“রানার চলেছে তাই ঝুম ঝুম ঘন্টা বাজছে রাতে….” কবি সুকান্তর এই কবিতাটি পরবর্তীকালে গান হয়ে লোকের মুখে মুখে ঘুরত। রানার অর্থাৎ ডাকহরকরা এক সময় দূর-দূরান্তে সংবাদ আদান-প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। প্রাচীনকালে যাতায়াতের বা যোগাযোগের তেমন সুব্যবস্থা ছিল না। প্রিয়জনদের কথা পৌঁছে দিতে এরাই ছিল একমাত্র ভরসা। ভয়কে তুচ্ছ করে, জীবন বিপন্ন করে এরা যে কত লোকের সুখ-দুঃখের কথা গ্রাম থেকে গ্রামে পৌঁছে দিত তার কোনও হিসেব নেই।
সংবাদ আদান-প্রদান শুধু মানুষই করে তা নয়। পশু, পাখিদের মধ্যেও এমন ঘটনা দেখা যায়। মানুষের ভাষা আছে তাই তারা সাধারণত ভাষার মাধ্যমেই ভাব বিনিময় বা সংবাদ আদান-প্রদানের কাজটা করে থাকে। পশু, পাখিদের ভাষা নেই। তারা এই কাজটি সারে ধ্বনির মাধ্যমে। মানুষেরও যখন ভাষা ছিল না, জঙ্গলে, গুহায় বাস করত, তখন তারাও ভাব বিনিময়ের জন্য পশু, পাখিদের মতোই ধ্বনির সাহায্য নিত। আফ্রিকার গভীর জঙ্গলে বসবাস করে এমন অনেক উপজাতি এখনও ঢাক বা ড্রাম জাতীয় কোনও বাজনা বাজিয়ে সংবাদ প্রেরণ করে। পতাকা (ফ্ল্যাগ) বা আলোর সংকেতের সাহায্যে সংবাদ দেওয়া নেওয়া বা নির্দেশ পাঠানোর রেওয়াজ এখনও আছে। শহরাঞ্চলে যানবাহন নিয়ন্ত্রণে আলোর সাহায্য নেওয়া হয়। লাল, হলদে এবং সবুজ আলোর মাধ্যমে গাড়ীর চালককে নির্দেশ পাঠানো হয় কখন তাকে থামতে হবে এবং কখন তাকে চলতে হবে।
সংবাদ দেওয়া নেওয়ার এই পদ্ধতিগুলি ছোট ছোট এলাকার মধ্যে ঠিক আছে। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে সংবাদ আদান-প্রদানের এই সীমানা বাড়তে থাকে। তখন মানুষের প্রয়োজন হল অন্য কারও সাহায্য নেওয়া। প্রাচীনকালে এই কাজটি যারা করত তাদের বলা হত ‘দূত’। রামায়ণ মহাভারতের যুগে সংবাদ দেওয়া নেওয়ার কাজটা মূলত দূতেরাই করত। আগেকার দিনে রাজাদের মধ্যে দূতের প্রচলন ছিল। সে যুগে দূত-হত্যা জঘন্যতম অপরাধ বলে গণ্য হত। এমনকি শত্রুপক্ষের দূতও যথাযথ মর্যাদা পেত। এই দূত প্রথা এখনও আছে। বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলিই তার প্রমাণ।
৩৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যবিলনের রাজা ছিলেন প্রথম সারগন। সম্ভবত তাঁর আমলেই চিঠির মাধ্যমে সংবাদ দেওয়া নেওয়ার কাজ প্রথম চালু হয়। সে সময় চিঠি লেখা হত মাটির টালি কিংবা পাথরের উপর। তারপর সেই মাটি কিংবা পাথর দিয়ে খাম তৈরি করা হত। রোদে খাম শুকিয়ে তাতে চিঠি ভরে প্রাপকের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হত। কোনও ক্রীতদাসকে দিয়ে এই চিঠি দেওয়া নেওয়ার কাজ করানো হতো। যার চিঠি সে সেটি পাওয়ার পর খামটি ভেঙে চিঠি বের করে নিত। মিশরের ৩৫০০ বছরের পুরনো একটি স্তূপ আছে। এটি দ্বিতীয় আমেন হোটেপ্-এর স্তূপ নামে পরিচিত। এর গায়ে পত্রবাহকের ছবি আঁকা আছে।
