গেল তিন দিনের টানা বৃষ্টিতে কাদার নদী হয়ে গেছে খানাখন্দে ভরা ট্রেইলটা। তেরছা বৃষ্টির ভেতর দিয়ে আধবোঁজা চোখে সামনে তাকাল ওরিন ওসমান, নিজের খামখেয়ালকে দুষছে। যে লোকটাকে বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করেছে সেদিন, আজ তার বাড়িতেই যাচ্ছে তুফান মাথায় করে!
ভালো কোনো কিছুই ঘটবে না এ থেকে, সে জানে, তবু এল পাসো থেকে মোগাইওনের দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দিচ্ছে শুধু একটি কারণে—তার সঙ্গের টাকাগুলো একজন অল্প বয়সী বিধবা আর তার সন্তানের প্রয়োজনে আসতে পারে। সন্দেহ নেই, বারটেন্ডার বা ওই স্যালুনের খদ্দের, কাউকেই টাকার ব্যাপারে বিশ্বাস করা যেত না। তা ছাড়া, নিছক মজা দেখার জন্যেও কেউ টনটো বেসিনে বিপদের মধ্যে নিজের গলা বাড়াতে রাজি হতো কি না, সে ব্যাপারেও সন্দেহ ছিল।
ওরিন ওসমান গোলযোগ-সন্ধানী নয়। ওদের পাঁচ ভাইয়ের কেউই তা না। নানা সময়ে, নানা ধরনের কাজ করেছে সে, বেশির ভাগ হিংসাত্মক। সে জন্মগতভাবে এবং সহজাত প্রবণতায় একজন পশ্চিমের মানুষ। বাফালো শিকার করেছে, প্রসপেক্টিং করেছে, একটা গোল্ড-মাইনিং টাউনের পত্তন করেছিল, যার মার্শালও ছিল সে-ই। পিঠ চাপড়ানো বা পিছিয়ে যাওয়া—কোনোটাই তার ধাতে নেই, ফলে সর্বদা একটা-না-একটা ঝামেলায় জড়িয়ে থাকে।
তবে ওর কিছু কিছু সমস্যা অন্য উত্স থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। এগুলো জন্ম নিয়েছিল সহিংসার প্রতি একটা গূঢ় এবং তীব্র টান থেকে, যে টান ওর সত্তার গভীরে লুকিয়ে আছে। এই প্রবণতা সমপর্কে ওরিন সচেতন এবং এটাকে সে দাবিয়ে রাখে। কিন্তু কখনো কখনো ফুঁসে ওঠে স্বভাবটা, আর তখন সে সোজা ঝাঁপিয়ে পড়ে বিপদের মধ্যে। ঢ্যাঙ্গা, কর্কশ একটা মানুষ, দেয়ালে পিঠ ঠেকলে ভয়ঙ্কর, লড়াই করে ক্ষিপ্ত ভাইকিংয়ের তেজে, তবে ঠান্ডা মাথায় এবং বুদ্ধি খেলিয়ে।
দীর্ঘদেহী পুরুষ ওরিন, দেখে যা মনে হয়, তারচেয়ে বেশি ওজন। উঁচু হনু আর সবুজ চোখ রোদে পোড়া লম্বাটে মুখাবয়বে এক ধরনের আভিজাত্য দান করেছে। ওই চোখগুলো ভীষণ শান্ত এবং সংযত। ঘোড়া আর অস্ত্রের প্রতি তার একটা নাড়ির টান রয়েছে। সে ওদের বোঝে, যেমন ওরা বোঝে তাকে।
বন্দুক চালনায় ওর হাতেখড়ি শৈশবে। এটাই রীতি ওদের পরিবারে। শরীরে এর ভার বহনের সামর্থ্য হওয়ার পরপরই রাইফেল ছোড়া শেখে ওরা। জীবনে প্রথম যখন শিকার করে সে, তখন তার বয়স নয় বছরও হয়নি। একটা কুগর মেরেছিল; ওদের শুয়োরের খোঁয়াড়ে হানা দিয়েছিল ওটা। তের বছর বয়সে হত্যা করে এক প্রতিবেশীকে, যার সঙ্গে ওদের তখন জাতি-বিবাদ চলছিল। লোকটা রাইফেল তাক করেছিল ওর বাবার দিকে, আর তাতেই ওরিনের মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল।
খুব অল্প বয়সে বাড়ি ছাড়ে সে, ন্যাচেজ ট্রেইল ধরে নিউঅর্লিন্স চলে যায়। এর কিছুদিন পর যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হল তখন সে-ও যোগ দিল যুদ্ধে। তবে কনফেডারেটদের দলে নয়, সে নাম লিখিয়েছিল ইউনিয়ন আর্মির পক্ষে, স্বাধীন দেশটাকে একসুতোয় বেঁধে গড়বার আশায়। যুদ্ধের পর প্রসপেক্টিং থেকে শুরু করে রাঞ্চিং, নানা ধরনের কাজ করেছে, বিদেশেও ছিল কিছু দিন। ইয়ুরোপ আর আফ্রিকার অনেক দেশ ঘুরেছে। কিন্তু কেন যেন কোথাও কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারেনি। কয়েকটা মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও হয়েছিল কিন্তু ভাগ্যের ফেরে সেগুলোও টেকসই হয়নি। শেষমেশ একদিন টেক্সাসে ফিরে আসে সে, মোরায় ছোটভাই ওরিনের রাঞ্চে দিন কয়েক কাটিয়ে আবার পথে নামে, যাযাবরের মতো ঘুরতে ঘুরতে এসে হাজির হয় এল পাসোয়। আর সেখানেই এক বারে, টনি কার্টিসের সঙ্গে বচসা হয় ওর। কার্টিস মিথ্যুক বলেছিল ওকে, পিস্তলের দিকে হাত বাড়িয়েছিল।
বিজলির গতিতে ড্র করে ওরিন, প্রতিপক্ষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে ধরাশায়ী করে। এর এক ঘণ্টা বাদে, মুমূর্ষুর বিবর্ণ হোটেল কামরায় তার ডাক পড়ে। ভাঁজ করা একটা কম্বলের ওপর মাথা এলিয়ে শুয়ে ছিল টনি কার্টিস, কালো চুলগুলো এলোমেলো, মুখ মড়ার মতো ফ্যাকাসে। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিল লোকটা। দরজার বাইরেই তাকে বলা হয়েছিল কার্টিস বড় জোর আর এক থেকে দেড় ঘণ্টা বাঁচতে পারে।
ঋজু ভঙ্গিতে কামরার ভেতর ঢুকল ওসমান, মৃতুপথযাত্রীর বিছানার পাশে নীরবে গিয়ে দাঁড়াল। অয়েলস্কিনে মোড়ানো একটা প্যাকেট বাড়িয়ে ধরল কার্টিস। ‘পাঁচ হাজার ডলার আছে এতে,’ অস্ফুটে বলল। ‘আমার স্ত্রীর কাছে নিয়ে যাও এটা…মোনার কাছে, পিভটরকে, মোগাইওনে। ও খুব…খুব…বিপদে আছে।’
যে লোকটা তাকে হত্যা করেছে, বিশ্বাস করে তারই হাতে এত টাকা তুলে দিচ্ছে, ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত বৈকি! ওসমান চোখ নামিয়ে তাকাল ওর দিকে, ভুরু কোঁচকানো।
‘আমাকে কেন?’ শুধাল সে। ‘আমাকে বিশ্বাস করছ টাকা দিয়ে? আর তা ছাড়া, আমিই বা করতে যাব কেন কাজটা?’
‘তুমি… তুমি সত্ লোক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তুমি মোনাকে সাহায্য করবে। করবে না? আ…আমি আসলে মাথা গরম, বোকা। দুশ্চিন্তায় ছিলাম…অধৈর্য হয়ে পড়েছিলাম। তোমার কোনো দোষ ছিল না।’
নীল চোখজোড়া থেকে অনেক আগেই চলে গিয়েছিল বেপরোয়া আলোটা আর যেটুকু আলো অবিশষ্ট ছিল, তা-ও এখন নিভে আসছিল।
‘আমি কাজটা করব, কার্টিস। তোমাকে কথা দিচ্ছি… ওরিন ওসমান তোমার কাছে ওয়াদা করছে।’
মুহূর্তের জন্য ঝিকিয়ে উঠল নীল চোখ দুটো, সেখানে পরিচিতির ছায়া। ‘তু… তুমিই… ওসমান?’
মাথা ঝাঁকাল ওরিন, কিন্তু আলোটা তখন নিভে গেছে। টনি কার্টিস যাত্রা করেছে চিরশান্তির দেশে।
দীর্ঘ, বন্ধুর যাত্রা, তবে আরও খানিকটা বাকি আছে। এল পাসোর পশ্চিমে লুটেরা অ্যাপাচিদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। সিলভার সিটিতে, পরিচিত চেহারার দুজন রাইডার ওকে অনুসরণ করে একটা সালুনে গিয়ে ঢোকে, মারামারি শুরু করে। ওরিন পোড়খাওয়া মানুষ, তস্করদের চালাকি দেখলেই ধরতে পারে, তাই পা দেয়নি ফাঁদে। গুলি করে নিভিয়ে দিয়েছে সালুনের বাতিগুলো, অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে নিঃশব্দে সরে পড়েছে।
রৌনটা হঠাত্ পা হড়কাল কাদামাখা ট্রেইলে উঠল হাঁচড়ে-পাচড়ে, গাছপালার ভেতর দিয়ে এগোল। সহসা, বৃষ্টি-ধূসরিত সন্ধ্যার মাঝে, একটা বাতি নজরে এল, তারপর আরেকটা।
‘ইয়োলো জ্যাকেট,’ স্বস্তির স্বরে বলল ওরিন। ‘এর মানে আমাদের জন্য ভালো বিছানা, বেটা। ভালো বিছানা আর ভালো খাবার।’
ইয়োলো জ্যাকেট একটা যাত্রা-বিরতির জায়গা। একটা স্টেজ স্টেশন, একটা স্যালুন, একটা লিভারি স্টেইবল আর একটা জরাজীর্ণ হোটেল রয়েছে। আর আছে রোদেপোড়া ইটের একগুচ্ছ বাড়িঘর আর কিছু ফলস-ফ্রন্টেড স্টোর। কপার
ক্রিকের এক কোণে গড়ে উঠেছে শহরটা।
এটা জ্যাক প্যালেন্সের শহর। প্যালেন্স ইয়োলো জ্যাকেট স্যালুন এবং লিংকন মাইনের মালিক। টমাস হার্ডি টাউন মার্শাল; মূলত প্যালেন্সের তল্পিবাহক। প্যালেন্স যেখানেই যায়, ছায়ার মতো তার সঙ্গে থাকে কার্ল রৌভ। দুর্মুখেরা বলে থাকে, বাইরে যা-ই মনে হোক না কেন, ইয়োলো জ্যাক টাউনের সব কিছুর নাটের গুরু আসলে প্রিন্স ময়নিহান, টনটো বেসিন অঞ্চলের বড় আউটফিট পিএম ব্র্যান্ডের মালিক।
ঘোড়া স্টেইবল করে ঢালু কাঁধের লিভারিম্যানের দিকে ফিরল ওরিন ওসমান। ‘ওকে এক বাটি ভূট্টা খেতে দিয়ো এখন। আর সকালে আরেক বাটি।’
‘ভূট্টা?’ এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়াল লিভারিম্যান জনি। ‘ভূট্টা হবে না। নাই।’
‘মালগাড়ির স্টক আর স্টেজ হর্সগুলোর জন্য ভূট্টা আছে। আমার ঘোড়াকে ওখান থেকেই দেবে।’
ওরিনের কণ্ঠে কর্তৃত্বের ঝাঁজ পুরোপুরি বুঝে ওঠার আগেই, দম দেওয়া পুতুলের মতো উঠে দাঁড়াল জনি, বিশাল রৌনটাকে ভূট্টা খাওয়াতে শুরু করল। অচিরেই নবাগতের কর্তৃত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বরের কথা তার স্মরণ হলো তার এবং বিষয়টা নিয়ে ভাবল সে, দেখল লোকটা চলে যাচ্ছে। ঋজু, দীর্ঘ পদক্ষেপে, সহজ এবং স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে, পায়ের পাতার ভরে, দীর্ঘদেহী অশ্বারোহী দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ওর কোমরে নিচু করে বাঁধা জোড়া পিস্তল ঝুলছে নিতম্বের কাছে।
অপলকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল জনি, তারপর কাঁধ উঁচু-নিচু করল। ‘জাত বিচ্ছু,’ বিড়বিড় করল সে, ‘হারামি টমাস হার্ডিকে এ ব্যাটা নিকেশ করলে ওর ঘোড়াটাকে আমি সারা জীবন মুফতে ভূট্টা খাওয়াতে রাজি।’
বাদুড়-ডানা দোর ঠেলে ইয়োলো জ্যাকেটে প্রবেশ করল ওরিন, স্যাডল ব্যাগগুলো ধপাস করে মেঝেয় রেখে, গটগট করে হেঁটে গেল বারে। ‘তোমার কাছে গলা ভেজানোর জন্য ভালো কী আছে, মিস্টার? রাই বাদে?’
‘ব্যাপার কী? রাই পছন্দ হয় না?’ খেঁকিয়ে উঠল বারটেন্ডার। লোকটার নাম ড্যানিয়েল, সংক্ষেপে ড্যানি। রোজ দুখানা পায়ের ওপর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ওর মেজাজ সর্বদা সপ্তমে চড়ে থাকে।
‘ব্র্যান্ডি আছে? বা কোনো আয়রিশ হুইস্কি?’
কটমট করে তাকাল ড্যানি। ‘মিস্টার, তুমি কোথায় এসেছ মনে, করছ? নিউইয়র্কে?’
‘ব্যাস, কর ড্যান। যে লোক জানে সে কী চায়, আমি তাকে পছন্দ করি। আমার কনিয়াক থেকেই ওকে দাও কিছুটা।’
ঘুরে বক্তার দিকে তাকাল ওরিন। বেশ লম্বা গড়ন, পরনে কালো রঙের দামি ব্রড ক্লথের স্যুট। ঈষত্ ঢেউ খেলানো সোনালি চুল, গায়ের রঙ হালকা গোলাপি। বয়স ত্রিশ বা কিছু বেশি। বাম কোমরে একটা হোলস্টার, উঁচু করে বাঁধা, পিস্তলের বাঁটটা সামনে ফেরানো।
‘ধন্যবাদ,’ সংক্ষেপে বলল ওরিন। ‘বৃষ্টির রাতে কনিয়াকের চেয়ে ভালো কিছু আর হয় না।’
‘আমার নাম ময়নিহান। পিএম আউটফিটটা আমি চালাই। এখান থেকে পুবে। সঠিক করে বললে, উত্তর-পুবে।’
মাথা ঝাঁকাল ওরিন। ‘আমি ওসমান। কোনো আউটফিট চালাই না, তবে খুঁজছি একটা। পিভটরক কোথায় জান?’
সবাই বলে তুখোড় পোকার খেলোয়াড় সে। বন্দুক ব্যবহার করতে করতে নজরও তীক্ষ। প্রিন্স ময়নিহানের চোখের তারায় চকিত ঝিলিক আর সতর্কতা তাই ওর দৃষ্টি এড়াল না।
‘পিভটরক? কেন, ওটা মোগাইওন অঞ্চলের একটা ঝরনা। একটা আউটফিটও অবশ্যি আছে ওদিক। এক-ঘোড়ার মামলা। কেন জিজ্ঞেস করছ?’
ওরিন শুরুতেই থামিয়ে দিল ময়নিহানকে। ‘দরকার আছে।’
‘অ। একাই যেতে হবে তোমাকে। কী একটা ঝামেলা চলছে ওখানে, মানে ক্যাটল ওয়র।’
পানীয়ের স্বাদ নিল ওরিন। কনিয়াকটা ভালো। বলতে কি, সেরা, নিউঅর্লিন্সের পশ্চিমে এত সরেস জিনিস সে এর আগে পান করেনি।
কী যেন নিজের নাম বলল লোকটা? হ্যাঁ, ময়নিহান। আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হয়, তার চেয়ে বেশি জানে লোকটা। কার্টিস তার বিধবা স্ত্রীকে সাহায্য করতে অনুরোধ করেছিল। পিভটরক আউটফিট কোনো বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে কি? ওরিন ঠিক করল ময়নিহানকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না। নির্দোষ সব বিষয়, বৃষ্টি, গরু, কনিয়াক—এগুলো নিয়ে ওরা গল্প করল আরও কিছুক্ষণ।
‘পশ্চিমে কেউ কনিয়াকের স্বাদ বোঝে না। কোথায় শিখেছ?’
‘প্যারি,’ যেন গুরুত্বহীন একটা ব্যাপার এভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দিল ওরিন, ‘মার্সেই, ফেজ, মারাকেশ।’
‘হুম, অনেক দেশ ঘুরেছ তাহলে। অবশ্য এটা এমন নতুন কিছু না।’ আঙুলের ইশারায় ভারী কাঁধের এক যুবককে দেখাল সোনালি-চুল। দু-হাতের ভাঁজে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে লোকটা। ‘ওই ছোকরাকে দেখছ? ওর নাম কেভিন পিটার্সন। কেমব্রিজ থেকে পাস করেছে, মদ খাওয়ার সময়ে কথায় কথায় ক্লাসিক্স থেকে উদ্ধৃতি দেয়… বলা যায়, অর্ধেক দিনই মাতাল থাকে… কিন্তু যখন সুস্থ থাকে, ওর মতো কাউহ্যান্ড দুটি পাবে কি না, সন্দেহ। তারপর কিথ, পিয়ানো বাজাচ্ছে যে, ভাইমারে লেখাপড়া করেছে, ভিয়েনায় স্ট্রসকে চিনত, লোকটা ‘দি ব্লু দানুব’ লেখার আগেই। পশ্চিমে সব ধরনের লোক পাবে, খেতাবধারী জমিদার থেকে ভবঘুরে মিসকিন, দুনিয়ার নানান কোণ থেকে এসেছে। কয়েক হপ্তা থাকে এখানে, অল্পদিনেই রপ্ত করে ফেলে ভাষাটা, এতটাই, যে মনে হবে এখানেই জন্ম। পশ্চিমের অনেক বড় রাঞ্চ আছে, যেগুলোর মালিক ইংরেজ।’
আরও খানিকক্ষণ খোশগল্প করেও প্রিন্স ময়নিহান কিছুই আদায় করতে পারল না ওরিনের থেকে। এমন নয় যে ওরিন এড়িয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু নিজের সমপর্কে কোনো তথ্য বা এখানে কেন এসেছে—এগুলোর কিছুই বলল না। চিন্তিত চেহারায় সরে গেল ময়নিহান। পরে, ওরিন ওসমান যখন বিদায় নিয়েছে, মার্শাল হার্ডি এল সেখানে।
‘ওসমান?’ মাথা নাড়ল হার্ডি। ‘চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু মনে করতে পারছি না। কিথ জানতে পারে। ও সবাইকে চেনে। পিভটরকে কী চায় ব্যাটা?’
বিছানায় চিত্ হয়ে শুয়ে, অন্ধকারের ভেতর তাকিয়ে ওরিন জানালায় আর ছাতে বৃষ্টির শব্দ শুনছে। বেশ জোরে পড়ছে, বর্শার ফলার মতো বিঁধছে জানালায়। অস্বস্তিভরে পাশ ফিরল সে, খানিক আগে প্রিন্স ময়নিহানের চোখে ফুটে ওঠা সতর্ক দৃষ্টির কথা মনে পড়তে ভুরু কোঁচকাল। ময়নিহান লোকটা কে? কী জানে সে?
কার্টিস অনুরোধ করেছিল, সে যেন তার স্ত্রীকে সাহায্য করে। এটা কি নিছক একজন মৃত্যুপথযাত্রীর অনুরোধ ছিল, নাকি সত্যিই সাহায্য প্রয়োজন ওদের? এখানে কি কোনো ঘাপলা আছে? টাকাটা যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েই সে নিজের পথ ধরবে, মনে মনে এই অঙ্গীকার করে ঘুমোতে গেল ওরিন।
অবশ্য শেষবারের মতো চোখ বন্ধ করার সময়ে সে এ-ও জানত, কোনো ঝামেলা দেখলে তার মত বদলাবে।
ওরিনের যখন ঘুম ভাঙল, তখনো বৃষ্টি পড়ছে; তবে আগের মতো মুষলধারে নয়। দ্রুত পোশাক বদলে তৈরি হয়ে নিল সে, পিস্তল দুটো পরখ করল, মনে মনে ঝালাই করছে গত রাতের সমস্যাগুলোর কথা।
কেভিন পিটার্সন টলতে টলতে ওরিনের পেছন পেছন সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেল নিচে। মাত্রা ছাড়া মদ্যপান আর ঘুমের কারণে টসটসে হয়ে আছে কেমব্র্রিজে পড়া লোকটার মুখ। ওরিনের দিকে তাকিয়ে করুণ হাসল সে। ‘রাতে মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে গেছিল মনে হয়,’ বলল। ‘আমার আসলে এই শহর ত্যাগ করা দরকার।’
একসঙ্গে নাস্তা খেল ওরা। পিটার্সনের চোখ সহসা ধারালো হয়ে উঠল যখন ওরিন পিভটরকে যাওয়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করল তাকে। ‘তোমার ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। কার্টিস পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে, ওদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। ওদের দিন শেষ! রাঞ্চটা শেষ পর্যন্ত জ্যাক প্যালেন্সরই হতে যাচ্ছে।’
‘সমস্যাটা কী?’
‘প্যালেন্স পিভটরকের মালিকানা দাবি করছে। টনি কার্টিসের বাপ জায়গাটা কিনেছিলেন এক মেক্সিকানের কাছ থেকে। ওই লোক জমিটা পেয়েছিল একটা ল্যান্ড গ্র্যান্টের সুবাদে। বুড়ো কার্টিস এরপর অ্যাপাচিদের সঙ্গে একটা রফা করেন, ফলে তার মালিকানা আরও মজবুত হয়। সমস্যা হচ্ছে, জ্যাক প্যালেন্স আরও পুরোনো একটা ক্লেইম দেখাচ্ছে। বলছে, আলভঅরেজের কোনো গ্র্যান্ট ছিল না। সেটা ছিল ওর বাপ কোলাসোর এবং তার থেকেই সে রাঞ্চটা খরিদ করেছে। বুড়ো কার্টিস বাকবোর্ড থেকে ছিটকে পড়ে নিহত হয়, আর ওর ছেলে, বিলি, ধাক্কা সামলাতে পারেনি। কার্ল রৌভ ওকে চ্যালেঞ্জ করতেই শহর ছেড়ে পালিয়েছে।’
‘আর ওর বউ?’
