ফিরে গিয়েছিলেন শুধু ফেগেলাস

ফিরে গিয়েছিলেন শুধু ফেগেলাস

সে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালের কথা। পারস্য জয় করে আলেকজান্ডার তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে ঢুকে পড়ছেন ভারতের উত্তর–পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। তক্ষশিলার মতো কিছু রাজ্য বশ্যতা স্বীকার করলেও রুখে দাঁড়িয়েছেন অনেকেই। খোদ পারস্য সেনা বাহিনীকে পদানত করে আসার পর এমন অবস্থায় পড়তে হবে‚ মদমত্ত গ্রিক বাহিনী ভাবেনি। শুরু হয়েছে একের পর এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। এই গল্প অবশ্য সেই ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে নয়। অনেক দূরে বঙ্গদেশে। সেখানেও এক নগর তখন ঘটে চলেছিল অন্য কিছু ঘটনা। এই গল্প তাই নিয়ে।

মূল কাহিনিতে যাবার আগে বলে রাখি, সেই সময় বঙ্গদেশের দক্ষিণ প্রান্তে গঙ্গা এবং তার একাধিক শাখা নদীর উপর বন্দর কেন্দ্রিক অনেকগুলি নগর ছিল। নৌবাণিজ্যের দৌলতে এই নগরগুলি তখন ঐশ্বর্যের প্রায় শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। আসলে সেই সুদূর অতীতে স্থলপথে পণ্য পরিবহন খুব সহজ ছিল না। যথেষ্ট খরচ সাপেক্ষ। নদীমাতৃক বঙ্গদেশে সেই সমস্যা না থাকায়‚ এ দেশের মানুষ সুযোগটা কাজে লাগিয়েছিল চমৎকার। নদী আর সমুদ্রপথে নৌকো আর বৃহৎ আকারর তপ্পক তথা জাহাজ প্রতিদিন এই সব নগরে এসে ভিড়ত। দেশ বিদেশের শ্রেষ্ঠীর দল আসত পণ্য নিয়ে। তাঁদের অনেকেই এই সব নগরে বাস করতেন। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে দক্ষিণবঙ্গে চন্দ্রকেতুগড় ছাড়াও তিলপি‚ কঙ্কনদিঘি প্রভৃতি অঞ্চলে এমন একাধিক নগরের অস্তিত্বর কথা জানা গেছে।

গ্রিক ঐতিহাসিকেরা অবশ্য বঙ্গ আর গঙ্গা নাম দুটিকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন। বঙ্গদেশকে তাই তাঁরা  ‘গঙ্গারিদাই’ তথা গঙ্গাদেশ নামে উল্লেখ করে গেছেন। প্রসঙ্গ শেষ করার আগে আর একটি কথা। এই সময় মগধের সিংহাসনে দোর্দণ্ডপ্রতাপ নন্দ বংশের রাজত্ব। সামরিক শক্তিতে তাঁদের সমকক্ষ তখন সারা ভারতে দ্বিতীয় কেউ ছিল না। পুরাণে এই নন্দ সম্রাটদের একাধিক উল্লেখ আছে। অথচ পরবর্তীকালে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত বা অশোকের উল্লেখ সামান্যই। ব্যতিক্রম নয় গ্রিক ঐতিহাসিকেরাও। দক্ষিণবঙ্গের এই সমৃদ্ধ নগরগুলি সে সময় স্বয়ং শাসিত হলেও মগধ সাম্রাজ্যের অধীনস্থ ছিল বলেই মনে করা হয়। গ্রিক ঐতিহাসিকরাও সেই ইঙ্গিত করে গেছেন। এই সমস্ত নগর থেকে প্রাপ্ত বিপুল পরিমাণ রাজস্বই ছিল নন্দ সম্রাটদের সমৃদ্ধির উৎস। সে যাই হোক‚ যে প্রসঙ্গে এত কথার অবতারণা এবার সেই গল্প।

দক্ষিণবঙ্গের সুবিস্তৃত নদীর গায়ে এমনই এক বন্দর নগরে সেদিন কুসুমপুর (পাটলিপুত্র) থেকে এক জাহাজ এসে ভিড়েছে। বন্দরে তাই যথেষ্টই ব্যস্ততা। একে তো কুসুমপুর দেশের রাজধানী। রফতানির জন্য বিবিধ দুর্মূল্য পণ্য সামগ্রী সেখান থেকে আসে। সম্রাটের নির্দেশ নিয়ে রাজপ্রতিনিধিরাও আসেন কখনও। নগর ক্ষত্রপকে সেজন্য সজাগ থাকতে হয়। বন্দর কার্যালয়ে তাই যথেষ্টই ভিড়। নগরের বিশিষ্ট কয়েকজন শ্রেষ্ঠীর প্রতিনিধিও ভিড় করেছেন। নতুন কী মালপত্র এসেছে সেই খোঁজে ব্যস্ত। ভিড় করেছে কিছু সাধারণ মানুষও।