ডাক চলাচলের জন্য প্রাচীনকালে পাখির সাহায্য নেওয়া হত। আর এ ব্যাপারে পায়রাই ছিল মানুষের প্রথম পছন্দের পাখি। ‘হোমা’ নামের পায়রাই এ কাজে বেশি ব্যবহার করা হত। রাজা সলোমনের কয়েকটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পায়রা ছিল। রাজপ্রাসাদ ছেড়ে দূরে কোথাও গেলে তিনি এই পায়রাগুলিকে সঙ্গে নিতেন। এদের সাহায্যে চিঠি দেওয়া নেওয়া করে রাজপ্রাসাদের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ রাখতেন। জুলিয়াস সিজার গুপ্ত সংবাদ সংগ্রহের জন্য পায়রার সাহায্য নিতেন। শোনা যায়, ইরাকে এক সময় পায়রার সাহায্যে ডাক ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়েছিল। ১৮৭১ সালে ফ্রান্স ও প্রুশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বাঁধলে পায়রার ডাক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল।
প্রাচীনকালে গ্রিক নাবিকেরা সমুদ্রে পাড়ি দেবার সময় সঙ্গে পায়রা নিয়ে যেত। দেশে ফেরার আগে সেগুলিকে উড়িয়ে দেওয়া হত। জাহাজ ফেরার আগেই পায়রাগুলি দেশে ফিরে আসত এবং নাবিকদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছে তাদের আগমনবার্তা আগেই পৌঁছে দিত। দুর্গম স্থানে চিঠি দেওয়া নেওয়ার জন্য উন্নত প্রযুক্তি হাতে আসার আগে পর্যন্তও সেনাবাহিনীতে পায়রার সাহায্য নেওয়ার রেওয়াজ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন সেনারা পায়রার সাহায্যে সংবাদ পাঠাত। তারা যুদ্ধ বিমানে দুটি করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পায়রা রাখত। বিমান দুর্ঘটনায় পড়লে বিমান চালক পায়রা দু’টিকে উড়িয়ে দিত। এরা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে বিপদের কথা জানিয়ে দিত। পায়রার পায়ে চিঠি বেঁধে দিয়ে প্রিয়জনদের কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার রেওয়াজ একসময় ছিল। তবে এইভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠত শুধু বিশিষ্ট লোকেদের মধ্যে।
সর্বসাধারণের মধ্যে ডাক ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য প্রয়োজন ছিল এমন এক ব্যবস্থা যাতে দূর-দূরান্তে নিয়মিতভাবে চিঠির আদান-প্রদান করা যায়। এর জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো প্রথম গড়ে তোলেন পারস্যের রাজা সাইরাস। ৫৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনিই প্রথম ‘ডাকহরকরা’র প্রচলন করেন এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়মিত ডাক চলাচলের ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। প্রথমদিকে পত্রবাহকরা পায়ে হেঁটে অথবা দৌড়ে চিঠিপত্র এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যেত। এতে সময় লাগত বেশি। দ্রুত এবং আরও দূরে চিঠি নিয়ে যাবার জন্য পরে ঘোড়ার ডাকের প্রচলন হয়।