মাথা ঝাঁকাল পিটার্সন, তারপর শ্রাগ করল। ওর চেহারায় সন্দেহ আর শঙ্কার আনাগোনা। ‘চমত্কার মেয়ে মোনা কার্টিস। শান্ত কিন্তু শক্ত। ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না। আফসোস, কার্টিসের যদি ওর সাহসের দশ ভাগের এক ভাগও থাকত!’ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল পিটার্সন। ‘মোনা থাকবে, কসম খেয়েছে লড়াই করবে।’
‘কর্মচারী আছে?’
‘দুজন। একজন অনেক পুরোনো, ওর শ্বশুরের আমলের। আর অপরজন এক দোআঁশলা অ্যাপাচি, নাম সিলভানাটো, সংক্ষেপে নাটো।’
কথাগুলো মনের ভেতর উল্টেপাল্টে দেখল ওরিন। বুঝতে পারছে, অনেক কিছু এখনো অব্যাখ্যাত রয়ে গেছে। পাঁচ হাজার ডলার এল কোত্থেকে—এটা একটা বিরাট প্রশ্ন।
বিলি কি সত্যি পালিয়ে ছিল, নাকি লড়বার জন্য টাকার জোগাড়ে গিয়েছিল? কীভাবে পেল টাকা?
‘আমি যাচ্ছি।’ উঠে দাঁড়াল ওরিন। ‘মোনার সঙ্গে কথা বলতে হবে।’
‘ওখানে কাজ নিয়ো না। ওর কোনো সম্ভাবনা নাই,’ গম্ভীর গলায় বলল পিটার্সন। ‘তুমি সরে থাকলেই বরং ভালো
করবে।’
‘আমি দুর্বলের পক্ষে লড়তে পছন্দ করি,’ হাল্কা চালে জবাব দিল ওরিন। ‘কে জানে, চাকরিও চাইতে পারি। মানুষকে তো এক সময় না এক সময় মরতে হবেই। সব কিছু যখন তার বিপক্ষে, তখনকার চেয়ে মরার জন্য ভালো সময় আর কোনটা?’
‘আমি, বাপু, জিততে পছন্দ করি,’ সোজাসাপ্টা উত্তর পিটার্সনের। ‘অন্তত সুযোগ চাই একটা।’
টেবিলের ওপর সামনে ঝুঁকল ওরিন; সচেতন, পিটার্সনের পেছনে দাঁড়িয়ে প্রিন্স ময়নিহান কথা শুনছে। ওর পাশেই আরেক বিশালদেহী, তার জামার বুকে তারা। ‘আমি যদি ঠিক করি ওর পক্ষে কাজ করব,’ ওরিনের গলা সহজ, আত্মবিশ্বাসী, ‘তুমি আমাদের সঙ্গে যোগ দিলে ভালো করবে। কারণ আমরাই জিতব।’
‘অ্যাই, তুমি!’ টিনের তারাখচিত লোকটা, টমাস হার্ডি, সামনে এগোল। ‘তুমি হয় শহরে থাক, নয়তো রাস্তা মাপ! এমনিতেই মোগাইওনে অনেক ঝামেলা। তুমি এর বাইরে থাক।’
চোখ তুলল ওরিন। ‘আমাকে বলছ?’ চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল ওর গলা। ‘তুমি টাউন মার্শাল, ইউনাইটেড স্টেটস মার্শাল বা শেরিফ নও। আর যদি শেরিফ হতেও, তাহলেও কিছু যেত-আসত না। ঝামেলাটা এই কাউন্টির বাইরে, তোমার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। এবার সর; আর, হ্যাঁ, কেউ না ডাকলে কখনো অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে এস না। বোঝা গেছে?’
মাথা হেট করল হার্ডি, মুখ লাল। টেবলের কোনা ঘুরল সে, চোখজোড়া ছোট আর বুনো হয়ে উঠেছে। ‘শোন!’ ওর কণ্ঠস্বর ক্রোধে ফ্যাঁসফেঁসে। ‘একটা দু-পয়সার রাখালের এত বড় সপর্ধা আমাকে…’
‘হার্ডি,’ শহর মার্শালকে থামিয়ে দিয়ে অবিচল কণ্ঠে ওরিন বলল, ‘তুমি কিন্তু সাধ করে ঝামেলা বাড়াচ্ছ। তোমার আওকাতের মধ্যে থাকছ না। তুমি টাউন মার্শাল, এই পরিচয় কিন্তু তোমাকে রক্ষা করবে না।’
‘আমাকে রক্ষা করবে?’ ক্রোধে বিস্ফোরিত হলো হার্ডি। ‘আমাকে? তবে রে, আজ তোর একদিন কি…!’
লাফিয়ে আগে বাড়ল হার্ডি। কিন্তু চট করে এক পাশে সরে গেল ওরিন, লাথি মেরে একটা চেয়ার ঠেলে দিল মার্শালের পথের ওপর। উন্মত্ত হার্ডি সুযোগই পেল না ওটা এড়ানোর, পড়ে গেল হুমড়ি খেয়ে, কাঠের মেঝের ঘষায় তার হাতের তালু ছড়ে গেল।
লাথি মেরে চেয়ারটা সরিয়ে দিল সে, উঠে দাঁড়াল এক লাফে। ওরিন দাঁড়িয়ে ওর মুখোমুখি, ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের হাসি। কেভিন পিটার্সনের হাসি দু-কান ছুঁয়েছে, আর ড্যানিয়েল বারে ঠেস দিয়ে উপভোগ করছে ব্যাপারটা।
হার্ডি একবার দেখল নিজের ক্ষতবিক্ষত হাতের তালু দুটো, তারপর ওরিনের চোখে চোখ রাখল। এক পা সামনে এগোল সে, পরক্ষণে,আচমকা, হাত বাড়াল পিস্তলের দিকে।
ড্র করল ওরিন, গুলি করল। স্তম্ভিত টমাস হার্ডি চেয়ে রইল তার অবশ হাতের দিকে। গুলির ঝটকায় ছিটকে পড়েছে পিস্তল, গরম .৪৪ সিসা ট্রিগার গার্ডে আঘাত করে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে ওর কড়ে আঙুলের ডগা উড়িয়ে নিয়ে গেছে। হার্ডি বোকার মতো দেখতে থাকে ক্ষীণ রক্তের একটা ধারা মেঝেয় পড়ছে ফোঁটায় ফোঁটায়।
আরও দুজন তাকিয়ে ছিল, তবে মার্শালের দিকে নয়। প্রিন্স ময়নিহান এবং পিটার্সন তীক্ষ দৃষ্টিতে ওরিনকে পযর্বেক্ষণ করছিল।
‘তোমার হাত তো খুব চালু,’ বলল ময়নিহান। ‘কে তুমি? এই তল্লাটে এমন ফাস্ট গান ছয়জন আছে কি না, সন্দেহ। আমি বেশির ভাগেরই চেহারা চিনি।’
ওরিনের হিমশীতল চোখে কৌতুকের ঝিলিক। ‘তাই? বেশ, এখন তবে আর একজনকে জানলে। সাতজন হলো।’ গোড়ালির ভরে ঘুরল সে, গটগট করে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। সবার চোখ তাকে অনুসরণ করল।
দুই
শার্টটেইল ক্রিকের উজানে ছুটছে ওরিন ওসমানের রৌন। ব্লাডি বেসিন আর স্কেলেটন রিজ পেরোল ওটা, একটা পাহাড়ি ঝরনার অদূরে ভার্দেয় পৌঁছাল। সেই রাতে হার্ডস্ক্র্যাবল ক্রিকের কাছে একটা খাড়াইর কোনায় বিছানা পাতল সে। অনেক রাত এখন, ইচ্ছে করেই সে আগুন ধরাল না।
চিন্তাভাবনা করে জায়গাটা বাছাই করেছে সে। পেছনে, আকাশপানে মাথা তুলেছে পাহাড়। বাঁয়ে খাড়া ঢাল নেমে গেছে হার্ডস্ক্র্যাবল ক্রিক অভিমুখে। ওর ক্যামপ অনেকটা হার্ডস্ক্র্যাবল মেসার গোড়ায়, অদূরে মাথা তুলেছে ডেডম্যান মেসা। সামনের জমি ঢালু হয়ে চলে গেছে ক্রিকের দিকে। প্রচুর শুকনো কাঠ রয়েছে। পাহাড়ের কার্নিশ জায়গাটাকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করছে।
হঠাত্ জেগে গেল ওরিন। মুহূর্তের জন্য নিশ্চল পড়ে রইল। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। কাত হয়ে শোয়া অবস্থায় তারাগুলো দেখতে পাচ্ছে সে। মাঝরাতের বেশি হবে এখন, অনুমান করল সে। কেন ঘুম ভেঙেছে, বুঝতে পারল না। তবে দেখল, রৌনটা ওর দিকে কয়েক কদম এগিয়ে এসেছে, মাথা উঁচু এবং কান খাড়া।
‘সামলে, বেটা,’ সাবধান করল ওরিন।
বেডরোলের ভেতর থেকে পিছলে বেরিয়ে এল সে, বুট পরে পায়ের ভরে সোজা হলো। অন্ধকারে হাতড়ে কাছে টেনে নিল উইনচেস্টারটা।
ওপরে পাহাড়ের চাতাল, তাই সে যেখানে আছে, সেই জায়গাটা নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। বোল্ডার আর সিডার ঝোপগুলো বাড়তি আড়াল জোগাচ্ছে। পাহাড়ের অন্ধকারের পটে রৌনটাকে দেখা যাবে না, কিন্তু ওর জায়গা থেকে, সহজেই দেখতে পাচ্ছে ক্রিকের পাড় আর খোলা জমির প্রায় ত্রিশ গজ এলাকা।
অসপষ্ট নড়াচড়া আর চাপা কণ্ঠস্বর শোনা গেল নিচে। তারপর শুনশান। রাইফেলটা নামিয়ে রেখে কোমরে গানবেল্ট বাঁধল ওরিন, সন্তর্পণে চাতাল ছেড়ে ঝোপের ভেতর গিয়ে ঢুকল।
খানিক পর, নড়াচড়ার শব্দ শুনল সে, তারপর একটা নিচু কণ্ঠস্বর: ‘কাছে-পিঠেই আছে কোথাও। খুব বেশি দূরে যেতেই পারে না ব্যাটা। ওরা বলল, হারামিটা এ পথেই এসেছে। ফসিল ক্রিকের পর ছেড়ে দিয়েছে মূল ট্রেইল।’
দুজন লোক। অপেক্ষা করতে লাগল ওরিন, সিডার ঝোপের ভেতর দাঁড়িয়ে, চোখে কাঠিন্য, সমস্ত পেশি টানটান এবং তৈরি। লোকগুলো নির্বোধ। কী ভেবেছে? সে বোকা?
তাসের জুয়ায় একজন জোচ্চুরি করেছিল একবার। তাকে যমের বাড়ি পাঠিয়েছে সে। প্রতিশোধ নিতে এসে লোকটার বাকি তিন ভাইও মারা পড়েছে। ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে লড়বারও অভিজ্ঞতা আছে তার। গৃহযুদ্ধের পরপর ডাকোটায় স্যু আর শাইয়েন গোত্রের বিরুদ্ধে লড়েছে। মিনেসোটায় লিটল ক্রো গণহত্যার কিছু দিন পরের ঘটনা এটা। অ্যাপাচি আর
কিওয়াদেরকে মোকাবেলা করেছে বারকয়েক।
এবার লোক দুটোকে দেখতে পেল সে। দুটো ছায়ামূর্তি চড়াই বেয়ে উঠে আসছে, ধূসর নুড়ি-পাথরের ঢালের পটে রেখায়িত হয়ে উঠেছে ওরা।
এতক্ষণ নিজের ভেতরে যে বুনো স্বভাবটাকে দাবিয়ে রাখছিল ওরিন, এবার শেকল ছিঁড়ল সেটা। আর অপেক্ষা করা যায় না। রৌনটাকে দেখে ফেলবে ওরা, তারপর ওকে নিকেশ না করা অবধি নড়বে না। অতএব, যা করার এখুনি করত হবে। চকিতে ফাঁকায় বেরিয়ে এল সে, নিঃশব্দে।
‘কাউকে খুঁজছ?’
লাট্টুর মতো ঘুরল ওরা। ওরিন নক্ষত্রের ঝিলিক দেখতে পেল একটা পিস্তলের ব্যারেলে এবং নিজের পিস্তলের ভোঁতা, কর্কশ কাশির আওয়াজ শুনল। লুটিয়ে পড়ল একজন, খাবি খাচ্ছে। অপরজন টলে উঠল প্রথমে, তারপর ঘুরে দৌড়ল ত্রস্ত পায়ে, গোঙাচ্ছে, অর্ধেক ভয়ে এবং অর্ধেক ব্যথায়। জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল ওরিন, পিস্তল তাক করতে চেষ্টা করল লোকটার দিকে, কিন্তু ঝোপের আড়ালে তাকে হারিয়ে ফেলল।
মৃত লোকটার উদ্দেশে ঘুরল ওরিন কিন্তু কাছে গেল না। নিহত আততায়ীকে সে পাশ কাটাল দূর দিয়ে, নিজের ঘোড়ার কাছে ফিরে গেল। শান্ত করল রৌনটাকে, তারপর শুয়ে পড়ল। কয়েক মিনিটের মধ্যে, ঝিমোতে শুরু করল সে।
ভোর তাকে আবিষ্কার করল লাশের সামনে। রৌনের পিঠে স্যাডল চাপানো হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। সিলভার সিটিতে যে দুজন লোক ওর পিছু নিয়েছিল, এই লোকটা তাদের একজন। হ্যাংলা, শ্যামলা-মুখো, চোয়াল ভাঙা, কপালের দু-পাশে কয়েক গাছি রুপোলি চুল। ডান চোখের ওপরে পুরোনো একট ক্ষত, গভীর এবং লালচে।
হাঁটু মুড়ে বসল সে, লোকটার পকেট তল্লাশি করল, কয়েকটা চিঠি আর একতাড়া কাগজ পেল। নিজের পকেটে ওগুলো চালান করল ওরিন, তারপর ঘোড়ায় চেপে সতর্ক ভঙ্গিতে রওনা হলো ক্রিকের উজানে। স্যাডলের ওপর আড়াআড়ি ফেলে রেখেছে উইনচেস্টার, বিপদ মোকাবেলার জন্য তৈরি। কোনো কিছুই ঘটল না।
ধীর লয়ে গড়িয়ে চলে সকাল, বৃষ্টির পর পরিবেশ গুমোট, নিশ্চল। কানের পাশে ভনভন করছিল একটা মাছি, হ্যাটের ঝটকায় ওটাকে তাড়াল ওরিন। সাবলীল অথচ জোর পায়ে ছুটছে রৌন, একেক কদমে অনেকটা জায়গা অনায়াসে অতিক্রম করছে। দ্রুত অথচ নিশ্চিত ভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছে দূরের বেগুনি রেনজের দিকে, ঘাসে ছাওয়া তৃণপ্রান্তরের ওপর দিয়ে, দু-পাশে পাইন আর অ্যাসপেনের সারি। এখানে-সেখানে দীর্ঘ কটনউডের পত্রপল্লবে বাতাসের ফিসফাস।
স্বপ্নের জায়গা এটা, গরু-মোষ কিংবা ভেড়া চরাবার জন্য আদর্শ জায়গা, মানুষের বসত গড়বার জায়গা। সামনে-বাঁয়ে, সুউচ্চ মোগাইওন রিম মাথা তুলেছে আকাশপানে। ওই রিমটার পেছনেই, মালভূমিতে, পিভটরক। মর্মরিত একটা অ্যাসপেন কুঞ্জবনের পাশ কাটিয়ে তরাইয়ের লম্বা উপত্যকার দিকে তাকাল সে।
এই প্রথম গরুর পাল দেখল সে; হূষ্টপুষ্ট, পরিতৃপ্ত গরুর পাল, নাবাল জমির তাজা ঘাস খেয়ে নাদুসনুদুস হয়েছে। একবার দূরে একজন অশ্বারোহীকে চোখে পড়ল, কিন্তু ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করল না সে। এ মুহূর্তে ট্রেইলটাই সন্ধান করছে। উত্তর-পুবে মুখ ব্যাদান করল একটা ক্যানিয়ন; ঘোড়া ঘুরিয়ে সে দিকে রওনা হলো ওরিন, ক্যানিয়ন থেকে নেমে আসা ক্রিক উজিয়ে। এখন ক্রমাগত ওপরে উঠছে সে। ভ-ূখণ্ডের চেহারা থেকে অনুমান করল, রিমে পৌঁছাতে প্রায় তিন হাজার ফুট খাড়াই পেরোতে হবে। তবে সে শুনেছে, সামনেই ট্রেইল আছে একটা, তাই এগিয়ে চলল।
রিম অবধি শেষ আটশ ফুটি ট্রেইলটা বন্ধুর এবং বিসর্পিল। নাগাড়ে উঠে গেল ওরিন। রিমের মাথায় মালভূমির বাতাস আশ্চর্য রকমের সতেজ ও স্বচ্ছ। সামনে এগোল সে। ইতিউতি কয়েকটা গরু চরছে। একটু বাদে, সরু ট্রেইলের ধারে কাঠের এবড়োখেবড়ো সাইনটা চোখে পড়ল তার। ওতে লেখা—পিভটরক এক মাইল।
একটা চ্যাপ্টা-মাথা ঢিবির ওপর নিচু, ছড়ানছিটানো বাড়ি, বর্গক্ষেত্রের তিন দিক লম্বা বার্ন আর চালাঘরে ঘেরা। যে দিকটা খোলা, সে দিকেই রিম আর ট্রেইল। ওই ট্রেইল ধরেই আসছিল ওরিন। কটনউড, পাইন আর দেবদারু গাছের সারি সুরক্ষা দিয়েছে বিল্ডিংগুলোকে। কোরালের ঘোড়াগুলোর পশমে শেষ বিকেলের আলোর দ্যুতি দেখতে পাচ্ছিল সে।
একটা বুড়ো লোক বেরিয়ে এল স্টেইবল থেকে, হাতে কারবাইন। ‘ঠিক আছে, স্ট্রেনজার। ওখানেই থাম। এখানে কী চাও?’
একগাল হাসল ওরিন। সাবধানে হাত তুলে, চ্যাপ্টা কার্নিশের টুপিটা ঠেলে দিল পেছনে। ‘মিসাস মোনা কার্টিসকে খুঁজছি,’ বলল। ‘আমার কাছে খবর আছে।’ ইতস্তত করল সে। ওর স্বামীর খবর।’
নিচু হলো কারবাইনের মাজল। ‘মিস্টার কার্টিসের? তার কী খবর থাকতে পারে?’
‘ভালো খবর না,’ ওরিন বলল লোকটাকে। ‘উনি মারা গেছেন।’
আশ্চর্যজনকভাবে বুড়োকে ভারমুক্ত মনে হয়। ‘আচ্ছা,’ সংক্ষেপে বলল সে। ‘অবশ্য আমরা এমন কিছুই আশঙ্কা করছিলাম। তা, কীভাবে মারা গেছে?’
দোনামোনা করল ওরিন। ‘এল পাসোর একটা সালুনে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েছিল, তারপর ড্র করতে ভীষণ দেরি করেছিল।’
‘ও কখনোই ফাস্ট ছিল না।’ ওরিনকে জরিপ করল বুড়ো। ‘আমার নাম জিম ডেভিডসন। তুমি নিশ্চয়ই টনি মারা গেছে—শুধু এই কথাটা বলতে সেই এল পাসো থেকে অ্যাদ্দূর ছুটে আসনি? কী জন্য এসেছ?’
‘সেটা মিসাস কার্টিসকেই বলব। তবে এখানে আসার পথে শুনেছি, তুমি এদের পুরোনো লোক, তাই তোমাকেও বলা যায়। আমি ওর জন্য কিছু টাকা নিয়ে এসেছি। টনি কার্টিস মারা যাওয়ার মুহূর্তে আমাকে দিয়ে বলেছে ওর কাছে পৌঁছে দিতে। পাঁচ হাজার ডলার।’
‘পাঁচ হাজার?’ অপলকে ওরিনকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে ডেভিডসন। ‘মানতে বাধ্য হচ্ছি, টনি তোমাকে খুব বিশ্বাস করেছিল। অনেক দিনের পরিচয়?’
মাথা নাড়াল ওরিন। ‘মাত্র কয়েক মিনিটের। মৃত্যুপথযাত্রী, আর কোনো উপায়ও ছিল না তার।’
বাড়ির একটা দরজা আছড়ে পড়ার আওয়াজে ওরা দুজনেই ঘুরল সে-দিকে। সুঠাম গড়নের এক যুবতী হেঁটে আসছে ওদের দিকে। ওর লাল চুলে ঝিলমিল করছে রোদ। সাধারণ একটা সুতির পোশাক পরনে, কিন্তু পরিপাটি। মেয়েটার আগে আগে দৌড়ে এল একটা ছোট্ট ছেলে, বয়স পাঁচ কি ছয় বছর হবে। ওরিনের দিকে ঝুঁকে এল সে, তারপর থমকে দাঁড়িয়ে একবার ওর মুখ এবং আরেকবার ওর পিস্তল দুটো দেখতে লাগল।
‘হাউডি, বুড়ো খোকা!’ স্মিত হেসে বলল ওরিন। ‘তোমার সপার কোথায়?’
চমকে উঠল ছেলেটা, লজ্জা পেল। পিছিয়ে গেল এক কদম, হতচকিয়ে গেছ আচমকা প্রশ্নে। ‘আ… আমার কোনো সপার নেই!’