তাদেরই একজন বিদূরক। মুখ ভরতি দাড়িগোঁফের জঙ্গল। না আঁচড়ানো অবিন্যস্ত চুল। ছোটখাটো মানুষটা সারাদিন প্রায় বাউণ্ডুলের মতো ঘুরে বেড়ায় নগরের পথে। শ্রোতা পেলে জমিয়ে গল্পের আসর বসায়। নয়তো তেমন কয়েকজন জুটে গেলে পথের পাশে ছক কেটে‘চৌপট’ খেলতে বসে যায়। পাশা খেলার মতো হলেও চৌপটে কিছু নিজস্ব নিয়ম আছে। মাথা খাটাতে পারলে পাশায় যে দানই পড়ুক‚ বাজি মাত করে দেওয়া যায়। তক্ষশিলা‚ গান্ধার প্রভৃতি দেশে খেলাটা যথেষ্ট জনপ্রিয় হলেও এদেশে নতুন। তবু চৌপটের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে। এই চৌপট খেলাতেও জুড়ি নেই তার। বিদূরক খেলতে বসলেই চারপাশে ভিড় জমে যায়। বিদূরক অবশ্য বেশি সময় থাকে না। দু’চার বাজি খেলেই উঠে পড়ে।

নদী ঘাটের অদূরে বন্দর কার্যালয়। পরিদর্শকের দফতর। বিদূরকও সেদিন হাজির হয়েছে সেখানে। জাহাজটির আগমন যেহেতু কুসুমপুর থেকে‚ কার্যালয়ে যথেষ্টই ভিড়। নগরে ভিনদেশী মানুষের আনাগোনা থাকায় অনেক সময়েই তাঁদের দোভাষীর প্রয়োজন। এজন্য উপার্জনের আশায় কার্যালয়ে জনা কয়েক দোভাষী হাজির থাকে। বিদূরকের ঢুঁ দেবার পিছনে সেটাও এক কারণ। কাজ চালাবার মতো ভিনদেশী কয়েকটা ভাষাও তার রপ্ত। এটা অবশ্য কষ্ট করে শিখতে হয়নি। নগরে নানা দেশের মানুষের আনাগোনা। আর সেও বলতে গেলে সারাদিন নগরের পথেই। কাজ চালাবার মতো দু’চারটে ভিনদেশি ভাষা শিখে নিতে দেরি হবার কথা নয়।

আজ অবশ্য বিদূরককে কিছু নিরাশই হতে হল। নতুন ভিনদেশী তেমন কাউকে নজরে পড়ল না। কার্যালয়ে অনেকেই চেনা। কিন্তু কেউ তেমন আমল দেয়নি। সবাই কাজে ব্যস্ত। খানিক ঘোরাঘুরির পর শেষে বের হয়ে পড়ল একসময়। অদূরে পথের পাশে এক চৌপটের ঠেক। আজ নতুন জাহাজ এসেছে। সকাল থেকেই ভিড় সেখানে। একবার ঢুঁ মারবে কিনা ভাবছে‚ চৌপটের ভিড়ের ভিতর থেকে একজন ওর দিকে তাকিয়ে প্রায় ছিটকে বেরিয়ে এলো।‘আরে‚ মিত্র যে! কী ভাগ্য!’

বলিষ্ঠ শরীর‚ উজ্জ্বল তামাটে রঙের দীর্ঘদেহী পুরুষটিকে গোড়ায় চিনতে পারেনি বিদূরক। কিন্তু একটু পরে ভুল ভাঙতে নিজেই চমকে উঠল। কী আশ্চর্য! অল্প আগে মানুষটাকে বন্দর কার্যালয়ে ভিড়ে অল্প সময়ের জন্য দেখলেও একেবারেই চিনতে পারেনি।

সে প্রায় মাস ছয়েক আগের কথা। সেদিন সুদূর ‘পাতাল’ (সিন্ধু মোহনা) বন্দর থেকে এক জাহাজ এসে ভিড়েছে। বিদূরকও যথারীতি হানা দিয়েছিল। এসব জাহাজে যারা আসেন তাঁদের অনেকেরই দোভাষীর প্রয়োজন হয়। কিন্ত তেমন কাজ মেলেনি। হতাশ হয়ে বেরিয়ে আসছে। কেউ পিছন থেকে ডাকল‚ ‘কহানীওয়ালা।’

যা অনুমান করেছে তাই। বিদূরক পিছন ফিরে দেখল‚ অদূরে দাঁড়িয়ে এক বিদেশী। সম্ভবত গান্ধার দেশের। তামাটে বলিষ্ঠ দেহ। গালে সুবিন্যস্ত দাড়ি। ইতিমধ্যে এগিয়ে এসেছেন তিনি। বিদূরক মানুষটির উপর ফের একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল‚ ‘ভিনদেশী‚ ভুল করছেন। আমি কবিরাজ বা কহানীওয়ালা নই।’

 বিদূরকের ওই উত্তরে আগন্তুক সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেও মুহূর্তে সামলে নিয়ে বললেন‚ ‘ত–তাহলে একটু আগে কয়েকজনকে যে আপনাকে কবিরাজ বলে ডাকতে শুনলাম!’