পরবর্তীকালে ডাকহরকরার মাধ্যমে চিঠিপত্রের আদান-প্রদান দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশে ঘোড়ার ডাকের প্রচলন ছিল। প্রথমদিকে রাজারা এ ব্যাপারে উদ্যোগী হলেও পরবর্তীকালে ডাক চলাচলের ভার পড়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উপর। কোথাও কোথাও ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ডাক চলাচল ব্যবস্থা শুরু হয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে ফরাসীর রাজধানীতে মঁসিয়ো জ্যাঁ-দ্য-ভিয়াইয়ে ডাক চলাচলের ব্যবস্থা করেন। তিনিই প্রথম ডাকবাক্সের প্রবর্তন করেছিলেন। রাজধানীর ব্যস্ত এলাকায় তিনি কতগুলি বাক্স বসিয়েছিলেন। এই বাক্সের সঙ্গে ঝোলানো থাকতো ছবি আঁকা খাম। চিঠি পাঠাতে হলে এই খামে নাম, ঠিকানা লিখে চিঠিটি ভরে বাক্সে ফেলে দিলেই হল। ডাক হরকরারা যথা সময়ে বাক্স থেকে চিঠিগুলি বের করে সেগুলি নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিত। এর জন্য অবশ্য পত্র প্রেরককে এক ‘সোল’ (আধ পেনির সমান) মূল্য দিতে হত। জ্যাঁ-দ্য-ভিয়াইয়ের এই ডাক ব্যবস্থা থেকেই পরবর্তীকালে ডাকটিকিট প্রচলনের পরিকল্পনা গড়ে ওঠে।চিঠি আদান-প্রদানে ডাকটিকিটের ব্যবহার প্রথম শুরু হয় গ্রেট ব্রিটেনে। ডাকটিকিটের নক্সা কেমন হবে তা ঠিক করতে সে দেশের সরকার সে সময় চিত্রশিল্পীদের কাছে নকশা চেয়ে পাঠান। এর জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রয় তিন হাজার নকশা সরকারের কাছে জমা পড়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের কথা একটি নকশাও সরকারের পছন্দ হল না। কী করা যায়? এমন চিন্তা ভাবনা যখন চলছে তখন ট্রেজারির সঙ্গে যুক্ত স্যার রাওল্যান্ড হিল দু’টি ছবি আঁকেন। ছবি দু’টি ছিল সে দেশের রানির। মজার কথা, এই ছবি দু’টিই সকলের পছন্দ হয়ে যায়। অবশেষে ১৮৪০ সালে ৬ মে এই ছবি দু’টির অনুকরণে দু’টি ডাকটিকিট ছেপে বের হয়। পৃথিবীর প্রথম ডাকটিকিট দু’টির একটি ছিল এক পেনি মূল্যের এবং অপরটি ছিল দু’পেনি মূল্যের। এদের রঙ ছিল যথাক্রমে কালো ও নীল। এই ডাকটিকিট দু’টিই ‘পেনি ব্ল্যাক’ নামে পৃথিবী খ্যাত হয়ে আছে। এরপরে অন্যান্য দেশেও ডাকটিকিটের ব্যবহার শুরু হয়। যেমন, ১৮৪৩ সালে জেনিভা এবং ব্রাজিলে, ১৮৪৫ সালে ক্যানটনস অফ ব্যাসল-এ, ১৮৪৭ সালে ত্রিনিদাদ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং মাউরিটিয়াসে, ১৮৪৯ সালে ফ্রান্স, বেলজিয়াম এবং ব্যাভেরিয়ায়।