‘সে কী? কাউহ্যান্ডের সপার নেই? ঠিক আছে, ব্যবস্থা করব একটা তোমার জন্য।’ পলক তুলল ও। ‘আদাব, মিসাস কার্টিস। আমি ওরিন ওসমান। তোমার জন্য একটা খারাপ খবর নিয়ে এসেছি।’
ঈষত্ পাণ্ডুর হয় মোনার মুখাবয়ব, কিন্তু চিবুক উঁচু। ‘তুমি কি বাসায় আসবে একটু, মিস্টার… ওসমান? জিম, ওর ঘোড়াটা প্লিজ কোরাল করে দাও।’
রাঞ্চ হাউসের লিভিং রুমটা সুপরিসর, শীতল। মেঝেয় ছোট্ট নাভাহো গালিচা পাতা, চেয়ার আর ডিভানগুলো সুন্দর করে ট্যান করা গরুর চামড়া দিয়ে মোড়া। প্রশংসার দৃষ্টিতে ঘরের পারপাশে নজর বোলায় ওরিন, আরিজোনার রোদে দীর্ঘ পথযাত্রার পর শীতলতা উপভোগ করছে। ঠিক যেমনটা করছে এই মেয়েটির সারল্যকেও। ড্রুসিলার সঙ্গে কোথায় যেন মিল আছে এর। ড্রুসিলার কথা মনে পড়তে বেদনায় টনটন করে উঠল ওর বুক।
হঠাত্ ওর মুখোমুখি হলো মেয়েটা। ‘এবার বোধ হয় আমাকে বলতে পার তুমি। কিছু রাখ-ঢাক বা ভণিতা করার দরকার নেই।’
যথাসম্ভব দ্রুত এবং সবিস্তারে ব্যাখ্যা করল ওরিন। যখন শেষ করল সে, মেয়েটার মুখ সাদা, চোয়াল পাথর। ‘আ… আমি এই ভয়টাই করছিলাম। যখন চলে যায়, আমি জানতাম ও আর ফিরবে না। তুমি বুঝতে পারছ, টনি মনে করত… না, বিশ্বাস করত আমাকে সে রক্ষা করতে পারেনি, ওর বাবাকে রক্ষা করতে পারেনি।’
পকেট থেকে অয়েল স্কিনে মোড়া প্যাকেটটা বের করল ওরিন। ‘তোমার জন্য পাঠিয়েছে এটা। বলেছে, এতে পাঁচ হাজার ডলার আছে। তোমাকে দিতে বলেছে।’
মোনা নিল প্যাকেজটা; ওটার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলল ঝরঝর করে। ‘হ্যাঁ।’ মেয়েটার কণ্ঠস্বর এত নিচু, ওরিনের কানে প্রায় পৌঁছায় না কথাগুলো। ‘ওর পক্ষে সম্ভব এটা করা। হয়তো ভেবে থাকবে, অন্তত এটুকু সে করতে পারে আমার, আমাদের জন্য। জান…।’ চোখ তুলল মোনা কার্টিস, ‘আমরা একটা ক্যাটল ওয়রের মধ্যে আছি। খুব সাংঘাতিক লড়াই। এটা সেই লড়াই করার টাকা। আমার ধারণা, টনি মনে করেছিল… মানে, ও নিজে গানফাইটার না, এই টাকাটা হয়তো কাজে আসবে, ঘাটতিটা পুষিয়ে দেবে। তুমি হয়তো অবাক হয়েছ এভাবে টাকা পাঠানোয়।’
‘না,’ বলল ওরিন, ‘হইনি। আমি বরং বাইরে কাউহ্যান্ডদের কাছে যাই। তুমি হয়তো এ সময়ে একা থাকতে চাইবে।’
‘দাঁড়াও!’ মোনার আঙুল ওর আস্তিন টেনে ধরে। ‘তুমি ওর সঙ্গে ছিলে, এত দূর এসেছ কষ্ট করে, আমি চাই, তুমি জান সব কিছু। আমার আর টনির মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। আসলে ও…, নিজেকে ও কাপুরুষ মনে করেছিল। মনে করেছিল, আমার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। অনেক দিন ধরেই আমাদের ঝামেলা চলছে ইয়োলো জ্যাকেটের জ্যাক প্যালেন্সের সঙ্গে। কার্ল রৌভ গায়ে পড়ে ঝগড়া লাগায় টনির সঙ্গে। মতলব ছিল, ওকে খুন করা। কিন্তু টনি লড়তে রাজি হয়নি। পিছিয়ে গিয়েছিল। সবাই বলেছে ও কাপুরুষ। টনি হজম করতে পারেনি ব্যাপারটা। একদিন রাতের অন্ধকারে চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে।’
ভ্রূকুটি করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল ওরিন, চিন্তা করছে কিছু। যে ছেলেটা ঝগড়া বাধিয়ে ছিল ওর সঙ্গে, সপর্ধা দেখিয়ে পিস্তল বের করতে গিয়েছিল, সে আর যা-ই হোক কাপুরুষ ছিল না। নিজের কাছে প্রমাণ করছিল কিছু? হতে পারে। কিন্তু কাপুরুষ ছিল না।
‘ম্যাম,’ ঝট করে বলল সে, ‘তুমি তার বিধবা স্ত্রী। ওর সন্তানের মা। তোমার একটা কথা জানা দরকার। তোমার স্বামী আর কী ছিল, আমি জানি না। আমি তাকে বেশি সময় দেখিনি। কিন্তু সে কাপুরুষ ছিল না। একেবারেই না। দেখ…’ দ্বিধা করে ওরিন, নিজের বিব্রতকর অবস্থার কথা ভেবে ফাঁপরে পড়েছে। এই মেয়েটাকে বলতে চাইছে না, সে-ই তার স্বামীকে খুন করেছে, আবার এটাও চাইছে না মেয়েটা ভাবুক, তার স্বামী কাপুরুষ ছিল। ‘সে যখন পিস্তলের দিকে হাত বাড়িয়েছিল, আমি তার চোখ দেখতে পেয়েছিলাম। আমি সেখানে ছিলাম, ম্যাম, দেখেছি সব কিছু। টনি কার্টিস কাপুরুষ ছিল না।’
কয়েক ঘণ্টা পর, বাংকে শুয়ে ঘটনাটা নিয়ে ভাবে ওরিন। পাঁচ হাজার ডলারের ব্যাপারটা সত্যিই রহস্যময়। কোত্থেকে এল টাকাটা? কার্টিস পেল কীভাবে?
পাশ ফিরল ওরিন, কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল। কাল সকালে সে ট্রেইলে নামছে আবার।
পরদিন সকালে যখন বিছানা ছাড়ল ওরিন, বাইরে ঝলমলে রোদ্দুর। সময় নিয়ে গোসল আর আর দাড়ি কামানো সারল সে, পিঠে রোদ উপভোগ করতে করতে, কাঁধ থেকে গুরুদায়িত্ব নেমে যাওয়ায় হালকা বোধ করছে। বাংকহাউসে ফিরে গানবেল্ট বাঁধছে সে—এমন সময়ে কতগুলো ঘোড়া এগিয়ে আসার আওয়াজ পেল। দরজায় গেল ওরিন, উঁকি দিল বাইরে।
উঠানে দাঁড়িয়ে তিনজন ঘোড়সওয়ার; পোড়া-মুখো নাটো বা ডেভিডসন—কাউকেই দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। ওদের একজন পরিচিত, ইয়োলো জ্যাকেটে দেখেছে, জ্যাক প্যালেন্স। লোকটা বিশালদেহী, চওড়া কাঁধ, শরীরে মেদের লেশমাত্র নেই। নিষ্ঠুর চেহারা।
মোনা কার্টিস বেরিয়ে এল সিঁড়ির মাথায়।
‘ম্যাম,’ প্যালেন্স বলল ঝটপট, ‘তোমাকে উচ্ছেদ করতে এসেছি আমরা। দশ মিনিট সময় দিচ্ছি, এর মধ্যে তৈরি হয়ে নাও। আমার লোক তোমার বাকবোর্ডে ঘোড়া জুড়ে দেবে। এই জায়গা আমার, দলিল আছে, তোমরা জবরদখল করে রেখেছ। অনেক সহ্য করেছি, কিন্তু আর না।’
চকিতে আস্তাবলের দিকে নজর বোলাল মোনা। কিন্তু প্যালেন্স মাথা নাড়ল। ‘ডেভিডসন কিংবা ওই দোআঁশলাটাকে খুঁজে লাভ নেই, ওরা কাজে বেরোনোর পরই আমরা এসেছি। আমার লোক ট্রেইলে নজর রাখছে। আমরা বিনা ঝামেলায় তোমাকে তাড়াতে চাইছি।’
‘তুমি যেতে পার, মিস্টার প্যালেন্স। আমি নড়ছি না!’
‘নড়ছ,’ প্যালেন্স বলল অধৈর্য্যের স্বরে। ‘আমরা জানি, তোমার স্বামী মারা গেছে। তোমাকে আমরা এভাবে
আমাদের রেঞ্জ দখল করে থাকতে দিতে পারি না।’
‘এটা আমার রেঞ্চ, আমি থাকব এখানে।’
খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসল প্যালেন্স। ‘আমাদেরকে জোর খাটাতে বাধ্য কোর না, ম্যাম। দরকার হলে, আমরা কিন্তু তা করব। এই দুর্গম জায়গায় কেউ কিস্যু জানতে পারবে না।’ দম নেওয়ার জন্য থামল প্যালেন্স, তারপর যোগ করল, ‘কাজেই, তুমি যাচ্ছ এবং এখনি।’
ওরিন পা রাখল বাংকহাউসের বাইরে, ঘোড়সওয়ারদের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেল তিন কদম। শান্ত, নিশ্চিত পদক্ষেপ, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মুখিয়ে আছে একটা ঝামেলা বাধানোর জন্যে। উত্তেজনাটা অবদমন করল সে, নিশ্চুপ রইল একটু সময়। তারপর মুখ খুলল।
‘প্যালেন্স, তুমি একটা মাথামোটা গর্দভ এবং মাস্তান। এখানে এসেছ একজন মহিলার দুর্বলতার সুযোগ নিতে, কারণ তোমার ধারণা, তিনি অসহায়। কিন্তু তোমার ধারণা ভুল। এবার ঘোড়া ঘুরিয়ে কেটে পড়… কোনো চালাকির চেষ্টা না। আর কক্ষনো পা রাখবে না এই জমিতে।’
মুহূর্তের জন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেল প্যালেন্সর মুখ, তারপর ক্রোধে কালো। সামান্য সামনে ঝুঁকল সে। ‘অ, তুমি এখনো আছ এখানে? বেশ, তোমাকেও চলে যাওয়ার সুযোগ দিচ্ছি। ভাগ!’
আরেক কদম আগে বাড়ল ওরিন, উত্তেজনার খই ফুটছে ওর ভেতরে। স্থির দৃষ্টিতে ওদের মাপছে সে, দেখল, একজনের চোখ শঙ্কায় বস্ফািরিত হলো।
‘সাবধান, বস! সাবধান!’
‘হ্যাঁ, সাবধান, প্যালেন্স,’ বলল ওরিন। ‘তুমি ভেবেছিলে এই মহিলা একা, কিন্তু তিনি একা নন। আমাকে যদি কাজ দেন, আমিও থাকব। তোমাদেরকে এই তল্লাট ছাড়া করব। কবরেও পাঠাতে পারি। কোনটা তোমাদের পছন্দ, বেছে নাও। তোমরা তিনজন। আমি একা। যদি শকুনের খোরাক হতে চাও, পিস্তলের দিকে আর আধা ইঞ্চি হাত বাড়ালেই তোমাদের খায়েশ পূরণ হবে; তিনজনেরই।’
আরও এক কদম এগোল সে। এখন উত্তেজনার চরমে পৌঁছেছে, একটা লড়াইয়ের জন্য উন্মুখ হয়ে উঠেছে তার সমগ্র অস্তিত্ব। ভেতরে ভেতরে চাঞ্চল্যবোধ করছে সে, কিন্তু সমস্ত পেশি তৈরি, মাথা ঠান্ডা। হাতের পাঞ্জা মেলে ধরল সে, আরেক পা এগোল।
‘আয়, কায়োটের বাচ্চারা, সাহস থাকে তো আয়!’
প্যালেন্সের মুখ শুকনো, চোয়াল দেবে গেছে। চোখ দুটো বস্ফািরিত। মুখের ভেতর তেতো বোধ করছে সে। তার অন্তরাত্মা বলছে মামলা খারাপ—সে সাক্ষাত্ যমের মুখে। সহসা একটা সত্য উপলব্ধি করল জ্যাক পালেন্স, যখন মাশুল চড়া, জুয়া খেলার সাহস তার নেই। সামনে দাঁড়ানো এই শান্ত মানুষটাকে যে বুনো আগ্রহ তাতিয়ে তুলছে, সেটা সপষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে; ওর আপাত-নিরাবেগ চেহারার আড়ালে প্রস্তুতির তীব্রতা পরিষ্কার। ভেতরে ভেতরে অসুস্থবোধ করল প্যালেন্স।
‘বস,’ ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল ওর পাশের লোকটা, ‘চল, কেটে পড়ি। এই লোক বিষাক্ত।’
পমলের ওপর আস্তে করে সহজ ভঙ্গিতে হাতটা রাখল জ্যাক প্যালেন্স। ‘মোনা, তুমি তাহলে বন্দুকবাজ ভাড়া করছ? এভাবেই মোকাবেলা করতে চাইছ ব্যাপারটা?’
‘আমি মনে করি, তোমরাই ভাড়া করেছ আগে,’ শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল মোনা। ‘তোমরা এবার বিদেয় হও।’
‘ফেরার পথে,’ ওরিন পরামর্শ দিল, ‘হার্ডস্ক্র্যাবল ক্যানিয়নে থেমে যেয়ো একবার। ওখানে তোমার এক ভাড়াটে খুনির লাশ পড়ে আছে। কাল রাতে সে ভুল হিশেব করেছিল।’
অদ্ভুত চোখে তাকাল প্যালেন্স। ‘তুমি কী বলছ, আমি বুঝতে পারছি না!’ ঝামটে উঠল। ‘আমি কাউকে পাঠাইনি।’
অপলকে ওর গমন-পথের দিকে তাকিয়ে রইল ওরিন, কপালে চিন্তার ভাঁজ। প্যালেন্সর চোখে যথার্থই বিস্ময় ফুটেছিল, কিন্তু সে যদি ওই লোক দুটোকে পাঠিয়ে না থাকে, তাহলে কে পাঠাল? সিলভার সিটি এবং এল পাসোতে দু-জায়গাতেই ছিল লোক দুটো, আবার দেখা যাচ্ছে, এই অঞ্চলও তাদের চেনা এবং ইয়োলো জ্যাকেটে তাদের কেউ একজন বন্ধু আছে। এমনও হতে পারে, ওরা আসলে তার পিছু নেয়নি বরং শুরুতে টনি কার্টিসের পিছু নিয়েছিল।
ঘুরে মেয়েটির উদ্দেশে স্মিত হাসল ওরিন। ‘কায়োট,’ বলল কাঁধ ঝাঁকিয়ে। ‘হম্বিতম্বিই সার, সাহস নেই।’
অদ্ভুত দৃষ্টিতে মোনা দেখছিল ওকে। বলল, ‘তুমি… তুমি ওদের খুন করতে, না? কেন?’
কাঁধ উঁচুনিচু করল ওরিন। ‘জানি না। হয়তো এ জন্য যে… মানে কোনো পুরুষ একজন মেয়েকে একা পেয়ে তার সুযোগ নেবে, আমার এটা পছন্দ না। তা ছাড়া’… স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে পড়েছে ওর মুখে… ‘প্যালেন্সকে আমার সজ্জন মনে হয়নি।’
‘আমাদের পয়লা নম্বর দুশমন এই লোক,’ সিঁড়ি থেকে নেমে এল মোনা। ‘কথাটা কি সত্যি তোমার মনের, মিস্টার ওসমান? মানে, ওই যে তখন বলছিলে, আমার এখানে কাজ করবে? আমার মানুষ দরকার; তবে এটাও বলে রাখি, জেতার সম্ভাবনা আমাদের খুব কম। বলতে পার, লড়াইটা একতরফা।’
‘হ্যাঁ, মনের কথা।’ আসলেই কি মনের কথা? অবশ্যই। একটা পুরোনো চিনা প্রবাদ মনে করে ওরিন—তুমি যদি কারও জীবন রক্ষা কর, সে তোমার দায় হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অবশ্য সে রকম না, কিন্তু এই মহিলার স্বামীকে হত্যা করেছে সে, তাই মহিলা বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া অবধি তার সঙ্গে থাকাটা ওর দায়। শুধু এটাই একমাত্র কারণ কি? ‘আমি থাকব,’ বলল ওরিন। ‘এর শেষ দেখে ছাড়ব। সারা জীবন যুদ্ধ করেছি আমি, এর চেয়ে অনেক তুচ্ছ কারণে অস্ত্র ধরেছি, তাই এখন থেমে যাওয়াটা লজ্জার ব্যাপার হবে।’
তিন
সারা সকাল রাঞ্চে ঘুরে ঘুরে কাজ করল ওরিন। কাজ করল মূলত বহু কিছু করার আছে বলে; তা ছাড়া, এর ফলে চিন্তা করার জন্য সময়ও পেল।
আস্তাবলে রাখা হয়েছে সব ঘোড়া। দেখে বোঝা যায়, নিয়মিত যত্ন নেওয়া হয় ওগুলোর। কোনো কোনোটা সাধারণ রাঞ্চ হর্সের চেয়ে উন্নতমানের; কয়েকটা মর্গ্যান জাতের। আস্তাবলের দরজার হুড়কো মেরামত করল সে, ঘুরে ঘুরে দেখল বাথানের সব জায়গা, বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে প্রবেশপথগুলো পযর্বেক্ষণ করল।
দুরবিন দিয়ে জরিপ করল পাহাড়-পর্বত; ক্যানিয়নগুলো খুঁটিয়ে দেখল। দুরবিনের আওতায় যত দূর দেখতে পেল, সব কিছুর ছবি গেঁথে নিল মাথায়।
ডেভিডসন আর নাটো ফিরতে ফিরতে মাঝ বিকেল হয়ে গেল। ওরিন ওদের দেখতে পাওয়ার আগেই মোনার সঙ্গে কাউহ্যান্ড দুজনের কথা হয়েছিল।
‘হাউডি,’ ডেভিডসনের গলায় বন্ধুতার সুর, কিন্তু চোখজোড়া তীক্ষ, মাপছে ওরিনকে। ‘মিজ মোনা বলল, তুমি প্যালেন্সকে তাড়িয়ে দিয়েছ। বলল, তুমি এখানে থাকার কথা ভাবছ।’
‘ঠিক। ওর বিপদ শেষ হওয়া পর্যন্ত থাকব, যদি আমাকে রাখে সে। আমি কারও হম্বিতম্বি পছন্দ করি না।’
‘আমিও না।’ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল ডেভিডসন, তারপর সরাসরি তাকাল ওরিনের দিকে। ‘মিজ মোনার ওপর চোখ দিয়ো না কিন্তু। ও খুব ভালো মেয়ে।’
রাগতভাবে চোখ তুলল ওরিন। ‘তুমিও উল্টোপাল্টা কিছু ধরে নিয়ো না,’ বলল শীতল কণ্ঠে। ‘তুমি যে রকম, আমিও ঠিক তেমনি ওকে সাহায্য করছি। আমরা সবাই মিলেমিশে কাজ করব। ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো ব্যক্তিগতই থাক। আমি শুধু এটুকু বলব, এই লড়াই শেষ হওয়ামাত্র আমি আবার ট্রেইলে নামছি।’
‘বেশ,’ মৃদু কণ্ঠে বলল ডেভিডসন। ‘আমাদেরও সাহায্য দরকার।’
তিন দিন কেটে গেল নির্বিঘ্নে। রাঞ্চের কাজে নিজেকে সঁপে দেয় ওরিন, ভূতের মতো পরিশ্রম করে চলে। এমনকি তার নিজেরও কোনো ধারণা নেই, কেন সে এত কঠোর পরিশ্রম করছে। রেঞ্জের পাদদেশে, পাথর-চোঁয়ানো ঝরনার অদূরে খুঁটি গাড়ার গর্ত খোঁড়ে সে, অনেকটা জায়গাজুড়ে বেড়া দেয়।
তারপর নাটোকে সঙ্গে করে তাড়িয়ে আনে পাহাড়ের কিনারে চরে বেড়ানো গরু-মোষগুলোকে, বেড়ার পেছনে ঠেলে দেয়। ক্যানিয়নের অনেক দূর অবধি বিস্তৃৃত তৃণপ্রান্তরের ওই জায়গায় ঘাস ঘন এবং গভীর, ফলে গবাদিপশুর খাবারের অভাব হবে না দীর্ঘ দিন। সব সময় সঙ্গে একটা রানিং আয়রন রাখছে সে; যেখানে প্রয়োজন হচ্ছে, ব্র্যান্ড করছে গরু-মোষ।
বহু দিন যাবত রাঞ্চে লোক নেই, ফলে প্রচুর কাজ পড়ে ছিল। সন্ধ্যায় সাজ-সরঞ্জাম মেরামত করে সে, আর রাতে নিঃসাড়ে ঘুমোয়। এই কদিন মোনা কার্টিসের ছায়াও দেখতে পায়নি।
তবে মেয়েটাকে দেখতে না পেলেও, তার চিন্তায় সে সর্বদা রয়েছে। ওদের প্রথম সাক্ষাতের কথা স্মরণ করে ওরিন। বৈঠকখানায় দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল মেয়েটা, ডাগর কালো চোখ দুটো তার ওপর স্থির রেখে। সিঁড়ির মাথা থেকে জ্যাক প্যালেন্স ও তার দলবলকে কীভাবে মোকাবেলা করেছিল মোনা, সে কথা মনে পড়ল।
মেয়েটার কাছে নিজেকে সে দায়বদ্ধ মনে করে। এ জন্যেই এখানে রয়ে গেছে কি? নাকি ওই মেয়েটিই তার রয়ে যাওয়ার মূল কারণ?