নগরের প্রধান পণ্যশালায় (বাজার) কয়েকজন কবিরাজ আসেন। এক–আধ কাকনী (পয়সা) দক্ষিণার বিনিময়ে চমৎকার গল্প শোনায় তাঁরা। গল্প শোনার তাগিদে কিছু ভিড় তাদের কাছে সবসময়ই থাকে। এ ব্যাপারে আড্ডাবাজ বিদূরকেরও কিছু দক্ষতা আছে। অথচ তার গল্প শুনতে দক্ষিণা লাগে না। তাই অল্প সময়ের মধ্যে ভিড় জমে যায়। কেউ তাই কবিরাজ বলেও ডাকে। কবি থেকে কবিরাজ। গান্ধারদেশে এদের অবশ্য বলে কহানীওয়ালা। অর্থাৎ যারা শ্রোতাদের নানা কাহিনী তথা গল্প শোনায়।  আরও পশ্চিমে পারস্যদেশের প্রভাব থাকায় ওই সব অঞ্চলে এরা ‘কিসসাওয়ালা’ নামেও পরিচিত। বিদূরক সেই কথায় অল্প হেসে বললেন‚ ‘তা বলে বটে। তবে সত্যিই কিন্তু আমি কবিরাজ‚ মানে কহানীওয়ালা নই।’

‘হায় ভগবান।’ আগন্তুক সামান্য কপাল চাপড়ালেন।

মানুষটা গান্ধারদেশের হলেও এদিকের ভাষা মোটামুটি জানে। বিদূরক বলল‚ ‘ভদ্দ‚ মনে হচ্ছে আপনি ওদেশের একজন কহানীওয়ালা। তেমন হলে কিছু সাহায্য বোধ হয় করতে পারব। কী নাম আপনার?’

‘একদম‚ একদম ঠিক ধরেছেন ভদ্দ। অধমের নাম ভাগল। গান্ধার দেশের পণ্যশালায়‘কহানী’ শুনিয়ে বেড়াতাম। তক্ষশিলা নগরেও কাজ করেছি। কিন্তু বর্তমানে সেই দিন আর নেই। সবাই প্রাণ নিয়ে ব্যস্ত। কে কহানী শুনবে? তাই চলে আসতে হল। এখন আশু একটা উপায়ের ব্যবস্থা দরকার। হাতের পয়সাকড়িও প্রায় শেষ।’

বিদূরক এমনটাই অনুমান করেছিল। আশ্বস্ত করে বলল‚ ‘ভদ্দ‚ সেজন্য ভাববেন না। দু’একটা দিন অপেক্ষা করুন। নগরের পণ্যশালায় একটা ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখি।’

ভাগল কিন্তু খুব একটা খুশি হলেন না। সামান্য ঢোঁক গিলে বললেন‚ ‘ভদ্দ‚ অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞ। তবু আর একটা অনুরোধ। ছোট এই নগরে কহানী শোনার মানুষ বড় কম। তাই ইচ্ছা ছিল‚ এত দূরে যখন এলাম‚ আগে কুসুমপুরের দিকেই যাব। মস্ত নগর। কহানী শোনার মানুষও নিশ্চয় বেশি। আপনি কবিরাজ শুনে মনে হয়েছিল‚ হয়তো কুসুমপুরেও কাজ করেছেন।’

‘আরে তাতে কী হয়েছে।’ বিদূরক জোরে হেসে উঠল এবার। ‘কুসুমপুরেও কয়েকজন চেনা মানুষ আছে আমার। মনে হয়‚ কিছু সাহায্য তাদের কাছে পেতেও পারেন।’

শুধু আশ্বাস দেওয়া নয়। দিন কয়েকের মধ্যে বন্দরের এক আধিকারিকের কাছ থেকে একটা জোরাল সুপারিশ পত্র বিদূরক এনে দিয়েছিল। দেরি না করে ভাগলও পরের জাহাজেই কুসুমপুর চলে গিয়েছিলেন।

মানুষটাকে তাই বিদূরকের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। কুসুমপুর থেকে হরদম জাহাজ আসে নগরে। ওদিক থেকে আসা পরিচিত কয়েকজনের কাছেই শুনেছে‚ কুসুমপুর নগরে ভাগল অতি অল্প দিনের মধ্যেই জমিয়ে নিয়েছেন। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। ভিন দেশের মানুষ। নতুন গল্পে ঝুলি ভরতি। তার উপর গল্পটা ভালই বলতে পারেন। নামডাক ছড়িয়ে যেতে সময় লাগেনি। ভাগলের ডাক পড়েছে রাজদরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাড়িতে। এমনকী খোদ সম্রাটের দরবারেও।

সেই ভাগল তার সামনে দাঁড়িয়ে‚ অথচ একটুও চিনতে পারেনি! আসলে মানুষটার গালে তখন সুবিন্যস্ত দাড়ি গোঁফ ছিল। চেহারাও ছিল অনেক পাতলা। এখন গালের দাড়ি নিপাট করে কামানো। শরীর কিছু পৃথুল। তলপেটে চর্বির জমতে শুরু করেছে। চিনতে না পারাই স্বাভাবিক। বিদূরক প্রায় ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাঁকে। ‘আরে কহানীওয়ালা যে! চিনতেই পারিনি! ছয়মাসে চেহারা দেখছি বিলকুল পালটে ফেলেছেন!’