আমাদের দেশে যে ডাক ব্যবস্থা চালু আছে তার সূত্রপাত ইংরেজ আমলে। তবে ইংরেজ আসার আগেও ভারতে ডাক ব্যবস্থা ছিল। চতুর্দশ শতাব্দীতে ইবনবতুতা ভারতবর্ষ ভ্রমণে আসেন। তাঁর লেখা থেকে জানা যায় যে মহম্মদ বিন্ তুঘ্লকের রাজত্বকালে ডাকহরকরার মাধ্যমে এদেশে ডাক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। এই সময় পায়ে চলা এবং ঘোড়ায় চড়া দু’ধরনের পত্রবাহক ছিল। এক মাইল অন্তর পায়ে চলা পত্রবাহক এবং চার মাইল অন্তর ঘোড়ায় চড়া পত্রবাহক পাল্টানোর ব্যবস্থা ছিল। ১৫৪১ – ১৫৪৫ সাল ছিল শের শাহের রাজত্বকাল। এই সময়ে তিনি বাংলার সোনারং থেকে সিন্ধু নদের তীর পর্যন্ত দু’হাজার মাইল লম্বা একটি রাস্তা তৈরি করেছিলেন। এই রাস্তা দিয়েই তাঁর আমলে ঘোড়ার ডাক চলাচল করত। প্রতি দু’মাইল অন্তর দু’টি করে ঘোড়সওয়ার থাকত। ১৬৭২ সালে মহীশূরের রাজা চিকদেওরাজ তাঁর রাজত্বে ডাকের সুব্যবস্থা করেছিলেন। পরবর্তীকালে হায়দার আলী এই ডাক ব্যবস্থার আরও উন্নতি ঘটান। মুঘল সম্রাট আকবরের সময় দশ মাইল অন্তর একটি করে ডাকঘর ছিল। দ্রুতগামী তুর্কী ঘোড়ার সাহায্যে সে সময় ডাক চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই ডাকঘরগুলিকে বলা হত ‘ডাকের আড্ডাঘর’। এছাড়াও হায়দ্রাবাদ, গোয়ালিয়র, জয়পুর, পাতিয়ালা, ত্রিবাঙ্কুর, কোচিন প্রভৃতি রাজ্যগুলিতে নিজস্ব ডাক ব্যবস্থা ছিল। ডাকহরকরাদের কাজ ছিল খুব কষ্টের এবং বিপদসঙ্কুল। সে সময় পথঘাট এত উন্নত ছিল না। চিঠির বস্তা পিঠে নিয়ে তাদের যাতায়াত করতে হত কখনও গ্রামের মেঠো পথ ধরে, আবার কখনও বনজঙ্গলের ভিতর দিয়ে। অস্ত্র হিসেবে হাতে থাকত একটি বল্লম মাত্র। আর মাথায় বাঁধা থাকত ঝুমঝুমি। পথ চলার সময় এই ঝুমঝুমি থেকেই ঝুমঝুম শব্দ বের হত। বনের পশুরা যাতে ভয় পায় তাই এই ব্যবস্থা থাকত। তা সত্ত্বেও এদের মধ্যে কাউকে কাউকে কখনও সখনও হিংস্র জন্তুর আক্রমণে যে প্রাণ দিতে হত না, তা নয়। রাতের অন্ধকারে পথ চলার সময় এদের হাতে একটি লন্ঠন থাকত। সেকালে ডাকহরকরার কাজ যারা করত তাদের বলা হত ‘কাসিদ’।
ভারতবর্ষে দু’ধরনের ডাকহরকরা ছিল। একদল ছিল যারা পায়ে হেঁটে চিঠি নিয়ে যেত, আর একদল ছিল যারা ঘোড়ার পিঠে চেপে এই কাজ করত। মরু অঞ্চলে, বিশেষ করে সিন্ধু দেশে ঘোড়ায় চেপে সব জায়গায় যাওয়া যেত না। তাই সেখানে ঘোড়ার বদলে অনেক সময় উট ব্যবহার করতে হত। তাই বলা যেতে পারে মরু অঞ্চলে উটের ডাকের প্রচলন ছিল।
আগেকার দিনে ডাকহরকরাদের কাজ শুধু চিঠি বিলির মধ্যেই আটকে থাকত না। চিঠি বিলির সঙ্গে আরও অনেক ধরনের কাজ করতে হত। মহীশূরের ডাকহরকরাদের গুপ্তচরের কাজও করতে হত। রাজস্থানের ডাকহরকরাদের চিঠির সঙ্গে ফল ও ফুলও নিয়ে যেতে হত। এগুলি তারা বিভিন্ন মন্দিরে পৌঁছে দিত। এমনকি ভ্রমণার্থীদের দেখাশোনার দায়িত্বও কখনও কখনও ডাকবিভাগকে নিতে হত।
ডাকহরকরাদের অনেক সময় চিঠি বিলিও করতে হত। চিঠি নিয়ে গ্রামে পৌঁছে ডাকহরকরারা বিউগল বাজাত। বিউগলের শব্দ শুনে গ্রামবাসীরা বুঝতে পারত যে গ্রামে ডাক পৌঁছেছে। তারা তখন ডাকহরকরার কাছে এসে চিঠি সংগ্রহ করত এবং কোনও চিঠি পাঠাতে হলে তার হাতে দিয়ে দিত। অনেক সময় নিশান উড়িয়েও ডাক পৌঁছনোর খবর প্রচার করা হত।
ভারতে প্রথম ডাকটিকিট বের হয় সিন্ধু দেশ থেকে। সেখানকার কমিশনার স্যার বার্টল ফ্রেয়ারের উদ্যোগে ১৮৫২ সালের ১ জুলাই এই টিকিট বের হয়। ‘সিন্ধু জেলা ডাক’ (Scinde District Dawk) নামের এই টিকিট শুধু ভারতবর্ষের নয়, এশিয়ার প্রথম ডাকটিকিট। এই টিকিট অবশ্য ভারতবর্ষের সর্বত্র ব্যবহৃত হত না। শুধু মাত্র সিন্ধু দেশেই এর ব্যবহার হত। এর কারণ, সেই সময় সিন্ধু দেশের ডাকঘর সর্বভারতীয় ডাকবিভাগের (ইম্পিরিয়াল ডাক বিভাগ) অধীনে ছিল না।
সর্বভারতীয় ডাকবিভাগ প্রথম ডাকটিকিট ছেপেছিল ১৮৫০ সালে। এই টিকিটের নকশা ছিল তালগাছ ও সিংহ। এই টিকিট ছাপা হয়েছিল কলকাতার টাঁকশাল থেকে। কিন্তু টিকিট এত কম ছাপা হয়েছিল যে সেগুলি ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। এরপর ভারতীয় সার্ভে অফিসের উদ্যোগে আবার ডাকটিকিট ছাপার আয়োজন করা হয়। এবার যে টিকিট ছাপা হল তার রঙ ছিল লাল, মূল্য ছিল দু’পয়সা, আর নকশা ছিল সাড়ে নয়টি অর্ধগোলাকৃতি খিলান। কিন্তু অল্প কিছু টিকিট ছাপানোর পর লাল কালি গেল ফুরিয়ে। সে সময় এই কালি আমাদের দেশে পাওয়া যেত না। বিদেশ থেকে আনাতে হত। সময় লাগত অনেক। কালির অভাবে টিকিট ছাপানোর কাজ বন্ধ হয়ে গেল। ফলে এই টিকিটও জনসমক্ষে আসতে পারল না। প্রকৃতপক্ষে সর্বভারতীয় ডাকবিভাগের প্রথম ডাকটিকিট বের হয় ১৮৫৪ সালে। এই সময় দু’পয়সা, এক আনা, দু’আনা এবং চার আনা মূল্যের চারখানি টিকিট বের হয়। দু’পয়সার টিকিট ছাপা হয়েছিল নীল কালিতে। এক আনা টিকিটের রঙ ছিল সিঁদুরের মতো লাল। সবুজ রঙে দু’আনার টিকিট এবং লাল ও নীল এই দুই রঙে ছাপা হয়েছিল চার আনার টিকিট। এরপর বহুবার টিকিটের রঙ ও নকশা পাল্টানো হয়েছিল এবং অন্যান্য মূল্যের টিকিটও বের করা হয়েছিল।
বর্তমানে ভারতবর্ষের যে কোনও জায়গায় চিঠি পাঠাতে একই ডাকমাশুল লাগে। আগেকার দিনে চিঠি যত দূরে যেত ডাকমাশুল তত বেশি লাগত। সবচেয়ে কম দামের ডাকটিকিটের মূল্য ছিল দু’পয়সা। সে সময় এমন মানুষও ছিল যাদের দু’পয়সা দিয়েও ডাকটিকিট কেনার ক্ষমতা ছিল না। এদের কথা ভেবে ডাক বিভাগ ১৮৭৯ সালে এক পয়সা দামের পোস্ট কার্ড চালু করে। এর ফলে ডাক পরিষেবা গরিব মানুষের কাছেও পৌঁছে যায়। তবে প্রথম প্রথম মানুষ পোস্ট কার্ডে চিঠি লিখতে ভয় পেত। কারণ এতে লেখা চিঠি যে কেউ পড়তে পারত। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনাও প্রকাশিত হত। এমনকি ব্যঙ্গ করে নানা ছড়াও লেখা হত।
গল্পের বিষয়:
ইতিহাস