রাঞ্চের এখানে-সেখানে কার্টিসের অদৃশ্য হাতের ছোঁয়া দেখতে পায় সে। ওগুলো থেকে অনুমান করা যায় আসল মানুষটাকে। ডেভিডসন পছন্দ করত ওকে। দোআঁশলাটাও তা-ই। ঘোড়ার সঙ্গে তার আচরণ ছিল মানবিক। সব বিষয়ে মানুষটা সুবিবেচক ছিল। কিন্তু হিংসাত্মক কাযর্কলাপকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করত, সব সময় তা এড়াতে সচেষ্ট থেকেছে। ধীরে ধীরে তার মনের পর্দায়, সেটা ঠিক কি বেঠিক সে জানে না, একজন মার্জিত রুচিশীল যুবকের ছবি ফুটে উঠল; যে যুবক একেবারেই বেমানান তার সময়ের জন্য।
পশ্চিমে জন্ম হলেও, স্বভাবগতভাবে মানুষটা ছিল শান্তিপূর্ণ, নিরুপদ্রব সময়ের উপযোগী। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে জড়িয়ে পড়েছিল রেঞ্জ ওয়রে এবং নিজের সীমাবদ্ধতার কথা তার জানা ছিল। কাঁচা চামড়া দিয়ে একটা ল্যাসো বানাতে বানাতে এসব কথাই ভাবছিল ওরিন, যখন মোনা হাজির হলো সেখানে।
ওকে আসতে দেখেনি ওরিন, তবে দেখলে এড়িয়ে যেত। কিন্তু এখন সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর সামনে এসে দাঁড়াল মেয়েটা।
‘তুমি ভীষণ পরিশ্রম করছ, মিস্টার ওসমান।’
‘বেতন হালাল করছি, ম্যাম। দেখলাম, অনেক কাজ। তা ছাড়া, আমি ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করি।’ ল্যাসোটা ঘুরিয়ে পরখ করল সে। ‘তোমাকে একটা কথা বলব বলব ভাবছিলাম, যদিও এটা আমার বিষয় না, তবে জুনিয়র কিন্তু বড় হয়ে উঠছে এবং একদিন তোমাকে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করবে। তুমি ওকে বোকা বানাতে পারবে না। তুমি হয়তো আঁচ করে থাকবে ব্যাপারটা, আবার এটা আমার কষ্টকল্পনাও হতে পারে, কিন্তু আমার বিশ্বাস, টনি কার্টিস এল পাসোয় গিয়েছিল তোমার জন্য টাকার জোগাড়ে।’
‘সম্ভবত সে বুঝতে পেরেছিল তাকে দিয়ে লড়াই হবে না, তাই টাকার ব্যবস্থা করে পেশাদার বন্দুকবাজ ভাড়া করতে চেয়েছিল। ও যা করেছে, সে জন্য সাহস লাগে। তাই রৌভ সুযোগটা দেওয়ামাত্র লুফে নিয়েছিল। কারণ ও জানত, রৌভ যদি হত্যা করে ওকে, তুমি টাকা জোগাড় করতে পারবে না।
‘আর এসব করতে গিয়েই হয়তো কোনো এক সময়ে নিজেকে যাচাই করার ইচ্ছে হয় তার। হয়তো বুঝতে চাইছিল, তার সাহস আছে কি না বন্দুকের মুখোমুখি হওয়ার এবং সে জন্যই এল পাসোয় ঝগড়াটা বাধিয়েছিল গায়ে পড়ে।’
কোনো জবাব দেয় না মেয়েটি, কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে। দেখে, কীভাবে দক্ষ হাতে একটা চামড়ার রিয়াটা তৈরি করছে ওরিন।
‘হ্যাঁ,’ এক সময়ে বলল মোনা। ‘আমিও ভেবেছি কথাটা। কিন্তু টাকা কোত্থেকে পেল, কিছুতেই মাথায় আসছে না। আবার না জেনে খরচ করতেও বাধছে।’
‘বোকার মতো কথা বল না,’ ঝাঁঝাল স্বরে বলল ওরিন। ‘কাজে লাগাও। তোমার দরকার ওই টাকা। বন্দুক ধরতে জানে, এমন লোক ভাড়া করতে হবে।’
‘কিন্তু আমার জন্য কাজ করবে কে?’ স্বগতোক্তির ঢঙে বলল মোনা, কণ্ঠে তিক্ততা। ‘কেউ যাতে আমার এখানে কাজ না করে, জ্যাক প্যালেন্স তার ব্যবস্থা করে রেখেছে।’
‘দেখি, আমি শহরে গেলে হয়তো পাব কিছু লোক।’ কেভিন পিটার্সনের কথা ভাবছে ওরিন। লোকটা ইংরেজ, কথায় কথায় শেক্সপিয়র থেকে উদ্ধৃতি দেয়। ‘আমার বিশ্বাস এক জনকে পাব।’
‘অনেক কিছু করতে হবে। জিম অবশ্যি আমাকে বলেছে—তুমি একাই তিনজনের কাজ করছ।’
উঠে দাঁড়াল ওরিন। এক কদম পিছু হঠল মোনা। সহসা বুঝতে পারছে, সামনে দাঁড়ানো লোকটা কত লম্বা। একজন মেয়ের অনুপাতে তাকে দীর্ঘাঙ্গিনীই বলা চলে, কিন্তু তার পরও উচ্চতায় ওরিনের ঠোঁট ছাড়ায়নি। কথাটা ভেবে একটু বিব্রত বোধ করে মোনা। চকিতে তাকায় ওরিনের কোমরে ঝোলান পিস্তল দুটোর দিকে। সব সময় লোকটা পরে থাকে ওগুলো, নিচু করে বেঁধে রাখে।
‘ডেভিডসন বলছিল, পিস্তলে তোমার হাত খুব চালু। বলছিল, তোমার মধ্যে… একজন বন্দুকবাজের সব চিহ্ন আছে।’
‘সম্ভবত।’ কথাটায় এতটুকু অখুশি হয় না ওরিন। ‘বন্দুক ব্যবহার করেছি আমি। বন্দুক, ঘোড়া, সারাজীবন এগুলো নিয়েই কাটিয়েছি।’ কথাটা মিথ্যে না। টেনেসিতে চেরোকি ইন্ডিয়ানদের মাঝে বড় হয়েছে ওসমানরা। তীরন্দাজি যেমন জানে, তেমনি জানে গুলি চালাতে। তবে অস্ত্র নিয়ে কখনো খেলা করে না ওরা; গোলাবারুদের অপচয় একদন বরদাস্ত করতে পারে না।
চালাঘরের ভেতরটা অন্ধকার হয়ে আসিছল, যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ওরা। বাইরের আলো-আঁধারিতে বেরিয়ে এল ওরিন। দুটো-একটা তারা বেরিয়েছে এরই মধ্যে; পশ্চিমে, পাহাড়ের ওপাশে, লাল আভার শেষ চিহ্নটুকু মুছে যাচ্ছে।
‘কাল,’ বলল ওরিন, ‘আমি শহরে যাচ্ছি। তুমি সবাইকে কাছে-পিঠেই রেখ।’
কাকভোরে ওকে পাওয়া গেল ইয়োলো জ্যাকেটের ট্রেইলে। দীর্ঘ পথ, বেশির ভাগ সময় মূল রাস্তা এড়িয়ে চলছে সে সাবধানীর মার নেই বলে। গুমোট, উজ্জ্বল আবহাওয়া। এখানে-সেখানে পিভটরকের কিছু বাছুর চোখে পড়ল তার। সেদিনের রাউন্ডআপের সময়ে দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল ওগুলো।
বিপদের জন্য তৈরি হয়ে পথ চলছে সে, স্যাডলের ওপর উইনচেস্টার আড়াআড়িভাবে রাখা, সমস্ত ইন্দ্রিয় সজাগ। গাছপালার আড়ালে ঘোড়া হাঁকাচ্ছে, চিরসবুজ পাইনপাতার পুরু কার্পেটের ওপর দিয়ে যাতে খুরের শব্দ ঢাকা পড়ে।
পথ চলতে চলতে, জমির মূল মালিকানার সমস্যাটা নিয়ে ভাবে ওরিন। মোনাকে যদি ওই জমি দখলে এবং নিজেকে ঝামেলামুক্ত রাখতে হয়, মালিকানার নাড়ি-নক্ষত্র জানতে হবে। বের করতে হবে, বুড়ো কার্টিস জমিটা কেনার আগে ওটার মালিক কে ছিল—আলভারেজ না কোলাসো।
এরপর, অবশ্যই জানতে হবে, যদি সম্ভব হয়, কীভাবে পাঁচ হাজার ডলার জোগাড় করেছিল টনি কার্টিস। কেউ কেউ হয়তো ভাবতে পারে টাকাটা ওর কাছে ছিল এবং এখন ওর স্ত্রীর কাছে আছে—এটুকু তথ্যই যথেষ্ট। কিন্তু বিষয়টা এত সরল থাকে না, যদি রাঞ্চের পানি অথবা জমির কোনো অধিকার বিক্রি করে দিয়ে থাকে টনি কিংবা এমন কোনো উপায়ে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে, যা মোনা বা তার সন্তানের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া করতে পারে।
এই রহস্যগুলো ভেদ করার পর নিজের ব্যাপারে মাথা ঘামানোর সময় পাবে সে, কেননা তত দিনে জ্যাক প্যালেন্স নামক সমস্যারও একটা সুরাহা হয়ে যাবে।
পিভটরকে এই কদিনের বসবাসেই জায়গাটাকে ভালোবেসে ফেলেছে সে। যদিও মোনাকে এড়িয়ে চলেছে সযত্নে, জুনিয়রকে এড়ায়নি। ছোট্ট ছেলেটা নিজেকে সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে ওরিনের সঙ্গে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার পাশে থেকেছে।
ছেলেটাকে ব্যস্ত রাখার জন্য, ওরিন ওকে শেখাতে শুরু করেছে কীভাবে র-হাইডের বিনুনি বাঁধতে হয়। ফলে, ও যখন রিয়াটা রিপু করেছে বা লাগাম মেরামত করেছে, ছেলেটা ওর পাশে বসে চেষ্টা করেছে আনাড়ি হাতে চামড়ার বেনি বুনতে।
মোনার সঙ্গে কয়েক মিনিট একান্তে কাটানোর কথা মনে হতেই অস্বস্তি বোধ করে সে। স্যাডলে একটু নড়েচড়ে বসে, ভ্রূকুটি করে। মেয়েটিকে সে কার্টিসের বিধবা স্ত্রী ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারছে না। যে লোকটাকে সে হত্যা করেছে, ওরিন ভাবল তিক্ততার সঙ্গে, মোনা তার বিধবা স্ত্রী।
ঘটনাটা যখন জানবে মেয়েটা, কোন মুখে সে দাঁড়াবে ওর সামনে? ভাবনাটাকে তাড়াতে চেষ্টা করে সে, কিন্তু নাছোড় সেটা ওর মনের মধ্যে গেঁথে থাকে। সজোরে মাথা নাড়ায় ওরিন, ব্যাপারটা ভুলে যেতে চায়। দু-দিন আগে বা পরে, সব জানবে মোনা। সে নিজে যদি খুলে না-ও বলে, প্যালেন্সই নিশ্চিত করবে, খবরটা যেন ওর কানে ওঠে।
হার্ডস্ক্র্যাবলের রাস্তা এড়িয়ে, মেসার পুব সীমানা পেরোল ওরিন। পুরোনো একটা ট্রেইল ধরে একে একে হোয়াইটরক এবং পোলস মেসা হয়ে, রক ক্রিকের কাছে ইস্ট ভার্দে অতিক্রম করে ডানে ঘুরল। এরপর বুলসিপ্রংয়ের দিকে ছুটল বোর্ডিংহাউস ক্যানিয়নের বুক চিরে, ট্যাংগল পিকের অদূর দিয়ে ভার্দের মূল স্রোতধারাটা পার হলো। বেশ কয়েক মাইলের ঘুরপথ এটা, কিন্তু তার পরও সতর্ক থাকছে ওরিন, নজর রাখছে চারপাশে। ইয়োলো জ্যাকেটের রোদে চৌচির রাস্তায় যখন রৌনটাকে হাঁটাল সে, তখন পড়ন্ত বেলা।
তার মনের ভেতর দানা বেঁধেছে একটা ধারণা। এখন সেই ধারণার ভিত্তিতে এগোবে সে। বাংকহাউসের রাতগুলোয় ডেভিডসনের সঙ্গে বহু কথাই হয়েছে। ওর থেকেই আলভিতো আলভারেজের কথা শুনেছে। বুড়ো কার্টিস যার থেকে জমি কিনেছিল, আলভিতো তার নাতি।
লিভারি স্টেইবলে দোল খেয়ে নামল সে, ঘোড়াটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল ভেতরে। জনি এগিয়ে এসে মিলিত হলো ওর সঙ্গে, কিছু একটা খুঁজছে ওরিনের মুখে। ‘তোমার সাহসের বলিহারি, বাপু। প্যালেন্স খ্যাপা কুকুর হয়ে আছে। রাগে গরগর করতে করতে শহরে ফিরেছে সেদিন। হার্ডি সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে, তোমার কপালে কী আছে!’
লোকটার উদ্দেশে স্মিত হাসল ওরিন। ‘এটাই আশা করছিলাম আমি। তুমি কোন পক্ষে?’
‘হুম,’ গম্ভীর শোনাল জিমের কণ্ঠ, ‘হার্ডিকে আমি দু-চোখে দেখতে পারি না। শহরে ভীষণ ডাঁট নিয়ে বেড়ায়। আমার বা আমার পরিবারের সঙ্গে কখনো ভালো ব্যবহার করে না। সত্যি বলতে কী, মিস্টার, খুব খুশি হয়েছিলাম সেদিন, তুমি যখন সবার সামনে বুদ্ধু বানালে ওকে। মরে যাওয়াটাও মনে হয় এর চেয়ে ঢের ভালে ছিল ওর জন্য। অবশ্যি সাধ করে বিপদটা ডেকে এনেছিল খচ্চরটা।’
‘তাহলে আমার ঘোড়াটার একটু যত্ন নিয়ো, আচ্ছা? আর দড়িটা আলগোছে পেঁচিয়ে রেখ টাইরেইলে।’
‘নিশ্চয়ই। ভূট্টাও পাবে ওটা। আমি মনে করি, তুমি যে ঘোড়া নিয়েই শহরে আস, তার ভূট্টা দরকার হবে।’
রাস্তায় বেরিয়ে এল ওরিন। আজ ওর পরনে কালচে জিন্স আর ধূসর পশমি শার্ট। কালো টুপিটা নিচু করে টেনে দেওয়া। আশেপাশের ছায়ার সঙ্গে সুন্দর মিশে গেছে ওর সুঠাম কাঠামো। প্রথমে আলভিতোর সঙ্গে দেখা করবে সে, তারপর চারপাশে ঘুরে দেখবে। কেভিন পিটার্সনকে একা পেতে চায় সে।
কথাটা মনে হতেই আস্তাবলে ফিরে এল সে। জনিকে বলল, ‘পিটার্সনের ঘোড়াতেও স্যাডল চাপিয়ে রেখ। সে-ও যাচ্ছে আমার সঙ্গে।’
‘পিটার্সন?’ চোখ বড় করল লিভারি মালিক। ‘আরে, সে তো মদে বেহুঁশ কদিন ধরে!’
‘তৈরি রেখ ওর ঘোড়াটা। ফেরার সময়ে ও থাকবে আমার সঙ্গে। আরও দু-একজনের কথা যদি তোমার জানা থাকে যারা বন্দুক ধরতে জানে, তাদের বলবে, আমি লোক নিচ্ছি, ভালো বেতন দেব। গানফাইটারের বেতন।’
ইয়োলো জ্যাকের পেছনের অফিস কামরায় জ্যাক প্যালেন্সের টেবল ঘিরে তিনজন লোক বসে। প্যালেন্স নিজে, টমাস হার্ডি, এবং প্রিন্স ময়নিহান।
‘কী মনে হয় তোমার, কার্ল পারবে ওকে সামলাতে?’ প্যালেন্স জিজ্ঞেস করল। ‘তুমি লোকটাকে ড্র করতে দেখেছ, প্রিন্স?’
‘পারবে। তবে হাড্ডাহাড্ডি হবে.. ভীষণ হাড্ডাহাড্ডি! আমি মনে করি, সবচেয়ে ভালো হবে টম যদি কাছে-পিঠে কোথাও ঘাপটি মেরে থাকে।’
‘আমাকে এর বাইরে রাখ।’ ঘন, রোমশ ভ্রূযুগলের নিচে দিয়ে তাকাল হার্ডি। ‘আমি আর ওই লোকের কোনো ব্যাপারে থাকতে চাই না। কার্ল একাই সামলাক হারামিটাকে।’
‘ভয় পাচ্ছ কেন,’ শেরিফকে আশ্বস্ত করল ময়নিহান, ‘তোমাকে কেউ দেখতে পাবে না, বিপদও হবে না। তুমি হোটেলের ছাদে থাকবে, উইনচেস্টার নিয়ে।’
চকিতে পলক তুলল হার্ডি, জিভ দিয়ে ওর পুরু ঠোঁটজোড়া ভেজাল। খুন-খারাবি তার জীবনে নতুন কিছু না, কিন্তু সামনে বসা এই লোকটা এত অবলীলায় এগুলো হজম করে যে, নিজের ভেতরেই কেমন অস্বস্তি লাগে।
‘ঠিক আছে,’ রাজি হলো সে। ‘তবে যা বললাম, লোকটাকে আমি মোটেও পছন্দ করি না।’
‘আমরা ওকে এমন জায়গায় আটকাব, তুমি পাশ থেকে গুলি করার সুযোগ পাবে। ঠিকমতো নিশানা করবে, যাতে এক গুলিতেই সাবাড় হয়। তবে গোলাগুলি শুরু না হওয়া অবধি অপেক্ষা করবে।’
আস্তে করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল রৌভ। একহারা, শ্যামবর্ণ চেহারা, শ্বাপদের মতো চলাফেরা। হাত দুটো বেজায় লম্বা, অস্থির। পরনে জিন্স এবং লাল পালক আর গুঁটিখচিত একটা সাদা বাকস্কিনের ভেস্ট। ‘বস, ব্যাটা শহরে। ওরিন এখানে।’ ওদের শলাপরামর্শ শুনতে পেয়েছে সে।
এতক্ষণ হেলান দিয়ে বসে ছিল প্যালেন্স, এবার সামনে ঝুঁকল। ‘এখানে? শহরে?’
‘ঠিক। আমি মাত্র দেখলাম ইয়োলো জ্যাকেটের বাইরে।’ সিগারেট বানাতে শুরু করে রৌভ। ‘সাহস আছে মানতে হবে। অনেক সাহস।’
‘মনে পড়েছে, প্রিন্স, এবার চিনতে পেরেছি ওকে,’ বলল রৌভ। ‘ওরিন ওসমান। টেনেসি মাউন্টেনের ওসমান খানদানের বড় ছেলে। বেশ কিছুদিন আগে গোল্ড মাইনিং টাউনের মার্শাল ছিল। একাই মহড়া নিয়েছিল চল্লিশ জনের, সব কটাকে ঘায়েল করেছিল।’
‘ঠিক!’ তীক্ষ চোখে তাকাল হার্ডি। ‘ওরিন ওসমান! আমার আগে মনে পড়েনি কেন? এখনো লোকে বলে, বয়েডকে সে কীভাবে বাধ্য করেছিল ন্যাড়া হতে।’
ময়নিহানের দিকে দৃষ্ঠি ফেরাল রৌভ। ‘এখুনি সাবাড়াতে চাও?’