‘ঠিকই বলেছ মিত্র।’ ভাগল একগাল হাসল। ‘আসলে যে দেশের যেমন নিয়ম। গল্প বলে খাই। অল্প দিনেই টের পেলাম‚ একগাল দাড়ি এদেশের মানুষের তেমন পছন্দ নয়। তাই কামিয়েই ফেললাম।’

‘এদেশের জল হাওয়ায় শরীরটাও কিছু পালটেছে বলুন?’ বিদূরক গলা ছেড়ে হাসল।‘চিনতেই পারিনি! তা কী খবর? বলি কী‚ এবার আমাদের এখানেও দিন কয়েক থেকে যান। আমরাও কিছু নতুন কহানী শুনি।’

‘শোনাতে পারলে খুশিই হতাম মিত্র।’ ভাগল অল্প থেমে বললেন‚ ‘কিন্তু এবার যে দেশে ফিরে যাব ঠিক করেছি! অনেক দিন হল দেশ ছাড়া।’

‘তা ঠিক।’ বিদূরক অল্প মাথা নাড়ল। ‘কিন্তু সেবার যেন বলেছিলেন‚ ওদিকের অবস্থা একেবারেই ভাল নয়!’

‘বলেছিলাম তো। তবে ইদানীং শুনতে পাচ্ছি‚ যবন সম্রাট সেকেন্দর শাহ্‌র (আলেকজান্ডার) এদেশ জয়ের শখ নাকি মিটে গেছে। দেশে ফিরে যাবেন।’

‘ও–ও–ও‚ তাই বুঝি?’ বিদূরক কিছু অবাক হল যেন। ‘শুনেছি‚ আগামী কালই দক্ষিণে পড়ুকা (বর্তমান পন্ডিচেরীর কাছে আরিকামাডু) যাবার তপ্পক (জাহাজ) ছাড়বে। ওতেই যাচ্ছেন?’

‘ইচ্ছে তো ছিল মিত্র। একবার পড়ুকা পৌঁছতে পারলে ভাবনা ছিল না। ওখান থেকে দ্বারাবতীর (বর্তমান দ্বারকা) বা পাতালের জাহাজ নিয়মিত মেলে। কিন্তু এখানে পৌঁছে যা খবর পেলাম‚ তাতে বেজায় নিরাশ হয়ে পড়েছি। বিদেশীদের জাহাজে ওঠায় ভয়ানক কড়াকড়ি চলছে। অনেক চেষ্টা করেও অনুমতিপত্র জোগাড় করতে পারলাম না। তাই আপনার দেখা পেতেই ছুটে এসেছি। আগের বার অনেক উপকার করছিলেন।’

ছোট হলেও মোহনার কাছে নগরটি সম্পূর্ণ বন্দর নির্ভর ব্যবসায়ীক কেন্দ্র। বিদেশীদের জন্য কখনই তেমন বিধিনিষেধ ছিল না। কিন্তু অল্পদিন হল‚ হরেক রকম কড়াকড়ি শুরু হয়েছে। বিশেষ করে অনেক দিন যারা রয়েছেন‚ তাদের নগর ছাড়তে দেওয়া হচ্ছে না। স্বয়ং নগর ক্ষত্রপের নির্দেশ। ব্যাপারটা খেয়াল হতে বিদূরকের মুখে উত্তর যোগাল না।

‘মিত্র‚ কিছু একটা ব্যবস্থা করা যায় না? আসলে ব্যাপার কী জানেন।’ মানুষটির কণ্ঠস্বর হঠাৎই গাঢ় হয়ে উঠল। ‘অনেক দিন দেশ ছাড়া। হঠাৎ সেদিন স্বপ্নে মেয়েটাকে দেখলাম। হাত নেড়ে ডাকছে। মাত্রই তিন বছর বয়স। আসবার সময় খুব কান্নাকাটি করছিল। মনটা বড্ড ব্যাকুল হয়ে রয়েছে। নইলে কুসুমপুরে ভালই তো ছিলাম।’

ভাগলের কথায় বিদূরক অল্প মাথা নাড়ল। নিজে বিয়েথা করেনি ঠিকই। কিন্তু সন্তানের ব্যাপারটা বোঝে না‚ এমন নয়। খানিক চিন্তা করে বলল‚ ‘দেখি বন্ধু‚ কিছু একটা ব্যবস্থা করা যায় কিনা। তবে কয়েক দিন সময় তো লাগবেই।’

‘তা লাগুক।’ ভাগল প্রায় যেন হাঁফ ছাড়লেন। ‘বন্দর কার্যালয়ে অনেকেই আপনার চেনাজানা। কিছু একটা ব্যবস্থা যদি করতে পারেন‚ খুব ভাল হয়।’

বিদূরক অবশ্য ভাগলের সেই কথায় তেমন কান না দিয়ে বলল‚ ‘বন্ধু‚ আপনার আশু প্রয়োজন কিন্তু দিন কয়েকের জন্য একটা থাকবার ব্যবস্থা। সেই ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন?’

বিদূরকের কথায় ভাগল মাথা নাড়লেন। ‘ভাল কথা বলেছেন মিত্র। অতিথিশালায় থাকার ইচ্ছা তেমন নেই। যদি অন্য কিছু ব্যবস্থা করতে পারেন‚ খুব ভাল হয়।’

বিদূরক সত্যিই বাহাদুর মানুষ। বিকেলের আগেই নগরের সবচেয়ে জমাট স্থান পণ্যশালার কাছে ভাগলের জন্য আস্ত একটা বাড়ি ঠিক করে ফেলল। ছোট এক কামরার হলেও পাকা। কুসুমপুরে গত কয়েক মাসে ভাগলের রোজগার খারাপ হয়নি। সবই সঙ্গে রয়েছে। সাধারণ অতিথিশালায় ওই কারণেই থাকার ইচ্ছে ছিল না। প্রায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

দিন কয়েক পরের কথা। এর মধ্যে বিদূরকের সঙ্গে এক দিনই ভাগলের দেখা হয়েছিল। বিদূরক নিজেই এসেছিল খোঁজ নিতে। অনেকক্ষণ গল্পও করে গেছে। কিছু আশার কথাও শুনিয়েছে। হয়তো একটা ব্যবস্থা হতে পারে। ভাগল তাই কিছু নিশ্চিন্ত হয়েছিল। কিন্তু তারপরেই যা ঘটল‚ তা প্রায় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো।

সেদিন সকাল হতে বেচারা প্রায় ছুটতে ছুটতে বন্দর কার্যালয়ের কাছে। উদ্‌ভ্রান্ত চেহারা। খানিক চেষ্টায় বিদূরকের দেখা মিলতেই ছুটে এসে চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ল। ‘ম–মিত্র‚ সর্বনাশ হয়ে গেছে আমার!’

‘কী?’ এই সকালের দিকে তেমন মানুষের ভিড় নেই। তবু বিদূরক ওকে টেনে কিছু নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে এলো। ‘কী হয়েছে বন্ধু?’

‘স–সর্বনাশ হয়ে গেছে মিত্র। সর্বনাশ হয়ে গেছে আমার।’ বলতে বলতে ভাগল বার কয়েক কপাল চাপড়ালেন। ‘গ–গত রাতে চোর। স–সর্বস্ব‚ সর্বস্ব গেছে। হায় হায়!’

মানুষটি ভয়ানক ভেঙে পড়েছেন তখন। উদ্‌ভ্রান্তের মতো অবস্থা। গুছিয়ে বলার মতো অবস্থা নেই। সব জানতে বিদূরকের সময় লাগল। ভেঙে পড়ার মতোই ব্যাপার।

গত রাতে ভাগল যথাসময়ে শুয়ে পড়েছিলেন। সকালে ঘুম ভাঙতে দেখেন‚ দরজা ভেজানো থাকলেও খিল দেওয়া নেই। সন্দেহ হতে খুঁজতে গিয়ে দেখেন‚ জিনিসপত্র রাখার বড় চর্মপেটিকাটি নেই। উধাও হয়ে গেছে। সম্ভবত কোনও এক সুযোগে চোর আগে থাকতেই ঘরে ঢুকে লুকিয়ে ছিল। ভাগল টের পায়নি। তারপর সে ঘুমিয়ে পড়তে নিঃশব্দে কাজ সেরে চলে গেছে।

সব শুনে বিদূরক কিছুক্ষণ থম হয়ে রইল। আসলে কী বলে সান্ত্বনা দেবে বুঝে উঠতে পারছিল না। মানুষটি ভয়ানক ভেঙে পড়েছেন। খানিক বাদে বিদূরক বলল‚ ‘বন্ধু‚ পেটিকায় টাকাপয়সা ছাড়া আর কিছু ছিল?’

‘অ্যাঁ!’ সামান্য থতমত খেয়ে ভাগল বলল‚ ‘স–সে তো ছিলই। ও–ওই একটাই তো পেটিকা। জ–জামা–কাপড়। আ–আনুষঙ্গিক আরও নানা জিনিস। হায়–হায়।’

‘ঘুমের ভিতর কিছুই টের পাননি? মানে সামান্য সাড়াশব্দ?’

‘ক–কী বলব বন্ধু।’ ভাগল জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁট সামান্য ভিজিয়ে নিলেন। ‘স–সেও এক রহস্য। অ–আমার ঘুম কখনই তেমন গাঢ় নয়। র–রাতে একবার উঠতেই হয়। ত–তা ছাড়া  ঘুমও ভাঙে ভাল করে আলো ফোটার আগেই। গ–গত রাতে সবকিছুই উলটো। স–সারা রাতে একবারও ঘুম ভাঙেনি। ঘুম থেকে উঠতেও অনেক দ–দেরি…।’

ভাগলের কথা একেবারেই স্বাভাবিক নয়। কেমন জড়িয়ে যাচ্ছিল। বিদূরক তার কথার মাঝেই বলল‚ ‘বন্ধু‚ গত রাতে গৌড়ী মজ্জ বা মাধ্বী…।’

কথার মাঝেই ভাগল প্রায় হাঁ–হাঁ করে উঠলেন‚ ‘ন–না মিত্র। এ–এমনকী বাইরেও কিছু খাইনি। র–রাতের জন্য শর্করা‚ যব আর মুগচূর্ণ ঘরেই থাকে। গ–গত কাল কিছু দধিও হয়েছিল। স–সেই সব দিয়েই রাতের খাওয়া সেরেছিলাম।’

‘দধি গত কালই পেতেছিলেন?’

‘ক–কেন!’ বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে ভাগল হাঁ করে বিদূরকের দিকে সামান্য তাকিয়ে অল্প মাথা নাড়লেন। সহমত সূচক।

সামান্য মৌনতার পর বিদূরক বলল‚ ‘বন্ধু‚ দেরি না করে একবার আরক্ষা কেন্দ্রে (থানা) যাওয়া দরকার। সব খুলে বলুন ওদের।’

‘ক–কিন্তু কিছু কি করতে পারবেন ওরা?’ বিদূরকের কথায় ভাগল দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বললেন।

আশঙ্কা মিথ্যে নয়। হাজার হোক‚ ভাগল ভিনদেশী মানুষ। সামান্য ভেবে বিদূরক বলল‚ ‘তা ঠিক। তবু এত বড় একটা ব্যাপার! আরক্ষা কেন্দ্রে না জানানো কি ঠিক হবে?’

অভিজ্ঞ মানুষ ভাগল। ব্যাপারটা নিজেও বুঝতে পারছিলেন। খানিক ভেবে বললেন‚ ‘মিত্র‚তাহলে তুমিও সঙ্গে চলো।’

বিদূরক সম্মত হল বটে। কিন্তু যথাস্থানে হাজির হয়ে সমস্যার কথা জানাতেই আরক্ষী প্রধান ভুরু কুঁচকে বিদূরকের উপর সামান্য চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন‚ ‘তা নগরে তুমি ওনার মুরুব্বি নাকি হে? সঙ্গে এসেছ।’

‘আজ্ঞে না ভদ্দ।’ বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে বিদূরক জবাব দিল‚ ‘সামান্য চেনাজানা মাত্র। বিদেশি মানুষ‚ একা আসতে ভয় পাচ্ছিলেন। তাই সঙ্গে এসেছি।’

‘তাহলে এবার এসো দেখি।’ আরক্ষী প্রধান বললেন‚ ‘বিদেশি যখন‚ জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে ভিতরে নিয়ে। একান্তে। তোমার সেখানে থাকা চলবে না। ভেগে পড়ো।’

আরক্ষী প্রধানের সেই প্রচ্ছন্ন ধমকে বিদূরক আর দেরি করেনি। দ্রুত স্থান ত্যাগ করেছিল। ভাগলের খোঁজ নিতেও আর যায়নি সেদিন।

গিয়েছিল পরের দিন সকালে। ভাগল তখনও বিছানায় শুয়ে। প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থা। দুই চোখের দৃষ্টি একেবারেই স্বাভাবিক নয়। ওকে দেখে উঠে বসতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হাত–পা কাঁপতে শুরু করায় পেরে উঠলেন না। শুয়ে পড়লেন আবার। তারপর সেই অবস্থায় জড়িত কণ্ঠে যা বললেন‚ তার মর্মার্থ‚ শরীর একেবারেই ভাল নেই। দেশে ফিরে যেতে চায়। বিদূরক যদি কিছু ব্যবস্থা করতে পারে‚ চীর কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে।

মানুষটিকে দেখেই বোঝা যায় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছেন। নিঃশব্দে খানিক পর্যবেক্ষণ করে বিদূরক বলল‚ ‘মিত্র‚ গতকাল আরক্ষা কেন্দ্রে কী হয়েছে জানি না। কিন্তু সেজন্য এক দিনের মধ্যে শরীর এমন হতে পারে না। গতকাল তোমাকে প্রথম দেখে যা সন্দেহ করেছিলাম‚ মনে হচ্ছে সঠিক। আশু চিকিৎসা না করালে ভয়ানক বিপদে পড়বে।’

উত্তরে ভাগল ভুরু কুঁচকে বিদূরকের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছু বলতে গিয়েও পারলেন না। গলা দিয়ে সামান্য ঘড়ঘড় শব্দ বের হল মাত্র।

বিদূরক ভাগলের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল‚ ‘শুনে ঘাবড়ে যেও না বন্ধু। আমার ধারণা‚ সেদিন রাতে তোমার ঘরে যিনি ঢুকেছিলেন‚ তিনি শুধু চুরি নয়‚ আর একটা কাজও করেছিলেন। ঘরে রাখা রাতের খাবারে কিছু মিশিয়ে দিয়েছিলেন। সম্ভবত দধির ভিতরে। তারই প্রভাবে শুধু যে রাতে তোমার ঘুম ভাঙেনি তাই নয়‚ ক্রমেই বাড়ছে নানা উপসর্গ। সময়মত চিকিৎসা না হলে পরে আরও বড় কিছু হতে পারে। দেরি করা একেবারেই উচিত হবে না।’

 বিদূরক তখনই একটা শকট ডেকে ভাগলকে নিয়ে হাজির হল নগরের বিশিষ্ট বৈদ্য সায়নদেবের কাছে। সায়নদেব প্রবীণ বৈদ্য। মুখ ভরতি দীর্ঘ পক্ব–শ্মশ্রু। বাড়ির সঙ্গেই তাঁর বৃহৎ বৈদ্যশালা। ভিড় থাকলেও বেশি দেরি করতে হল না। অল্প পরেই ভাগলের ডাক পড়ল। ভিতরে ছোট এক বিছানায় তাঁকে শুইয়ে দেওয়া হল। কিছু সময় পরীক্ষার পরে বৈদ্যাচার্য তাঁকে দুটি বড়ি খেতে দিলেন। একটু পরেই ভাগলের চোখে গভীর ঘুম নেমে এলো।

ভাগলের সেই ঘুম যখন ভাঙল‚ বৈদ্যশালার দুই কর্মী তাঁর মাথায় সমানে তীব্র গন্ধযুক্ত জল ঢেলে চলেছে। চোখ মেলে তাকাতেই একজন সুতোয় বাঁধা এক গোছা শেকড় তাঁর নাকের সামনে ধরলেন। তার অল্প পরেই কিছু চাঙা হয়ে উঠে বসলেন তিনি। ভীষণ খিদে পেয়েছিল। সেকথা জানাবার আগেই অবশ্য একজন দধি আর মধু সহযোগে কিছু মুগচূর্ণ এনে সামনে রাখল। ভাগল প্রায় গোগ্রাসে খেয়ে ফেললেন সব। কিছু সুস্থ হতে জিজ্ঞাসা করে যা জানলেন‚তাতে ভীষণ অবাক হয়ে গেলেন। বড়ি দুটি খাবার পরে সেই যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন‚ তারপর পুরো সাত দিন পরে আজই তাঁর ঘুম ভাঙানো হয়েছে।

পরের দুই দিনের মধ্যে ভাগল অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠলেন। কথায় জড়তা প্রায় নেই। শরীরে সেই আগের বলও যেন ফিরে এসেছে। শুধু স্মৃতি শক্তিই মাঝেমধ্যে কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। মনে করতে বেশ বেগ পেতে হয় তখন। বৈদ্যাচার্য অবশ্য ভরসা দিয়েছেন। নিয়মিত এসে দেখেও যাচ্ছেন।

তবু ভাগল আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে চাইছিলেন না। বিদূরক এর মধ্যে নাকি দু’দিন দেখতে এসেছিল। সেই থেকে ভয়ানক উৎকণ্ঠা নিয়ে মানুষটির অপেক্ষায় রয়েছে। ভীষণ দরকার। জমে রয়েছে অনেক কথা। সেদিন আরক্ষা কেন্দ্রের সব বিদূরককে অবশ্য বলা সম্ভব নয়। কদিনে স্মৃতিশক্তি এমনিতেই ভয়ানক দুর্বল হয়ে পড়েছে। তবু সেদিনের কথা ভাবতে গেলে মুহূর্তে কেঁপে ওঠে বুক। অথচ আরক্ষী প্রধান সেদিন যথেষ্ট ভাল ব্যবহারই করেছিলেন। একান্তে নিয়ে জানিয়েছিলেন‚ চোর সেই রাতেই নাকি বমাল ধরা পড়েছে। পেটিকা তাদের হেফাজতেই রয়েছে এখন। চিন্তার কারণ নেই।

খবরটা শুনে খুশি হবার বদলে মুহূর্তে সারা শরীর কেঁপে উঠেছিল। সারা মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস‚ আরক্ষী প্রধান লক্ষ্য করেননি। তিনি তখন এক কর্মচারীকে দিয়ে পেটিকা আনিয়ে ওর সামনেই খুলে ফেলে ভিতরের জিনিসপত্র হাঁটকাতে ব্যস্ত। একটু পরেই জামাকাপড়ের তলা থেকে সঞ্চিত টাকার থলিটা বের করলেন তিনি। ওকে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন‚ ‘ভদ্দ‚ সব ঠিক আছে কিনা ভাল করে দেখে নিন।’

হাত বাড়িয়ে থলিটা নিতে পারলেও শরীরের সব ক্ষমতা তখন প্রায় লোপ পেয়ে গেছে। হাঁ করে তাকিয়ে আছেন আরক্ষী প্রধানের দিকে। তিনি ততক্ষণে ভিতর থেকে ভূর্জপত্রের ছোট একটা দিনলিপি বের করে খানিক উল্টে দেখে ভুরু কুঁচকে বললেন‚ ‘এতে কী লেখা আছে বলুন তো? কিছুই বুঝতে পারছি না!’

উত্তরে একটি কথাও বলতে পারেনি তিনি। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন শুধু। কী বলবেন? গত কয়েক মাসে কুসুমপুরে কম সংবাদ তো সংগ্রহ হয়নি। গল্প শোনানোর ছলে একাধিক বার মগধ সম্রাটের বিভিন্ন অমাত্য আর সেনাপতিই শুধু নয়‚ বার কয়েক গিয়েছেন স্বয়ং সম্রাটের দরবার এবং তাঁর অন্দরমহলেও। সংগ্রহ করেছে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। খুঁটিনাটি সমেত সব শঙ্খলিপিতে লেখা আছে ওই দিনলিপির পাতায়। প্রকাশ হয়ে পড়লে মৃত্যুদণ্ড অবধারিত।

সেকেন্দর শাহ্‌র গ্রিক সেনাদল গান্ধার‚ কম্বোজ প্রভৃতি অঞ্চল দখল করতে পারলেও কাজটা খুব সহজে হয়নি। তার উপর যখন বঙ্গদেশ আর মগধের সিংহাসনে দোর্দণ্ডপ্রতাপ নন্দ সম্রাটের প্রতাপের কথা কানে এলো‚ দমে গিয়েছিল বেশ। তবে সেকেন্দর শাহ্ অন্য ধাতুর মানুষ। বঙ্গ আর মগধের প্রকৃত সংবাদ সংগ্রহের জন্য যে কয়েকজন গুপ্তচর নিয়োগ করেছিলেন‚ তিনি তাঁদেরই একজন। কাজটা সুচারুভাবেই সম্পূর্ণ করেছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এভাবে ধরা পড়ে যাবেন‚ ভাবতে পারেননি। সেদিন আরক্ষী প্রধানের সামনে যখন বলির পাঁঠার মতো দাঁড়িয়ে আছেন‚ আরক্ষী প্রধান দিনলিপিটি ফের পেটিকায় রেখে ওকে যেতে আদেশ করলেন। এভাবে ছাড়া মিলবে‚ ভাবতেই পারেননি তিনি। এক মুহূর্ত দেরি না করে চলে এসেছিলেন তারপর।

গত কদিন সেই চিন্তাই কুরে খাচ্ছে ভিতরে। তবে কী আরক্ষী প্রধান হিজিবিজি লেখা দিনলিপিটিকে তেমন গুরুত্ব দেননি? এই ভয়ানক অবস্থায় ভরসা বলতে একমাত্র বিদূরক। যদি কিছু ব্যবস্থা করতে পারে‚ অন্তত প্রাণটা বাঁচবে।

একা বিছানায় ভাগল তখন আতঙ্কে কাঠ হয়ে রয়েছেন। ওই সময় বন্ধ দরজা ঠেলে যিনি ভিতরে ঢুকলেন‚ তাঁকে দেখে প্রায় আঁতকে উঠলেন তিনি। সেই দিনের আরক্ষী প্রধান। মানুষটি কিন্তু ঘরে ঢুকেই অভিবাদন করে বললেন‚ ‘ভদ্দ‚ একটা সুখবর আছে। আজই পাতালে যাবার তপ্পক ছাড়ছে। তাতেই আপনার দেশে ফেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আপনাকে সেই তপ্পক তুলে দেবার জন্যই এসেছি আমি।’

হঠাৎ এই খবরে  ভাগলের মুখে কোনও কথাই সরল না। তক্ষশিলা ফেরার জন্য এর থেকে ভাল আর কিছু হয় না। এক জাহাজেই পৌঁছে যাওয়া যাবে সিন্ধু নদীর মোহনায়। তারপর নদীপথ। আরক্ষী প্রধানের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন শুধু।

জাহাজে সেরা একটা কামরা বরাদ্দ হয়েছে ভাগলের জন্য। ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে চর্মপেটিকাও। অবশ্য সেটা এখনও খুলে দেখতে পারেনি। মুক্তির আনন্দে ভাগল তখন প্রায় বিভোর। ঘণ্টা পড়ে গেছে। অল্প পরেই জাহাজ ছাড়বে। দাঁড়ি–মাঝিদের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। ভাগল কামরার ভিতরে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছেন। ওই সময় দরজা ঠেলে একজন রাজপুরুষ ভিতরে প্রবেশ করলেন। ছোটখাটো চেহারার মানুষটি যে যথেষ্ট পদমর্যাদা সম্পন্ন‚বুঝতে অসুবিধা হয় না। দাড়িগোঁফহীন নিপাট চেহারার সেই মুখের দিকে তাকিয়ে ভাগলের ভুরু কেমন কুঁচকে উঠল। মানুষটিকে কোথায় যেন দেখেছেন। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। স্মৃতিশক্তি কদিন হল একেবারেই যেন কাজ করছে না। তবু সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলেন‚ আগন্তুক হাত তুলে নিষেধ করে বললেন‚ ‘গূঢ়পুরুষ (গুপ্তচর)‚ ফেগেলাস।’

উত্তরে ভাগলের মুখ মুহূর্তে সাদা হয়ে গেল। কোনও কথাই বলতে পারলেন না। ভাবতেই পারেননি‚ তাঁর পরিচয় ইতিমধ্যে ফাঁস হয়ে গেছে। বরং উলটোই ভেবেছিলেন। আরক্ষী প্রধান শঙ্খলিপিতে লেখা দিনলিপি নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি হয়তো। টেরও পায়নি কিছু। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন‚ আগন্তুক অল্প হেসে বললেন‚ ‘চর্মপেটিকা ফেরত দেওয়া হলেও দিনলিপিটি কিন্তু নেই ওতে। রেখে দেওয়া হয়েছে। নির্দেশমতো বৈদ্যাচার্যও গত কয়দিনে তোমার মগজ ভালই ঘুলিয়ে দিতে পেরেছেন। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ব্যাপারটা বাড়বে আরও। সেকেন্দর শাহ্‌র কানে খুব বেশি কিছু পৌঁছে দেওয়া তোমার ক্ষমতায় কুলোবে না। অন্তত বছর কয়েক। সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত। সেজন্য অবশ্য মন খারাপ করো না। কারণ যথেষ্টই ভাগ্যবান ব্যক্তি তুমি। সেকেন্দর শাহ্ কুসুমপুরে গূঢ়পুরুষ পাঠিয়েছিলেন কম নয়। ধরা পড়ে সবাইকে ফাঁসি‚ নয়তো শূলে চড়তে হয়েছে। ফেগেলাস‚ একমাত্র তুমিই ফিরে যেতে পারলে। ছেড়ে দেওয়া হল স্রেফ কথা রাখার জন্যই।’

কথা শেষ করে মুহূর্তেই বেরিয়ে গেলেন তিনি।*

গল্পের বিষয়:
ইতিহাস
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত