাদেশী হিসেবে প্রায় সাড়ে ২৯ লক্ষ টাকা) এবং অনেক অলঙ্কারাদি সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলো। পালানোর জন্য তারা আবার আলাদা বেশ কতগুলো তেজী ঘোড়াও প্রস্তুত করে রেখেছিলো, যাতে করে কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থাই তাদের ধাওয়া করে খুব একটা সুবিধা করতে না পারে।
সিন্দুক ভাংতে ওয়াইল্ড বাঞ্চ সেগুলোতে বিষ্ফোরণ ঘটিয়েছিলো। এর ফলে ভেতরে থাকা ডলারের নোটগুলোও হালকা-পাতলা বিভিন্ন জায়গায় পুড়ে যায়। গুজব শোনা যায়, পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে সেসব পোড়া নোটের দেখা মিলেছিলো নিউ ইয়র্ক ও মেক্সিকোর মতো এলাকাগুলোতে।
২) ছলনাময়ী জিয়ান্নি
জিয়ান্নি ডি ভ্যালোইস-সেইন্ট-রেমি সবসময়ই চাইতেন বিত্তবৈভবের প্রাচুর্যে তার জীবনটা ভরে উঠুক। তবুও অভাব কেন যেন তার পিছু ছাড়ছিলো না। আর এ নিয়ে তার হাপিত্যেশেরও কোনো অন্ত ছিলো না। একসময় বিয়ে হলো জিয়ান্নির। তিনি ভেবেছিলেন, বিয়ের পর হয়তো অর্থের জন্য দীর্ঘদিনের হাহাকার কাটবে তার। কিন্তু না, তখনও কাঙ্ক্ষিত সচ্ছলতা ধরা দিলো না তার জীবনে। এবার তাই ভিন্ন পথে হাঁটবার পরিকল্পনা করলেন তিনি, আইনবিরুদ্ধ এক পথ।
জিয়ান্নি; Source: Wikimedia Commons
জিয়ান্নি জানতেন, রানী মেরি অ্যান্টোইনেট (ফরাসি বিদ্রোহের পূর্বে ফ্রান্সের সর্বশেষ রানী) এর সাথে সম্পর্ক খুব একটা ভালো যাচ্ছিলো না কার্ডিনাল ডি রোহানের। এ সুযোগটাকেই কাজে লাগালেন তিনি, প্রেমের ফাঁদে ফেললেন রোহানকে। সম্পর্কের একপর্যায়ে জিয়ান্নি জানালেন, মেরির সাথে তার কথা হয়েছে। কিছু কাজ করলে রোহান আবারও মেরির মন জয় করতে পারবেন। সহজ-সরল রোহান জিয়ান্নির ছলনা বুঝতে পারেন নি। তিনি তার অভিনয়কে সত্য বলেই ধরে নিলেন।
কার্ডিনাল ডি রোহান; Source: Wikimedia Commons
জিয়ান্নির পরিকল্পনা কতটা গোছানো ছিলো তা ভাবলেও অবাক হতে হয়। রোহানের ধারণা পাকাপোক্ত করতে তিনি রানীর নাম দিয়ে বেশ কিছু চিঠি জালিয়াতি করেছিলেন। এমনকি একবার মেরির মতো দেখতে এক পতিতাকেও সাজিয়ে এনেছিলেন তিনি, দুজনের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিলেন রাতের আঁধারে। অন্ধকারে সেই পতিতাকে মেরি ভেবে ভুল করেছিলেন রোহান। তিনি ভাবলেন, আসলেই বুঝি রানী তার শয্যাসঙ্গিনী হতে এসেছেন, সত্যিই বুঝি রানীর সাথে তার সম্পর্ক জোড়া লেগে যাচ্ছে।
প্রেমাবেগে উদ্বেলিত রোহান রানীকে উপহার দিতে চাইলেন। রানীর জন্য উপহার বলে কথা, সেটা তো যেনতেন জিনিস হলে চলবে না। তাই তিনি কিনে আনলেন ডায়মন্ডের তৈরি নেকলেস, যেটির বর্তমান বাজারমূল্য দশ লক্ষ ইউএস ডলারের কম হবে না (৮ কোটি ২১ লক্ষ টাকার কাছাকাছি)। মজার ব্যাপার হলো, রোহানের কাছ থেকে এই উপহার নিয়ে যায় নিজেকে রানীর ভৃত্য বলে পরিচয় দেয়া এক লোক। সেই লোকটি আর কেউ নন, স্বয়ং জিয়ান্নির স্বামী! ছদ্মবেশ ধরে নেকলেসটি হাতিয়ে সটকে পড়েন তারা। পরবর্তীতে জানা যায় যে, সেই নেকলেসটি আসলে রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের উপপত্নীর জন্য বানানো হয়েছিলো।
জিয়ান্নি অবশ্য ধরা পড়েছিলেন। কিন্তু পুরুষের ছদ্মবেশ ধরে জেলখানা থেকে পালিয়েও যান তিনি। বাকি জীবনটা তিনি লন্ডনেই কাটিয়ে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
৩) থমাস ব্লাডের অদ্ভুত প্রাপ্তি
ইতিহাসে অদ্ভুত উপায়ে চৌর্যবৃত্তি সারার জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে আছে থমাস ব্লাড। আর এ চুরির ফল হিসেবে তিনি যা পেয়েছিলেন, সেটা জানলে বিস্মিত না হয়ে উপায় থাকবে না।
থমাস ব্লাড; Source: Wikimedia Commons
ব্লাড পরিকল্পনা করেছিলো রাজকোষাগার থেকে বিভিন্ন ধনরত্ন চুরির। তবে এজন্য যে পরিকল্পনা সে সাজিয়েছিলো, তা ছিলো একেবারেই দুর্বল। প্রথমেই কোষাগারের বৃদ্ধ রক্ষীকে আঘাত করে অজ্ঞান করা হয়। এরপর ভেতরে ঢুকে হাতের সামনে যা পায়, তাই নেয়া শুরু করে সে আর তার দুষ্কর্মের আরেক সঙ্গী। এগুলোর মাঝে রাজার মুকুটে শোভা পাওয়া মূল্যবান রত্নও ছিলো।
রাজা দ্বিতীয় চার্লস; Source: Wikimedia Commons
বের হতে গিয়েই তালগোল পাকিয়ে যায় সবকিছু। কারণ ততক্ষণে অন্যান্য প্রহরীরা টের পেয়ে যাওয়ায় চলে আসে তারা। ফলে গ্রেফতার করা হয় থমাস ব্লাডকে। কিন্তু ব্লাডের এক কথা, সে রাজা দ্বিতীয় চার্লস ছাড়া আর কারো সাথেই কথা বলবে না। অবশেষে তাকে সত্যি সত্যিই রাজার সামনে হাজির করা হয়। তার চুরির এমন অদ্ভুত কাহিনী জেনে রাজাও বেশ মজা পেয়ে গেলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, ব্লাডকে যেন আয়ারল্যান্ডে বিশাল বড় একটি জমি উপহার হিসেবে দেয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, তিনি তাকে নিজের সভাসদবর্গের একজন হিসেবেও স্থান দেন!
৪) ডি বি কুপারের অমীমাংসিত রহস্য
ডি বি কুপারকে বলা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত প্লেন হাইজ্যাকার, যার কোনো কূলকিনারা আজও করতে পারে নি পুলিশ।
ডি বি কুপার;
১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর দুপুরবেলা পোর্টল্যান্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান প্রায় ছ’ফুট লম্বা মধ্যবয়স্ক কুপার। কাউন্টারে নিজেকে ড্যান কুপার হিসেবে পরিচয় দিয়ে সিয়াটল যাবার জন্য ৩০৫ নং ফ্লাইটের টিকেট কাটেন তিনি। তিনি ঠিক কোন সিটে বসেছিলেন তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। সে যা-ই হোক, দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে এক-তৃতীয়াংশ যাত্রী নিয়ে উড়াল দেয় প্লেনটি। কিছুক্ষণ পরই ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টের কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে তিনি নিজের উদ্দেশ্যের কথা জানান, দাবি করে বসেন ২ লক্ষ ইউএস ডলার, বর্তমানের হিসেবে যা প্রায় ১১,৬০,০০০ ইউএস ডলারের কাছাকাছি (আনুমানিক সাড়ে ন’কোটি টাকা)। সেই সাথে চারটি প্যারাস্যুটও চান তিনি। নাহলে সাথে থাকা বোমার সাহায্যে প্লেনে বিষ্ফোরণের হুমকি দেন কুপার।
এরপর সময় সুযোগ বুঝে প্লেন থেকেই মুক্তিপণের অর্থগুলো নিয়ে প্যারাসুট সহ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কুপার। অনেক অনুসন্ধান চালিয়েও তার কোনো হদিস খুঁজে পায় নি পুলিশ। শেষমেশ গত বছরের ৮ জুলাই হাল ছেড়ে দেয় এফবিআই-ও। তারা জানায়, কুপারের চেয়েও আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অর্থ ও জনশক্তি বিনিয়োগ করতে হবে তাদের। তাই এসব নিয়ে আর পড়ে থাকা যাবে না।
৫) জাপানের অমীমাংসিত রহস্য
১৯৬৮ সালের কথা। জাপানের কুখ্যাত ফুশু জেলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো ব্যাঙ্কনোট বহনকারী একটি গাড়ি। সেখানে ছিলো প্রায় তিনশ মিলিয়ন ইয়েন (বর্তমান বাজারমূল্য বাংলাদেশী হিসেবে প্রায় সাড়ে ২১ কোটি টাকা)। পুলিশ ইউনিফর্ম পরিহিত এক লোক হঠাৎ করে হাত উঁচিয়ে গাড়িটি থামাতে বলে। গাড়িটি থামার পর সে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে থাকা লোকদের জানায়, ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের বাড়িতে কিছুক্ষণ আগেই হত্যাচেষ্টার উদ্দেশ্যে বোমা হামলা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তার কাছে খবর এসেছে যে, এ গাড়িতেও বোমা লুকিয়ে রাখা আছে।
সন্দেহভাজন ডাকাতের কম্পোজিট ইমেজ;
এ কথা শুনে ভয় পেয়ে যায় গাড়ির লোকজন। তাকে গাড়িটি সার্চ করার অনুমতি দেয় তারা। একটু পরই গাড়ির কাছ থেকে ধোঁয়া ওড়া শুরু করলে লোকগুলো সবাই দৌড়ে জেলের দেয়ালের কাছে চলে যায়। ঠিক এ মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিলো পুলিশের ইউনিফর্ম পরে ছদ্মবেশ ধারণ করা লোকটি। সাথে সাথেই সে ড্রাইভারের সিটে উঠে চোখের পলকে হাওয়া হয়ে যায় গাড়িটি নিয়ে!
ঘটনাস্থলে ১২০টি আলাদা আলাদা এভিডেন্স খুঁজে পেয়েছিলো পুলিশ। কিন্তু এগুলোর অধিকাংশই আসলে পুলিশকে ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছিলো। এরপর থেকে লোকটিকে ধরতে চিরুণি অভিযান চালিয়েছে জাপানের পুলিশ। বলা হয়ে থাকে, এটি দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যায়বহুল তদন্ত ছিলো। কিন্তু আজপর্যন্ত সেই ডাকাত কিংবা তার চুরি করা অর্থের কোনো নামগন্ধও খুঁজে পায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।