একটু দোনামোনা করে ময়নিহান, পলিশ করা বুটের ডগা জরিপ করছে। হার্ডিকে যেভাবে সামলেছিল ওসমান, তাতে শহরে ওর বন্ধু হয়েছে। মোনা কার্টিসের পক্ষ নেয়াতেও লোকটার ওপর মানুষ খুশি। যা-ই ঘটুক, দিনের আলোয় ঘটতে হবে। সে সময় এমন জায়গা প্যালেন্স আর তাকে থাকতে হবে, যেন মানুষ দেখতে পায় এবং মনে করে, ঘটনার সঙ্গে ওদের কোনো সমপর্ক নেই। পাশাপাশি, ওর দুর্বল জায়গায় আঘাত করতে হবে। সব মানুষেরই কোনো না কোনো গোপন দুর্বলতা থাকে, কিছু লুকোছাপা থাকে। সেখানে স্ক্রু টাইট দিতে হয়। দুর্নাম ছড়াতে হয়।
‘না, এখন না। আমরা অপেক্ষা করব।’ হাসল সে। ‘একটা কথা জেনে রাখ, লোকটার যেমন সাহস আর পারিবারিক পরিচয়, চ্যালেঞ্জ করলে ঠিক আসবে।’
কিন্তু কীভাবে আসবে?’ অস্ফূটে মন্তব্য করল কিথ। ‘সেটাই হচ্ছে লাখ টাকার প্রশ্ন।’
বিরক্তিভরে ঘাড় ফেরাল ময়নিহান; অনেক বেশি কথা বলে ফেলেছে সে। কখন নিঃশব্দে কামরায় ঢুকেছে পিয়ানোবাদক কেউ লক্ষ করেনি। ‘ধন্যবাদ, কিথ। এসব নিয়ে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে। আর শোন… তুমি কিছুই শুনতে পাওনি।’
‘অবশ্যই শুনিনি।’ আকর্ণ হাসল কিথ, পায়ের পাতার ভরে ঘুরল লাট্টুর মতো, দরজা খুলে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ওর চলে যাওয়া দেখে প্যালেন্স। ‘আমি এই লোকটাকে পছন্দ করি না, প্রিন্স। আমি ওকে বিশ্বাস করব না।’
‘কিথের কথা বলছ? কিথ পিয়ানো বাজাতে পারলে আর একটু ভালো মদ পেলেই খুশি। জানই তো, গানবাজনার লোক কেমন হয়ে থাকে। ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’
চার
বাদুড়-ডানা দরজার ওপর দিয়ে ইয়োলো জ্যাকেট সালুনের ভেতরটা একটুক্ষণ জরিপ করার পর সরে এল ওরিন। নিঃসন্দেহে একটা চক্রান্ত চলছে অন্য কোথাও। এই শহরের ভাগ্যবিধাতাদের কাউকে দেখা যাচ্ছে না। দ্বিধায় পড়ল সে, বিষয়টার তাত্পর্য বিবেচনা করল মুহূর্তের জন্য। তারপর ঘুরে এগোল একটা অন্ধকার গলিপথ ধরে, জীর্ণ একটা তারকাঁটার বেড়ার সামনে এসে থামল।
ওয়াগনের চাকায় দেবে যাওয়া একটা মেঠোপথের কিনার ঘেঁষে অনেকদূর অবধি চলে গেছে বেড়াটা। ওটার পাশ দিয়ে এগোল সে, একটা কটনউডের ঝাড় অতিক্রম করল। একটু বাদে একটা খড়ের গাদার দেখা পেল সে। ওটার কাছাকাছি এসে ডানে ঘুরল ওরিন, আগাছায় ছাওয়া একটা রাস্তা ধরে অনতিদূরের অ্যাডৌবিটার দিকে এগিয়ে গেল। বাড়িটার জানালায় সন্ধেবাতির টিমটিমে আভা।
অ্যাডৌবির দরজায় নক করল সে। ছিটকিনি খোলার আওয়াজ হলো ভেতরে, তারপর কপাটের পাশ দিয়ে অল্পবয়সী এক তরুণী উঁকি মারল। মেয়েটার চেহারায় ইন্ডিয়ার রক্তের ছাপ, গায়ের রঙ কালচে। ওরিন সাবলীল সপ্যানিশে বলল, সে আলভিতোর সঙ্গে দেখা করতে চায়। খানিক দ্বিধার পর, চওড়া হলো দরজার ফাঁক এবং ওরিন ভেতরে ঢুকল।
বেশ সুপরিসর কামরা। এক পাশে কালির ঝুল পড়া ফায়ারপ্লেস, যেখানে ছোট্ট একটা আগুন জ্বলছে। ঘরের মাঝখানে অয়েল ক্লথে ঢাকা টেবিল, ওটার ওপর দাঁড়িয়ে একটা লণ্ঠন। টেবলের আরেক পাশে, দেয়ালের ধারে, বিছানায় মনের সুখে নাক ডাকছে এক যুবক।
খেলা থামিয়ে কালো চোখের দুটো ছেলেমেয়ে তাকাল ওর দিকে। গলা চড়িয়ে হাঁক পাড়ল মেয়েটা, থেমে গেল নাক ডাকার আওয়াজ, কম্বল সরিয়ে বিছানায় উঠে বসল যুবক।
‘সেনিয়র আলভিতো আলভারেজ? আমি ওরিন ওসমান।’
‘আমি তোমার কথা শুনেছি, সেনিয়র।’
ওখানে ওর আসার উদ্দেশ্য সংক্ষেপে বলল ওরিন। মন দিয়ে শুনল আলভিতো, তারপর এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়াল। ‘আমি ঠিক জানি না, সেনিয়র। গ্র্যান্টটা অনেক পুরোনো। আমরাও আর ধনী নই। আমার বাবা,’ কাঁধ ঝাঁকাল সে, ‘যৌবনে টাকা ওড়াতে পছন্দ করত।’ একটু ইতস্তত করল সে, মন্তব্যটা নিয়ে ভাবল একটুক্ষণ, তারপর দায়সারাভাবে বলল, ‘আমিও ওড়াতে পছন্দ করি। টাকা তো খরচ করার জন্যই, না কি? না, সেনিয়র, আমার মনে হয় না কোনো দলিলপত্র আছে। বাবা আমাকে গ্র্যান্টের কথা বলেছিল, কিন্তু দলিলের কথা বলেনি। আর এটা কোলাসো, মানে আমার বাবার পালক বাবার কাছে কোনো কিছু থাকার প্রশ্নই আসে না।’
‘পরে তোমার যদি কিছু মনে পড়ে, জানাবে নিশ্চয় আমাদের?’ জিজ্ঞেস করল ওরিন। তারপর হঠাত্ একটা ভাবনা খেলল তার মাথায়। ‘তুমি তো একজন ভাকেরো, না? কাজ চাও?’
‘কাজ?’ আলভিতো চোখ ছোট করে তাকাল। ‘কোথায়? সেনিয়ওরা কার্টিসের রাঞ্চে?’
‘হ্যাঁ। বুঝতেই পারছ, বিরাট কাজিয়া লাগতে যাচ্ছে। আমি ওখানে কাজ করছি। আজ রাতে আরেকজনকে নিয়ে যাচ্ছি সঙ্গে করে। তুমি যদি রাজি থাক, কাজটা তোমার।’
শ্রাগ করল আলভিতো। ‘কেন নয়? বুড়ো সেনিয়র কার্টিস আমাকে আমার প্রথম ঘোড়া উপহার দিয়েছিলেন। রাইফেলও দিয়েছিলেন একটা। খুব ভালো মানুষ ছিল; তার ছেলেও।’
‘তাহলে শহরের বাইরে যোগ দাও আমার সঙ্গে, ট্রেইলটা যেখানে দুই টিলার মাঝ দিয়ে গেছে। চেন জায়গাটা?’
‘সি, সেনিয়র। আমি থাকব ওখানে।’
আপনমনে পিয়ানো বাজাচ্ছিল কিথ যখন বাদুড়-ডানা ঠেলে সালুনে ঢুকল ওরিন। দ্রুত চোখ বুলিয়ে সবার অবস্থান মাথায় গেঁথে নিল সে। কিথকে প্রথমেই দেখেছে, ড্যানি বারে, কেভিন পিটার্সন একটা টেবিলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে, আরও জনা ছয়েক লোক গুলতানি মারছে এখানে-সেখানে। বারের কাছাকাছি পৌঁছেছে সে, এমন সময়ে পেছন দিককার একটা দরজা খুলে কামরায় পা রাখল কার্ল রৌভ।
লোকটাকে আগে দেখেনি ওরিন, তা সত্ত্বেও ডেভিডসনের নির্ভুল এবং সযত্ন বিবরণ থেকে সহজেই চিনতে পারল। ওরিনের মতো অত লম্বা না, তবে আরও ছিপছিপে। পাকানো দড়ির মতো গড়ন, ক্ষিপ্র গতি আর সাবলীল আঙুল চালনার জন্য আদর্শ। ওর সমস্ত পেশি শিথিল, কিন্তু এ ধরনের লোকদের ক্ষমতা ভালোই তার জানা বলে মুহূর্তে সতর্ক হয়ে গেল ওরিন। ঘরে ঢুকেই রৌভ দেখতে পেয়েছিল ওকে, কাছেই বারের একটা জায়গায় অবস্থান নিল।
সব চোখ এ মুহূর্তে এই দুজনের দিকে। হার্ডিকে কীভাবে নাস্তানাবুদ করেছে ওরিন, তারপর রাঞ্চ থেকে কার্যত একাই তাড়িয়ে দিয়েছে প্যালেন্স আর তার চামচাদের—এসব খবর এখন শহরের লোকের মুখে মুখে। ওর দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসল রৌভ। ‘একটা ড্রিংক চলবে?’ জিজ্ঞেস করল ওরিন।
মাথা ঝাঁকাল রৌভ। ‘আমার কোনো আপত্তি নেই।’ তারপর ওরিনের চোখে চোখ রেখে নিচু স্বরে বলল, ‘যাকে আমি হত্যা করতে যাচ্ছি, তার সঙ্গে গলা ভেজাতে আমার আপত্তি নেই।’ ওর হলদেটে চোখে ব্যঙ্গ।
ওরিন কাঁধ উঁচু-নিচু করল। ‘আমারও না।’ রৌভের অকপট স্বীকরোক্তি তার পছন্দ হয়েছে। ‘যদিও একটা তফাত আছে। আমি নিজেই আমার ড্রিংক করার কিংবা কাউকে খতম করার সময় ঠিক করি। কিন্তু তোমাকে আরেকজনের হুকুমের অপেক্ষায় থাকতে হয়।’
ভেস্টের পকেট থেকে কাগজ আর তামাক বের করে একটি সিগারেট বানাতে শুরু করল কার্ল রৌভ। ‘কিন্তু আমার জন্য তুমি অপেক্ষা করবে, কমপাদ্রে। আমি জানি তোমার রগ।’
একে অপরের উদ্দেশে গ্লাস উঁচু করল ওরা, এক চুমুকে সবটুকু পানীয় শেষ করল। বারের ওপর গ্লাস নামিয়ে রাখছে ওরা এমন সময়ে একটা দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল জ্যাক প্যালেন্স। ওদের দুজনকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ড্রিংক করতে দেখে রাগে কালো হয় গেল তার চেহারা। নীরবে সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিল লোকটা, হঠাত্ কী মনে হতে থেমে ঘুরে দাঁড়াল।
‘আমি ভাবছি,’ ঘরের সবাইকে শুনিয়ে বলল সে, ‘মোনা কার্টিস কী বলবে, যখন জানবে, তার এই নতুন কর্মচারীই হচ্ছে সেই লোক, যে তার স্বামীকে খুন করেছে?’
প্রতিটা মাথা ঘুরে গেল বারের দিকে। সাদা হয়ে গেল ওরিনের মুখ। মুহূর্তেক আগেও মিত্রভাবাপন্ন কিংবা নিরপেক্ষ ছিল সবার চেহারা, কিন্তু এখন সবাই সতর্ক, মনোযোগী। মোনাকে পছন্দ করে সবাই, সে জানে, ঠিক যেমন করত ওর স্বামী কার্টিসকেও। এখন এই লোকগুলো ওর শত্রুতে পরিণত হবে।
‘তুমি এখানে কেন এসেছ, ওসমান, এটাই আমার মাথায় ঢুকছে না। মেয়েটার স্বামীকে খুন করার পর তার রাঞ্চে কেন আসবে তুমি? আরও ফায়দার জন্য কি? মেয়েটার যেটুকু
সম্বল আছে, সেটাও লুট করতে চাইছ? নাকি তোমার চোখ বিধবা মেয়েটার ওপরেই?’
অতি কষ্টে রাগ দমন করল ওরিন। হালকা সুরে বলল, ‘প্যালেন্স, রাঞ্চ দখল করতে তুমিই গিয়েছিলে। আমি তোমাকে তাড়িয়েছি। আমি এখানে আছি শুধু একটা কারণে, মহিলা রাঞ্চের মালিকানা রাখতে পারছে, কায়োটের দল কেড়ে নিচ্ছে না—এটা নিশ্চিত করার জন্য।’
প্যালেন্স দাঁড়িয়ে রইল পাথরের মতো, ওরিনের মুখোমুখি। রাগে কাঁপছে রাঞ্চার, ফোঁসফোঁস নিঃশ্বাস নিচ্ছে। নিজের গায়ে লোকটার তপ্ত নিঃশ্বাসের ঝাপটা অনুভব করল ওরিন। পাশেই দাঁড়িয়ে কার্ল রৌভ। প্যালেন্স যদি বন্দুক বের করতে নেয়, ওরিনের বাঁ হাতে আচমকা ঝটকা মেরে তার ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে রৌভ। তবে সেই অবস্থার জন্যও প্রস্তুত আছে ওরিন। টের পাচ্ছে, আবার একটা বুনো হিংস্রতা জেগে উঠছে তার ভেতরে, যেটা তাকে উদ্বুদ্ধ করে হানাহানিতে।
আবার মুখ খুলল সে, কণ্ঠস্বর মোলায়েম কিন্তু কথাগুলো কাটা কাটা। ‘কই, সিদ্ধান্ত নাও, প্যালেন্স। যদি মরতে চাও, এখুনি তা পার। ফের একটা বাজে মন্তব্য করেছ কি, প্রতিটা শব্দ তোমার গলা দিয়ে নামাব। পিস্তলের দিকে হাত বাড়ালে খুন করব তোমাকে। রৌভ যদি এর মধ্যে আসতে চায়, আসতে পারে, আমার কোনো আপত্তি নেই।’
ফুট কাটল কার্ল রৌভ, সেও আস্তে করেই। ‘আমি এর ভেতর নেই, ওসমান। আমি শুধু নিজের জন্য লড়ি। যখন আসব তোমাকে হত্যা করতে, একাই আসব।’
ইতস্তত করে জ্যাক প্যালেন্স। রৌভের ভরসায়, ক্ষণিকের জন্য সাহসী হয়ে উঠেছিল সে। কিন্তু এখন দোটানায় পড়ে গেছে; এবং আচমকা ঘুরে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। স্যালুনের সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।
রৌভকে ভাবনা থেকে খারিজ করে দিল ওরিন, সোজা হেঁটে গেল কেভিন পিটার্সনের দিকে, কাঁধে ধরে ঝাঁকাল। ‘ওঠ, কেভিন, তোমাকে বিছানায় শুয়ে দিচ্ছি।’
নড়ল না পিটার্সন। ঝুঁকে ওর বগলের নিচে দিয়ে একটা হাত গলিয়ে দিল ওরিন, টেনে তুলল বিশালদেহী ইংরেজকে। পা বাড়াল দরজার উদ্দেশে। দরজার কাছে গিয়ে ঘাড় ফেরাল সে। ‘দেখা হবে, রৌভ।’
গ্লাস উঁচু করল কার্ল, ওর হ্যাট পেছনে ঠেলে দেওয়া। ‘নিশ্চয়,’ বলল। ‘আমি একাই থাকব।’ কথাটা শেষ করার পরপরই টমাস হার্ডিকে মনে পড়ল তার; মনে পড়ল, কী পরিকল্পনা হয়েছে পেছনের কামরায়। ঈষত্ কালো হয় গেল ওর মুখ, হুইস্কিটা সহসাই বিস্বাদ ঠেকল। আস্তে করে গ্লাসটা বারে নামিয়ে রাখল সে, ঘুরে পেছনের দরজা দিয়ে অদৃশ্য হলো।
একলা তাস খেলছিল প্রিন্স ময়নিহান, মুখে চুরুট। ‘আমি পারব না, প্রিন্স,’ ধোঁয়ার এপাশ থেকে বলল রৌভ। ‘এই খুনের ব্যাপারটা তোমাকে আমার ওপর ছেড়ে দিতে হবে। শুধু আমার ওপরে।’
দুই টিলার মধ্যবর্তী অন্ধকার জায়গায় আলভিতোর সঙ্গে যোগ দিয়েছে ওরিন। আরেকটা ঘোড়ার পিঠে অঘোরে ঘুমোচ্ছে পিটার্সন। যাতে পড়ে না যায়, স্যাডলের সঙ্গে দড়ি দিয়ে ওকে বেঁধে রেখেছে ওরিন। গাঢ় অন্ধকারের ভেতর একটা ঝোপের আড়ালে অপেক্ষা করছিল আলভিতো। সে-ই আগে দেখতে পায় ওরিনকে। মৃদু শিস দিয়ে দৃষ্টিআকর্ষণ করে। ওরিন সাড়া দিতেই ঘোড়ায় চেপে বেরিয়ে এসেছে মেক্সিকান, চকিতে একবার পিটার্সনকে দেখে নিয়েই, বিনা বাক্যব্যয়ে, ওদের সহযাত্রী হয়েছে।
পরদিন সকালে বেশ বেলায় পিভটরকে পৌঁছাল ওরা।
ইতিমধ্যে নেশা কেটে গেছে কেভিন পিটার্সনের, গাল বকছিল। ‘হুম!’ হুঙ্কার ছাড়ল সে। ‘তোমার সাহসের বলিহারি, ওসমান। আমাকে ছেড়ে দাও, যাতে ফিরতে পারি। আমি এ সবের মধ্যে নেই।’
ওর বেহাল অবস্থা দেখে একগাল হাসল ওরিন। ‘অবশ্যই ছেড়ে দেব, কেভিন। কিন্তু তুমিই না সেদিন বলছিলে শহর ছাড়তে। এভাবে না হলে আর কীভাবে সম্ভব হতো, বল।’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল বটে কিন্তু ওর চোখে উপচে পড়ছে কৌতুক। ‘তোমার মঙ্গলের জন্যই করেছি এমন। পাহাড়ের তাজা বাতাস, ঠান্ডা দুধ খাও দু-চার দিন…’
‘দুধ?’ বোমার মতো ফেটে পড়ল পিটার্সন। ‘আমি কি দুধের খোকা নাকি, যে দুধ খাব? আমাকে ছেড়ে দিয়ে একটা বন্দুক দিয়েই দ্যাখ, তোমার চামড়া দিয়ে আমি ডুগডুগি বাজাব!’
‘আর এই রাঞ্চটা প্যালেন্সের হাতে তুলে দেবে? প্যালেন্স আর ময়নিহানের হাতে?’
রক্তজবা চোখে ওর দিকে চেয়ে থাকল পিটার্সন, সহসা ধারালো হয়ে উঠেছে দৃষ্টি। ‘ময়নিহান নামটা শুনলাম মনে হলো? এর মধ্যে সে আসছে কোত্থেকে?’
‘যদি জানতাম, তাহলে ভালোই হতো। তবে আমার ধারণা, সব চক্রান্তের পেছনে আসল মাথা ওই লোক। প্যালেন্সের লাটাইও তার হাতেই।’
সম্ভাবনাটা নিয়ে একটু সময় ভাবল পিটার্সন। ‘হতে পারে।’ ওরিন ইতোমধ্যে খুলতে শুরু করেছে ওর বাঁধন। ‘এই দিকটা আমি ভেবে দেখিনি। কিন্তু কেন?’
‘ওকে তুমি চেন আমার আগে থেকে। কেউ একজন কার্টিসের পেছনে লোক লাগিয়েছিল তাকে মেরে ফেলার জন্য। আমার মনে হয় না, কাজটা প্যালেন্সের। তাহলে আর কে হতে পারে?’
‘হুম।’ দোল খেয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামল পিটার্সন। টলে উঠল সামান্য, চট করে রেকাবের দড়িটা ধরে টাল সামলাল। লাজুক দৃষ্টিতে ওরিনের দিকে তাকাল সে। ‘আমার অবস্থা কাহিল।’ একটা বিস্ময়ের ভাব খেলে গেল ওর চেহারায়। ‘খিদে পেয়েছে! তাজ্জব ব্যাপার, কতকাল আমার খিদে পায় না।’
বাড়তি চারটা হাত পেয়ে পিভটরকে কাজ এগিয়ে চলল ঝড়ের বেড়ে। কিন্তু ওরিনের মন বিশ্রাম নেয় না। পাঁচ হাজার ডলারের রহস্যভেদ বাকি। জমির মালিকানার ব্যাপারটাও আছে। রাতের পর রাত আলভিতোকে উত্সাহিত করে চলল সে স্মৃতির পাতা হাতড়ে ওর বাবা আর দাদুর কথা মনে করতে। ওর বর্ণনা থেকে একটু একটু করে মানুষগুলোকে জানছে সে। আস্তে আস্তে মাথার ভেতর একটা আইডিয়া দানা বাঁধছে, তবে সেটাকে দাঁড় করাবার মতো যথেষ্ট মজবুত ভিত্তি এখনো পায়নি।
বেশ কয়েক দিন কেটে গেছে এর মাঝে। কিন্তু প্যালেন্সর ছায়াও চোখে পড়েনি। দু-দফা জনাকয়েক ঘোড়সওয়ারকে দেখা গেছে, দৃশ্যত জরিপ করছিল চারপাশ। পাহাড়ের কিনার থেকে তাড়িয়ে আনা হয়েছে গরুর পাল, বেড়ার ভেতর ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ইয়োলো জ্যাকেটে যাওয়ার দিন দলছুট যেসব গরু-বাছুর দেখেছিল সে, তার প্রায় সবই ধরে আনা হয়েছে।
ওরিন অস্থির। জানে, যখন বিপদ আসবে, তা আসবে আচমকা। এভাবেই চেষ্টা নেবে প্যালেন্স। এত দিনে সে নিশ্চয়ই পিভটরক রাঞ্চ রস্টারে কেভিন পিটার্সন আর আলভিতো আলভারেজের যুক্ত হওয়ার খবর জেনেছে।
‘বেইকার বিউটে কিছু গরু-বাছুর দেখেছি,’ একদিন সকালে বলল কেভিন। ‘কেমন হয়, আমি ওদিকে গিয়ে একবার দেখে এলে?’
‘চল, দুজনাই যাই,’ জবাব দিল ওরিন। ‘আমি নিজেও ও-দিকটা একবার দেখতে চাইছিলাম ঘুরে। কিন্তু সময় করে উঠতে পারছিলাম না।’
উজ্জ্বল সকাল। ক্ষিপ্রগতিতে মাইলের পর মাইল পেছনে ফেলে ছুটে চলেছে ওরা, সতর্ক নজর রাখছে মাথার ওপরে পাহাড়ি এলাকার দিকে। এত সতর্কতার পরও অশ্বারোহী দলটাকে যখন দেখতে পেল, তারা বড় জোর একশ গজ দূরে। পাঁচজনের একটা পসি। সবার আগে টমাস হার্ডি এবং সাদা-গোঁফঅলা এক আগন্তুক।
নজর এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আগুয়ান অশ্বারোহী দলটার দিকে এগিয়ে গেল ওরা। নবাগতেরা ইতোমধ্যে থেমে গেছে ওদের আসতে দেখে। ওরিনকে দেখে বিজয়ের হাসি ফুটল টমাস হার্ডির তোবড়ানো মুখে।
‘এই যে, এই লোককেই তুমি খুঁজছিলে, মার্শাল!’ উল্লসিত কণ্ঠে বলল সে। ‘কালো হ্যাট পরা লোকটাই ওরিন।’
‘কী ব্যাপার?’ শান্তস্ব্বরে জিজ্ঞেস করল ওরিন। আগন্তুকের ব্যাজ ইতোমধ্যে চোখে পড়েছে তার। কিন্তু আরও একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেছে সে। ভদ্রলোককে দেখে যোগ্য-সত্ অফিসার মনে হচ্ছে।
‘এল পাসোতে হুলিয়া জারি হয়েছে তোমার নামে। আমি রড মার্শ, ডেপুটি ইউএস মার্শাল। আমরা টনি কার্টিসের হত্যার তদন্ত করছি।’
শক্ত হয়ে গেল কেভিনের ঠোঁট দুটো, তীক্ষ চোখে তাকাল ওরিনের দিকে। প্যালেন্স যখন সালুনে তথ্যটা ফাঁস করে, পিটার্সন বেহুঁশ মাতাল ছিল।
‘ওটা ন্যায়সঙ্গত লড়াই ছিল, মার্শাল। কার্টিসই ঝগড়া বাধিয়ে ড্র করেছিল।’
‘আমাদেরকে কথাটা বিশ্বাস করতে বলছ তুমি?’ একরাশ ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল হার্ডির কণ্ঠে। ‘একটা ইঁদুরের সাহসও ছিল না ওর! কেন, এর কদিন আগেই রৌভ চ্যালেঞ্জ করেছিল ওকে, টনি পিছিয়ে যায়। দুটো হাত আছে, এমন কারও বিরুদ্ধে কার্টিস ড্র করবে না।’
‘আমার বিরুদ্ধে করেছিল।’ ওরিন উপলব্ধি করে এখানে দুটো যুদ্ধ লড়ছে সে—এক, গ্রেফতার এড়ানো এবং দুই, পিটার্সনের শ্রদ্ধা ও সাহায্য লাভ। ‘আমার ধারণা, সে ইচ্ছে করেই রৌভের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেনি, কারণ তার একটা কাজ বাকি ছিল এবং সে জানত, রৌভ তাকে হত্যা করবে, ফলে কাজটা অসমাপ্ত থেকে যাবে।’
‘আষাঢ়ে গল্প!’ ঠোঁট ওল্টাল হার্ডি। ‘ওই তোমার আসামি, মার্শাল, এখন যা করার তুমিই কর।’
মার্শকে সপষ্টত বিরক্ত দেখায়। বোঝা যায়, হার্ডিকে তার আদৌ পছন্দ না। কিন্তু তাকে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। সে মুখ খোলার আগেই, ওরিন কথা বলল আবার।
‘মার্শাল, আমার এমন বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে, এখানে আমার সুনাম হানির একটা চক্রান্ত চলছে। এর লক্ষ্য, আমাকে কিছু সময়ের জন্য এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া। আমি তোমাকে ওয়াদা করছি, মার্শাল, এখানকার ঝামেলা মিটলেই আমি নিজে এল পাসো গিয়ে তোমার কাছে রিপোর্ট করব। আমাকে তুমি বিশ্বাস করতে পার, ওসমানরা কেউ ওয়াদার বরখেলাপ করে না, টেনেসির সবাই এ কথা জানে; এল পাসোতেও কারও কারও অজানা নয়।’
‘দুঃখিত।’ মার্শের কণ্ঠে আফসোস। ‘আমার একটা দায়িত্ব আছে। আমি হুকুমের চাকর।’
‘বুঝতে পারছি সেটা,’ বলল ওরিন। ‘কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আমারও একটা দায়িত্ব আছে। মোনা কার্টিসকে যেন কেউ পিভটরক থেকে উচ্ছেদ করতে না পারে, তা দেখা। আমি সেটা নিশ্চিত না করে নড়ছি না।’
‘তোমার দায়িত্ব?’ মার্শের চাহনি শীতল কিন্তু দৃষ্টিতে কৌতূহল। ‘ওর স্বামীকে হত্যা করার পরও?’
‘ওটাই যথেষ্ট কারণ, স্যার,’ সোজা-সাপটা জবাব দিল ওরিন। ‘বোঝার চেষ্টা কর, লড়াইটা আমার ইচ্ছায় হয়নি। কার্টিস গায়ে পড়ে শুরু করেছিল। ভীষণ উত্তেজিত, উদ্বিগ্ন হয়েছিল সে। আবেগতাড়িত হয়েছিল। মারা যাওয়ার আগে আমাকে ডেকে বলল, একটা প্যাকেজ ওর স্ত্রীকে পৌঁছে দিতে। বলল, ওটা পেলে তার উপকার হবে। সেই দায়িত্বটাই, স্যার’ মার্শের চোখে চোখ রাখল ওরিন, ‘সবার আগে আসে।’
‘তোমার দায়িত্বটাকে সম্মান করতে পারলে আমি খুশিই হতাম,’ স্বীকার করল মার্শ। ‘তোমাকে দেখে একজন ভালো মানুষই মনে হচ্ছে, আজকাল যেটার খুব অভাব। তা ছাড়া, টেনেসির ওসমানদের কথা আমিও শুনেছি। কিন্তু আমি নাচার। আমার ওপর নির্দেশ আছে। তবে, ডুয়েলটা যদি সত্যিই ন্যায়সঙ্গতভাবে হয়ে থাকে, পুরো ঝামেলাটা মিটে যেতে বেশি সময় লাগবে না।’
‘কয়েকটা দিনই যথেষ্ট,’ জবাব দিল ওরিন, ‘এই ইঁদুরগুলোর জন্য।’ যুক্তি নিষ্ফল এখানে, বুঝতে পারছে সে। তার ঘোড়াটা দ্রুতগামী। সামনে ঘন পাইন বন। এখন দরকার একটা সুযোগ।
যেন অন্তর্যামী সে, ওর মনের কথা পড়তে পেরেছে, আচমকা তার ধূসর ঘোড়াটা ওরিন আর মার্শালের মাঝখানে এনে দাঁড় করাল কেভিন পিটার্সন। আর প্রায় ঠিক এক ইসময়ে পা ছুঁড়ল ওরিন, বুটের ডগা দিয়ে হার্ডির ঘোড়ার পাঁজরে খোঁচা মারল। ক্ষিপ্ত হয়ে চিঁহি করে উঠল ব্রংকোটা, চার পায়ে লাফাতে শুরু করল। চকিতে নিজের ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল ওরিন, সপার ছোঁয়াল পেটে, দুই লাফে অন্যদের অতিক্রম করে ঘোড়াটা ঢুকে পড়ল পাইন বনে, সন্ত্রস্ত হরিণের মতো ছুটছে।
একটা গুলির আওয়াজ হলো ওর পেছনে, তারপর আরেকটা। মাথার ওপর গাছের পাতা ঝরাল দুটোই, কিন্তু রৌনটা ছুটতেই থাকল। শুরুতে বনানীর উদ্দেশে সমকোণে এগিয়েছিল সে, কিন্তু দ্রুত রাস্তা বদলে পিভটরকে ফেরার পথ ধরল। বাঁয়ে কর্ডুরয় ওয়াশ ঝরনাটা দেখা যেতেই, রৌনের মুখ ঘুরিয়ে পানিতে নেমে গেল ওরিন।
ঝরনাটা ধরে প্রায় মাইল খানেক উজাল সে, তারপর ডাঙায় উঠে ছোট্ট একটা রিজের মাথায় ঝোপঝাড়ের ভেতর থামল কিছু সময়ের জন্য। নজর ফেরাল পেছনে।
একদল ঘোড়সওয়ার লেগে রয়েছে ট্রেইলে। ছড়িয়ে পড়ে ওর ট্র্যাক খুঁজতে ব্যস্ত ওরা। এই দলটার সামান্য তফাতে আরেকজন অশ্বারোহীকে দেখা যাচ্ছে, নীরবে লক্ষ করছে লোকগুলোর গতিবিধি। কানো সপর্শ করল ওরিনের হাসি। ওই নিঃসঙ্গ ঘোড়সওয়ার নিশ্চয়ই কেভিন পিটার্সন।
ঘোড়া ঘোরাল ওরিন, পাহাড়ি একটা থাকের শেষ মাথা অবধি এগোল, তারপর একটা গোড়ালি ঢাকা শুকনো বালিয়াড়ি পেরিয়ে পাইন বনে প্রবেশ করল। নরম পাইন পাতার কার্পেটে মোড়া পথ, বলতে গেলে ওর কোনো ট্র্যাকই রাখছে না পেছনে।
সিঞ্চ হুক বিউট ওর বাঁয়ে এবং আরেকটু কাছে, ডানে, টুয়েন্টি নাইন মাইল বিউট। টিলা দুটোকে দু-পাশে রেখে ছুটল সে, সোজা উত্তর-পশ্চিমে হর্সট্যাংক ওয়াশ লাগোয়া ভাঙাচোরা, দুর্গম ক্যানিয়নের দিকে এগোল। ক্যানিয়নে নেমে উত্তর-পশ্চিমে গেল খানিক দূর, তারপর চক্রাকারে দক্ষিণে ঘুরে আরও গভীরে, কাফপেন ক্যানিয়নে ঢুকে গেল।
এখানে একঝাঁক বোল্ডারের মাঝে একটা ঘেসো জমিতে ঘোড়াটাকে স্টেইক করল সে। রাইফেল হাঁটুর ওপর আড়াআড়ি রেখে বিশ্রাম নিতে বসল। এক ঘণ্টা পর চড়াই বেয়ে উঠে গেল ক্যানিয়নের মাথায় একটা কার্নিসের ওপর, পেছনে উঁকি দিল। পসি বাহিনীর চিহ্নমাত্র দেখতে পেল না কোথাও। এমনকি, ঘোড়ার খুরের আওয়াজও শুনতে পেল না।
কাফপেনের তলদেশে যেখানে ঘোড়াটাকে বেঁধে রেখেছ, সেখান থেকে বেশি দূরে না, পানি মিলবে। কিন্তু খাবার? খোসা ছাড়িয়ে এক মুঠো চিয়া বীজ খেল সে, কয়েকটা পাইন বাদাম গালে পুরল।
এই গ্রেফতার-চেষ্টার হোতা জ্যাক প্যালেন্স, নয়তো প্রিন্স ময়নিহান, ভাবল সে। দ্বিতীয় জন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, কেননা লোকটাকে তার সাপের চেয়েও খল মনে হয়েছে। ঘটনা যা-ই হোক, এ মুহূর্তে সে ফেরারি। পসি যদি রাঞ্চে যায়, মোনা কার্টিসকে সব খুলে বলার সুযোগ পাবে রডনি মার্শ। ওরিনই তার স্বামীর হত্যাকারী, মেয়েটাকে এ কথা জানাচ্ছে মার্শাল ভাবতেই জীবনটা ওর বিষময় মনে হলো। সে বোঝে, দু-দিন আগে বা পরে মোনা ঠিকই জানতে পাবে। কিন্তু ওরিন নিজেই সব কথা খুলে বলবে ঠিক করেছিল, উপযুক্ত সময়ে।
পাঁচ
সন্ধে যখন অনেকটাই নেমে গেছে, স্যাডলে চাপল ওরিন, কাফপেন বেয়ে নিচের ফসিল সিপ্রংসের দিকে নেমে গেল। পথ চলতে চলতে নিজের মোক্ষম চাল নিয়ে চিন্তাভাবনা করে সে। মার্শের হাতে গ্রেফতার হোক বা না হোক, সে এখন রাঞ্চেও নেই। এটাকে উপযুক্ত সময় ভেবে হামলা চালাতে পারে শত্রু। নানা বিচার-বিশ্লেষণ করে তাদের মনে হতে সে পালিয়েছে। বস্তুত, সে কার্টিসের রাঞ্চটা হাতিয়ে নেওয়ার মতলবেই এখানে এসেছিল, প্যালেন্স এমনটা ভেবেছে বলেই মনে হয়।
অবশেষে ফসিল সিপ্রংসের ওপরে একটা ড্রয়ের কিনারে রাতের মতো বিছানা পাতল সে। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে ছিল, গা এলিয়ে দেওয়ামাত্র ঘুমিয়ে পড়ল। চোখে সকালের রোদ নিয়ে জাগল সে। আকাশের বেশ অনেকটা উঁচুতে উঠে এসেছে সূর্য, উঁকি মারছে পাহাড়ের আড়াল থেকে। চট করে হাত-মুখ ধুয়ে নিল সে, কফি আর গরুর জার্কি দিয়ে হালকা নাস্তা সেরে স্যাডলে চাপল।
যেখানেই যাক সে এখন, তাকে বৈরিতার মুখোমুখি হতে হবে। ইয়োলো জ্যাকেটে প্যালেন্সের অভিযোগের প্রেক্ষাপটে তার ওপর সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে মানুষের। এতক্ষণে সবাই হয়তো এটাও জেনে গেছে, ইউএস মার্শাল তাকে খুঁজছে।
অনেক চিন্তাভাবনার পর, পাহাড়-পর্বতের ভেতর দিয়ে নাগাড়ে পশ্চিমে এগোল সে, পরদিন রাত নাগাদ ছাউনি ফেলল টারেট বিউটের ভয়াল ছায়ায়। বছর কয়েক আগে ঠিক ওই জায়গাতেই রাতের আঁধারে পাহড়ের মাথায় উঠে অ্যাপাচিদের অতর্কিতে আক্রমণ করেন মেজর র্যান্ডাল, জয়ী হন যুদ্ধে।
ধলপ্রহরে বিছানা ছাড়ল ওরিন, গোধূলির আলোয় জরিপ করল ইয়োলো জ্যাকেটের আশপাশ। শহরে কিছু প্রাণচাঞ্চল্য চোখে পড়ল ওর। দিনের এই সময়টার পক্ষে একটু বেশিই মনে হলো। হিচ রেইলগুলোয় একসারি ঘোড়া দাঁড়িয়ে, সবই জিন চাপানো। একটা খাঁজের মাথা থেকে দুরবিন লাগিয়ে ঘোড়াগুলো জরিপ করতে করতে ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাল সে। মার্শাল রডনি মার্শ এত তাড়াতাড়ি ফিরতে পারার কথা না। এর অর্থ, এটা অন্য কোনো আয়োজন। এবং আয়োজটা যে সুসংগঠিত, সেটা এত দূর থেকেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
দুরবিনের ভেতর দিয়ে আশেপাশের বাড়িঘর জরিপ করার সময়ে হঠাত্ একটা লোক তার নজরে এল। লোকটার পরনে একটা রঙ-জ্বলা লাল শার্ট। সালুনের নিকটবর্তী একটা বিল্ডিংয়ের পেছনের দরজা দিয়ে সন্তর্পণে বেরিয়ে রাস্তায় নামল সে, কাছেই আরেকটা দালানের পেছন দিকে লুকানো একটা ঘোড়ার কাছে গিয়ে স্যাডলে চাপল। এত দূর থেকে লোকটার পরিচয় বোঝার উপায় নেই। অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘোড়ায় চড়েছে লোকটা। দুরবিনের ভেতর দিয়ে ওরিন হঠাত্ বুঝতে পারল, কেন ঘোড়সওয়ারের ভঙ্গিটা আজব মনে হচ্ছে। পুবের লোকদের ধরনে ঘোড়ায় চড়েছে সে।
এই ঘোড়সওয়ার পশ্চিমের কেউ না। কুঁজো হয়ে অলস ভঙ্গিতে বসেছে স্যাডলে, অশ্বারোহী সৈনিকদের মতো শিরদাঁড়া টানটান করে নয়। ঘোড়ার পিঠে কিছুটা সামনের দিকে চড়েছে লোকটা, মরুভূমি আর এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি অঞ্চলের জন্য যা বিপজ্জনক হতে পারে। তবে লোকটার ঘোড়ায় চড়ার ঢঙের চেয়ে তার চোরের মতো পালিয়ে আসার ধরনটাই ওরিনের নজর কেড়েছে বেশি। কয়েক মিনিট পযর্বেক্ষণ করে সে বুঝল, লোকটা যে পথে শহর ছাড়ছে, তাতে অল্পক্ষণের মধ্যে সে যে খাঁজটার মাথায় রয়েছে, ঠিক তার নিচে চলে আসবে।
নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্যাডল চাপানো ঘোড়াগুলোর ওপর থেকে নজর সরাল ওরিন, ধারণা করছে, আগুয়ান অচেনা ঘোড়সওয়ারের কাছে তার ধাঁধার জবাব মিলবে। পেট ঘষতে ঝোপের ভেতর অনেকটা নেমে গেল সে, উঠে খাড়া ঢাল ধরে নিচে নামল আরও কয়েক ধাপ, ট্রেইলের পাশে কতকগুলো বোল্ডারের পাশে আত্মগোপন করল।
ভীষণ গরম ওখানে। হাওয়া নেই। অল্পতেই ঘাম ফুটল ওরিনের কপালে। তবে মিনিট খানেকের মধ্যে একটা ঘোড়া এগিয়ে আসার শব্দ পেল সে। চকিতে পিস্তল বের করল হোলস্টার থেকে, ট্রেইলের কিনারে নেমে গেল। এখন ঘোড়সওয়ারকে সপষ্ট দেখতে পাচ্ছে। পিয়ানোবাদক কিথ।
বন্দুক উঁচিয়ে ওকে থামতে ইশারা করল ওরিন। ‘কোথায় যাচ্ছ, কিথ?’ প্রশ্ন করল শান্তস্বরে। ‘এত তাড়া কিসের?’
‘আমি যাচ্ছি মার্শালের খোঁজে,’ কিথের গলায় আন্তরিকতা। ‘ময়নিহান আর প্যালেন্স মতলব করেছে, তোমাকে খোঁজার জন্য নিজেদের লোক পাঠাবে, আর সেই ছুতোয় দখল করে নেবে পিভটরক।’
ওপরে-নিচে মাথা ঝাঁকাল ওরিন। নিখুঁত ফন্দি, সন্দেহ নেই, তার আগেই অনুমান করা উচিত ছিল। ‘কিন্তু মার্শালের সঙ্গে রাস্তায়ই তো দেখা হওয়ার কথা ওদের?’
‘না, অন্য ট্রেইল ধরে যাচ্ছে ওরা। জানে, মার্শাল কোন পথে এগোচ্ছে, কারণ তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্যালেন্স।’
‘কিন্তু তোমার স্বার্থ কী এখানে? তুমি কেন এই বিপদে গলা বাড়াচ্ছ?’
‘মোনা কার্টিসের জন্য,’ অকপটে বলল কিথ। ‘খুব ভালো মেয়ে ও। টনিও ভালো ছেলে ছিল। দুজনেই সব সময় ভালো ব্যবহার করত আমার সঙ্গে। টনির বাবাও করতেন। এটুকু যদি একজন বন্ধুর জন্য করতে না পারি, তাহলে আমি মানুষ কেন! তা ছাড়া, ওই শয়তান ময়নিহানের সব প্ল্যান আমার জানা।’
‘আচ্ছা, ময়নিহানই তাহলে নাটের গুরু। প্যালেন্সের ভূমিকা কী এখানে?’
‘ওই ব্যাটা একটা আস্ত উজবুক,’ অবজ্ঞার সুর ফুটল কিথের কণ্ঠে। ‘ময়নিহান ব্যবহার করছে ওকে, কিন্তু সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি ওর ঘটে নেই। ও মনে করে, ওরা পার্টনার। কিন্তু কাজ ফুরালেই প্রিন্স ছেঁড়া জুতোর মতো ছুড়ে ফেলবে ওকে, যা সে সবার বেলাতেই করে থাকে। হার্ডিকেও ঝেড়ে ফেলবে।’
‘আর রৌভকে?’
‘হয়তো তাকেও। রৌভের একটা উপযোগিতা আছে, একটা পর্যায় অবধি।’
হ্যাটটা মাথার পেছনে ঠেলে দির ওরিন, হাতের পিঠে কপালের ঘাম মুছল। কোন পরিস্থিতিতে টনি কার্টিসকে হত্যা করে, সে তা ব্যাখ্যা করল পিয়ানোবাদককে, তারপর বলল, ‘কিথ, আমার ওপর তোমাকে বিশ্বাস রাখতে হবে। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি মোনা কার্টিসকে সাহায্য করতে।’ দম নেওয়ার জন্য থামল ওরিন। ‘বিশ্বাস কর, আমি নিরুপায় ছিলাম তখন। জানই তো, বুলেট কখনো চেনা-অচেনা বাছবিচার করে না। যা-ই হোক, টনি বিশ্বাস করেছিল আমাকে। পাঁচ হাজার ডলার আমার হাতে দিয়ে অনুরোধ করেছিল, ওটা ওর স্ত্রীকে পৌঁছে দিতে।’
‘পাঁচ হাজার?’ কিথ হতবুদ্ধি। ‘এত টাকা সে পেল কোথায়?’ ‘আমিও জানতে চাই সেটা,’ কবুল করল ওরিন। আরেকটা চিন্তা খেলল তার মাথায়। ‘কিথ, তুমি তো এই শহরে অনেক দিন; সব কিছুই বলতে গেলে জান। এই কোলাসো গ্র্যান্টের ব্যাপারে কিছু বলতে পার?’
একটু ইতস্তত করল কিথ, তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘ওরিন, এটা সমপর্কে আমি খুব সামান্যই জানি। একমাত্র প্রিন্স ময়নিহানই বলতে পারবে সব কিছু। আমার ধারণা, দুটো গ্র্যান্টের সব কাগজপত্র হস্তগত করেছে সে, যাতে কেউ কিছু প্রমাণ করতে না পারে।’
‘তাহলে আমি ময়নিহানের কাছেই যাচ্ছি,’ কর্কশ কণ্ঠে জবাব দিল ওরিন। ‘এই রহস্যের জট আমি ছাড়াবই।’
‘ময়নিহানের কাছে গেলে কিন্তু তুমি প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারবে না। লোকটা অসম্ভব ধূর্ত। জাত র্যাটল স্নেক। মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে ছোবল মারবে। তা ছাড়া রৌভ আছে।’
‘জানি,’ স্বীকার করল ওরিন, ‘রৌভ আছে।’ পরিস্থিতি খতিয়ে বিচার করল সে, তারপর পলক তুলল। ‘মার্শালকে নিয়ে চিন্তা করবে না। তার ভার আমার ওপর ছেড়ে দাও। তার সঙ্গের সব লোক মোনা কার্টিসের শত্রু। ওরা তোমাকে কথা বলার সুযোগই দেবে না। তুমি অন্য রাস্তায় সোজা পিভটরকে চলে যাও। কেভিন পিটার্সনকে বলবে, কী ঘটছে। ময়নিহানের পসি দলটার কথা বলবে। আমি এখানকার কাজ সেরে, ফেরার পথ ধরব।’
কিথ চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ তার গমন-পথের দিকে তাকিয়ে থাকে ওরিন। সপষ্টতই প্যালেন্সের কোনো খবরের অপেক্ষায় রয়েছে পসি। ময়নিহাও কি যাবে ওদের সঙ্গে? খুব হুঁশিয়ার আদমি সে। ইয়োলো জ্যাকেটে অপেক্ষা করবে। একজন নিরীহ দর্শকের ভূমিকায় দেখা যাবে তাকে, বরাবরের মতো…
মাইল কয়েক যাওয়ার পর, আচমকা রাশ টেনে কিথ থমকে দাঁড়াল। প্রিন্স ময়নিহানের গোপন পরিকল্পনা ওরিনকে জানাতে ভুলে গেছে সে। টমাস হার্ডিকে দোতলার কোনো জানালায় নয়তো ছাতে লুকিয়ে রাখবে ওরা, রৌভের সঙ্গে ডুয়েলের সময়ে ওরিনকে অ্যামবুশ করার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ স্যাডলে ঠায় বসে থাকল কিথ, চোখে উদ্বেগ, কপালে কুঞ্চন। এখন ফিরে গেলে অনেক সময় নষ্ট হবে; তা ছাড়া, ওরিনকে এখনো আগের জায়গাতেই পাবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। ওরিন ওসমানকে তার নিজের ভাগ্য নিজেরই সামলাতে হবে।
দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে সামনের ভাঙাচোরা পাহাড়ি এলাকার উদ্দেশে ঘোড়া ছোটাল কিথ…
কার্ল রৌভ স্যালুনের পেছনের কামরায় আবিষ্কার করল ময়নিহানকে। দরজা খোলার শব্দে চকিতে পলক তুলল ময়নিহান। তারপর রৌভকে দেখে মাথা ঝাঁকাল।
‘তোমাকেই আশা করছিলাম, কার্ল। আমি চাই, তুমি কাছে-পিঠেই থাক। আমার ধারণা, আজ অথবা কাল এখানে মেহমানরা আসছেন।’
‘মেহমানরা?’ ময়নিহানের মুখে সঙ্কেত খুঁজল রৌভ।
‘না, বরং বলা উচিত একজন মেহমান। ওরিন ওসমানকে প্রত্যাশা করছি আমি।’
সম্ভাবনাটা মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করল কার্ল রৌভ। হ্যাঁ, প্রিন্সের অনুমানই ঠিক। ওসমান আত্মসমর্পণ করবে না। বরং শহরে এসে প্যালেন্সকে মোকাবেলা করাটাই ওর মতো মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। জনা তিন-চারেক লোক ছাড়া কেউ জানে না পিভটরক-জটিলতার সঙ্গে ময়নিহানের সমপর্কের কথা। প্যালেন্স এবং হার্ডি ওর ব-কলম হিসেবে কাজ করছে। হার্ডি, প্যালেন্স, রৌভ, এবং কিথ। কিথ লোকটা বুদ্ধিমান। মাতাল, গোবেচারা পিয়ানোবাদক হতে পারে, কিন্তু তার কাঁধের ওপর একটা মাথা আছে।
সহসা মনে মনে চমকে উঠল রৌভ। আশেপাশে কোথাও কিথকে দেখা যাচ্ছে না। বেশ কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই প্রথম কিথকে সে বারে পায়নি। কিথ উধাও হয়েছে। কিন্তু কোথায় যেতে পারে? পসির ব্যাপারে মোনা কার্টিসকে সাবধান করতে গেছে? গেলই বা? মোনা কার্টিসের সঙ্গে তার কোনো শত্রুতা নেই। সে ভাড়াটে বন্দুকবাজ। অর্থের বিনিময়ে লড়াই করে। হতে পারে, এই লড়াইয়ে সে ভুল পক্ষে আছে। কথাটা ভাবতে ভাবতে ওরিন ওসমানের কথা মনে পড়ল তার। লোকটা ক্ষুরের মতো ধারালো। একহারা, ক্ষিপ্র। এখন এগুলো স্মরণে আসায় রৌভের আরও মনে পড়ল, লোকটা সমপর্কে সে আর কী কী শুনেছে।
কেউ তার চেয়েও দক্ষ গানফাইটার হতে পারে, এটা স্বীকার করতে কার্ল রৌভের বাধে। হার্ডির বিপক্ষে ওরিনের ড্র করার ঘটনাটা এখনো শহরবাসীদের মুখে ফিরছে।
ব্যাপারটায় রৌভ বিরক্ত, কারণ মানুষ ওদের দুজনার মধ্যে তুলনা করতে শুরু করেছে। কারও কারও মতে ওরিন বেশি ক্ষিপ্র। সম্ভাবনাটা তাকে খোঁচাচ্ছে।
আগে ওরিনকে মোকাবেলা করবে সে, তারপর নিজের পথ দেখবে।
‘তোমার মনে হয় না ও আসবে এখানে?’ ময়নিহান প্রশ্ন করল, রৌভের দিকে তাকিয়ে।
মাথা ওপরে-নিচে দোলাল রৌভ। ‘হ্যাঁ, আসবে। হার্ডি বা প্যালেন্সকে সে বাজারে বেচতে পারে। আমার ধারণা, ওই ইউএস মার্শালের চেয়েও বেশি বুদ্ধি ধরে ওসমান।’
ওরিনকে একাই সামলাবে রৌভ। টমাস হার্ডি শহরের বাইরে। নিজের নিয়তিকে কার্ল রৌভ একাই মোকাবেলা করতে চাইল।
স্যাডল চাপানো ঘোড়াগুলো দেখছে ওরিন এসমান। একজন ইন্ডিয়ানের ধৈর্য্য তার। জানে, কীভাবে অপেক্ষা করতে হয় এবং কীভাবে উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলতে হয়। এখন অপেক্ষা করছে সে। পেশিগুলোকে বিশ্রাম দিচ্ছে। এতে করে বিপদের সময়ে সর্বদা টানটান থাকে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, চূড়ান্ত মুহূর্তের কথা বলে দেয় কানে কানে। অভিজ্ঞতা থেকে সে বুঝতে পারছে, পরিস্থিতি বিস্ফোরণের বিন্দুতে পৌঁছেছে।
মার্শাল ফিরে আসবে। প্যালেন্স এবং হার্ডির কৌশলে পসির সঙ্গে দেখা হবে না তার। আর ওই ঘোড়সওয়ারের দল, যাদের বেশির ভাগই, সন্দেহ নেই, জ্যাক প্যালেন্সের ভাড়াটে গুন্ডা, নয়তো দালাল। তারা হিংস্র নেকড়ের মতো হামলা চালাবে পিভটরকে, ওরিন ওসমানকে খোঁজার নামে ঠান্ডা মাথায় খুন করবে রাঞ্চের সবাইকে।
এখন কিথ ওদেরকে ঠিক সময়ে সতর্ক করে দিলেই হয়। অত্যাসন্ন বিপদের কথা জানতে পারলে, কেভিন পিটার্সন বা হাডসনের নেতৃত্বে যথাযথ পাল্টা ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে ওরা। মার্শাল সমস্যার একটা শুঁড়, কিন্তু এর প্রাণ ইয়োলো জ্যাকেটে।
প্রিন্স ময়নিহান আর কার্ল রৌভকে যদি সরিয়ে দেওয়া যায়, শুঁড়গুলো আপনা থেকেই শুকিয়ে অক্কা পাবে। সুউচ্চ মোগাইওন রিমের পেছনে, পিভটরকে যত বড় বিপদই
ঘনিয়ে আসুক না কেন এ মুহূর্তে, চূড়ান্ত আঘাত হানতে হবে এই ইয়োলো জ্যাকেটেই।
গড়িয়ে উপুড় হলো ওরিন, চোখে দুরবিন লাগাল। ইয়োলো জ্যাকেট স্যালুন থেকে বেরিয়ে আসছে কয়েকজন লোক, ঘোড়ায় চাপছে। নিঃসাড়ে শুয়ে, ওরিন ওদের যাওয়া দেখল। কমপক্ষে তিরিশজন হবে। বেশিও হতে পারে। যখন নিশ্চিত হলো সবাই চলে গেছে, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে, হাত দিয়ে জামাকাপড়ের ধুলো ঝাড়ল। তারপর ঢালের নিচে নেমে গিয়ে, উঠে বসল স্যাডলে।
নীরবে ছুটে চলে সে, একটা হাত ঊরুর ওপর পড়ে, দৃষ্টি সজাগ, ছবি গেঁথে নেওয়ার জন্য মস্তিষ্ক তৈরি।
ইউএস মার্শালকে নিয়ে ভাবল সে। রডনি মার্শ নীতিপরায়ণ মানুষ। নতুন দেশে শুরুতে বসতি করা মানুষ। পশ্চিম এবং সেখানে জন্ম নেওয়া মানুষদের জানেন। তিনি নির্বোধ নন, বরং যথেষ্ট বুদ্ধিমান, হুঁশিয়ার লোক। আইন প্রয়োগের ব্যাপারে ভীষণ কঠোর, আবার তেমনি পুরুষের স্বভাববৈশিষ্ট্যগুলোও ভালোই বোঝেন। দক্ষিণী জীবনবিশ্বাসের আদি রীতি-নীতিগুলোকে তিনি শ্রদ্ধা করেন। আর তাই ওরিন যখন বলেছিল, মোনা কার্টিসকে রক্ষা করা তার জন্য ফরজ, কারণ সে তার স্বামীকে হত্যা করেছে, তখন বিষয়টার তাত্পর্য মার্শাল উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু যা হয়ে থাকে, দীর্ঘ সময় অনুশাসনের মধ্যে বেড়ে উঠলে তিনি কেতাবি আইনের বাইরে যেতে পারেননি।
লিভারি স্টেইবলে ঘোড়া ঘোরাল করল ওরিন। ওকে দেখে তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকাল জনি।
‘সাবধান থাকলেই ভালো করবে তুমি,’ সতর্ক করল আস্তাবলের মালিক। ‘সারা দুনিয়া তোমাকে খুঁজছে, তোমার রক্তের জন্য হন্যে হয়ে আছে ওরা!’
‘জানি। রৌভ কোথায়? শহরেই?’
‘অবশ্যই! ওই খুনিটা ময়নিহানকে ছেড়ে কোথাও নড়ে না।’ ওরিনের মুখ জরিপ করল জনি। ‘রৌভের সঙ্গে ঝামেলা কোর না, ওসমান। ওর কিন্তু দু-হাতই সমান চলে।’
‘জানি।’ ওরিন কিছুক্ষণ অপলকে দেখল ওর ঘোড়াটাকে। ছায়াচ্ছন্ন একটা স্টলে জনি বেঁধে রাখছে ওকে। কী মনে হতে জনির উদ্দেশে ফিরল সে। ‘জনি, তুমি সব সময় আমার সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করেছ। আমি এটা কখনো ভুলব না। আজকের পর, এই শহরে নয়া জমানা চালু হতে যাচ্ছে, তবে আজ আমার সাহায্য দরকার। পিভটরক সমপর্কে তুমি কী জান?’
সামান্য দ্বিধা করে লোকটা, তামাক চিবোয় আস্তে আস্তে। তারপর এক দলা পিক ফেলে সোজা তাকাল ওরিনের দিকে। ‘কথাটা বলার জন্য আজতক পাইনি কাউকে,’ বলল সে, ‘তবে দুটো জিনিস আমি বুঝি। জমিটা বুড়ো কার্টিসের এবং তার মৃত্যুটা দুর্ঘটনা ছিল না। তাকে খুন করা হয়েছে।’
‘খুন?’
‘হ্যাঁ।’ মুখ বিকৃত করল জনি। ‘দামি মদ পছন্দ করত সিনিয়র; কোথাও পেলে লোভ সামলাতে পারত না। সেদিন ওর সঙ্গে পরম সুহূদের মতো আচরণ করে ময়নিহান, একত্রে মদ খাওয়ার দাওয়াত দেয় এবং বুড়ো তা কবুল করে।’
‘এর খানিক পর এখানে এসে একটা ঘোড়াগাড়ি ভাড়া করে বুড়ো, কারণ ওর ঘোড়াটা খোঁড়া হয়ে গিয়েছিল। আমি দেখলাম, কয়েকবারের চেষ্টায় সে উঠে বসল গাড়িতে। একবার তো পড়েই যাচ্ছিল মুখ থুবড়ে।’
‘মাতাল ছিল?’ ওরিনের চোখ সজাগ, উত্সুক।
‘ওই বুড়ো?’ নাক দিয়ে বিজাতীয় একটা শব্দ করল আস্তাবলের মালিক। ‘আস্ত পিপে ছিল। একটা টার্কি যত খুদ খেতে পারে, ও তার চেয়ে বেশি মদ গিলতে পারত এক বৈঠকে। কিন্তু সেদিন মাত্র এক পেগ খেয়েছিল, জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, অথচ ওই টুকুতেই হাঁটতে পারছিল না!’
‘তার মানে, কিছু মেশানো হয়েছিল পানীয়তে।’ মাথা ঝাঁকাল ওরিন। নিশ্চয় ময়নিহানের বুদ্ধি। ‘তারপর কী হলো?’
‘কার্টিস নিহত হওয়ার পর পথ হারানো ঘোড়াগুলোকে যখন ফিরিয়ে আনা হয়, আমি ওদের একটার পাছায় বুলেট ঘষার দাগ দেখেছিলাম।’
হুম্, ব্যাপারটা তাহলে এ-ই। নেশাচ্ছন্ন একজন মানুষ, একদল চঞ্চল ঘোড়া এবং একটা বুলেট, যা ঘোড়াগুলোকে দিশেহারা করার জন্য যথেষ্ট। প্রিন্স ময়নিহান নিঃসন্দেহে পাকা খেলোয়াড়।
‘তুমি বলছিলে তুমি নিশ্চিত, ওই জমির মালিক কার্টিস। কীভাবে নিশ্চিত হলে?’
কাঁধ ঝাঁকাল জনি। ‘কারণ সে অপর মালিকানাটার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিয়েছিল। নিশ্চয় ঝামেলার খবর তার কানেও গিয়েছিল। আমরা যদি শুনে থাকতে পারি, তার না জানার তো প্রশ্নই ওঠে না!’
‘যা-ই হোক, রাঞ্চে ফেরার সময়ে সব কাগজপত্র তার সঙ্গেই ছিল। আমাকে দেখিয়েছিল ওগুলো; সব প্রমাণ।’
‘এবং সেদিনই সে খুন হয়? লাশ আবিষ্কার করেছিল কে?’
‘টম হার্ডি। ওই পথেই যাচ্ছিল সে, অনেকটা কাকতালীয়ভাবে।’
মোনার দলিলপত্র প্রিন্স ময়নিহানের কব্জায়। যে করেই হোক, প্রিন্সের সঙ্গে মোলাকাত করতে হবে তাকে।
ছয়
দরজা অবধি গিয়ে মুহূর্তের জন্য ছায়ায় দাঁড়াল ওরিন, বাইরের রোদে বেরোনোর আগে চোখ সইয়ে নিচ্ছে। ধূলিধূসর রাস্তা থমথমে, অস্বাভাবিক রকমের নির্জন। রঙহীন তক্তার এবড়োখেবড়ো চেহারার দালানকোঠা নয়তো বালু-রঙা অ্যাডৌবিগুলো রাস্তার ওপাশ এবং উজান থেকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। খাঁ খাঁ করছে হিচ রেইলগুলো। গামলা উপচানো পানির ক্ষীণ একটা ধারা কালচে দাগ সৃষ্টি করছে গামলাটার একপ্রান্তের তলদেশে।
রাস্তার উজানে কোথাও, তবে বাড়িঘরের আড়ালে, একটা মুরগি চেঁচিয়ে দুনিয়াকে জানান দিল তার ডিম পাড়ার কথা। নিঃসঙ্গ একখণ্ড মেঘ অলস ঝুলে আছে নীল আকাশে। ওরিন পা রাখল বাইরে। গানবেল্টটা টেনে ঠিক করে নিয়ে পথের দিকে নজর বোলাল।
রৌভ ইয়োলো জ্যাকেটেই থাকবে। ময়নিহানের সঙ্গে দেখা করতে হলে রৌভকে মোকাবেলা করতে হবে আগে। এভাবেই ব্যাপারটা সামলাতে চায় সে; একটা কাজ একবারে।
ভীষণ নিরুদ্বিগ্ন বোধ করছে সে। অতীতে এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করেছে, সে কথা ভাবছে। একাই কীভাবে শহরছাড়া করেছিল তিন বিগলো ভাই আর তাদের জনা চল্লিশেক সাঙ্গোপাঙ্গকে, সেটা মনে করল। আরও মনে করল জীবনে প্রথম নরহত্যার কথা, গৃহযুদ্ধের সময়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানর কথা।
মৃদু হাওয়ায় উড়ে গেল বোর্ডওয়কের কিনারে পড়ে থাকা একটা ছেঁড়া থলে। রাস্তার আরেকটু উজানে, পানির গামলার অদূরে, একটা ধেড়ে ইঁদুর বেরিয়ে এল একটা দোকানের নিচে থেকে, গুঁটিপায়ে রওনা হলো পানির দিকে। হাঁটতে শুরু করল ওরিন ওসমান, মেইন স্ট্রিটের উজানে।
দূরত্বের বিচারে খুব বেশি দূর না হয়তো, কিন্তু বন্দুকবাজের পদক্ষেপের মতো এত দীর্ঘ পদক্ষেপ এবং গুলির আগমুহূর্তের বিরতির মতো এত দীর্ঘ বিরতি আর কোনো কিছুই হয় না। আজ রৌভ নিমেষ বুঝে যাবে, শহরে তার উপস্থিতি কিসের আলামত; ময়নিহানও বুঝবে।
প্রিন্স ময়নিহান জুয়াড়ি না। কার্ল রৌভ যত বিশ্বস্তই হোক না কেন, শুধু তার ভরসাতেই থাকবে না সে। আস্তিনের ভাঁজে রাখা তাস সব সময়ই কাজে দেয়। সন্দেহ নেই, প্রিন্স একটা তুরুপের তাস ঠিকই লুকিয়ে রাখবে কোথাও না কোথাও। কিন্তু কোথায় রাখবে? কে হতে পারে সেই তুরুপ? কখন খেলবে হাতটা?
শেষেরটা অনুমান করা কঠিন না। ঠিক গোলাগুলির মুহূর্তে।
ত্রিশ গজও যায়নি সে, যখন ক্যাঁচ করে উঠল একটা দরজা এবং একজন লোক রাস্তায় পা রাখল। ওরিনকে না দেখার ভান করল সে, ঝটিতি হেঁটে রাস্তার ঠিক মাঝখানে গিয়ে থামল, তারপর এভাবে ঘুরল চকিতে, যেন কুচকাওয়াজের ড্রিল মাস্টার।
কার্ল রৌভ।
আজ রঙ-জলা নীল একটা শার্ট পরেছে সে। ওর চওড়া, অস্থিসার কাঁধ কামড়ে ধরেছে শার্টটা, অলসভাবে পড়ে আছে বুকের ভাঁজ আর সমতল পেটের ওপর। এত দূর থেকে দেখা যাচ্ছে না লোকটার চোখ, তবে ওরিন ওসমান নিশ্চিত, ওগুলো দেখতে কেমন।
পাতলা, ছুঁচোল মুখ; সজারুর কাঁটার মতো গোঁফ; উঁচু চোয়ালের হাড়; লম্বা, চঞ্চল আঙুল। লোকটার নিতম্ব সরু, শরীরের কোথাও বাড়তি মেদ নেই। চোখ তুলল কার্ল রৌভ, সামনে তাকাল। শুকনো লাগছে তার ঠোঁটজোড়া, কিন্তু স্নায়ু টানটান। নিজেকে ভীষণ হালকা মনে হয় তার এবং অনুভতিটাকে সে উপভোগ করে। ঠিক ওই মুহূর্তে ওরিনের প্রতি এক ধরনের মায়া বোধ করে রৌভ।
লোকটা খেলার সব নিয়মকানুন জানে। ঠিক যেভাবে এগিয়ে আসা উচিত, সেভাবেই আসছে। প্রতিটি পদক্ষেপে ঠিকরে বেরোচ্ছে আত্মবিশ্বাস আর সতর্কতা।
গুমোট পরিবেশ। সামান্যতম শব্দ নেই কোথাও যা নৈশব্দ্যের স্বচ্ছ পেয়ালা খানখান করতে পারে।
তপ্ত হাওয়া এতই নিশ্চল, যেন রাস্তার নাটক দেখার জন্য থমকে দাঁড়িয়েছে। ওরিন টের পেল, ওর হ্যাটব্যান্ডের নিচে ঘামের একটা চিকন ধারা গড়িয়ে নামছে আস্তে আস্তে। সতর্ক ভঙ্গিতে হাঁটছে সে, প্রতিটা পা ফেলছে যত্নের সঙ্গে এবং হিসেব করে। কার্ল রৌভই থামল আগে, আনুমানিক ষাট গজ দূরে।
‘ওসমান, দেখা হলোই তাহলে শেষমেশ। অবশ্য আমরা দুজনই জানতাম, দেখা হচ্ছে।’
‘নিশ্চয়ই।’ ওরিনও দাঁড়িয়ে পড়েছে, পা ফাঁক, হাত দুটো ঝুলছে দুপাশ থেকে, কনুইয়ের কাছে ইষত্ বাঁকা, আঙুলগুলো ছড়ানো। ‘তুমি ভুল দলে যোগ দিয়েছ, কার্ল।’
‘তার পরও দেখা হয়েছে আমাদের।’ রৌভ সামনে দাঁড়ানো দীর্ঘদেহী লোকটার দিকে তাকাল। পাথরে খোদাই করা মুখ, চোয়াল শক্ত এবং তৈরি। কোনো বন্দুকবাজকে ভয় করে না রৌভ। যদিও বন্দুকবাজের গুলিতে মরণই তার কপালের লিখন। হঠাত্ তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটল। হ্যাঁ, তার মরণ বন্দুকের গুলিতেই, তবে আজ নয়।
কেঁপে উঠল তার হাত, মুহূর্তে সঙ্কেত পৌঁছে গেল সমস্ত পেশিতে, ড্র করার ভঙ্গিতে ঝলসে উঠল থাবা দুটো। আবছা একটা নড়াচড়ার চেয়ে বেশি কিছু মনে হলো না ওটা, পরক্ষণে থেমে গেল নড়াচড়াটা এবং ঢাকনা খোলা হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করতে করতে সে দেখল একটা সিক্স শুটারের কালো, গোমড়া মুখ তার দিকে তাকিয়ে। হেরে গেছে সে; ড্রতে হেরে গেছে।
বিস্ময়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলল রৌভ; নিশানা ঠিক না করেই টিপে দিল ট্রিগারটা এবং লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। ওরিন ওসমান ধেয়ে আসছে তার দিকে, দেখল সে। তেড়ে আসছে লোকটা, পিস্তল উদ্যত অথচ গুলি করছে না!
আতঙ্কে দিশাহারা রৌভ দেখল ব্যবধান কমে আসছে ওদের মাঝে। দ্রুত ট্রিগার টানল সে, বজ্রনির্ঘোষের মতো আওয়াজ করে তিনটি গুলি উগরাল ওর পিস্তল। চতুর্থ গুলির জন্য হাতুড়িটা পড়ছে, এমন সময়ে আরেকটা বন্দুকের গর্জন শুনল সে।
কিন্তু কোথায় গর্জেছে ওটা? ওরিনের গান মাজলে আগুনের ঝলক দেখা যায়নি কোনো। দৌড়াচ্ছে একহারা গড়নের ঢ্যাঙ্গা লোকটা, দ্রুত চলমান এক টার্গেট। আর সে, রৌভ, তাড়াহুড়ো করে ফেলেছে বেশি ড্রয়ে পরাস্ত হয়েছে, এই উপলব্ধির আতঙ্কে বুদ্ধি হারিয়ে।
ডান হাতের পিস্তলটা উঁচু করল সে, মাছিতে নিশানা করছে ওরিনের খুলি। কিন্তু আচমকা থমকে দাঁড়িয়েছে ওরিন; আগুন ঝরাচ্ছে তার সিক্স শুটার।
মাজল থেকে লাফিয়ে আগে বাড়ল আগুন, ঝটকা মারল রৌভকে। কেঁপে উঠল সে, বুলেটটা বেরিয়ে গেছে শরীরের এক পাশ ঝলসে দিয়ে। হাত বদলাল সে, কিন্তু পরক্ষণে বুকে জোর ধাক্কা খেল একটা, কী ঘটেছে মস্তিষ্কে, সে খবর পৌঁছানোর আগেই লুটিয়ে পড়ল ধুলোয়।
রহস্যময় গুলির আওয়াজটা ওরিনও শুনতে পেয়েছিল, কিন্তু আমলে নিল না। এখন অপেক্ষা করতে পারে না সে; মনোযোগ ফেরানোর সময় না এটা। রৌভকে পড়ে যেতে দেখল সে, তবে শুধু হাঁটু অবধি।
এখনো পাঁচটা গুলি আছে পিস্তলবাজের কাছে, আর ওদের দূরত্বটা এ মুহূর্তে পনেরো গজও হবে না। উঁচু হলো রৌভের পিস্তল। ফের গুলি করল ওরিন। তড়াক করে শূন্যে লাফিয়ে উঠল রৌভ, যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তারপর হুড়মুড় করে পড়ে গেল শক্ত মাটিতে, ডাঙায় তোলা মাছের মতো খাবি খেতে লাগল।
আবার শব্দ হলো গুলির। ওরিনের পায়ের কাছে পথের ধুলো ওড়াল একটা বুলেট। পাঁই করে বন্দুক ঘোরাল ওরিন, দোতলার একটা খোলা জানাল লক্ষ করে গুলি ছুড়ল। স্যালুনের দরজার উদ্দেশে পা বাড়াচ্ছিল সে, কিন্তু পেছনে একটা কাতর শব্দ শুনে থেমে গেল।
‘ওরিন ওসমান?’
রৌভ। বস্ফািরিত চোখ, মনে হচ্ছে এখুনি কোটর থেকে ছিটকে পড়বে। একটু দ্বিধা করল ওরিন, তাকাল ডাইনে-বাঁয়ে, তারপর নিস্তব্ধ রাস্তায় বসে পড়ল হাঁটুর ভরে। ‘কী, কার্ল? তোমার জন্য কিছু করতে পারি?’
‘পেছনে… ডেস্কের… পেছনে… তু… তুমি…।’ অসপষ্ট হয়ে এল ওর ছেঁড়া ছেঁড়া কথা। তারপর মনে হয়, অনেক কষ্টে সমস্ত শক্তি একত্র করে পলক তুলল সে। ‘দারুণ, ইয়ার! বিজলি… বিজলি!’
পরমুহূর্তে হিমশীতল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল কার্ল রৌভ। হ্যাটটা সামান্য উঁচু করে অনন্তের পথযাত্রীকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করল ওরিন। ঠিক, লোকটা এক মুহূর্ত আগেও তার দুশমন ছিল এবং ওর হাত আরেকটু চালু হলে সে-ই এখন
পড়ে থাকত ধুলোয়। কিন্তু এখন ওই লোক মৃত, সমস্ত তর্কবিতর্কের ঊর্ধ্বে। ওরিন নিশ্চিত, তার জায়গায় থাকলে, রৌভও তাকে সম্মান জানাতে কসুর করত না।
উঠে দাঁড়াল ওরিন ওসমান, হাত দিয়ে জামাকাপড়ের ধুলো ঝেড়ে এগোল ইয়োলো জ্যাকেটের দিকে, বাদুড়-ডানা ঠেলে পা রাখল ভেতরে।
দোতলার কামরাটা ফাঁকা; সিঁড়ি ফাঁকা; কেউ নেই আশেপাশে। নিচে নেমে এল ওরিন, দেখল বারের পেছনে ড্যানি দাঁড়িয়ে। ওর মুখ ভয়ে শুকনো, পাণ্ডুর।
স্থির, শীতল চোখে ওরিন তাকাল ওর দিকে। ‘কে নেমেছে ওই সিঁড়ি দিয়ে?’
ঠোঁট ভেজাল ড্যানি। বিষম খেল সে, তারপর ফিসফিস করে বল, ‘কেউ না… তবে পেছনে… পেছনে আরেকটা সিঁড়ি আছে।’
গোড়ালির ভরে লাট্টুর মতো ঘুরে দাঁড়াল ওরিন, বুড়ো আঙুল দিয়ে পিস্তলে গুলি ভরতে ভরতে দীর্ঘ অথচ অনায়াস পদক্ষেপে এগোল কামরার পেছনের দিকে। খোলাই ছিল অফিসের দরজাটা; চৌকাঠের ওপর তার ছায়া পড়তেই তাকাল প্রিন্স ময়নিহান।
কিছু একটা লিখছিল সে। ডেস্কময় ছড়ানো-ছিটানো কাগজ, ব্যস্ত মানুষের যেমন থাকে। অদূরে একটা লিকারের বোতল, পাশেই একটা ভরা গ্লাস।
কলমটা নামিয়ে রাখল ময়নিহান। ‘ওকে হারিয়ে দিয়েছ তাহলে? আমিও আন্দাজ করেছিলাম, তুমিই জিতবে।’
‘তাই?’ ওরিনের দৃষ্টি শীতল। লোকটা যদি সটকে পড়ার ফিকির করেও থাকে, তা তার জন্য করাটাই স্বাভাবিক, চেহারায় সেসবের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। ‘তোমার আরেকটু ফাস্টগান ভাড়া করা উচিত, প্রিন্স।’
‘একটু আগে পর্যন্ত,’ কাঁধ ঝাঁকাল ময়নিহান, ‘কার্ল-ই ছিল সবচেয়ে ফাস্ট। তবে এটা আমার মাথাব্যথা না। ও প্যালেন্সের জন্য কাজ করছিল।’
কামরার ভেতরে একটা পা রাখল ওরিন, হাত দুটো মুক্ত রাখছে, চোখ প্রিন্স ময়নিহানের চোখের ওপর স্থির। প্রিন্সও লক্ষ করছে ওকে, দৃষ্টি সতর্ক, কৌতূহলী।
‘আমার সঙ্গে ওসব চালাকি চলবে না,’ বলল ওরিন। ‘প্যালেন্স একটা ভাঁড়, আস্ত ভাঁড়। কোনো সুবিধা করতে পাররে না সে। তুমি যে পসি পাঠিয়েছ, তাদেরও অনেকেই ফিরবে না।’
পসির উল্লেখে আড়ষ্ট হয়ে গেল ময়নিহানের চোখের পাতা। ‘থাক ওসব।’ যেন কিছুই হয়নি—এভাবে হাত নাচাল রাঞ্চার। ‘বস আরাম করে, গলা ভেজাও। ভালো জিনিস আছে। দ্যাখ, ওসমান, আমরা কেউই কচি খোকা নই। সবাই সাবালক। আপসে নিজেদের বিবাদ মেটাতে পারি। আমি কখনোই খুনখারাপি পছন্দ করি না।’
‘মানে নিজের হাত নোংরা করতে চাও না, এটাই বলছ তো?’ যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল ওরিন। ‘কী ব্যাপার, প্রিন্স? ভয় পাচ্ছ? ভয় পাও নিজে খুন করতে?’
শক্ত হয়ে গেল ময়নিহানের চোয়াল, চোখ বড় বড়। ‘এটা তুমি ঠিক করলে না, ওসমান। আমাকে ভিতু বলাটা তোমার উচিত হয়নি।’
‘তাহলে উঠে দাঁড়াও। আমি, বসে আছে এমন লোককে গুলি করতে চাই না।’
‘আহ, মাথা ঠান্ডা কর, ওসমান। ড্রিংক নাও একটা। এস, আপসে রফা করি।’
‘নিশ্চয়ই।’ ন্যাকা সাজল ওরিন। ‘তুমিও নাও একটা।’ আগে থেকেই ভরে রাখা গ্লাসটার দিকে হাত বাড়াল সে, কিন্তু ময়নিহানের দৃষ্টি ভাবলেশহীন। হাত বদল করল ওরিন, অন্য গ্লাসটা মুঠোয় নিল। আর ঠিক তখনি ছোবল দেওয়া সাপের মতো, ময়নিহান জাপটে ধরল ওর ডান হাতটা, সামনে হ্যাঁচকা টানে ভারসাম্য নষ্ট করে দিল।
একই সময়ে, বাঁ-পাশে উঁচু করে বাঁধা হোলস্টারের দিকে বিজলিগতিতে ছুটে গেল ময়নিহানের হাত, সামনে ফেরানো বাঁট আঁকড়ে ধরে এক ঝাঁকিতে বের করে আনল পিস্তলটা। আর ওরিন ডান হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য চেষ্টা করার পরিবর্তে, আপসে শরীরটা ছেড়ে দিল সামনে, ময়নিহানের ওপর গিয়ে পড়ল। দুজনের ভার সইতে পারল না চেয়ারটা, উল্টে পড়ল পেছনে। উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল ময়নিহান, কিন্তু ওরিন কাঁধে তুলে নিল তাকে, দেয়ালে আছড়ে ফেলে নিজেকে মুক্ত করল।
পিস্তল উঁচু করল ময়নিহান। কিন্তু নিশানা করতে পারার আগেই ওরিনের বাঁ হাতের রদ্দায় নলটা সরে গেল এক পাশে। রাঞ্চারের কব্জি চেপে ধরল ওরিন, গান ব্যারেলের নিচে থেকে ডান হাতটা ওপরে ওঠাল আপার কাটের ভঙ্গিতে, হ্যাঁচকা টানে কেড়ে নিল পিস্তলটা। এবার লোকটাকে ধাক্কা মারল সে, পিস্তল ফেলে দিয়ে খোলা হাতে সজোরে একটা চড় কষাল ওর মুখে।
তীক্ষ আওয়াজ হলো একটা, যেন চাবুক চালিয়েছে কেউ। সাদা হয়ে গেল ময়নিহানের মুখ, চোখে সর্ষের ফুল দেখতে শুরু করল সে। খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ছুটে এল পিএম আউটফিটের মালিক, এলোপাতাড়ি ঘুসি ছুড়ছে। আস্তে করে এক পাশে সরে দাঁড়াল ওরিন, একটা হাঁটু উঠিয়ে প্রিন্সের তলপেটে আঘাত করল। তারপর পিস্টনের মতো কনুই চালাল মুখে, ধাক্কা মেরে ফেলে দিল মাটিতে। হাঁচড়-পাচড় করে উঠে দাঁড়াল ময়নিহান, নাক-মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে।
আচমকা সামনে ঝাঁপ দিল সে, তবে ওরিনকে লক্ষ্য করে নয়, টেবলের বিক্ষিপ্ত কাগজপত্রের ভেতর থেকে একটা বুলডগ .৪১ বের করে আনল। হাতটা ছুটে যাচ্ছে কাগজপত্রের দিকে, দেখল ওরিন, একটা .৪১ বেরিয়ে আসছে। ইতোমধ্যে তার পিস্তলও উঠে এসেছে হাতে। বদ্ধ ঘরে বোমা ফাটল যেন। সে-ই গুলি করল আগে, মাত্র চার ফুট দূরত্বে পরপর তিনটে।
আড়ষ্ট হয়ে গেল প্রিন্স ময়নিহান, উঁচু হলো পায়ের পাতার ওপর, তারপর ডেস্কের ওপর পড়ে গেল উল্টে, ছড়ানো-ছিটানো কাগজপত্র আর ভাঙা কাচের মধ্যে মুখ গুঁজে নিশ্চল পড়ে থাকল।
মাতালের মতো টলছে ওরিন। আবছা মনে পড়ছে ডেস্কটার ব্যাপারে কিছু একটা বলেছিল রৌভ। কিনার ধরে ডেস্কটার এক পাশে হ্যাঁচকা টান মারল সে, দেয়াল থেকে খসিয়ে আনল। হাতলযুক্ত ছোট্ট একটা প্যানেল বেরোল ওটার পেছনে, তালা দেওয়া। গুলি করে তালাটা ভাঙল সে, প্যানেলের ডালা খুলল টান মেরে। এক তোড়া নোট, স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি ছোট একটা থলে আর কিছু দলিলপত্র।
এক নজরই যথেষ্ট হলো। এগুলোই সেই দলিল, যার কথা জনি বলেছিল। মোটা পার্চমেন্টে জমির আসল দলিল, সাথে কোলাসোর নকলটা। হঠাত্ বেশ কয়েকটি ঘোড়া ছুটে আসার আওয়াজ পেয়ে সচকিত হয়ে উঠল ওরিন। দলিলগুলো দ্রুত চালান করল শার্টের নিচে। থমকে গেল সে, তাকাল। শার্টটা রক্তে ভিজে গেছে।
কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজগুলো পকেটে ঢোকাল ওরিন। তারপর নিজের দিকে নজর ফেরাল। রৌভ ঠিকই গুলি লাগিয়েছিল। আশ্চর্য, একটুও টের পায়নি সে। স্রেফ একটা ঝাঁকুনি, আর সামান্য অসাড় বোধ করেছিল শুধু। এখন প্যালেন্স ফিরে আসছে।
এপাশ-ওপাশ চোখ বুলিয়ে একটা কাটা শটগান দেখতে পেল সে, চট করে বন্দুকটা তুলে নিয়ে পা বাড়াল দরজার উদ্দেশে, মাতালের মতো টলছে। দরজা অবধি পৌঁছাতেও পারল না।
ধাবমান ঘোড়ার খুরের আওয়াজই কেবল ঝমঝম করে ওর মাথার ভেতর, ধাবমান ঘোড়া এবং তারপর ক্ষীণ একটা গন্ধ। চেনা মনে হয় গন্ধটা; ওটা তাকে গৃহযুদ্ধের সময়ে তার একবার অস্থায়ী সামরিক হাসপাতালে শুয়ে থাকার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। পিটপিট করে চোখ খুলল সে। প্রথমেই নজরে পড়ল কামরার দেয়ালে টাঙানো একটা ছবি—গম্ভীর মুখে ওর দিকে তাকিয়ে এক ভদ্রলোক, তাঁর নাকের নিচে এক জোড়া ঝাঁটা গোঁফ, চোখে চশমা। বুড়োর দৃষ্টি অসম্ভব অন্তর্ভেদী, যেন ওর অন্তস্তল অবধি দেখে নিচ্ছেন।
ঘাড় ফেরাল সে। দেখল, মোনা কার্টিস লক্ষ করছে তাকে। ‘বাব্বা! ঘুম ভাঙল তাহলে! তুমি অলস হয়ে যাচ্ছ, ওরিন। সরি, মিস্টার ওসমান। রাঞ্চে তুমিই সবার আগে উঠতে।’
মেয়েটার দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকল সে। আগে কখনো এত সুন্দর মনে হয়নি ওকে। খারাপ লক্ষণ, মনে মনে নিজেকে বলল ওরিন। খারাপ, কেননা এবার তার সময় হয়েছে বিদায় নেওয়ার, ঘোড়ার পিঠে চড়ে।
‘আমি কদ্দিন হলো এখানে?’
‘দেড় দিনের মতো? অনেক রক্ত হারিয়েছ।’
‘রাঞ্চে কী হয়েছিল? কিথ পৌঁছেছিল সময়মতো?’
‘হ্যাঁ। আমি রাঞ্চেই থেকে গেছিলাম। অন্যরা তখনই রওনা হয়ে যায়।’
‘তুমি থেকে গিয়েছিলে মানে?’
‘অন্যরা,’ মোনা বলল শান্তকণ্ঠে, ‘ট্রেইলের ভাটিতে মাইল দুয়েক দূরের একটা জায়গায় গিয়ে ওঁত পাতে। ওই দলে ছিল কেভিন পিটার্সন, জিম ডেভিডসন, আলভিতো ও কিথ; এবং নাটো, অবশ্যই। ওরা চলে যাওয়ার পর, আমি রাঞ্চের উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন জায়গায়, যাতে প্যালেন্সরা দেখতে পায় আমাকে, মনে করে আমি একা। বুদ্ধিটা নাটোর, কিছু ইন্ডিয়ান রক্ত আছে তো! নিখুঁত হয়েছিল অ্যামবুশটা।’
‘লড়াই জমেনি, তার মানে?’
‘একদম না,’ ঝিকিয়ে উঠল মোনার সামনের পাটির দাঁতগুলো। ‘এত অবাক হয়েছিল ওরা, কিছু বুঝে ওঠার আগেই চমপট দিয়েছে। শুধু তিনজন পারেনি। আর চারজন মারাত্মক আহত হয়েছে।’
‘প্যালেন্স, হার্ডি, ওরা? মার্শাল?’
‘শহরে ফেরার সাহস হয়নি, পাছে লিঞ্চ মবের পাল্লায় পড়ে। দুজনই পালিয়েছে। মার্শাল শহরেই আছেন। তোমার অবস্থা একটু ভালো হলেই দেখা করতে আসবেন। উনি বুঝতে পেরেছেন সবকিছু। এখন আর কোনো জটিলতা নেই।’
‘কাগজগুলো পেয়েছ?’ দলিলগুলোর কথা হঠাত্ মনে পড়ায় সচকিত সে জিজ্ঞেস করল। ‘ময়নিহান পাঁচ হাজার ডলার পাঠিয়েছিল এল পাসোয়, সেটার রসিদও ছিল? সব নোটে চিহ্ন দিয়ে রেখেছিল।’
‘হ্যাঁ,’ সংক্ষেপে বলল মোনা। ‘পেয়েছি। ওর মতলব ছিল টনিকে চুরির দায়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া। আর যদি সেটা ব্যর্থ হয়, তাহলে পেছনে লোক লাগিয়ে মেরে ফেলা। কিন্তু মাঝখানে তুমি এসে পড়ায় সব ভন্ডুল হয়ে যায়।’
‘তাই?’ নিজের হাত দুটো পযর্বেক্ষণ করে ওরিন। ভীষণ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে ওগুলো। ‘ময়নিহানের হিসেবের মধ্যে আমি ছিলাম না।’
অবসান হয়েছে সবকিছুর। রাঞ্চের মালিকানা পেয়েছে মেয়েটা; এখন সে স্বাধীন, কেউ আর ঘাঁটাবে না। শুধু একটা কাজ বাকি রয়েছে এখনো। কথাটা তার জানাতে হবে ওকে। বলতে হবে, সে-ই ওর স্বামীর হত্যাকারী।
বালিশে পাশ ফিরল ওরিন। ‘আরেকটা কথা,’ শুরু করল সে, ‘আমি…’
‘এখন না। এখন তোমার বিশ্রাম দরকার।’
‘দাঁড়াও। তোমাকে এটা বলতে হবে আমার। এটা… এটা টনির সমপর্কে।’
‘মানে এটাই তো… যে তুমিই হচ্ছ সেই লোক, যে…?’
‘হ্যাঁ, আমিই…’ খানিক ইতস্তত করে স্বীকার করল ওরিন।
‘আমি জানি। প্রথম দিন থেকেই জানি, ওরিন। একদম শুরু থেকেই, তুমি না বললেও।’
‘ঘোরের মধ্যে প্রলাপ বকেছি?’
‘সামান্য। তবে এটা তারও আগের কথা। ওই যে তুমি যখন বললে পিস্তল বের করার সময় কেমন দেখাচ্ছিল ওর চোখ, তখনই জানি। কার পক্ষে জানা সম্ভব এটা, যে তাকে গুলি করেছে সে ছাড়া?’
‘বুঝেছি,’ ম্লান শোনাল ওরিনের গলা, মুখ খড়িমাটি। ‘তাহলে আমি বরং একটু আরাম করি। আবার রাস্তায় নামতে হবে।’
ওর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল মোনা, এবার বসে পড়ল মাথার কাছে। ‘রাস্তায় নামতে হবে? তোমাকে কি যেতেই হবে, ওরিন? কাল রাতে তুমি যেসব কথা বলেছ, আমি ভেবেছিলাম… ভেবেছিলাম’ মোনার চেহারায় লজ্জা, ‘হয়তো তুমি আর পথে নামতে চাও না। আমাদের কাছেই থেকে যাও, ওরিন। আমরা খুশি হব তুমি থাকলে। আর তা ছাড়া, জুনিয়রও জিজ্ঞেস করছিল তোমার কথা। জিজ্ঞেস করছিল ওর সপার কোথায়।’
একটু সময় নীরব রইল ঢ্যাঙ্গা লোকটা, ভাবল কী যেন, তারপর ধীরে ধীরে বলল: ‘হ্যাঁ, আমার বোধ হয় থেকে যাওয়াই উচিত হবে। এক জোড়া সপারের ব্যবস্থা করতে হবে ওর জন্যে। ছোটদের কথা দিলে সেটা রাখতে হয়।’
‘তাহলে থাকছ তুমি? যাচ্ছ না কোথাও?’
ওরিন পলকহীন তাকাল মেয়েটির দিকে। ‘থাকছি,’ বলল মৃদুকণ্ঠে। ‘যত দিন না তুমি তাড়িয়ে দিচ্ছ।’
স্বর্গীয় হাসিতে উদ্ভাসিত হলো মোনার চেহারা, ওরিনের চুলে সে হাত বোলাল। ‘তাহলে তুমি অনেক দিন এখানে থাকছ, ওরিন ওসমান, অনেক… অনেক দিন।’
একটি বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে